ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু/সর্বকালের হাওয়া

সর্ব্বকালের হাওয়া

কেমন করিয়া কি হইল কিছুই বোঝা গেল না, ঘটনাটা বড়ই অকস্মাৎ ঘটিয়া গেল। অবশ্য ব্যাপারটা সংসারের পক্ষে একান্তই অপ্রত্যাশিত নয় এবং এ-সব ঘটনা প্রত্যহ ঘটে না, অকস্মাৎই ঘটে; তবে কি না একবারে এতটাই!

 পরাণ কৈবর্ত্ত চিরদিনের রগচটা লোক, সে-কথা তার ঘরের লোকই বা শুধু কেন, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও অজানিত নয়। এইখানেই ত তার জন্ম-কর্ম্ম সমস্তই, তার রীতি প্রকৃতি তাই না জানেই বা কে? কিন্তু কথা এই যে, ওই ধরণের স্বভাবের লোকদের সঙ্গে কারবারে আসিতে হইলে অপর পক্ষদেরও একটুখানি বেশী সহ্যগুণের প্রয়োজন থাকে। এরা ঠিক দাবানলও নয়, কালানলও নয়, মাত্র তৃণগুচ্ছ। এক মুহূর্ত্তেই তাহারা দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠে, কিন্তু সে জ্বলন তাদের তেমনি বেশীক্ষণও থাকে না, যদি না ইন্ধন যোগাইয়া দেওয়া হয়; তবে অল্পক্ষণেই আপনার আগুনে আপনি জ্বলিয়া ছাই হইয়া নিবিয়া যায়। সেই ছাইও আবার বাতাসে উড়িয়া যাইতে বেশীক্ষণ সময় লাগে না, কিছুক্ষণ পরে পূর্ব্বচিহ্নের অস্তিত্ব খুঁজিলে অল্পই পাওয়া যায়। পূর্ব্বে যখন পরাণের মা থাকোমণি বাঁচিয়া ছিল, তা’র হাজামজা বাবাঠাকুরের দোর-ধরা তাবিচ-কবচের বোঝা-পরা একমাত্র ছেলেকে সে সদাশঙ্কিত সাবধানতার সঙ্গেই চোখে চোখে রাখিয়া মুখে মুখে তার প্রয়োজন সাধন করিয়া গিয়াছে। ক্ষুধা পাইবার পূর্ব্বেই সাজানো অন্ন, তৃষ্ণানুভবের আগেভাগেই জলের ঘটি, বিশ্রামের জন্য সর্ব্বদাই পরিপাটিরূপে স্বহস্তে প্রস্তুত শীতলপাটি পাতা শয্যা, যখন যা কিছু প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় বস্তুজাত তার মায়ের হাত হইতে সে লাভ করিয়াছে। বাপ তার জন্য খুসীই ছিল। মায়ের লালন সেও তার অবশ্যপ্রাপ্য রাজকরের মত অলঙ্ঘনীয় প্রাপ্য বলিয়া মনে করিত। এক ছেলে গরীবের ঘরেই কি, আর বড়লোকের ঘরেই বা কি, একই ভাগ্য লইয়া জন্মায়। অবশ্য সোনার চামচ মুখে করিয়া কেহই আসে না, সেটা ঠিকই; তবে সোনার জলে ধুইয়া যায় তাদের মায়ের চোখ দুটি, কোথাও কোথাও বাপেরও। আর সেইখানেই বিপদের ভবিষ্য বোঝা ভারী হইয়া উঠিতে থাকে। উভয় পক্ষেই যদি “লালন” চলে, “তাড়না”র নাম থাকে না, পুত্র যথাকালে মিত্র হইতে পারে না। পরাণের বাপের চাইতে তার মা কিছু বেশী দিন বাঁচিয়াছিল। তার যখন মৃত্যু হয়, তখন পরাণের ঘরের নূতন বউ পুরাতন হইতে চলিয়াছে। নয় বৎসর বয়সে বিবাহ হইয়া এগারো বছরে জয়দুর্গা ঘর বসত করিতে শ্বশুরঘরে আসিয়া বসিল। সেও প্রায় তিন বৎসর আগের কথা। পাড়ার হিসাবে তার বয়স পৌণে এক কুড়ি হইতে চলিয়াছে, অথচ থাকোমণিকে সে একটি পৌত্র রত্ন দিবার নামও করিল না। বধূর এই অন্যায় অনাচারে পরাণের মা ভিতরে বাহিরে সত্য করিয়াই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতে লাগিল। পাড়ার পাঁচজনেও ইতিমধ্যে বলাবলি করিতে সুরু করিয়াছে যে, “বউটা বাঁজা তালগাছ হলো নাকি লো? হাঁ পরাণের মা, নাতি কি আমাদের মিষ্টি খাওয়াবার ভয়ে পালিয়ে রৈল নাকি গা? বয়েস ত বৌমার গড়িয়ে এল, আর হবে কবে?”

 প্রথম প্রথম থাকো এ-সব পরিহাসের হিসাবেই হাসিমুখে গ্রহণ করিয়া যথোচিত ভাবেই প্রত্যুত্তর দিয়াছে; কিন্তু ক্রমশঃ পাঁচ মুখে পাঁচ কথা শুনিতে শুনিতে তার স্নেহ-দুর্ব্বল মন আশঙ্কাচঞ্চল হইয়া উঠিতে লাগিল। তাইতো, সত্যিই তো, সেই কবে বিয়ে হয়েছে, এতদিনে একটি সন্তান হইতে পারিত। বাড়ীর তুলসীতলায় ও ‘বাবাঠাকুরে’র উদ্দেশ্যে মানত করিল, ব্রাহ্মণপাড়ার রাধাঠাকুরাণীর কাছে দৈব-মাদুলী ভিক্ষা করিয়া স’ পাঁচ আনা পয়সা বধূর মস্তকে ছোঁয়াইয়া রাখিয়া সেই মাদুলী তাহাকে পরাইয়া দিয়া উৎকণ্ঠিত চিত্তে প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। তথাপি হা-পুত্রের ঘরে পুত্র আসিল মা।

 প্রথম সন্তানের জন্য গ্রামান্তরের অত বড় জাগ্রত যে ‘বাবাঠাকুর’ তাহাকে পুত্রদান দিয়েছেন, তাঁর আশ্রয় লওয়া সম্ভবপর ছিল না। তাঁহার কার্য্যবিভাগ শুধু মৃতবৎসাদেরই জন্য। জয়দুর্গা শাশুড়ীর নিদারুণ মনকষ্টের প্রতি তিলেক ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করিয়াই যথাপূর্ব্ব হাসিয়া খেলিয়া স্বামীর সহিত ঝগড়া ও ভাব করিয়া, শাশুড়ীর প্রতি ঝঙ্কার ঝাড়িয়া দিনের পর দিন বাড়িয়াই যাইতে লাগিল। আদুরে সেও বড় কম হয় নাই, বাপের বাড়ীতে শাসন সহবৎ সে অল্পই শিখিয়াছে। প্রথম দিকে একমাত্র ছেলের বউ বলিয়া শাশুড়ীও বড় অল্প প্রশ্রয় দেয় নাই। পাড়ার পাঁচটা মেয়ে জড়ো করিয়া অষ্টাকষ্টে, কড়িখেলা, জল ডেঙ্গাডেঙ্গি, খোন্তাখুনি প্রভৃতি খেলা ও হুড় করিয়াই সে কাটাইত। কিন্তু এমন করিয়া বেশী দিন গেল না। এইবার থাকো তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া বিদ্রোহী হইয়া উঠিল, রুখিয়া বলিল, “খেয়ে খেয়ে হাতি হচ্চ; ছেলেপিলে হবে কোত্থেকে? পরাণের আমি আবার বিয়ে দেব।”

 প্রথমে রাখিয়া ঢাকিয়া, শেষে সর্ব্বসাক্ষাতেই এই রটনা চলিতে লাগিল। বউয়ের মুখের উপরেও অবশেষে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় একদিন শাশুড়ী প্রচার করিয়া দিল, “আর তিনটে মাস আমি দেখবো। তারপর আর আমায় কেউ আটকাতে পারবে না। তিলু কৈবর্ত্তের ঝিয়ের সঙ্গে কথা আমি কয়েই রেখেছি।”

 আশপাশ হইতে যে সব কথা কানে আসিতেছিল, মুখোমুখি হইবামাত্র জয়দুর্গা তেলে-পড়া বেগুনের মত ছ্যাঁক্ করিয়া উঠিল, “দেবে ত দেবে! ছেলে কি তোমাদের আমি পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি নাকি? এমন জ্বালাও ত দেখিনি।”

 উত্তর হয়ত দেওয়া কঠিন। কিন্তু কথাই আছে, বুদ্ধিমান যেখানে কথা খুঁজিয়া পায় না, মূর্খ সেখানে নির্ভয়ে জবাব চালাইয়া যায়। থাকো বধূর চোপা শুনিয়া চটিয়া উঠিল, “চুরি করবি কেন? সাত জন্মের বাঁজি যে তুই, ছেলে হবে কোত্থেকে! তিলুর মেয়ে আতুসীর সঙ্গে বিয়ে আমি ঠিকই করেছি।”

 বৌ বলিল, “দে দিকিনি, কেমন দিবি, দেখি! সতীন আমি সইবোনা, তাই এই মা কালী আর বাবাঠাকুরের নাম নিয়ে দিব্বি খেয়ে বলে দিচ্ছি, ঘরে আনবি কি সগুষ্ঠি বেড়া আগুনে পুড়ে মরবি। দরজায় শেকল দিয়ে ঘরের চালে আগুন জ্বালিয়ে দেব; এই সোজা বলে রাখলুম।”

 এরপর শাশুড়ী তারস্বরে বধূর উদ্দেশ্যে অনেক কটুবাক্য বর্ষণ করিতে লাগিল, কিন্তু যতই দম্ভ প্রকাশ করুক না কেন, ছেলের দ্বিতীয়বার বিবাহ দিবার ব্যবস্থা সে আর ভরসা করিয়া করিতে পারিল না। অগত্যা মাস পাঁচ-ছয় পরে তিলু কৈবর্ত্ত তার ডাগর মেয়ে আতুসীর অন্যত্র বিবাহ দিয়া দিল। জয়দুর্গা হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল, হাসিতে হাসিতে শাশুড়ীকে মন্তব্য প্রকাশ করিল, “কি, ছেলের বিয়ে দিলে না যে বড়? বলে,—‘সাধ যায় বোষ্টম হ’তে, প্রাণ যায় মোচ্ছব দিতে।’

 শাশুড়ী নিজের মনের জ্বালায় নিজেই জ্বলিতেছিল, বৌয়ের এই কাটা ঘায়ে লবণ নিষেক তার সহিবে কি করিয়া; তাই দপ্ করিয়া জ্বলন্ত হইয়া উঠিল, দাঁত কিড়মিড় করিয়া অকথ্য ভাষায় গালি দিল, পরে বলিল, “তুই না ম’লে কোন ভাল মানুষের মেয়েকে পুড়িয়ে মারবার জন্য তোর হাতে তুলে দেবো না, ভাল খাকি?”

 কথাটা নিছক সত্য! জয়দুর্গাও তা ভাল করিয়াই জানে, আর জানে বলিয়াই তার এই বিজয়োল্লাস! শাশুড়ীর এই বুক-ভাঙ্গা দুঃখে গালিগালাজকে তুচ্ছ করিয়া লইয়া ফেরৎ জবাব উহ্য রাখিয়াই একান্ত সহানুভূতির সুরেই সে বলিল, “আহা তা’ সত্যি!” তারপর আবার মুখ টিপিয়া ঈষৎ ক্রুর ও বক্রহাসি হাসিল; তার পর টিপ্পনি কাটিয়া বলিল, “শুধু তাই নয়, ঢাকের দামে আবার মনসাশুদ্ধ বিকোবে কিনা, দাদাশ্বশুরের পিণ্ডির জোগাড় করতে গিয়ে নিজের পিণ্ডি চটকাবার ব্যবস্থা হয়ে ওঠবার যে ভয় রয়েছে।”—

 হি-হি হি-হি হাসির শব্দে থাকোমণির সর্ব্বাঙ্গে গরম জলের ঝাপটার মতই গরম রক্তের অন্তঃস্রোত ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল। জঘন্য গালি দিয়া চীৎকার শব্দে কাঁদিয়া বাড়াভাতের কাঁসি লাথি মারিয়া ফেলিয়া দিয়া অবশেষে ছেলে বাড়ী ফিরিলে তাহার কাছে নিজের পরাভবের কথা নালিশ করিল। এতদিন যা করিবার সে নিজে করিয়াছে, ছেলেকে বউয়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতে কোনদিন চেষ্টা করে নাই। কেন করে নাই তা অবশ্য সঠিক বলা যায় না, সবটাই যে বধূর প্রতি পূর্ব্বতন ভালবাসার জের তা নাও হইতে পারে, নিজের কর্ত্তৃত্ব শক্তির প্রতি একটা স্থির বিশ্বাসও এর মধ্যে ছিল। ঘরকন্নার মধ্যে সে তার স্বামীকেও কোনদিন টানাটানি করেন নাই, ছেলেকেও না। বেটাছেলের পক্ষে বাহিরের কাজই যথেষ্ট; ওরা কি এইসব ‘ঘরকুটুলী’ ব্যাপারের মধ্যে থাকিতে পারে, না ডাকিতে আছে? কিন্তু সহ্যেরও ত একটা শেষ আছে। ছেলের কাছে এতদিনকার জমাইয়া রাখা মনের কথা আজ থাকোমণি কান্নাধরা গলায় একটি একটি করিয়া সমস্তই খুলিয়াই বলিল; বলিতে বলিতে বারে বারে পিছন ফিরিয়া খিড়কির দরজার দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল পুকুরঘাট হইতে জয়দুর্গা ফিরিয়া আসিতেছে কি না।

 পরাণ যে মায়ের একমাত্র সন্তান বলিয়া মাতৃভক্তিতে খুবই তদ্‌গত ছিল তা’ বলিতে পারি না। বরং সংসারে দেখা যায় যে-সব ছেলে মায়ের বেশী আদুরে তারাই মায়ের প্রতি অনাসক্ত ও অশ্রদ্ধাকারী হয়! হয়ত হওয়া উচিত, হয়ত ইহাই মাতৃ-কর্ত্তব্যের অবহেলার প্রতিফল। যাই হোক, এ ক্ষেত্রে সেটা ঠিকই ফলিয়াছিল। মায়ের প্রতি আশৈশব আজ পর্য্যন্ত পরাণের অত্যাচারের সীমা ছিল না। এতটুকু ত্রুটি পরাণের মা ঘটিতে দিত না তাই রক্ষা, নহিলে তুচ্ছতম খুঁটিনাটি ধরিয়া টিকটিক খিটখিট সে করিয়াই আছে। আজ কিন্তু কোথা হইতে এতদিনকার প্রসুপ্ত মাতৃভক্তি সহসা উথলিয়া উঠিল, অবশ্য তার একটা বড় রকম অগ্রবর্ত্তী কারণও বর্ত্তমান ছিল। জয়দুর্গা দেখিতে এমন কিছু ভাল নয়, তার উপর আবার থাকোর কথামত “খাইয়া খাইয়া” সে দিনকের দিন সত্যসত্যই একটি ক্ষুদ্র হস্তিনীমূর্ত্তিতে রূপান্তরিত হইয়া উঠিতেছিল। গালের মাংসপিণ্ডের মধ্যে ক্ষুদ্র চক্ষু ক্ষুদ্রতর হইয়া ডুবিয়া যাইবার জোগাড় করিয়াছে। এদিকে মাথায় খাটো মানুষ, আর একটু মাংস লাগিলেই ভাঁটার মত গড়াইয়া দেওয়া চলিবে, মাঠে লইয়া গিয়া ফুটবল খেলার কাজেও লাগিতে পারে। এ কথা সে স্ত্রীকে জানাইয়া দিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ করে নাই এবং পরিবর্ত্তে তার থ্যাবড়া নাক এবং তাল-পত্রে প্রস্তুত সিপাহীর মত লম্বা চাঁচাছোলা পাকসিটে মূর্ত্তির বিরুদ্ধে অজস্র কুৎসা প্রচারিত হইতেও শুনিয়াছে। তিলুর মেয়ের চেহারা এদিকের নয়, তার ছিপছিপে গড়ন পেটন তেমন না হোক, চেহারায় একটা জৌলুষ আছে! তাহাকে বধূ করিতে মায়ের সঙ্কোচকে সে প্রশংসনীয় মনে করে নাই, আজ সুবিধা পাইয়া উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, “তুই পোড়ারমুখীই ত যত নষ্টের গোড়া। ঐ রাক্ষুসীটার ভয়ে এমন মেয়েটাকে হাতছাড়া করলি!”

 থাকোর মনেও সে বিষয়ে আফশোষ বড় কম ছিল না। কান্নাকাতর কণ্ঠে সে উত্তর করিল, “কি করি বল ধন, খাল কেটে যে কুমীর এনে ঘরে তুলেছি, বলে কি না ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারবে। যা দস্যি ছুঁড়ি, অনায়াসে তা পারে।”

 “ইস্, পারলেই হোল। বল্লি না কেন আমায় সে কথা, দেখে নিতুম সে কাকে পুড়িয়ে মারে। দিতুম এক বোতল কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে শলাই ধরিয়ে। শুধু অমন কনেটাকে তুই ঐ মাদিহাতীটার হুকমীতে কিনা ছেড়ে দিলি!”

 ছেলের পৌরুষ জাগিতে দেখিয়া হঠাৎ থাকোর সহজ জ্ঞান ফিরিয়া আসিল—“কি যে বলিস্ গোপাল! এই ত ওর সবে পনেরটা বছর বয়স। রাধা ঠাকরুণ বলছিল—আঠার বছর বয়স পার না হলে মেয়েদের বাঁজা বলা যায় না। যাক্ যাক্, ও সব কথা তুই ভাবিস্ নে, সে আমি সময় বুঝে যেমন হয় করবো।”

দুই

 সময় বুঝিবার কিন্তু সময় আর হইল না। থাকোমণি পৌত্র-মুখ না দেখিয়াই মরিল, জয়কালী শাশুড়ীর মৃত্যুকালে সেবা করিয়াছিল। জমানো টাকা ছেলেকে ও হাতের সোনার তাগাগাছি বউকে দিয়া গলার মাদুলিশুদ্ধ বিছে হার সে অনাগত পৌত্রের জন্য রাখিয়া গেল। রাধাঠাকরুণ বলেছেন আঠারো বছর বয়স হলেই জয়দুর্গার সন্তান হবে।

 আঠারোর পর আরও বছর দুই গেল, ছেলের দেখা নাই। তা নাই থাক, তার জন্য আজ কেহ কাঁদিতেছে না। যে কাঁদিত সে তার কান্না সঙ্গে লইয়া গিয়াছে। পরাণের স্ফূর্ত্তির প্রাণে ছেলেমেয়ের জন্য কোন প্রতীক্ষিত উৎকণ্ঠাই ছিল না। জয়দুর্গার মনের মধ্যে যাই থাক, মুখে সে দম্ভ ভরিয়া বলিত, “দূর দূর, ছেলে নিয়ে কি করবো, ছেলে হলে তার বাপের মতনই হবে। ধেনো গিলে গিলে নোংরা কথা, পচা খেউড় গেয়ে গেয়ে বেড়াবে। পোড়া কপাল, ঝাঁটা মার অমন ছেলের মুখে। যদি ভুলেও জন্মাতে আসে আমার কাছে, জন্মমাত্তর পা ধরে পাথরে আছড়াব, তা কিন্তু বলে দিচ্ছি।”


 অলক্ষিত থাকিয়া সে কথা হয়ত বা জন্মসম্ভাবিত সন্তান শুনিয়া থাকিবে, এ পথে সে পা বাড়াইল না।

 এদিকে পরাণের বখামি যত দিন দিন বাড়িয়া চলিতেছিল, জয়দুর্গার রসনা ততই তীব্রতর হইয়া উঠিতেছিল, তাহাদের কোন্দলের কোলাহলে প্রতিবেশীদের কান ও প্রাণ ঝালাপালা হইবার উপক্রম করিয়াছিল। নিতান্ত পার্শ্ববর্ত্তীরা উভয় পক্ষকেই শান্ত করিবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিয়া অবশেষে হার মানিয়া নিরস্ত হইয়াছে। বুঝাইয়া কিছু বলিতে গেলে পরাণ বলে, “হয়েছে কি এখুনি, ওকে খুন করবো, তবে না ঠাণ্ডা হবো।”

 জয়দুর্গা গোঁজ খোঁপার সঙ্গে সমানভাবে মুখ গোঁজ করিয়া গজরাইতে থাকে, “আমিই কি ছাড়বো না কি? একসঙ্গে দুটো খুন করে হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে গিয়ে চড়বো। ফাঁসি দেবে, দেবে; একবারই না দেবে। দু’বার ত আর দিতে পারবে না।”

 আর এই অতি নির্ভীক ও সতেজ অভিব্যক্তিতে যে গোপন রহস্যের ইঙ্গিত নিহিত ছিল, সে কথা লইয়া ইতিপূর্ব্বে বহু আলোচনা ও আন্দোলন হইয়া গিয়াছে। তিলু কৈবর্ত্তর বিধবা মেয়ে আতুসীকে লইয়াই সে প্রসঙ্গ। কিন্তু জয়দুর্গার মুখর মুখের কুৎসা রটান ব্যতীত অন্য কোন স্পষ্ট প্রমাণ না পাইলে গ্রাম্যমুখ্যরা ত তার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না।

 তারপর অকস্মাৎ সেই চরম পরিণতির কাল আসিয়া উপস্থিত হইল। পূর্ব্বরাত্রে সারারাত্রি অনুপস্থিত স্বামীর নিকট জয়দুর্গা গরুর খড় কুচাইতে কুচাইতে এমন সুরে ও বাক্যে কৈফিয়ৎ চাহিয়া বসিল যে, পুরুষের দেহ ধারণ করিয়া সে রকম অভিভাবকের মত মুখভঙ্গী এবং কণ্ঠকাঠিন্য সহ্য করা সম্ভবপর নয়। পরাণ হাতে শক্ত মুঠি বাঁধিয়া খানিকটা সামনের দিকে আগাইয়া আসিয়া দাঁত মুখ খিচাইয়া জবাব দিল, “যে চুলোতেই থাকি না কেন, তোর বাবার তাতে কি এলো গেলো?” জয়দুর্গা যথাকার্য্যে নিরত রহিয়াই সদর্পে প্রত্যুত্তর করিল, “আমার বাবার কচু, জানা দরকার আমার। আমি শুনতে চাই, কোন্ চুলের দোরে মরতে গেছলে সারারাত ধরে!”

 রাগে পরাণ ফুলিতেছিল, গুম্ হইয়া জবাব করিল, “যমের দক্ষিণ দোরে, যাবি?” “নিয়ে চলো না সঙ্গে করে, যাচ্ছি”—বলিতে বলিতে কুক্ষণেই সে তার বিচালী কাটা খাঁড়ার মত একান্ত তীক্ষ্ণ ফলা বাঁট ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, “সে হলেও বুঝি, যমেই বা তোকে নেয় কোথায়? তুই যে যমেরও অরুচি?”

 কথায় উত্তর না দিয়া পরাণ প্রচণ্ড রাগের মাথায় যাহা করিয়া বসিল তাহা এই,—সে মুহূর্ত্ত মধ্যে পরিত্যক্ত বঁটিখানা তুলিয়া লইয়া দুইহাতে বাঁটখানা চাপিয়া ধরিয়া জয়দুর্গাকে যেখানে-সেখানে চোপাইয়া দিল। আর্ত্তনাদের পর আর্ত্তনাদ, তার পরই রক্তাক্ত কলেবরে জয়দুর্গা সংজ্ঞা হারাইয়া সশব্দে মেজের উপর পড়িয়া গেল।

তিন

 সকলেই মনে করিয়াছিল পরাণের ফাঁসী হইবে। তার দক্ষিণ ধারের প্রতিবেশী তার বাড়ীখানা কিভাবে দখল করা যায় তার জন্য গভীর চিন্তায় ডুবিয়া থাকিয়া নানাপ্রকার ফিকির ফন্দি বাহির করিতেছিল, এমন সময় এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিয়া সমস্তই উল্টাইয়া দিল।

 জয়দুর্গা সঙ্গে সঙ্গে মরে নাই, সদরের হাসপাতালে তৃতীয় দিনে তার জ্ঞান হইতেই হাকিম সদলবলে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করিতে আসিলেন। অত্যন্ত দুর্ব্বল এবং কণ্ঠাগত প্রাণ হইলে কি হয়, ডাক্তারের মতে যখন তার মৃত্যুর আর অধিক বিলম্ব নাই, তখন তাঁদের কর্ত্তব্য পালন অবিলম্বে না হইলে চলিবে কিরূপে? প্রথম প্রশ্নের উত্তরেই সে বলিয়া বসিল—তার স্বামী তাহাকে আঘাত করে নাই, সে নিজেই নিজেকে আহত করিয়াছে।

 প্রশ্নকারী সবিস্ময়ে কহিলেন, “সে কি, পাশের বাড়ীর লোক যে দেখেছে বঁটি ছিল পরাণের হাতে?”

 নারী কহিল, “তোমার বউ যদি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মহত্যে হতে যায়, তুমি তার হাত থেকে অস্তর ছিনিয়ে নিতে যাবে না?”

 প্রশ্নকারী প্রতি প্রশ্নের জটিলতায় ক্ষণকাল বিমূঢ় হইয়া রহিলেন, পরে ঐ কূট প্রশ্নের কুটিলতা এড়াইয়া গিয়া পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, “তাহলে তুমি বলতে চাও তোমার স্বামী তোমায় মারে নি?”

 “ও মা, বলতে চাই কি রকম? তোমাদের দরকারে হয়কে নয় করবো নাকি? কেন, আমায় ও মারবে কেন? আমি কি ওর মতন কু-চরিত্তির যে ও আসবে আমায় খুন করতে?”

 “তুমিই বা হঠাৎ আত্মহত্যা করতে গেলে কি জন্যে?”

 “শোন কথা! আত্মহত্যে হঠাৎ না করে চোখে কাজল পরে, কপালে টিপ কেটে, পায়ে আলতা দিয়ে, ঠোটে রং লাগিয়ে তোমাদের বড় নোকেদের ঘরে করে বুঝি? নাঃ বাপু, আমাদের সে-সব নেই,— আমরা করলে এমনি হঠাৎই করি।”

 প্রশ্নকারী বিব্রত বিপন্নতার সহিত তাড়াতাড়ি করিয়া বলিলেন, “না না, তা’তো বলিনি; তবে এরকম রাগ কেন হলো? রাগের কারণটা কি তাই জানতে চাইছি।”

 “জিজ্ঞেস করলেই পারতে তোমাদের সেই মুখপোড় যমের অরুচি পুষ্যিপুত্তরকে! কেন করলুম? রাগে ঘেন্নায় মানুষ পাগল হয়ে যায় না! কু-চরিত্তিরকে নিয়ে ঘর করতে রুচি কতদিন থাকে মানুষের বল ত? সহ্যির তো একটা সীমা আছে! কোন্ চুলোমুখীর চুলোর দোরে সারারাত কাটিয়ে বাড়ী ফিরেছিল সেটা ওকে তোমর বুঝি শুধোতে পারনি? কেন লজ্জা করেছিল?”

 স্বামী-স্ত্রীতে দেখা করাইয়া দেওয়া কর্ত্তৃপক্ষরা হয়ত কর্ত্তব্য বোধ করিয়া ছিলেন। পরাণ কাঁদিয়া আপত্তি করিলেও শুনিলেন না। যখন জয়দুর্গার সঙ্গে তার দেখা হইল তখন তাহার মুমূর্ষু অবস্থা। গলার স্বর গলা দিয়া বাহির হইতে চায় না, কানেও সহজে বাহিরের স্বর ঢোকে না। তথাপি দর্শকের পরিচয় বারবার করিয়া জানানো হইলে অর্দ্ধনিমিলিত নেত্র বারেক মাত্র উন্মীলন করিয়া সে তার সম্মুখে চাহিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল। চোখে জাল পড়িয়া গিয়াছে, সমস্তই তার কাছে ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট, নাভিশ্বাসের ঘন ঘন আন্দোলনে অতবড় শরীরটা তার ঢেউয়ে পড়া ক্ষুদ্র তৃণখণ্ডের মতই সমানে আন্দোলিত হইতেছিল, তাহারই মধ্য হইতে জয়দুর্গা কোনমতে এই কথা কয়টা মাত্র বলিল:

 “ওকে বলো যেন গয়ার পেরেত শিলেয় গিয়ে একটা পিণ্ডি চটকায়, নইলে কি পেত্নী হয়ে শেষে ওর আর ওর সেই হতচ্ছাড়ি সোহাগী আঁচল-দুলুনীর ঘাড় ভাঙ্গবো?”

 পরাণকে জয়দুর্গা ফাঁসী বা আন্দামন গমন হইতে বাঁচাইয়া দিয়া গেলেও তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি গ্রামের লোকেরা কেহই বিশ্বাস করে নাই। যারা এতদিন তার মুখর কলহপরায়ণতায় তাকে নিন্দা-বিদ্বেষ করিয়া আসিয়াছিল, তারাই স্তম্ভিতচিত্তে তার প্রশংসা না করিয়া পারিল না। পরাণকে খুনে বলিয়া সকলেই মনে মনে শিহরিয়া রহিল। তার মুক্তি তারা বেশ মনের সঙ্গে পছন্দ করিতে পারিল না। স-সর্প গৃহে বাস করার মতই এই হত্যাকারীকে নিজেদের ভিতর রাখা একটুও নিরাপদ নয়, এ-কথা প্রত্যেকেই পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করিল, কিন্তু প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিবার মত সাহস কেহই সঞ্চয় করিতে পারিল না। দক্ষিণধারের প্রতিবেশীই এ ঘটনায় সবিশেষ আশাহত হইলেন, দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া আত্মগতই তিনি বলিলেন, “হরি হে দীনবন্ধু! তুমিও শেষকালে তোমার নাম ডোবালে? কলিকালে পাপীরই বন্ধু হলে? তা’ হও, কি করবে, তোমার আর দোষ কি? যুগের হাওয়া।”

 কিন্তু বেশীদিন নয়, পরাণ শীঘ্রই ইহাদের মুক্তি দিল। সেও আর এ ঘটনার পরে তার চিরপরিচিতদের মধ্যে তিষ্ঠিতে পারিতেছিল না। সে সুস্পষ্টরূপেই বুঝিতে পারিতেছিল যে, তার আজীবনের পরিচিতরা তাকে আর ঠিক স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখিতে পারিতেছে না। এই কয়টা দিন হাজত বাস করিয়া আসিয়াই সে যেন তাদের আগেকার চিরপরিচিত সেই পরাণ কৈবর্ত্ত আর নয়—একজন ঘোর অপরিচিত ব্যক্তি, যার সমস্তটাই রহস্যময় কঠিন আবরণের মধ্যে সকলের পক্ষে দুষ্প্রবেশ্য হইয়া আছে। তার প্রতি পদক্ষেপে লোকে পিছনে হটিয়া যায়, গলার স্বর শুনিলে মানুষ চমকিয়া নীরব হইয়া পড়ে, মুখের হাসি সন্দেহের ছায়ায় আত্মগোপন করে। প্রতি মুহূর্ত্তে, প্রত্যেক লোকের প্রতিটি ব্যবহারে অব্যক্ত ভাষায় তার স্বরে ধ্বনিত হইতে থাকে, “আইনের চোখে পার পেয়ে এলেও—ও খুনী ও—খুনী! নাঃ, জয়দুর্গা প্রতিশোধ লইয়াছে বটে!”

 যেমন তেমন দামে বাড়ীঘর, তৈজসপত্র বেচিয়া পরাণ গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গেল। অতসীর সঙ্গে সে ফিরিয়া আসিয়া আর দেখা করে নাই, জন্মের মত যখন বিদায় লইতেছে তখন একবারের জন্য সে দারুণ প্রলুব্ধ হইয়া উঠিল, জয়দুর্গা যদি তাকে সে ঘটনার পর ক্ষমা করিতে পারে, অতসী কি পারিবে না? জয়দুর্গাকে সে একদিনের জন্যও ভালবাসে নাই, কিন্তু অতসী ত জানে তাকে সে কতখানি ভালবাসিয়াছিল। মায়ের দেওয়া টাকা, অনাগত সন্তানের মাদুলীহার, নিজের সখের সৌখীন টুকিটাকি সমস্তই ত সে তার ভালবাসার নিদর্শন অতসীকেই দিয়াছে। আজও জয়দুর্গার সোনার তাগা, কানফুল, নাকছাবি, রূপার গোট, চাবিশিলি, রূপার চুড়ী, পায়ের কড়াচুকী তাকেই দিতে পারে, সে কি সঙ্গে যায় না? বাড়ী জমি বিক্রির টাকা দিয়া কোন অজ্ঞাত গ্রামে গিয়া, না হয় সহরে পৌঁছিয়া তারা নূতন করিয়া ঘরকন্না পাতিবে। মাছ আর ধরিবে না, কল-কারখানায় আজকাল কত রকম-বেরকমের কাজ।

 অতসী তাহাকে দেখিয়া একছুটে পলাইয়া যাইতেছিল। তার কঠিন স্বরের পিছু ডাকে সভয়ে পিছন ফিরিল বটে, কিন্তু ভরসা করিয়া খুব কাছাকাছি আসিতে পারিল না, খানিকটা দূর হইতেই জিজ্ঞাসা করিল, “কি?” ঐটুকু স্বর হইতেই তার বক্ষস্পন্দনের অস্বাভাবিক গতির পরিচয় সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল।

 পরাণের বুকটাও ভিতরে ভিতরে ভারী হইয়া উঠিয়াছে। স্বাভাবিক ভাবে কথা কহিবার চেষ্টা করিয়াও অনেকখানি ইতস্ততঃ করিয়াই সে কহিল, “আমি গাঁ ছেড়ে যাচ্ছি।”

 অতসী যথাপূর্ব্ব থাকিয়াই সংক্ষেপে উত্তর দিল, “শুনেছি”—

 “হ্যাঁ, বাড়ীঘর সমস্তই বেচে ফেলে নগদ টাকা করেছি, শুধু গয়নাগুলো যেমন তেমনই আছে।

 অতসী কোন ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না, শুধু তার শুষ্ককণ্ঠ মধ্য হইতে একটা অস্পষ্ট নীরস ধ্বনি বাহির হইল, ―“ও!”

 “কলকাতায় গিয়ে ভাবছি কল-কারখানায় কাজ করবো, খাটতে পারলে সেখানে একশ টাকা রোজগার করা যায় সবাই বলে।”

 অতসী এইবার একটা কিছু বলিবে—পরাণ মনে মনে এরূপ আশা করিয়াছিল; সে কিন্তু কিছুই বলিল না, যেমন তেমনই দাঁড়াইয়া রহিল। পরাণের গ্রাম ত্যাগের খবরে হয়ত একটুখানি স্বস্তিবোধ যেন তার মধ্যে ফিরিয়া আসিতেছিল। এই ব্যাপার লইয়া তার উপরেও ঘরে বাহিরে যে একটা কুৎসিত রটনা না চলিতেছিল এমন নয়।

 “তুমি আমার সঙ্গে যাবে অতসী? দুজনায় আমরা আবার নতুন করে ঘর বাঁধবো, তুমি সেখানে—”

 “আ-মি?” অতসী সহসা বেতসীর মতই সঘনে কাঁপিয়া উঠিল। প্রায় রুদ্ধশ্বাসে হাঁপাইয়া সে আর্ত্তকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, “তোমার সঙ্গে? ওরে বাবা! না—না, তোমার সঙ্গে আমি যাবো না—যাবো না।”

 পরাণের বুকের ভিতর একটা বোমা যেন সে নিজের হাতে দাগিয়া দিল; বহুক্ষণ পরে ঝাপসা দৃষ্টি পরিষ্কার হইয়া আসিলে সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল অতসী কোথাও নাই। অদূরে তাদের খিড়কী দরজায় খড়াৎ করিয়া খিল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিতর হইতে নারীকণ্ঠের শব্দ শোনা গেল,—

 “কিরে আতু! অমন করে ছুটে এলি ক্যানে? হলো কি তোর?”

 “ওমা, সেই খুনে এয়েছে গো! বলে, ‘আমার সঙ্গে চল্’! উঃ, ভয়ে আমার গা,—হাত দে দেখ না, এখনও কাঁপচে গো!”

 “ঘরকে আসুক না তোর বাপ, পুলিশকে খবর দিতে বলছি! আ, মর্ মর্! মুখপুড়ি ছুঁড়ি অমন গুণের সোয়ামীকে আবার সোহাগ করে বাঁচিয়ে গেলেন! আদিখ্যেতা দেখে বাঁচিনে।”

 হি-হি করিয়া হাসিয়া উঠিয়া অতসী হাস্যকম্পিত স্বরে মন্তব্য করিল, “যমেরও অরুচি যে ও—যম ওকে নেবেক ক্যানে।”

 এবার আর তার কণ্ঠস্বরে ভয়ের কম্পন ছিল না, কৌতুক উছলিত হইতেছিল

 মা বলিল, “তাই বটেক, কি গব্বেই ধরেছিল—থাকি আঁটকুড়ী! আঁতুড়ে নুন জোটাতে পারে নাই একটুক্!”

 পরাণের দুচোখ বারেকমাত্র জ্বলন্ত কয়লার মতই দপদপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেও পরক্ষণে যেন বরুণবাণে নির্ব্বাপিত অগ্নিবাণের মতই তার সেই দুচোখের অগ্নিশিখা একান্ত ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হইয়া গেল। দুচোখ ভর্ত্তি সহসা সমাগত অনাহুত অশ্রুর আবিলতায় সে প্রায় অন্ধের মত স্খলিত পদে যে-পথে আসিয়াছিল তাহারই অভিমুখে ফিরিয়া চলিল, গভীর দীর্ঘশ্বাসের ভারে ভারাক্রান্ত বক্ষ ফুলিয়া উঠিতেছিল, আর্ত্তনাদের মতই তার অবরুদ্ধ-স্বর কণ্ঠ হইতে একটা অস্ফুট শব্দ মাত্র বাহির হইল, “জয়ি, জয়ি! তোকে আমি চিনিনি, তুই দেবতা, আমি পিচেশ।”