হেমলক

দিব্যেন্দুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ অনেকদিনই হয়েছিল কিন্তু চিঠিপত্রের আদান-প্রদান বহুকাল পর্য্যন্ত বজায় থেকেছে। কলেজ ছাড়ার পর আমি ঢুকলুম ডাক্তারী লাইনে, আর সে পড়াশুনো ছেড়েই দিলে। তা দেবে নাই বা কেন, প্রথম গ্রেট ওয়ারে ওর বাবা তো আর কম টাকাটা ব্যবসা করে লাভ নি। শুনেছি সে এত বেশী যে তার নিম্নতন তিন পুরুষে নাকি পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে অর্থাৎ বেশ একটি স্প্রিংয়ের গদি-আঁটা প্রশস্ত ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে জীবনগুলো কাটিয়ে দিতে পারবেন। অবশ্য যতটা রটে, সবটাই ঘটে না, তবু কিছু কিছু তো বটেই! একথাটাও তো আর অসত্য নয়। দিব্যেন্দু তার বাপের কাজ-কর্ম্মের সাহায্যও নাকি কতকটা করেছিল, ওর বাবার তখন লোহার কারবারে মোটামুটি সোনা ফলছে। বহর কতক পরে ওর বাবা হঠাৎ মারা পড়লেন, তার বছর দু’বছর পরেই শুনলুম দিব্যেন্দু তার সোনা-ফলা লোহার কারবার খুব মোটা একটা টাকা নিয়ে কোন্ এক মাড়োয়ারীকে বিক্রি করে দিয়েছে। বড়ই চটে গেলুম। বাঙ্গালীকে ঐ রোগেই তো মেরেছে! আর এই করে করেই মাড়োয়ার হয়ে উঠেছে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এবং বাংলা দেশটি হয়ে দাঁড়াচ্চে ধুধু মরু! দুদিন পরে এর শুক্‌নো গাছের ডালে ডালে যে পাখীরা শুধু ডাকতে থাকবে, তাদের ধ্বনি হচ্ছে—‘ঘু-ঘু-ঘু ঘু-ঘু-ঘু! এবং বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে এরাই বিচরণ করবে। চিঠি লিখলুম,—“তোমার বাবার কষ্টোপার্জ্জিত অতবড় কারবারটা এমন করে নষ্ট করলে, এর মানে কি?

 উত্তর দিলে, ‘এখন নয়, দুটো বছর পরে বুঝতে পারবে মানে কি!’

 ১৯২৭-২৮ সাল থেকে পৃথিবীর সর্ব্ববিধ বাজারই পড়তে আরম্ভ করলাে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পৃথিবীজোড়া সবচেয়ে বড় যুদ্ধের বীজ পোঁতা হলাে; কিন্তু মানুষ বড়জোর অদূর ভবিষ্যৎই দেখতে পায়, সে তাে সর্ব্বদর্শী নয়, ঐ লোহাই যে আবার সোনার চাইতেও বড় হয়ে উঠবে তখন সেকথা কেউ কি জানতো।

 দিব্যেন্দু ইছামতীর তীরে বিশাল জমিদারী কিনে সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাসানে বাড়ী তৈরী করিয়ে সমস্ত নাগরিক সভ্যতার বাইরে গিয়ে বাস করছে, বিয়ে সে আগেই করেছিল,—এই পর্য্যন্ত খবর তার চিঠিপত্রে পেয়েছিলাম। বিয়ের সময় অবসর করে সেখানে যাবার জন্যেও সে আমায় একটা চিঠি মারফৎ আমন্ত্রণ করেছিল। তার পর থেকে বছর দুই তাদের কোন খবরাখবর পাইনি; বলা বাহুল্য, আমারও খবর নেবার অবসর তখন একেবারেই ছিল না। নতুন একটা তীব্রতম বিষ-প্রতিষেধক ঔষধ আবিষ্কার করে—আমি তখন তাই নিয়ে একটা সাধনায় মগ্ন হয়ে ছিলাম।

 আমার সাধনা সফল হয়েছে। শুধু সাপের বিষই নয়,—সময়ে প্রয়ােগ করতে পারলে আর্সেনিক এমন কি পটাসিয়াম সায়নাইডের প্রচণ্ড বিষক্রিয়াকে পর্য্যন্তও পরাভব করে ফেলতে সমর্থ।

 অভাবনীয় রূপেই এতবড় মহৌষধ আমার হাত দিয়ে ভগবান মানব সমাজকে দান করলেন। সেও এক উপকথার কাহিনীর মতই চমকপ্রদ অদ্ভুত ব্যাপার। আচ্ছা, দিব্যেন্দু এখন একটু সরেই দাঁড়াক না, সেই কথাটাই আগে বলি, এই দুটো ব্যাপার তাে পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়; সেই কাহিনীটা আগে থেকে এখানে বলে রাখা ভাল। সে একটা বসন্তকালের সন্ধ্যা। কলকাতায় থাকি, সেখানে অবশ্য শীত-বসন্তের কোন মূর্ত্ত পরিচয় আমরা পাইনে; ওসব ঋতুগুলি আমাদের কাছে প্রায় অবান্তর এবং অনাবশ্যক। অতি ঘনিষ্ঠতর পরিচয় ও কারবার আমাদের যা আছে তা’ বরং এই দুটি ঋতুর সঙ্গে; একটি গ্রীষ্ম, একটি বর্ষা। গ্রীষ্ম ঋতুটি যত কষ্টকরই হােক, যাদের ইলেকট্রিক-ফ্যানের হাওয়া খাওয়ার মত সৌভাগ্য আছে, তাদের কথা ছেড়ে দিলেও তালপাতার পাখাতেও কিছু-কিঞ্চিৎ কষ্ট লাঘব হতে পারে। ঘরের ফাটা-চটা মেঝেয় শুয়েও এক রকমে কেটে যায়। যত-কিছু দুর্দ্দশা এবং সেটা অত্যন্ত অকরুণ মূর্ত্তি ধরে নাকাল করে কলকাতার বর্ষায়। হ্যাঁ,— সবখানের থেকেও কলকাতার বর্ষাকেই আমার বেশী ভয়। অন্যত্র রাস্তায় এমন নদী সৃষ্টি হয় না। পথে অবশ্য কাদা হয়, পিছলও হয়ে থাকে কিন্তু কথায় কথায় এক-হাঁটু জল দাঁড়ায় না, আর বাড়ীর উঠোনের জলে রান্না ভাঁড়ার বৈঠকখানা—সব একাকার হয়ে যায় না। ট্রাম বাস মােটর অচল হয়ে লাখ লাখ লােককে জুতো-জামা শুদ্ধ নোংরা জলে সাঁতার কাটায় না। এই বসন্ত সন্ধ্যাতেও কলকাতার রীতিক্রমে কোন বাসন্তী পরিবেশ ছিল না, অতি সাধারণ সবদিনকার মতই সাঁজবেলা। পাশের বাড়ীর রান্নাঘরের উনান ধরানাের কেরােসিনের ঝাঁজালাে গন্ধযুক্ত ঘুঁটেগন্ধী বাসন্তী বায়ু মধ্যে মধ্যে প্রচুরতর ধোঁয়ার সঙ্গে আমার নাসারন্ধ্রে প্রবিষ্ট হচ্ছিল। তাদেরই উপরতলায় স্কুলের ফেরত মেয়ে দুটি একটি জীর্ণাবস্থ হার্ম্মোনিয়ম নিয়ে দুজনে দুই সুরে তারস্বরে সঙ্গীত সাধনা করছিলাে, শুনে শুনে একান্ত অভ্যস্ত না হলে কখনই ঐ বেসুরাে-বেতালার উচ্চৈঃস্বরের গান শুনতে শুনতে অ্যানাটোমী বা কেমিস্ট্রীর সূক্ষ্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা সম্ভব হত না।

 রাস্তায় মােটর, মােটর-বাস, লরী, রিক্সার একঘেয়ে চলন—ঘণ্টার টিং টিং এবং ছােট বড় মাঝারি বয়সের পথচারীদের হল্লা ও ফেরিওয়ালাদের সুরে বেসুরে নানান জিনিসের ফিরিস্তি এতাে আছেই, ওসব কানে ঢুকলে যদি তাদের আমল দেওয়া যায়, তাহলে আর রাজার রাজ্য চালনা থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা, কৃপণ সুদখোরের সুদ-গোনা সমস্ত বন্ধ রেখে আবহকাল অপেক্ষা করতে হয়, সমুদ্রের সমস্ত ঢেউ-এর ওঠাপড়া বন্ধ হলে স্নান করতে নামবার মত।

 কলকাতায় বাস করলে যোগাভ্যাসের কাজ হয়। যোগদর্শনকার পতঞ্জলী বলেছেন, “যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।”

 যাক্ ধান ভানতে শিবের গীত এলো নাকি! কোথায় এই শেষ বসন্তের গুমোট করা সন্ধ্যায় কলকাতার এক পুরোণো গলির ছোট্ট একটা বাড়ীতে খানকয়েক পুরাতন চেয়ার ও একটা টানাওলা টেবিলের সামনে বসে হিসেব কষা, আর কোথায় দার্শনিকের সমুচ্চ মতবাদ। হিসাবে একটুখানি ভুল থেকেই যাচ্ছে, ঠিক ক্যালকুলেসান করে জিনিষটাকে দৃঢ় প্রত্যয়ের উপর দাঁড় করাতে পারছি না। একটা প্রচ্ছন্ন সংশয় থেকেই যায়। নাঃ, আরও ভাল করে রিসার্চ্চ করা দরকার। যদি নিজের একটা ল্যাবরেটোরী থাকতো! এরকম লুকোছাপা করে অন্য কাজের আড়াল দিয়ে অনেক কিছু মিথ্যা রচনা করে এসব কাজ কখন সাক্‌সেসফুল হয়? অথচ উপায়ও তো নেই।

 জানলাটা সামনের দিকে খোলাই ছিল, হঠাৎ সশব্দে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়ে ফের সঙ্গে সঙ্গেই সজোরে খুলে আবার ঝনাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর গল্পের সেই “ঢাকন খোল, নাচন দেখ”-র মতই এই খোলে এই পড়ে। টেবিলের কাগজপত্র এদিকে ওদিকে ফর্ ফর্ করে উড়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো, মায় আমার সেই মিল না হওয়া হিসেবের চোতা কাগজখানাও। ঝড় উঠেছে। বেশ বড় রকমের ঝড়। এতটুকু বোবা গলির ভেতরকার এই ছোট্ট ঘরটুকুতেই যার এতটা দাপাদাপি, বাইরে না জানি সে কি করছে? উঠে গিয়ে জানলার বিদ্রোহী কপাট দুটোকে টানাটানি করে এনে কোনমতে ছিট্‌কিনিটা আটকে দিলুম। ইতিমধ্যে কাচের ফ্রেমে বাঁধানো ঠাকুরদাদার ওয়াটার কলারের ফেড-হওয়া এন্‌লার্জ্জখনা হাওয়ার দোলায় দোল খেতে খেতে ধুপ করে দড়ি ছিঁড়ে খসে পড়লো এবং কাঁচভাঙ্গার শব্দ হলো ঝন্‌ঝন্ ঝনাৎ। কি বিপদ! দড়িটা অনেক দিন বদলানো হয়নি, পচে গেছলো নিশ্চয়। কে কি করে, যেটি না হাতে করে করবো তা আর হবে না। অথচ এই অভূতপূর্ব্ব আকস্মিক অনর্থ—আবিষ্কারের অদ্ভুত উত্তেজনায় সারা দুনিয়াই তখন আমার কাছে ঐ পাশের বাড়ীর রান্নাঘর থেকে ভেসে-আসা ধোঁয়ার মতই ধোঁয়াটে।

 খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে জানা গেল। কাল-বৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব শুরু হয়েছে ঐ সঙ্গে। তা না হবেই বা কেন? বসন্তের বাসন্তী সমারোহ আমাদের এই পচা গলিতে না থাকতে পারে, তাই বলে তো আর সে রুদ্র-বৈশাখের রুদ্র-লীলার দাপাদাপির কিছুটা ভোগ করে রেহাই পেতে পারে না। স্থান যেমনই হোক, কালটা তো ঠিকই আছে।

 দরজায় আঘাতের পর প্রচণ্ড করাঘাত চলছিল। হাওয়ার ধাক্কা বলে যতই তাকে উড়িয়ে দিতে চাই, ততই তার উগ্রতা বেড়ে ওঠে। বোধ হয় কোন ঝড়ে-পড়া জলে-ভেজা বিপন্ন মানুষই হবে। আমারই কোন বন্ধু বা আত্মীয়ও তো হতে পারে। দরজা খুলতেই কেউ একজন ছুটে এসে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো, আর সঙ্গে সঙ্গেই হয়ত কোথাকার কোন তার কেটে বা অমনি কিছু একটা বিপত্তি ঘটে আমার ঘরের ইলেক্‌ট্রিক আলোটা ফিউস্‌ড্ হয়ে গেল। এ বড় মন্দ মুস্কিল তো নয়! এখন আমি করি কি? সিগারেট ফুঁকি না, দিয়াশলাই এ ঘরে দুষ্প্রাপ্য, এক সেই রান্নাঘরের কাজের জন্যে যদি ওদিকে থাকে। সেখানে এখন যাবার যো কি, যে প্রচণ্ড ধারায় বৃষ্টি চলছে, খোলা দালান উঠোন পার হতে হতে ভিজে বেড়ালেরও অধম হয়ে যাব যে। নিরুপায়ে বিপন্নভাবে প্রশ্ন করলেম, “কে?”

 যে এসেছিল দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দিতে দিতে উত্তর করলে, “আপনার ঘরে টর্চ্চ আছে?”

 ঠিক কথা, টর্চ্চ একটা আছে, কিন্তু কোথায় আছে? টেবিলের উপর, না ওর ড্রয়ারটার মধ্যে? আছে, না আমার বিশ্বাসী চাকরটার শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে যেমন অনেক কিছুই উধাও হয়ে যায়, তাই গেছে, তাও তো জানিনে। বললেম, “থাকলেও থাকতে পারে, তবে খুঁজে বার করি কি করে? আপনি কে? এমন করে এসেই বা ঢুকলেন কেন?”

 বাইরের ঘনঘোর দুর্য্যোগের নিকষ কালিমায় নিরালোক গৃহের অন্ধকার নিরন্ধ্র ও জমাট বেঁধে গেছলো, এতটুকু অস্পষ্ট আলোর রেখা কোথাও দিয়ে চোখে পড়ে না, সেই কঠিন পাথরের গুহার মত অন্ধকার কক্ষে একটা অদ্ভুত হাসির শব্দ একটিবারের জন্য হা হা করে বেজে উঠলল, অপরিচিত কণ্ঠের স্বর পরক্ষণে ভেসে এলো— “পিরামিড বিষ হেমলকের যে প্রতিষেধক নিয়ে আপনি এক্সপেরিমেণ্ট করছেন, এ-ঘরে নিশ্চয়ই তা আছে? আমায় শীগ্‌গির দিন, শীগ্‌গির।”

 অনুজ্ঞাব্যঞ্জক সুদৃঢ় কণ্ঠস্বর।

 গভীর বিস্ময়ে প্রায় অভিভূত হয়ে পড়ে বলে উঠলেম, “পিরামিড বিষ! কে বললে এ-কথা আপনাকে?”

 আবার সেই হাসিই উত্তর দিল, “কে বললে, সে কাহিনী বলতে গেলে বলা হয়ত শেষ হলেও হ’তে পারে, কিন্তু আপনার প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিমেণ্টের এই সুবর্ণ সুযোগ হঠাৎ আর পাবেন না স্যার। রিসার্চারের ভাগ্যে এতবড় সুযোগ কদাচিৎ মেলে, তাই নয় কি? অস্বীকার করতে পারেন কি এ-কথা?”

 সীমাহারা বিস্ময়ের সঙ্গে সমান ওজনের আতঙ্ক মিশ্রিত হলো। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো—“সে কি, ওই দুষ্প্রাপ্য মিশরীয় সর্পবিষ আপনি খেয়েছেন নাকি? পেলেন কোথায়? ওর নাম হেমলক তাই বা জানলেন কি করে? এতো একজন মৃত ব্যক্তির মনগড়া কাল্পনিক উপাধি।”

 আবারও সেই উচ্চ হাস্য—এবার তার ধ্বনি তীক্ষ্ণ এবং তীব্রতর, —“ফের ঐ রকম অবৈজ্ঞানিক কৌতূহল! আপনি জানেন ঐ বিষক্রিয়ার মেয়াদ মাত্র আধঘণ্টা। আমার শরীরে এক কোয়ার্টার আন্দাজ পূর্ব্বে বিষ ঢুকেছে, আগুন জ্বলছে,—“দেহযন্ত্র পুড়িয়ে দিতে মাত্র পনের মিনিট সময় আর বাকি। যদি ওষুধ না পাই শুধু মরবো না, আপনাকে এই রিভলবারের গুলিতে শেষ করে দিয়ে তবেই আপনার অনুসরণ করবো।”

 টর্চ্চের তীব্র আলো জ্বলিয়া উঠিল, সর্ব্বাঙ্গে জলঝরা সুদীর্ঘাকৃতি চড়চড়ে ফর্সা রংএর সুপরিচ্ছদধারী যুবক, বাঁ হাতে তার রিভলবার, —একান্তই নাটকীয় দৃশ্য।

 আমার টর্চ্চটাও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে চুরি যায়নি, টেবিলের উপরেই ছিল, ওষুধটা তো সর্ব্বদা হাতের কাছেই রাখি, ঐ অধুনাবিস্মৃত মিশরীয় বিষের একান্ত দুষ্প্রাপ্য প্রতিষেধকটি মিশর ভ্রমণে গিয়ে নেহাৎই দৈব কৃপায় সেখ সাদুল্লার অযাচিত কৃপায় অবিশ্বাস্যভাবে লাভ করে পর্য্যন্ত তাই নিয়েই তো আমি এই গবেষণা করে যাচ্ছি এবং সেই তীব্র বিষের সঙ্গে পটাসিয়াম সায়নাইডের একটা মিল খুঁজে পেয়ে তারই উপর আমার এই প্রাণান্তপণের অনুসন্ধান তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছি। হার্টের উপর অত্যন্ত জোরে এসে যে কোন মহা-গরল অতি তীব্র আঘাত হেনে থাকে সেগুলি সমশ্রেণীর—এই নীতি ধরে কাজ করে চলেছি। ঐ বিষটির নাম নাকি হেমলক। এই কথা সেই মিশরীয় সেখই বলেছিলেন। আলো জ্বলতেই আগন্তুক তরিৎপদে এসে আমার একমাত্র পুরাতন ইজিচেয়ারখানা দখল করে শুয়ে পড়লো। দেখা গেল পা তার থরথর করে কাঁপছে। হাঁ করে একটা ঊর্দ্ধশ্বাস টেনে নিয়ে বলে উঠলো, “শীগগির করো,—ঠাণ্ডা বরফ হয়ে রক্ত জমে আসছে, আগুনের বদলে বরফ,—হাঃ হাঃ হাঃ!”

 যথাসম্ভব শীঘ্রই গ্লাসে জল ঢেলে তাতে তিন ফোঁটা ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দিলাম। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সে ধীরে ধীরে চোখ বুজলো।

 আমি টর্চ্চের সাহায্যে আমার রিষ্টব্যাণ্ডে বাঁধা ঘড়িটা মুহুর্মুহুঃ দেখে চলেছি। দুই তিন করে পনের ষোল আঠার কুড়ি মিনিট গত হয়ে গেল। অদ্ভুত আগন্তুকের শরীরে কোন রকম সাড়া নেই, একেবারে নীরব নিথর। কি হ’ল! মরে গেল নাকি? ভয়ে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাই যদি হয়ই, উঃ! কি মহা বিপদেই আমি জড়িয়ে পড়বো। অনেকে জানে আমি কোন ওষুধ বার করবার চেষ্টা করছি। কিসের ওষুধ নাই জানলো, এই অপরিচিতের শরীরে অজ্ঞাত বিষক্রিয়ার পরিচয় আবিষ্কৃত হলে কে না মনে করবে —আমিই ওকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছি। আমি এখন কি করি? উপায় কিছুই চারদিকে হাতড়ে পাচ্চিনে। পুলিসে খবর দিই? টেলিফোন তো ঘরেই রয়েছে, সব কথাই তাদের খুলে বলবো। ছাড়া আর তো কোন পথই নেই। একবার নাড়ীটা দেখে নিই আগে —একেবারেই শেষ হয়ে গেছে কিনা। প্রাণটা থাকতে থাকতে খবর দিতে পারলে ভাল ছিল। বড্ড ভুল করেছি। বড্ডই ভুল করেছি এতখানি দেরী করে। মড়া তো ফেলতেই হবে, গোপন ত আর থাকবে না।

 মুখের কাছে টর্চ্চের আলো ফেলে নিরীক্ষণ করে দেখলেম, শবের মুখের মত মুখ। তা শুভ্র বা পাণ্ডু নয়, ঈষৎ পীতাভ নীল। যেন হাল্কা করে কপালময় কে নীল বড়ির ফিকে জলে হলুদ গুলে দিয়েছে। চোখ আধখোলা। মনে হয় দৃষ্টিহীন, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ মনে হ’ল পাওয়া যাচ্চে না, তবে মরেই গেছে! উঃ! কি মহা ফ্যাসাদেই যে ফেললে আমাকে হতভাগা! কে আমার এতবড় শত্রু ছিল? আবারও কব্জি খুঁজে নাড়ী পেলাম না—নাঃ, মরাই ঠিক।

 নিকটবর্ত্তী পুলিশ-ষ্টেশনের ফোন নাম্বার গাইড-বুক দেখে খুঁজে নিলেম টর্চ্চ জ্বেলে। এই সর্ব্ব শরীর-মনের খর-কম্পনের মধ্যে দিয়ে এইটুকু করতেই বেশ পাঁচ সাত মিনিট সময় খরচ হয়েও গেল! রিসিভারটা সবে তুলে নিয়ে কম্পিত স্বরকে কোন মতে ফুটিয়ে তুলেছি,—“হ্যালো!”

 পিছন থেকে হঠাৎ একটা অস্ফুট স্বর ভেসে এলো, “ষ্টপ!”

 স-চমকে টেলিফোন রিসিভারটা ছেড়ে দিতেই সেটা সশব্দে ঘরের মেঝেয় পড়ে গেল। আমি মড়া-কাটা, মড়া-ঘাঁটা মেডিকেল কলেজের মেডেলিষ্ট, সার্জারী পাশ করা ছাত্র, উদীয়মান একজন ডাক্তার, ভূতভয়গ্রস্ত একটা শিশুর মতই চমকিত এবং বলতে কি, আতঙ্কে প্রায় অভিভূত হয়ে উঠে পিছন ফিরে তাকালাম। যার শরীরে ডাক্তারী পরীক্ষায় জীবনী চিহ্ন খুঁজে পাইনি, কয়েকটি মিনিটের মধ্যেই তার একি অচিন্তনীয় পরিবর্ত্তন। অর্দ্ধনিমীলিত নেত্র পূর্ণ বিস্ফারিত, মড়ার মুখের মত বিবর্ণ ললাটে গণ্ডে ঈষৎ শোণিতোচ্ছাস সুপরিস্ফুট—পুনর্জ্জন্ম একেই বলে, না?

 তখন আর কিছুই মনে রইলো না, সুবিপুল পুলকোচ্ছ্বাসে সমস্ত দেহ মন এক মুহূর্ত্তে সবল ও সরস হয়ে উঠলো, যেমনটি হয় বর্ষাজল পেলে তৃণশস্যদের। বালকের মত আনন্দে প্রায় নৃত্য করে— চিৎকারের মতই একটা ধ্বনি করে উঠলেম—“ইউরেকা! ইউরেকা!”

 আমার পরিশ্রম ব্যর্থ হয়নি। পৃথিবীর একটা প্রচণ্ডতম গোপন মারণাস্ত্রকে পরাভূত করে মানব সমাজের মহদুপকার করার একটা সুমহান প্রচেষ্টায় ভগবান আমার হাত দিয়ে এত বড় আবিষ্কার তবে সত্য সত্যই করিয়ে নিয়েছেন? আর যাঁর দেওয়া সেই আরবী লেখা ফরমূলা? দুহাত জোড় করেই তাঁকে প্রণতি জানালাম, তিনি সেখ সাদুল্লা, সেই অজ্ঞাতকুলশীল মিশরী ফকির।

দুই

 হ্যাঁ, এইবার দিব্যেন্দুর কথা আরম্ভ করি। দিব্যেন্দু অনেকদিন নীরব থেকে বোধ করি আমার নীরবতা তার চাইতেও গভীরতর দেখেই অল্প কিছুদিন আগে সেটা ভঙ্গ করেছে।

 হঠাৎ একদিন তার সেই কোন্ না-জানা জায়গা থেকে এক পত্র এসে হাজির হলো। কাগজের পাতা ভর্ত্তি বিস্তর অনুযোগ, অর্থাৎ কিনা কেন আমি তাকে ভুলে গেলুম? কি এমন সে অপরাধ করেছে ইত্যাদি বহু গঞ্জনা দিয়েছে, তাতে ঠিক ঐ সব কথাই আমিও তো তাকে ফেরত দিতে পারতাম, তা কিন্তু আমি দিলাম না, কি হবে তার অনুযোগগুলি তাকেই প্রত্যর্পণ করে। যখন তার দাবী আমার বন্ধুপ্রেমেরই উপর! এইবা দাবী করে কজন এ পৃথিবীতে? অন্য কারু কি হয় জানিনে, নির্ব্বান্ধব আমি, আমার কাছে সত্যকার হৃদয়বৃত্তির দেনা-পাওনা তো বলতে গেলে কারু সঙ্গেই বড় একটা নেই, অবশ্য কৃত্রিম এবং স্বার্থঘটিত একতরফা দেনা —সে কিছু কিছু সংসারে বাস করলে থেকেই থাকে। শুনেছি, এমন কি পাহাড়ের গুহায় বাস করেও মুনিঋষিরাও সব সময়ে স্বার্থপর সংসারীদের দৈবাৎ-দৃষ্ট হয়ে হাত এড়াতে পেরে ওঠেন না। একবারটি ওদের ওখানে যাবার জন্যে সনির্ব্বন্ধ নিমন্ত্রণ তার কাছ থেকে তো কতবারই এসেছিল। যেতে যে অনিচ্ছা ছিল তাও নয়; কিন্তু কিছুতেই সেটা ঘটে ওঠেনি। ঐ যে আবিষ্কারকের চিত্ত, ও আর কোন কিছুতেই যেন আকৃষ্ট হতে চায় না! নূতন নূতন আবিস্ক্রিয়ার ঝোঁকে নেশায় বুঁদ হয়ে ওরই পিছনে ঘুরে বেড়াতে চায়। মনটা বড় নীরস ও কঠোর হয়ে যাচ্ছে, এটা তো ভাল নয়।

 এ কয়েক বৎসরে আমারও ত আর আগের দিন নেই। সেই পচা গলির বাসিন্দা বিনয় বসু ত সেই ঝড়ের রাতেই নবজন্মে জন্মে গেছে। আশ্চর্য্য আগন্তুকের ভৌতিক আবির্ভাব এবং কি বলি তাকে?—‘রেসারেক্‌সান’?—মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান? সে এক অদ্ভুত কাণ্ড তো বটেই—সেই থেকে আমার ভাগ্যদেবতা অকৃপণ হস্তে আমাকে “রূপ” না থোক, “রূপা” এবং “দিশোজহি” যশ প্রচুরতর রূপেই ঢেলে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। কাজেই ডক্টর বি. কে. বসু এম. বি. (এক্ষণে এম. ডি., এফ. আর. সি. এস. ইত্যাদি) আজ সেই পচা-বাড়ীর ভাড়াটে নয়, চৌরঙ্গী অঞ্চলে প্রাসাদ ভবনের অধিবাসী। তার নিজের প্রকাণ্ড ল্যাবরেটারীতে পাঁচ-সাতজন ভাল ভাল নামকরা ডাক্তার ও অসংখ্য কর্ম্মচারী খাটছে। স্বদেশেই শুধু নয়, সুদূর প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে নামের সঙ্গে গ্রোস গ্রোস তার অচিন্তনীয় আবিষ্কারের ফল প্যাক হয়ে হয়ে যাত্রা করছে।

 —যাক, আপনার কথাকে পাঁচ কাহন করতে চাইনে, ওদের কথাই বলি। দিবু তার ছেলের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করে পাঠায় বিস্তর অনুনয় করে, সে সময়ে বিদেশ থেকে কয়েকজন সায়াণ্টিষ্ট কলকাতায় এসেছেন, আমার ল্যাবরেটারী দেখতে আসতে ইচ্ছুক, তাই যেতে পারলাম না। অবশ্য যথোচিত ভাবেই বন্ধুর প্রথমজাত নবকুমারকে তার প্রাপ্য পাঠিয়ে দিয়ে কথঞ্চিৎ কর্ত্তব্য পালন করতে ভুলিনি এবং তার জন্যে ফিরতি ডাকে সাভিমান অনুযোগ লাভও করেছি। মাস কয়েক সব চুপচাপ কেটে যাবার পর হঠাৎ এক সন্ধ্যায় একখানা অশ্রুজলে বিকৃত চিঠির মধ্য থেকে জানা গেল, দিব্যেন্দুর দিব্যদর্শন (তার ফটো আমায় ওরা পাঠিয়েছিল) ছেলেটি অকস্মাৎ মারা গেছে। কি হয়ে তা’ ডাক্তার ধরতে পারেনি, আর পার্ব্বেই বা কখন? মাত্র এক ঘণ্টার চাইতেও কম সময়ে তার অসুখ আরম্ভ ও শেষ হয়ে গেল। সেই খবর পেয়ে একবার যাবার ইচ্ছে জেগেছিল, কিন্তু সেবারও অবসর পেলাম না।

 এতদিনে সময় পেয়েছি। দিব্যেন্দুর দ্বিতীয় সন্তান জন্মেছে খবর দিয়ে সে যে চিঠিটা দিয়েছিল, সেটা পড়ে আমার মত সংসারাতীত বৈরাগী মানুষেরও কঠিন চোখ দুটোকে শুকনো রাখা শক্ত। ছোটখুকি ডলিকে পেয়ে পুত্রশোকাহতা ডলির মা কোথায় একটু শান্ত হবেন, বড়ই সে আশা করেছিল, ফলে কিন্তু ঘটেছে ঠিক বিপরীত। সুন্দর ফুটফুটে সোনার পুতুল কোলে পেয়েই তার সে কি ডুকরে ডুকরে বুক-ফাটা কান্না, সে যেন কানে শোনা যায় না। থেকে থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিট হয়ে যায়, আর জ্ঞান হলেই ভয়ে দু’চোখ ঠিকরে বার করে চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখে আর আর্ত্তনাদ করে বলতে থাকে, “তুই কেন এলি মা আমার! এ হতভাগীর কাছে তুই কেন এলি? তোকেও মেরে ফেলবে, বাঁচতে দেবে না,—না দেবে না, আমি জানি দেবে না।”

 দিব্যেন্দু লিখেছে, “ডাক্তার আনিয়েছিলুম, ওরা চেঞ্জে যেতে বলে! নার্ভাস্ স’কে হয়েছে, দৃশ্য বদলালে সেরে যাবে, ইলা কিছুতেই এখান থেকে এক পা নড়তে রাজী নয়, বলে, ‘আমার কপাল যে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাবে। যদি বা দুটো দিন সবুর করত, তা’ও করবে না। না যাবে না, আমি যাবো না।’ কি করি বলতে পারো?

 আর নয়! সুখের দিনের সাদর নিমন্ত্রণ তার আমি নিইনি কিন্তু এতবড় দুঃখের দিনের প্রচ্ছন্ন প্রত্যাশা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারলাম না। এখানকার ব্যবস্থা এক রকম করে দিয়ে ওদের কাছে রওয়ানা হলেম।

তিন

 মানুষের কপালে সুখ নেই, এ কথাটা শাস্ত্রকারদের আমি মানি অন্তরের সঙ্গেই। যদি বা কোন সন্দেহ থেকে থাকে দিব্যেন্দুর বাড়ী পৌঁছে সেটুকুও দূর হলো। সে কি একটা বাড়ী! যেন একজন স্বাধীন রাজার রাজপ্রাসাদ। কতখানি জমি নিয়ে চৌরস করে তার চারদিকে চার-মানুষ ভোর বিরাট পাঁচিল-ঘেরা। পাঁচিলের মাথায় লোহার সূক্ষ্মাগ্র ফলকের বেষ্টনী, চোরের বাবারাও একে টপকে আসতে পারবে না। সামনে মস্তবড় গম্বুজওয়ালা তোরণ। দুদিকে একটি করে দরোয়ানের ঘর। দু’জন করে গুর্খা সিপাই রাত্রি-দিন বন্দুক-ঘাড়ে পাহারা দিচ্চে, কোমরের চওড়া চামড়ার বেল্টে যথারীতি চামড়ার কেসে তাদের জাতি-বাচক তীক্ষ্ণধার শাণিত কুকরী আছেই।

 ষ্টেশন থেকে নেমে স্থলপথে যাবার সুবিধা নেই, ওদের প্রমোদতরণী বা ক্ষুদ্র মোটর-বোট “ইলাবরর্ত্ত” আমার জন্য নদীর ওপর প্রতীক্ষা করছিল। নদী? না নদী ঠিক নয়। সেটা নাকি নদী থেকে পাঁচ সাত মাইল উপরের দিকে বেরিয়ে আসা নদীর একটা খাঁড়ি। তাহলেও জলের তাতে কখনও অভাব হয়নি, অথৈ জলে গ্রীষ্মবর্ষা টলমল করছে। দুধারে বন-করম্‌চা থোকা থোকা হয়ে ফলে আছে, কতকগুলো লাল, কতকগুলো গোলাপী। কদমফুল, কামরাঙ্গা, পালতে-মাদার আরও কত কি চেনা-অচেনা গাছ ফলেফুলে তাদের আরণ্যক বাগান সাজিয়েছে। বাড়ীর চারদিক বেড়ে নিপুণ চিত্রকরের হাতের আঁকা চিত্রের মত সুরচিত একটি চমৎকার ফুল বাগান। দেশে-বিদেশে এমন ফুল এমন লতা কমই আছে যা এই বাগানটিতে নেই। নেই শুধু আম, তাল, তমাল, পনস, নারিকেল, সুপারি, কদম্ব, বকুল প্রভৃতি বড় গাছ একটিও। মাঝমধ্যখানে একটি মার্ব্বেলের ফোয়ারা, সাধারণতঃ অর্দ্ধ-বিবসনা পরীমূর্ত্তিরাই এই সব জলদেবতার তরফে বারিবাহিনী হয়ে থাকে। এখানে তার ব্যতিক্রম হয়েছে। পাথর কেটে তৈরি-করা পদ্মের উপর পদ্মাসনা উপবিষ্টা, দু’পাশ থেকে দুটি শ্বেতহস্তী তাঁর মাথায় জল ঢালছে। পরিকল্পনায় ওরিজিন্যালিটি আছে। ও মানুষটা বরাবরই বেশ একটু ভাবপ্রবণ, রুচিটাও ওর বরাবরই সুরুচি।

 সন্ধ্যা হয়, দৌড়দার সিঁড়ি কয়টা অতিক্রম করে সামনের লম্বাচৌড়া দালানে উঠে হ্যাট-ষ্ট্যাণ্ডে হ্যাট রেখে ওর নির্দ্দেশ মত বাঁহাতি ছোট টেবিল-ঘেরা চেয়ার শ্রেণীর মধ্যের একটায় বসে পড়তেই অনতিবিলম্বে উর্দ্দি-পরা ‘বয়’শ্রেণীর ভৃত্য চায়ের সরঞ্জাম ও খাবারের ডিস বহন করে এনে রাখলে। দু’জনকার মত ব্যবস্থা! দেখে একটু বিস্ময়বোধ করতে বাধ্য হলেম, এই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সুবেশাসুন্দরী একটি গৃহকর্ত্রীর আবির্ভাব স্বতঃই কল্পনালোকে উদ্ভাসিত হয়ে না উঠে পারেনি। আশ্চর্য্য! আমাদের চা-পর্ব্বের আগাগোড়া শেষ হয়ে গেলেও সেই ঈপ্সিতাকে দেখা গেল না।

 দিব্যেন্দু হয়ত আমার মানসিক বিস্ময় অনুভব করেই ক্ষমা প্রার্থনার হিসাবে ঈষৎ কুণ্ঠার সঙ্গেই নিম্নস্বরে বললে, “আমার স্ত্রীর শরীরটা ভাল নেই, তাই তিনি আসতে পারলেন না, তুমি হয়ত তাঁকে ক্ষমা করবে।”

 সৌজন্য সহকারেই জবাব দিলেম, “নিশ্চয়ই ক্ষমা করব। বিশেষ যখন আমি একজন ডাক্তার।”

 দিব্যেন্দু হাসল, এতক্ষণের মধ্যে এই তার মুখে একটু হাসি দেখলেম, অথচ এই সেই দিবু, যে একদণ্ড না হেসে আর পরকে না হাসিয়ে থাকতেই পারতো না!

 বললে, “তাও আবার একটা বাজে ডাক্তার নয়। মহৌষধি আবিষ্কারক মহর্ষিস্থানীয় মহাশয় মহান্ ব্যক্তি!

 “কি যে তুই বলিস্! ঐটুকুতেই ‘মহর্ষি’ বনে গেলাম? ঋষি সম্বন্ধে কল্পনার দৌড় ত দেখছি তোর সুবিধের নয়। কথায় বলে, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদের দরজা পর্য্যন্ত’।”

 দুজনেই একত্রে হেসে উঠলাম, এবার বোধ হল সে যেন একটু প্রাণখোলা হাসিই হাসল, যেন বহু-বিস্মৃত অতীত দিনের যৌবনস্বপ্নের রঙ্গীন ছায়া তার মুষড়ে-পড়া মনটাকে এক মুহূর্ত্তের জন্য অন্ততঃ পুরনো রং ফিরিয়ে দিল। তারপর দুজনে সেই অতীত কালেই হঠাৎ পশ্চাদ্‌বর্ত্তন করলেম। আমার মানব-চিত্তের সাইকোলজি-ঘাঁটা মন সেই ক্ষণেই তার মানসিক ডিপ্রেসনের মহৌষধি আবিষ্কার করে ফেলেছিল। বর্ত্তমানকে যতটা সম্ভব চাপা দিয়ে পুরাতনকে জাগাতে পারলে এই অতি সৌভাগ্যে দুর্ভাগা (জানি না আমার এ কল্পনাটা সত্য কিনা!) বাল্যবন্ধুটির অকাল-বার্দ্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া দেহমনকে হয়ত কিছুমাত্রায় তাজা করে দিয়ে যেতে পারবো। বর্ত্তমান যে কোন কারণেই হোক তার সুখের বা শান্তির নয়।

 আর তার স্ত্রীই যে সেই অজ্ঞাত অশান্তির উৎস, তাতেও সেই ক্ষণেই আমার দৃঢ়প্রত্যয় জন্মে গেল।

চার

 কিন্তু পরের দিন সকাল বেলায় খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে উঠতেই খোলা জানলা দিয়ে দিবুর দিব্যোদ্যান যখন আমায় সাগ্রহে আহ্বান জানালো এবং আমিও সানন্দে সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে নেমে এলেম, তখন সর্ব্বপ্রথম যার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটলো, তাকে দেখে গত সন্ধ্যার দৃঢ়প্রত্যয় আমার শিথিল না হয়েই পারলো না। পরিণত যৌবনে এমন অটুট রূপ বাঙ্গালী-ঘরের মেয়েদের বেশী দেখিনি। নিখুঁত ভাস্কর্য্য-প্রতিমা, যেন একখানি সচলা দেবী-মূর্ত্তি! ইনিই দিব্যেন্দুর স্ত্রী। মুখখানি ঈষৎ ম্লান, পাতলা ঠোঁটের কোণায় কোণায় ক্ষীণ একটুখানি ক্লান্ত হাসি। তবুও তার সেই পরিম্লান মুখে দৃষ্টিপাত করলে একটা উচ্চাঙ্গের অনুভূতি স্বতঃই মনের ভিতর জেগে ওঠে। এ মেয়ে নাকি তার স্বামীর জীবনকে অসুস্থ করতে পারে? তবে হ্যাঁ, সেই যে চিঠিতে লিখেছিল, পুত্র-শোকাতুরার মানসিক বিপর্য্যয়ের কথা, সেইটেই হয়ত এদের অব্যাহত সুখের উজানে ক্ষণিকের ভাঁটার টান এনে দিয়েছে।

 ইলার গলার স্বরটি পর্য্যন্ত যেমনই মিষ্টি, তেমনি শান্ত। বললে, “কাল আপনি এলেন, আমার এমনি দুর্ভাগ্য আমি আপনাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসতেও পারলাম না। আমায় ক্ষমা করুন।”

 ব্যস্ত হয়ে বল্লেম, “সে কি কথা! ক্ষমা কিসের? আপনার শরীর সুস্থ ছিল না, তা’তে কি হয়েছে? আমায় একান্ত বাইরের লোক বলে ভাববেন না; দেখাশোনা না থাকলেও আমরা সেই বরাবরের বাল্যবন্ধু দুজনে দুজনার ভাইয়ের মতই।”

 মনে হলো ইলার বিষন্ন-করুণ মুখখানি আমার এই কথায় ঈষৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সে যেন সেইক্ষণেই আমায় তাদের একজন আত্মীয় বলেই গ্রহণ করলে। না-জানি কি রকম লোকটা এলো, ভেবে হয়ত একটু ভয়ই পেয়েছিল সে।

 এরপর থেকে আস্তে আস্তে সে আমার ছোট বোনটির মতই হয়ে উঠলো, আমি যাকে বহুদিন পূর্ব্বেই হারিয়েছি।

 একটা জিনিষ আমায় খুব বিস্মিত করেছিল, সেটা এই বাড়ীতে ইলেকট্রিকের প্রচুর বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও একটি রাত্রেও আলো না জ্বলা। প্রথম প্রথম ভেবেছি বিগড়ে গেছে, মেরামত হলেই জ্বলবে। ক্রমে এক হপ্তা কেটে যেতেও যখন কোন ব্যবস্থাই দেখলেম না তখন দিব্যেন্দুকে প্রশ্ন করে বসলেম, “তোমার পাওয়ার হাউসে হ’ল কি? সারা বাড়ীতে একশো-দেড়শো ইলেকট্রিক বাল্‌ব ঝুলছে, সাতডেলে ঝাড়, বিচিত্র ফানুস-ঢাকনী, ও-সব কি শুধু দেখবার জন্যে?”

 দিব্যেন্দুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। একটা উদ্‌গত নিশ্বাস চেপে ফেলে ও উত্তর দিলে, “ভূতের উপদ্রব!”

 “ভূতের?”

 “তা ছাড়া আর কি বল্‌বো? খোকাটার মৃত্যুর আগের রাত থেকে তুমি আসবার আগের দিন পর্য্যন্ত হাজার বারেরও বেশী চেষ্টা করেও ইলেকট্রিক-ব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারিনি। এর জন্যে বড় বড় এক্সপার্ট ইঞ্জিনীয়ার বার বার এনেছি, নিজের ত কথাই নেই। পাওয়ার-হাউসে ডবল তালা, গুর্খা সিপাই পাহারা সমস্ত করেছি। কি করে কি হয় কেউ জানে না, প্রতি রাত্রে যন্ত্র বিগড়ানো, ‘কনেকসান কাট’ হবেই। একটি দিনও বাদ পড়বে না, বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছি।”

 কাণ্ডটি ভৌতিক বই কি! প্রকাণ্ড জমির দক্ষিণ-ধারে কতকগুলো আউট-হাউস দেখা যায়, বেশ বুঝতে পারা যায় যে, বাড়ীর ঐ অংশটুকুমাত্র পুরাকালের চিহ্ন স্বরূপ খাড়া আছে, অবশ্য নূতন রং-চং মেরামতির মধ্য দিয়ে হঠাৎ একটা কৌতুহল মনে জাগলো। বললাম, “চল তো একবার দেখে আসি।” দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম, দিব্যেন্দু একটুখানি হেসে বল্লে, “কি মতলব? ভূতের রোজা, না ডিটেকটিভ?

 উত্তর দিলেম, “স্রেফ কৌতূহল।”

 লাল কাঁকর ফেলা দুরমুস করা উদ্যান-পথ, দুধারে রাঙা ইঁটের ঢেউ তােলানর পরে দুধারে সমানভাবে ছাঁটাই-করা বর্ডার গাছ। দুপাশের চৌকা ফ্লাওয়ার বেডে নানা জাতের ফুল গাছ। যথােপযুক্ত স্থানে লােহার থামের মাথায় লোহার তারের জালির উপর দিয়ে লতিয়ে দেওয়া অপূর্ব্ব সব লতাকুঞ্জ। সবুজ ভেলভেট-মােড়ার মত নরম ঘাসে-ঢাকা বিস্তীর্ণ ভূমিতে ঝোঁপের ভাবে তৈরী করা কেতকী এবং নানা বর্ণের ক্যানাজাতীয় ফুলের গাছ ঘেরা সুরচিত ক্রীড়াভূমি। সে সমস্ত অতিক্রম করে আমরা অবশেষে বাড়ীর শেষপ্রান্তে সেই পূর্ব্ব কথিত পাওয়ার-হাউসের সামনে উপস্থিত হলেম। বড় বড় দু-দুটো তালা সত্যই ফটকের মতন সুদৃঢ় নিরেট লােহার দরজায় ঝুলছে, তারও বাইরে লােহার কোলাপ্‌সিবিল্ গেট, তাতেও দুটো তালা। অবাক হয়ে চেয়ে থেকে অবশেষে প্রশ্ন করলেম, “কতদিন এই নতুন গেটটা হয়েছে, নতুনই তো দেখছি। এটা বেশী দিনের ত নয়।”

 দিব্যেন্দু উত্তর করলে, “নয়ই তাে। ডলি জন্মাবার পর এটা করিয়েছি। খােকার মৃত্যুর রাত্রে,—” একটুক্ষণ থেমে গিয়ে যেন জোর করেই এক নিশ্বাসে বলে গেল,—“জানাে, সে-রাত্রে, হঠাৎ সমস্ত বাড়ী গভীর অন্ধকারে ডুবে গেল! তার শেষ-মুহূর্ত্তে আমরা তার মুখে একফোঁটা ওষুধ, একটু জলবিন্দু দিতে পারিনি। তার শেষ চোখ-চাওয়া মুখ, জীবিত মূর্ত্তি দেখতে পাইনি।” দিব্যেন্দু ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললে। “সেই থেকে এই অন্ধকারের খেলা আরম্ভ হলাে, প্রায়ই হয়, তবে আমিও অন্য ব্যবস্থা করে কতকটা তৈরী হয়েছি, ডলির জন্ম-রাত্রেও ঠিক ঐ একই ব্যাপার! সবটা না হলেও কিছুটা অসুবিধে হলাে বৈকি। বিশেষতঃ ইলা ভীষণ ভয় পেতে লাগলাে, মূর্চ্ছার পর মূর্চ্ছা। আর অনবরত কান্না এই বলে যে, ‘যে আসছে ওকে নিয়েই আমায় এই সময় চলে যেতে দাও, ও থাকতে পাবে না, ওকে থাকতে দেবে না। সেই থেকে ওই যে কি ওর বাতিক হয়ে গেল, মেয়েটাকে তো চাঁদ-সূযির মুখ আজ পর্য্যন্ত দেখতে দিলে না। বাড়ীর ঠিক মাঝখানের ঘরে সে থাকে, ওঁর কে দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়া কোথায় ছিলেন, তাঁকে আনিয়েছেন; ভাল নার্স আনলুম, তাকে বেবীর নার্সারীর ত্রি-সীমানায় ঢুকতে দিলেন না। ঝি-চাকরদের কারুকে ওর ঘরে যেতে দেয় না, শুধু আমার বাপের আমলের বুড়ো রাখুদা দুধ দুয়ে দেয়, জল এনে দেয়, যেটুকু নেহাৎ দরকার ঐ করে, আর ওঁরা দুজন।”

 কি আর বলি? সন্তানহারা মেয়েদের মস্তিষ্ক বিকৃতির অনেক বিবরণী ডাক্তারী নজীরে পাওয়া যায়, এও তারই মধ্যে আর একটা। আহা অভাগিনী মা! এত সুখ ঐশ্বর্য্য সবই ওর এই মৃত্যুফোবিয়ায় ব্যর্থ হ’তে বসেছে। দিব্যেন্দু অবশ্য আদর্শ স্বামী ও মানুষ, কিন্তু সেও মানুষ বই আর তো অমানুষিক কিছু নয়। সহ্যেরও একটা সীমা আছে।

 দিব্যেন্দু পকেট থেকে একটা মোটা চাবির রিং বার করে বড় বড় ভারী ভারী তালাগুলো খুলতে খুলতে বলতে লাগলো—“জানো ডাক্তার! কাল তুমি যখন এলে, ইলা তোমার সঙ্গে দেখা করতে নীচে নামলো না দেখে তোমায় যে বললুম, ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ’,—সে স্রেফ মিছে কথা। আসল কথা, সন্ধ্যার দিকে সে তার খুকিকে ছেড়ে একটি পাও নড়ে না, তা’ সে যতই কেননা যাই হোক। রাত্রে ঐ ঘরেই তার খাবার যাবে, ঐ ঘরে সে শোবে, তাও ভিতর থেকে প্রত্যেক দরজায় চাবিতালা লাগিয়ে। সে চাবি নিজে না হলে মিসেস্ পাকড়াসী স্বহস্তে বন্ধ করবেন। চাবি থাকে ওঁর আঁচলের রিংয়ে।”

 সুগভীর একটা শ্বাস মোচন করে সে বললো, “এমন করে দিনের পর দিন বেঁচে থাকা যায়? অ্যাঁ! আর ঐ যে জীবটা তার জন্মান্তরের কত মহাপাতকের ফলেই না জানি কে আমার ঘরে জমেছে, ওটার পক্ষে এ কি হচ্চে, বল তো? দেড় বছরের হ’তে যায়, না পারে ভাল করে চলতে, না শিখেছে ভাল করে কথা কইতে, হাসি কি স্ফূর্ত্তি ও’তো জানেই না। ‘রিকেটি’ হয়ে যাচ্চে বন্দী জীবনে থেকে থেকে। ওর মায়ের অত্যধিক স্নেহাতঙ্কই শেষ পর্য্যন্ত ওকে শেষ না করে ছাড়বে না, নিজেও শেষ হবে।”

 নাঃ, পাওয়ার-হাউসের মধ্যে কোন সন্দিগ্ধ পরিবেশ দৃষ্ট হলো না। সে যেন সেই পুরাকাহিনীর লখিন্দরের লোহার বাসর-ঘর। কালনাগিনী কোন সূত্রে এর ভিতর প্রবিষ্ট হয়, সে সত্যই মহা রহস্য। ভূত অবশ্য মানি না, বিশেষতঃ সায়াণ্টিফিক ভূত। কিন্তু তা ভিন্ন কি বলাই বা যায় এক্ষেত্রে? সমস্ত দেওয়ালে ঘা মেরে মেরে ঘরের মেজেয় বড় বড় হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে দেখা আগেই হয়েছিল, আমিও যেটুকু সম্ভব আবার দেখলাম, নিরেট কঠিন গাঁথুনি, একটু চূণবালি খসলো না। বাহিরে এসে চারপাশে দেখা হলো, বাড়ীর বেষ্টনী প্রাচীর থেকে অন্ততঃ একশো গজ দূরে এ ঘর। আশে-পাশে কোথাও কোন বড় গাছ নেই, সেকথা আগেই বলেছি। প্রথমটা একটু বিস্মিত হয়েছিলেম, এতবড় জমির মধ্যে ফলের গাছ নেই এটা আশ্চর্য্য! এক সময় হয়ত ছিল, কেটে ফেলে পাঁচিল থেকে বেশ অনেকখানি বাদ দিয়ে নূতন নূতন কলমের চারা বসানো হয়েছে, যাদের ফলবান হয়ে উঠতে যুগান্তর এসে যাবে। তাহলে এর এইই কারণ? পরে শুনলাম এই কাণ্ডটি নাকি করিয়েছেন খুকীর মা ইলা দেবীই। বাগানের সমস্ত নামজাদা আম জাম কাঁটাল জামরুল গোলাপ-জাম এমন কি, নারকোল গাছগুলোকেও তিনি বেঁচে থাকতে দেননি! নিজে অফলা হবার আক্রোশে ওদের ফলবন্ত মূর্ত্তি হয়ত তাঁর অপ্রকৃতিস্থ চিত্তকে ঈর্ষান্বিত করে তুলেছিল, নয় কি? একেই বলে “স্ত্রীয়শ্চরিত্রম্”—সেই সঙ্গেই মনে হলো, “পুরুষস্য ভাগ্যং”ও যে দেবতার অদৃশ্য প্রবাদবাণী এ-ও কিছুমাত্র বেঠিক নয়। এরও উদাহরণ আমাদের এই সর্ব্বসুখের অধিকারী হয়েও একান্ত দুর্ভাগ্য দিব্যেন্দু।—যাক্ ভাগ্যিস বিয়ে করিনি, খুব বেঁচে গেছি বহু ঝামেলা থেকে। মেয়েদের নিয়ে ঘর করা আর আগুন নিয়ে খেলা, ও দেখছি একই কথা।

পাঁচ

 “স্ত্রীয়শ্চরিত্র” যে কি বস্তু তখনও তা ভাল করে জানতে পারিনি। সেটার একটা উদাহরণ পেলেম ঠিক এর পরের রাত্রে। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় চাঁদের উপর একখানা হিম-কুয়াসার পাতলা চাদরের আচ্ছাদন পড়া সত্ত্বেও বাগানে আলোর অপ্রতুলতা হয়নি। আমার শোবার ঘরটা ছিল ঠিক পিছন দিকের সারিতে, ঐ দিকে কেয়াবন, ঝুমকোলতা এবং কলকে ফুলের কুঞ্জগুলো বেশ সুস্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। খোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেই নীচের দিক থেকে মানুষের গলার সাড়া পেলেম। রাত তখন পৌনে দুটো। জল খেয়ে ঘড়ি দেখে ফের শুতে যাচ্ছিলাম, জ্যোস্নাস্নাত উদ্যানের রূপ যেন আমাকে টেনে রাখলে। কানে ভেসে এলো একান্ত অপ্রত্যাশিত শব্দটা:

 “তুমি কি বোঝ না এমন করে তোমায় এ বাড়ীতে ঢুকতে দেওয়া আমার পক্ষে কত বড় সাঙ্ঘাতিক? কেন তুমি আস? আরও কি তুমি করতে চাও?”

সমস্ত শরীর মন শিউরে উঠে যেন এতটুকু হয়ে গেল! এ’ কি! এ’যে মনে হচ্ছে ইলার গলার স্বর। দিব্যেন্দুর স্ত্রীর। কিন্তু অপর ব্যক্তি যে ওর কথার উত্তর দিলে সে তো দিব্যেন্দু নয়!

 “যা’ করতে চাই সে তো তুমি জানো, অনর্থক ন্যাকা সাজচো কেন? আমার উদ্দেশ্য যদি সিদ্ধ না হয়, ঝাড়ে বংশে সব্বাই শেষ হবে এ-ও জেনে রেখো এবং তার জন্যে প্রস্তুত থেকো, তোমায় আর সাতটি দিন মাত্র সময় দিলাম। এই আমার শেষ নোটীশ।”

 কেতকীবনের অন্তরাল থেকে নিশাচর ও নিশাচরীরা কখন কোন দিক দিয়ে চলে গেছে জানতে পারিনি, আমার কানে নিজেরই মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠে ঝম্ ঝম্ শব্দে তাল বাজাচ্ছিল। এ কি শুনলেম? সত্যি শুনেছি, না এসব নাইটমেয়ার মাত্র? স্বপ্নই সম্ভব! কেউ তো কোথাও নেই, ঝিঁঝির অখণ্ড সঙ্গীতই তো শুধু গাছগুলোর মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে! মানুষের কণ্ঠ এর মধ্যে থেকে হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গীতে বড় বড় রহস্যময় সংলাপ শুনিয়ে দিয়ে তেমনি সহসা কোথায় বা এক মুহূর্ত্তে মিলিয়ে গেলো। এ-ও কি কখন সম্ভব? না, এ দিব্যেন্দুদের জটিল পরিস্থিতির বিষয়ে অত্যন্ত সহানুভূতির বশে উদ্ভট কল্পনার ফলেই ঐ রকম একটা কাল্পনিক দৃশ্য বা অদৃশ্য অভিনয় মাথার মধ্যেই সৃষ্টি হলো। একটা ‘ক্যাফি-অ্যাসপিরিণ’ গলাধঃকরণ করে জল খেয়ে বিছনায় ঢুকে শুয়ে পড়লেম। ঘুমটা এসে গেলেই মাথাটা ক্লীয়ার হয়ে যাবে। এ-বাড়ীর যা ব্যবস্থা দেখেছি, তাতে বাইরে থেকে রাত্তির বেলা ‘ফোরটীফায়েড’ এই বাড়ী বা জেলখানার মধ্যে কোন লোকের আসতে পারা কখনই সম্ভব নয়।

 সকালবেলা চায়ের টেবিলে উপস্থিত হয়ে দেখলাম দিব্যেন্দু তখনও আসেনি, ইলা দেবী সমস্ত খাদ্য-সরঞ্জাম প্রস্তুত করিয়ে নিয়ে আমাদের প্রতীক্ষা করছেন। ঘরে ঢুকেই সর্ব্বপ্রথম তাঁর মুখের দিকে দৃষ্টিটা একটু তীক্ষ করেই নিক্ষেপ করলেম। গত রাত্রের কথা ঘুমভাঙ্গার পর মনে ছিল না; এঁকে দেখেই সেটা আমার মনে মধ্যে ঈষৎ হুল ফোটালো। মুখের বিষন্ন ক্লান্ত ভাবটুকু যা ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে গেছে, সে ছাড়া নতুন কোন চিহ্ন দেখতে পেলেম না। আমি আসতেই উনি উঠে খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে সুন্দর নিটোল হাত দুখানি যুক্ত করে একটি ছোট্ট নমস্কার জানালেন, ঈষৎ হাস্য ঠোঁটে এনে মিষ্টস্বরে বল্লেন, “যদি কোন রকম অসুবিধা হয় আমায় দয়া করে একটুখানি জানতে দেবেন, আমি বুঝতে পারছি আমার সব কর্ত্তব্য আমি ঠিকমত করতে পারছিনে, তবু যতটুকু সম্ভব ছোট বোন মনে করে করিয়ে নেবেন।”

 বেশ দেখা গেল “ছোট বোন” কথাটা বলে ফেলেই উনি কি রকম যেন একটু সচকিত হয়ে গিয়ে শেষ কথা কয়টা যেন টেনে এনে শেষ করলেন।

 পুত্রশোকে নার্ভস্ ব্রেকডাউন হয়েছে—কথাবার্ত্তা বেশী কইতেই যেন কষ্ট পান। আহা বেচারী!—

 শিষ্টাচার জানাতে আমার পক্ষ থেকে অবশ্য ত্রুটি হলো না, সে না বল্লেও চলে।

 সেদিন অনেকখানি ইতস্ততঃ করেও শেষকালটায় একরকম মরিয়া হয়ে উঠে এক নিশ্বাসে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসলেম, বলে বসলেম,—“ইলা দেবী! ছোট বোনই যদি হলেন, তাহলে বড় ভাইয়ের একটা আবেদন শুনুন—”

 সবিস্ময়ে ইলা দেবী তাঁর ডাগর চোখ দুটি তুলে চাইলেন, একটু যেন ভয় পাওয়া সে দুটি চোখ। সবের মধ্যেই যেন একটা সন্দেহের ভাব। ঐটেই তো ঐ রোগের দস্তুর।

 আমার তখন আর ফেরবার পথ নেই, বলে উঠলেম, “দিবুর মেয়েটিকে আমি আজও দেখিনি, অথচ এখানে আসবার সময় কল্পনা করেছিলেম—একটি ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে এই নিঃসার জীবনটাকে একটুখানি রাঙিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। আপনি জানেন না, আমি বড়দের চাইতে বাচ্চাদেরই বেশী ভালবাসি।”

 ইলার সুন্দর মুখখানি গম্ভীর হয়ে গেল, সে একটুক্ষণ নীরব থেকে একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললে, “আমি তাকে আনছি, তবে তাকে দেখে আপনি সুখী হতে পারবেন না। সে মানুষের সন্তান হলেও একটি কাঠের পুতুলের মতন, রং তাতে ফোটেইনি, সে আপনার মনকে কি দিয়ে রাঙাবে।”

 আমাদের প্রাতঃরাশ সমাপ্ত হয়ে গেছলো, ইচ্ছা করেই বাইরের দিক থেকে মধ্যের বড় ড্রইংরুমে এসে বসলেম। ইলা দেবী আমার এই বিবেচনা বুদ্ধির সম্ভবতঃ মনে মনে তারিফই করলেন, দেখলেম সেটা প্রকট হয়ে উঠলো তাঁর ঈষৎ প্রসন্ন মুখভাবে।

 ইলা দেবীর পাশাপাশি তাঁরই প্রায় সমবয়সের একটি মহিলা দিব্যেন্দুর মেয়েকে কোলে করে ঘরে ঢুকলেন। এরই কথা দিব্যেন্দু বোধ করি আমায় বলেছিল, ইলা দেবীর পরিচিতা,—না আত্মীয়া,— ঐ রকমই কি যেন কি একটা হন।

 মেয়েটি সত্যি সত্যিই একটি রংচটা বড় কাঠের পুতুল! কালীঘাটে আগে যেমন খোদাই করা পুতুল একটি পয়সা দিলেই পাওয়া যেত। সাদা দুধের মত রং, রক্তের যেন তাতে লেশমাত্র নেই, গায়ের চামড়া যেন পার্চমেণ্ট কাগজের মত স্বচ্ছ। শরীরের প্রত্যেকটি শিরা-উপশিরা হাড়-পাঁজরা সমস্তই একটি একটি করে গোনা যায় ট্রান্‌স্‌পারেণ্ট কাঁচের গ্লাসের মধ্যে রাখা বাসি এক মুঠো ঝরো-ঝরো জুঁই-ফুল। অভিভাবিকার শিক্ষা মত ইংরেজী-কেতায়—“টাটা” এবং বাংলায় নমস্কার জানালে, গলার ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বর পাখীর বাচ্চার কাকলীর মতই ক্ষীণ ও অস্ফুট।

 তথাপি ওরই মধ্যে যে একখানি রূপের পসরা সাজানো রয়েছে সেও দেখতে পেতে বাধে না। ইলারই অনুরূপ পাতলা দুখানি ঠোট, কালো ও বিশাল দুটি চোখ, রুক্ষ চুলগুলিতেও সেই একই মৃদু কুঞ্চন, নীল শিরা-বারকরা কপালখানিও ছোট্ট। আমার হঠাৎ কান্ত কবির একটি বড় করুণ লাইন মনে পড়ে গেল:—

“ফুটিতে পারিত গো ফুটিল না সে,
অকালে ঝরে গেল, মরমে মরে গেল,
প্রাণ-ভরা আশা সমাধি পাশে।”

 কিন্তু কেনই বা তা যাবে? সাগ্রহে বলে ফেললেম, “ইলা দেবী, আপনার মেয়ের চিকিৎসার ভার আমার হাতে দিন, আমি ওকে স্বাভাবিক করে দোব।”

 বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তড়াক্ করে চেয়ার থেকে ছিট্‌কে লাফিয়ে উঠে দিব্যেন্দু আমায় জড়িয়ে ধরে গভীর আনন্দে বলে উঠলো,“গ্যারাণ্টি?”

 “গ্যারাণ্টি”—

 ইলা দেবী সহসা নতজানু হয়ে আমার পায়ের তলায় বসে অঞ্জলিবদ্ধ করে প্রণাম করলেন, তাঁর দুচোখে জলের ধারা অঝোরে ঝর ঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো।

 আমি তাঁর হাত ধরে উঠালেম, সস্নেহে বললেম, “দক্ষিণা পরে নোব বোন।”

 মিসেস পাকড়াসী হঠাৎ এই ভাব-তরঙ্গের সমস্ত মাধুর্য্য ধ্বংস করে দিয়ে বলে উঠলেন, “বেবির বেদানার রস খাবার সময় হয়েছে, ওকে আমি নিয়ে যাচ্চি।”

আমি সুস্পষ্ট চমকে চম্‌কে উঠলেম, এই কণ্ঠই যে সেই নিশীথরাত্রের নিশাচারিণীর কণ্ঠে শুনেছিলেম, তাতে আমার অণুমাত্র সন্দেহ রইলো না। কিন্তু কেন?—আর সেই অনুজ্ঞাকারী পুরুষটিই বা কে?

ছয়

 ডলি খুব সহজেই আমার বশ হয়ে গেলো। তার এক ফোঁটা ছোট্ট জীবনে সেই ভীষণ কড়াকড়ি দিয়ে ছকা ডিসিপ্লিনের মধ্যে কিছুই কারুর কাছ থেকে সে এ পর্য্যন্ত ভাল জিনিষ পায়নি তো, স্বাধীন সত্তা ওর মধ্যে জন্মাবে কি করে। মা ওর মুখের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারেন না, খোকার শোকের আঘাত ও ভবিষ্যতের আতঙ্কে এই ছাল-ছাড়ানো পাখীর ছানার মতন মেয়েটাকে তিনি ঠিক সইতেই পারছেন না, তা’ ওকে দেখবেন কি করে! সে যত্ন অজস্রই পায়, আদর মোটেই পায় না। মিসেস পাকড়াসী সেবাটা খুবই চুটিয়ে করেন, কিন্তু করলে কি হবে, ঐ রকম নীরস গাম্ভীর্য্যে ভরা নীরস মুখের বিরূপ যত্ন-আত্তির অর্থ বোধ করা কচি-বাচ্চার পক্ষে সহজসাধ্য নয়।

 আমি ক্রমশঃই তাকে জালে ফেলে কাছে টানতে লাগলেম। হপ্তা খানেকের মধ্যে সে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করেই যেন আমার সঙ্গে গাইতে আরম্ভ করলে, “ভাঙলে আদল”—কখনও আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে—“আদুন দালা, আদুন দালা,”—

 আমি তার সমস্ত রুটিন ভেঙ্গে যখন তখন তাকে নিয়ে বাইরে চলে আসতে লাগলেম। বাগানেও ক্রমশঃ তাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে আরম্ভ করে দিলেম। প্রথম দিনটায় আমার এই কাণ্ডে ইলা দেবী তো বিবর্ণ পাংশু হয়ে গেলেন। মনে হল এক্ষুণি, ছুটে এসেই আমার হাত থেকে ছিনিয়ে বুঝি মেয়েকে টেনেই নেবেন, কিন্তু বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলেম, তা না করে প্রাণপণে আত্মসম্বরণ করছেন। এমন কি, পাছে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফেলেন,— সেই ভয়ে একটুক্ষণ স্তব্ধ থেকে হঠাৎ ‘আসছি’ বলে বাড়ীর মধ্যে পালিয়ে গেলেন! অনুকম্পার সঙ্গে সেইদিকে চেয়ে উচ্চারণ করলেম, “আহা বেচারী!” কিন্তু দয়া তাঁকে না করে করলেম তাঁর মেয়েকে। সেও তো আর কম বেচারী নয়, বরং ঢের বেশীই। সমস্ত জীবনটাই তো তার সামনে পড়ে আছে অফলা হয়ে।

 খেলনার দোকান তার ঘরে, সে কিন্তু আর সেদিকে ফিরেও চায় না। “আঙ্কাল দাই”—এই হল তার সর্ব্বক্ষণের মুখের বুলি। আমিও তাকে সহজে হাতছাড়া করি না। মিসেস পাকড়াসীর একান্ত ভয় ব্যগ্রতা অস্থির আগ্রহ কিছুকেই আমল না দিয়ে ওঁর “ওয়ার্ডটি”কে যথাশক্তি নিজের হস্তগত করে নিতে লাগলেম। এমন কি দিব্যেন্দু ও ইলা দেবীকে বলে ওর খাওয়ানোর ভারটাও জোর করে নিজের হাতে ছিনিয়ে নিলেম। ফলের রস, মেডিকেটেড ফুড সব বন্ধ করে দিয়ে খাঁটি দুধ ষ্টীমে জল বসিয়ে তাতেই গরম করে এবং নিজের সঙ্গে চারটি করে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করলেম। বেশ বুঝতে পারি ইলা খুব ভয় পায়, কিন্তু এত ভদ্র যে নিজের দেওয়া কথা সে কিছুতেই ভাঙ্গে না। বিবর্ণ মুখে চট করে সেখান থেকে সরে যায়। বেশ দেখতে পেলেন ঐ মেয়েটি “মৃদুনিকুসুমাদপি” হলেও “বজ্রাদপি কঠিনও” বটে? সত্যের সে পূজারিণী। আমার হাতে মেয়ের সমস্তটা ছেড়ে দেবে কথা দিয়েছে, কথার খেলাপ সে কিছুতেই করবে না। অবশ্য এটাও ঠিক যে ঐ ত্যাগ স্বীকারের প্রত্যক্ষ ফল সে সঙ্গে সঙ্গেই ফলতে দেখতেও তো পাচ্ছিল। এক হপ্তার ভিতরেই কি আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তনই না ঐ আধমরা মেয়েটার হয়েছে! সে এখন কোলে বড় একটা চড়ে না, আমার আঙ্গুল ধরে হেঁটে বেড়ায়। নিজের হাতে প্লেটে ছড়িয়ে দেওয়া শুকনো ভাত, গরম ভাজা খই, বিস্কুটের টুকরো তুলে তুলে খায়। কমলালেবুর কোয়া চোষে, বেদানা চিবোয়, আবার চেঁচিয়ে ডাকে, “আঙ্কাল! এতো।”

 ইলাকে দেখলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ইলা মেয়েকে বুকে তুলে নিয়েই হঠাৎ কেঁদে ফেলে। মেয়ে অবাক হয়ে মায়ের মুখ নিরীক্ষণ করতে করতে আস্তে আস্তে সান্ত্বনা দেয়,—“কেঁনো না, তুপ কলো, অতুক্ তব্বে, আঙ্কাল বুক্‌বে। দত্তি মা! কেঁনো না।”

 মিসেস পাকড়াসীকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। উনি ওঁর ওয়ার্ডের চার্জ্জ থেকে মুক্তি পেয়ে খুসী না বিরক্ত? ওঁর ওই ভাবাবেগশূন্য পাথরে কোঁদা মুখে কিছুমাত্র তা বোঝবার উপায় নেই।—অদ্ভুত এই নারী।

 কিন্তু বোঝবার দিন হঠাৎ একদিন বড় শীঘ্রই আমাদের সামনে এসে পৌঁছে গেল। অন্ধকার রাত্রি, মেঘও খানিকটা আকাশের কোলে কোলে জমে রয়েছে। চাঁদ তো নেই-ই, নক্ষত্রও কদাচিৎ চলমান মেঘের ফাঁকে এক একটা করে দেখা দিয়ে যাচ্ছিল। ঘুমটা ভেঙ্গে গেছলো, বিছানা ছেড়ে উঠেছি, হঠাৎ আমার ঘরের ঠিক নীচে বাগানের সেই কেতকী-কুঞ্জের ওপাশ থেকে মানুষের গলার সাড়া এলো,—সেটা চাপা একটা তর্জ্জন।

 “তোমায় সেদিন শেষ নোটিশ দিয়ে গেছি যে ইলার মেয়েকে সাত দিনের মধ্যে যদি খতম করতে না পারো, একসঙ্গে এ বাড়ীর সব্বাই মরবে সেকথা ভুলে নিশ্চয় যাওনি?”

 এর উত্তরও শোনা গেল চাপা ক্রোধ ও বিরক্তিতে ভরা—“আচ্ছা একি জুলুম তোমার, নিজে যা করতে পারো করো, আমি একটা স্ত্রীলোক, একদিন ভদ্র ঘরেরই মেয়ে ছিলেম, তোমার ছলনায় ভুলে আজ আমায় একটা ফাঁসুড়ে খুনির স্ত্রী হতে হয়েছে, সে তো একটা জন্মের জন্যে, না না—বহু বহু জন্মের জন্যেই যথেষ্ট, তা’তেও তুমি খুসী নও? ঐ কচি বাচ্ছাটাকে আমায় দিয়ে হত্যা করাবে? তবু তোমার ভয়ে তাকে হাতে না মেরে স্লো-পয়জন তো করছিলামই, যদি ভগবান তাকে স্বয়ং পিতৃবন্ধুর মূর্ত্তি ধরে এসে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রক্ষা করেন, আমি তার কি করতে পারি?”

 ভূমে প্রচণ্ড পদাঘাতের শব্দ শোনা গেল, “কালকের মধ্যে তুমি তাকে পুরো ডোজ দিয়ে মারবে কি না? হ্যা কিম্বা না—উত্তর দাও। ধর্ম্মতত্ত্বের বক্তৃতা করতে যেও না। হ্যাঁ, কিম্বা না? এই শেষ কথা।”

 “না”—

 “এক্ষুণি মরবে জেনেও?”

 “আঃ, মরলে ত আমি বেঁচেই যাই। যে যন্ত্রণা দিন-রাত ভোগ করছি আমি, মরণ তো আমার পক্ষে ভগবানের পরম আশীর্ব্বাদ।”

 “তবে সেই আশীর্বাদই গ্রহণ কর—হতভাগী।”

 “যাক স্বামীর হাত থেকে তবু একটা পাবার মত কিছু ভাল জিনিষ এতদিনে পেলুম। অনেক ধন্যবাদ!”

 গুড়ম্ গুম্ একটা মাত্র ভীষণ আওয়াজ শোনা গেল। আর কোন প্রতিশব্দ পর্য্যন্ত নয়। মিসেস্ পাকড়াসী তাঁর স্বামীর দান বীরাঙ্গানার মত নির্ব্বিকার চিত্তে নিঃশব্দেই গ্রহণ করে নিলেন বুঝতে পারা গেল।

 পিস্তলের আওয়াজে দিব্যেন্দুর চাকর দবোয়ান অনেকেই ছুটতে ছুটতে সেইখানে এসে জড়ো হয়েছিল। ঝিয়েরাও আর্ত্তদৃষ্টি মেলে মেলে এসে দাঁড়াতে লাগলো। আসেন নি শুধু ইলা দেবী। হয়ত ঘুম ভাঙেনি, নয়তো মেয়ে ফেলে আসতে ভরসা করেন নি। আসেন নি সে ভালই করেছেন।

 মিসেস্ পাকড়াসীর ঠিক হার্টের উপর রিভলবারের অব্যর্থ গুলি বিঁধেছে। এত কাছ থেকে মারা হয়েছে যে পিস্তলের নল ওর বুকে ঠেকেছিল তার প্রমাণ জামা কাপড়েই রয়েছে। প্রাণ বার হতে মুহূর্ত্তকালও সময় লাগেনি।

 পুলিশ না এনে উপায় নেই। লাস চালানও দিতে হলো। ওর জিনিষপত্রের মধ্যে থেকে কতকগুলি জিনিষ পাওয়া গেল যাতে করে জানা গেল উনি মিসেস্ পাকড়াসী নন, মিসেস্ হাজরা। কুমুদিনী হাজরা। একটা ছোট্ট কাঁচের শিশিতে সিকিভাগ ভর্ত্তি এক প্রকার সাদা মিহি গুঁড়া পাওয়া গেল, সেটা যে কি ডাক্তারী পরীক্ষাতেও তা’ স্থির হলো না। আমি অনেক চেষ্টা করে সেটা আদায় করে রেখে দিলেম। “সো-পয়জন” করার কথাটা তো আর ভুলে যাইনি। হয়ত ঐটেই সেই “ফুল ডোজ” যার সামান্য অংশ শরীরে ঢুকে দিব্যেন্দুর মেয়েটি আস্তে আস্তে মরণের মুখে এগিয়ে চলেছিল। ঘোর সন্দেহ হলে জিনিষটা আমার ‘হেমলক’ নয়তো?

 সব চাইতে বড় সমস্যা এই বাড়ীর মধ্যে অর্থাৎ বাগানের ভিতর আততায়ী এলো কি করে? শুধু ঐ একবারই নয়, আমার সাক্ষ্য থেকেই সবাই সেদিন জানতে পারলে—এর পূর্ব্বেও তিনি ঐভাবে এ বাড়ীতে গতায়াত করেছেন। মিসেস্ পাকড়াসীর সহায়তায়?···হতে পারে। কিন্তু ওকে খুন করে সে কোথা দিয়ে পালালো? কোন দিকের কোন রন্ধ্র পর্য্যন্ত তো খোলা ছিল না! কেয়াবন কেটে ফেলা হলো; কিন্তু ওর তলায় কোথাও কিছুই তো নেই। দিব্যেন্দু যখন এই জায়গাটা কেনে, এটা পরিত্যক্ত একটা নীলকুঠি ছিল। সেই সময়কার সেই ভাঙ্গা বাড়ীটার অবশেষ তারই একটা দিকের ভিতটা এই পর্য্যন্ত ছিল বটে, সেই নিশানাটাই শুধু কেয়া ঝোপ সাফ হতে জানতে পারা গেল। বনটা সম্পূর্ণ কেটে শেষ করেও আর তো কিছুই বেরুলো না! দিবু বললে, বড় চারচৌকা ভাবের কুঠিটার গড়ন ছিল বলে এই বাড়ী করবার সময় এই দিকের ভিত্তিটা লাইন ধরে বাদ দিয়েছিল। তিন দিকের ভিত খুঁড়ে ফেলে তার উপর বাড়ীটা করেছে। এদিককার খানিক খানিক বাগানের দরকার হিসাবে রাস্তা তৈরির ভিতর এসে গিয়েছিল। ঐ দিকটাই শুধু চলনপথে পড়েনি। ইলার সখে এখানেই কেয়াগাছগুলো লাগানো হয়েছিল। কিন্তু কুমুদিনীর হত্যাকারী সর্প-প্রকৃতির হলেও কলেবরে তো মনুষ্যাকৃতিই, জাত সাপ তো আর নয় যে কেয়াবনের মধ্যের গহ্বরে অদৃশ্য হবে? কোন্ পথে সে গেল? হলো কি তবে? ম্যাজিসিয়ান? সয়তান? প্রেত? যোগসিদ্ধ?—কি সে?

 ইলার অবস্থা অবর্ণনীয়। সে যে কি অবস্থা—সে আর বলা যায় না। মুহুর্মুহুঃ সে মূর্চ্ছিত হতে লাগলো। মেয়েটাকে সে না পারে ধরে রাখতে, না পারে ছাড়তে। আমার হাতে রেখেও আর সে যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। যখন জ্ঞান হচ্ছে, অর্দ্ধ অভিভূত তন্দ্রাচ্ছন্নের মতই পড়ে থাকছে, কখনও বিড়বিড় করে কি যেন সব বলছে, কখনও কেঁদে ভাসাচ্ছে, কার কাছে যেন ব্যাকুল হয়ে দয়া প্রার্থনা করছে, সে যে কি মর্ম্মান্তিক দৃশ্য—সহ্য করাই দায়।

 দিব্যেন্দুদের বাড়ীতে এসে যেটুকু ক্ষীণ দীপশিখা জ্বালিয়ে তুলতে পেরেছিলেম, একটি পিস্তলের গুলির নির্ম্মম ফুৎকারে এক মুহূর্ত্তেই নিভে গেল!

 এ কথা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেম, “ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং—ন বিদ্যা ন চ পৌরুষম্।” এক্ষেত্রে বিধিলিপির কথা না ভেবে তো মানুষের উপায় নেই।

সাত

 এ-রকম একটা অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটে গেলে সমস্ত পরিস্থিতিটাই যে অস্বাভাবিক রকমে উলটে যাবে, সেটা কিছুই বিচিত্র নয়। পুলিশ-হাঙ্গামা, সুদূর সদরে লাস চালান দেওয়া, সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে প্রাণান্তকর টানাটানি, সদর কোর্টে, করোনারের কোর্টে, পুলিশ থানায় বারম্বার যাতায়াত, যতরকম অস্বস্তিকর ব্যাপার পৃথিবীতে ছড়ানো আছে সমস্তই একত্রিত হলো। আমিই ছিলুম এ কেসের প্রধান সাক্ষী। সেই দুটি রাত্রির নৈশ অভিসারের অদৃশ্য অভিনেতাদের মুখনিঃসৃত বিচিত্র সংলাপের একক শ্রোতা। এ ভিন্ন আর কেউই কোন কিছুই বলতে পারলে না, যাতে করে এই গভীর হস্যজনক ব্যাপারের অন্ধকারময় কৃষ্ণ-যবনিকা ভেদ করে একটু ক্ষীণতম আলোকরশ্মির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মৃতার জিনিষপত্রের মধ্য থেকে একখানি হিসাবের খাতায় লেখা নামটি পাওয়া গেল, কুমুদিনী হাজরা। ইলাদেবীকে ওঁর হস্তাক্ষর চেনবার জন্য দেখামাত্র তিনি কাঁপতে কাঁপতে একটা অস্ফুট চীৎকার করেই মূর্চ্ছিত হয়ে গেলেন। এইটুকু তার থেকে বোঝা গেল, এ হাতের লেখা ঐ “বিন্দুমতী পাকড়াসীর”ই বটে! ওরই মধ্যে আর একটা অর্দ্ধব্যক্ত ধ্বনি আমার কানে এসে আঘাত করেছিল, “পিশাচ! পিশাচ! তুমি নরপিশাচ!” কে সেই নরপিশাচ? পিশাচী বললে না হয় কুমুদিনীকে বোঝাতে পারতো যে, তার মেয়েকে স্লো-পয়জন করে বিশ্বাসহন্ত্রী হয়ে মেরে ফেলতে বসেছিল। ‘তুমি’ থেকে মনে হলো হত্যাকারী এঁর খুবই অজানা লোক নন। কিন্তু জেরা করে করে কোন ফলই ফললো না। কোন প্রশ্ন করলেই সঙ্গে সঙ্গে অর্দ্ধব্যক্ত কাতরানি ভিন্ন আর কিছুই পাওয়া যায় না—বরঞ্চ নূতন করে এক একট দীর্ঘস্থায়ী ফিট হয়ে যায়। এমন করে এ মেয়ে বাঁচবেই বা কতক্ষণ? আর বেঁচেই বা করবে কি এ? অথচ মনে হয়, ইচ্ছা করলে এ অনেক কিছু জানিয়ে দিয়ে প্রতিকার করবার পথ করে দিতে পারতো। কিন্তু এ কি অদ্ভুত কাণ্ড? কি আশ্চর্য্য রহস্য ওর মধ্যে নিহিত?

 আমি ইতিমধ্যে একটা নূতন আবিষ্কার করে ফেলে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। সেই ছোট্ট সরু শিশির গুঁড়োটুকু থেকে এক অণু পরিমিত বস্তু আমার ভোরের বেলার বেড্-টির তলানিটুকু খেতে নিত্য সমাগত (জানলা দিয়ে) কাঠবেড়ালীটার বিশ্বস্ত পানীয়টুকুতে মিশিয়ে দিলেম। পরম পরিতোষে সে চেটেপুটে খেয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল, পরদিন কিন্তু আর ফিরে এলো না বাগানে গিয়ে বেশী খুঁজতে আমায় হলো না; আমার ঘরের দিকেই যে কাঞ্চন ফুলের গাছটা দিয়ে সে আমার ঘরের জানলায় এসে পৌঁছতো, তারই তলায় তার প্রাণহীন দেহটা গুটিশুটি হয়ে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। মনে একটু কষ্ট যে হয়নি তা’ কি বলতে পারি? কিন্তু এ রকম পাপ তো আগে ঢের করেছি, আবার হয়ত এই নিয়ে করতেই হবে।

 আরও কম মাত্রায় দিব্যেন্দুর খুব সৌখীন একটা কুকুরকেও ঐ গুঁড়োর একটু কণা দিন তিনেক খাওয়ানোর পর তার ওজন নেওয়ালেম, তিন দিনে প্রায় তিন পাউণ্ড কমে গেছে সে, মরণ দশায় পৌঁছুতে খুবই কম বাকি। বলা বাহুল্য, একটা অজুহাতে ওর ওজন নিয়ে তবেই এই এক্সপেরিমেণ্ট আরম্ভ করেছিলেম।

 কোন ভুল নেই,—ডলিকে এই দিয়েই শ্লো-পয়জন করা হচ্ছিল, —দিব্যেন্দুর ছেলে এরই দ্বারায় হত হয়েছে।

 কুকুরটা আধ হাত সাদা শুকনো জিভ বার করে পড়ে পড়ে ধুঁকছিল, আমার সুপ্রসিদ্ধ সর্প-বিষের প্রতিষেধক জবরদস্তি করে ওকে খাইয়ে দিলাম। দুঘণ্টা পরে দেখতে গেছি, কৃতজ্ঞ জীব লেজ তুলে ছুটে এসে আমার গায়ে পায়ে মুখ ঘষে ঘষে—ওঃ সে কি পরমানন্দই যে জ্ঞাপন করলে, মানুষেও অমনটি পারে না।

 ডলিকে তৎক্ষণাৎ গিয়ে একটা ডোজ অ্যানটি-হেমলক আমি খাইয়ে দিলেম। নিঃসন্দেহে এইবারে ওর সমস্ত জড়ত্ব, আধিব্যাধি বিদূরিত হয়ে গিয়ে ও মানুষ হয়ে উঠবে। হয়েছে—অবশ্য কতকটা কদিনেই! কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিষক্রিয়াও তো কিছুটা থেকে গেছে এখন পর্য্যন্ত,—আর ওই সাংঘাতিক সর্পবিষ!

 এই সব নানান হাঙ্গামা চলেছে, দিব্যেন্দু পুনশ্চ সদর থেকে খুব বড় এক্সপার্ট এনে ইলেক,ট্রিকের বন্দোবস্ত করিয়ে ওর সেই যন্ত্রালয়টাকেও ইলেক্‌ট্রিফায়েড করিয়ে নিলে। না জেনে যেখান দিয়েই যে কেউ প্রবেশ করতে চেষ্টা করবে তাকেই নিমিষের মধ্যে বিদ্যুতাহত হয়ে মরতেই হবে। সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুতালোকে সমস্ত বাড়ী-বাগান দিনের আলোর মত উজ্জ্বল হয়ে রইলো, হাজার দুহাজার পাঁচহাজার পাওয়ারের আলোয় নৈশোদ্যানের প্রত্যেক অংশ স্পষ্ট দেখা যেতে লাগলো। গোপনীয় বলে কোথাও কিছু আর এর মধ্যে থাকতেই পারলো না।

 মধ্যরাত্রে সহসা সমস্ত আলোই এক সঙ্গে নির্ব্বাপিত হয়ে গিয়ে ঘোর অন্ধকারে চারদিক মেঘাচ্ছন্ন অমানিশার মূর্ত্তি ধারণ করলে। নিঃসন্দিগ্ধ পুরবাসী অন্য সমস্ত আলো বাতি সে রাত্রে একেবারে গুদামজাত করে ফেলেছিল। একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। ক্রমশঃ আলো জ্বালাও দু’একটা করে হতে লাগলো। আমি ও দিব্যেন্দু দুটো টর্চ্চ নিয়ে বাগানে বেরিয়ে পড়েছিলেম। কোন চিহ্ন কোথাও নেই সত্যি, কিন্তু সেই ভূতপূর্ব্ব কেয়াবনের দিক থেকে একটা ভারী জুতাপায়ের শব্দ সুস্পষ্টরূপেই আমাদের দুজনার কানে এসে পৌঁছেছিল, তাতে দুজনেই আমরা সম্পূর্ণরূপে নিঃসন্দিগ্ধ।

 পাওয়ার হাউসে যথারীতি পূর্ব্বানুবৃত্তি হয়ে গেছে। তার সমস্ত যন্ত্রপাতি বিপর্য্যস্ত, এমন অবস্থা যে মেরামত করবার কোন উপায় পর্য্যন্ত আর নেই।

 এ কি প্রহেলিকা! সত্য সত্যই ভৌতিক কাণ্ড নাকি? ঈভিল-স্পিরিটরা নাকি এই রকম সব অত্যাচার করে শুনেছি। কিন্তু তারা ‘হেমলকে’র সাহায্য নেয় তাতো কখনও শুনিনি।

 আর তা বা কি করে বলা যায়? মিসেস পাকড়াসী তো আর ভৌতিক নন, রক্তমাংসের তৈরী মানবীই যে ছিলেন তার মধ্যে তো আর সংশয় নেই, না হলে গুলি খেয়ে মরলেন কি করে? লোকটা তাকে দিব্যেন্দুর সন্তানদের পয়জন করে মারবার জন্যে নিযুক্ত করেছিল, তাহলে সেই বা ভূত হবে কেমন করে, মানুষ না হয়ে? আর ঐ সর্প-বিষেরই বা সহায়তা নেবে কেন সে?

 দিব্যেন্দুকে হঠাৎ এক সময় প্রশ্ন করে বসলুম, “আচ্ছা, তোমার শ্বশুরবাড়ী কোথায়? তাঁদের কে কে এবং কোথায় আছেন? তোমার বিয়েতে আমি তো আসিনি, এ বিষয়ে কিছুই তাই জানিনে।”

 দিব্যেন্দু ঈষৎ অপ্রতিভের মত লজ্জিত মুখে জবাব দিলে, “বিয়েটা আমার ভাই ঠিক যথারীতি তো ঘটেনি, তাই কাউকেই জানাতে পারাও যায়নি। ব্যাপারটা একটু রোমাণ্টিক গোছের হয়েছিল কিনা।”

 “তাই নাকি?—কি রকম?”

 “অর্থাৎ ঘটক বা অভিভাবকরূপে তৃতীয়পক্ষ এ বিয়েতে কেউ ছিলেন না, স্রেফ বর-কনেকেই ঘটকালী করা থেকে সব কিছুই করতে হয়েছিল।”

 “ঠিক বুঝলেম না। কোর্টশিপ করে স্বাধীনভাবেই না হয় বিয়েটা হলো, হিন্দু মতেই তো হয়েছে, না তিন আইনে? অসবর্ণ বিয়ে?”

 দিব্যেন্দু বললে, “অসবর্ণও নয়, আবার ঠিকঠাক সবর্ণও হয়ত না হতেও পারে। ইলার সঙ্গে লাহোর যাবার সময় ট্রেনে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। ওরা রাওলপিণ্ডির অধিবাসী। সঙ্গে ছিলেন ওর মস্ত বড় পাগড়ী-বাঁধা চুড়িদার পায়জামা আচকান-পরা বাবা। যদিও পরিচয় দিয়েছিলেন বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ বলেই, কিন্তু কথায় বার্ত্তায় আচার ব্যবহারে তাঁকে কোন মতেই বাঙ্গালী বলা চলে না, এতই তিনি খাঁটি পাঞ্জাবী।”—একটু থেমে বললে, “বুঝতেই পাচ্চো, সে শ্রীমূর্ত্তি প্রত্যক্ষ করলে কাকারা কখনই তাঁর কন্যাকে বধূ করে ঘরে আনতে রাজী হতেন না, অগত্যা ওদের পশ্চাদানুবর্ত্তন করে ‘পিণ্ডিতে’ গিয়ে পুরুত ডেকে যথাশাস্ত্র পাণিগ্রহণ-পর্ব্ব সেরেই একেবারে ওকে বাড়ী নিয়ে ফিরলেম। তা’ আমাদের শাস্ত্রেও তো রয়েছে, “স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি,”—কেমন, না? নেই একথা?”

 উত্তর দিলেম, “আছে বৈকি! আর তোমার স্ত্রী—‘স্ত্রী রত্নই’। বড় দুঃখ হয় এমন মেয়ের জীবন এমন কষ্টের হয়ে গেল।” দিব্যেন্দু একটা সুগভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করলে।

 প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছ। ওর সেই পগ্যধারী বাপের কি হল? আসে টাসে?”

 দিব্যেন্দু যেন শিউরে উঠলো, “ভগবান রক্ষা করুন! সে এলেই তো এর উপর আমি একেবারেই গেছি! ইলা অবশ্য সব কথা জানে। বাপটিও কি কম সয়তান! আমার মনের ভাব বুঝে নিয়ে আমায় সে-ই প্রলোভিত করে বিয়ের ব্যবস্থা করলে; যেই সব পাকা হয়ে গেল তখন বলে বসলো, তার সর্ব্বস্ব দুষমনে লুটে নিয়ে গেছে। পাঁচ হাজার টাকা না পেলে বিয়ে দেবে না, এ টাকা তার কর্জ্জ আছে।” অত টাকা তখন এক কথায় দেওয়া আমার পক্ষে খুবই কঠিন, তুমি বুঝেই দেখ। একবার ভাবলুম, যাক্‌গে, বিয়েয় কাজ নেই, ফিরেই যাই।—কিন্তু ইলাকে দেখলে সঙ্কল্প ঠিক রাখা কঠিন হয়ে ওঠে। বেশ বুঝতে পারি, ও-ও যেন আকুল হয়ে আমার উপর দৃঢ় নির্ভর করে বসেছিল,—হয়ত মুক্তি চাইছিল। শেষে অনেক কষ্টে টাকাটা জোগাড় করে তাড়াতাড়ি বিয়েটা চুকিয়েই ফেলি। ও টাকা নিয়ে লিখে দিয়েছিল, কোনদিন কোন সম্পর্ক ও আমাদের সঙ্গে রাখবে না। তারপর অল্পদিনের মধ্যে মারাও গেল। সম্পত্তি কিছু অবশ্য যশোর জেলায় আছে। কে দেখছে। ইলাও সে-সব নিতে চায়নি।”

 ব্যাপারটা কেমন যেন জটিল ও রহস্যপূর্ণ ঠেকলো। একটা ঐ রকম বাজে লোকের মেয়ে ইলা, অমন নম্র ভদ্র শিক্ষিত—এ কি করে হয়? হয়ত মায়ের দিক থেকে হয়ে থাকবে। জগতে কতই বৈচিত্র্য দেখা যায়, কত ভাল ভাল লোকের মন্দ ছেলেমেয়ে হয়, আবার বিপরীতও তো ঘটে।

 দিব্যেন্দু বললে, “টাকাটা সে নেহাৎ ঠকিয়ে নেয়নি, ঐ জমি-জমা জ্ঞাতিদের হাত থেকে উদ্ধার করতে ঐ টাকাটা সত্যই ওর ধার হয়েছিল।”

আট

 কদিন ধরেই এই সব নানা বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে গিয়ে শরীর মন কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কি শুভক্ষণেই না সুদীর্ঘ দিবসান্তে বন্ধু গৃহে পদার্পণ করেছিলেম। ইলার অবস্থা প্রায় সমান। অনেক যত্ন চিকিৎসায় এইটুকু হয়েছে যে ততটা ঘন ঘন মূর্চ্ছাটা বন্ধ হয়ে দিনে রাত্রে দু’ একবারে দাঁড়িয়েছে। তবে মেয়েটার কথা প্রায় সে ভুলেই থাকে, আর সেইজন্যই মেয়েটার স্বাস্থ্যোন্নতিটা এতবড় বিপদের মধ্যেও বেশ দ্রুত গতিতেই হচ্ছিল। বিশেষতঃ আমার ঐ ওষুধটা খাবার পর থেকে।

 এদিকের পুলিশ হাঙ্গামা সব চুকেবুকে এসেছে, ডলির জন্যে একজন বিদেশিনী গবর্ণেসের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছিল, ইতিমধ্যে দু’একখানা আবেদনপত্র এসেও গেছে, লোক ঠিক হলে তার হাতে মেয়ে ও মেয়ের মাকে সঁপে দিয়ে আমি বিদায় নোব। অবশ্য সেকথা মুখে প্রকাশ করে বলবার উপায় নেই। দিব্যেন্দু তো প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়, ইলাকে ভরসা করে বলাই হয়নি।

 হঠাৎ সে রাত্রে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল।

 বেশ জোর হাওয়া বয়ে চলেছে, দূর থেকে নদীজলের প্রবাহধ্বনি অন্যদিনের মত অস্ফুটভাবে নয়, একটু প্রবল হয়েই ভেসে আসছে। বৃষ্টি আসবার বিলম্ব নেই, মুহুর্মুহুঃ বজ্রধ্বনির সঙ্গে বিদ্যুদ্বিকাশ হচ্ছিল। শুনতে শুনতে কোন সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেম বুঝতে পারিনি, হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে সজোরে করাঘাতের পর করাঘাতের দ্রুত অস্থির ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক মুহূর্ত্ত সময় লাগলো নিশ্চিত হতে। আমার দরজাতেই কেউ ধাক্কা দিচ্চে, না আর কোথাও।

 দরজার খিল্‌টা খুলে দিতেই সবেগে কে ঘরে ঢুকে পড়লো এবং দুরন্ত ঝড়ো-হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণশিখায় জ্বালিয়ে রাখা ল্যাম্পের আলোটুকু নিবে গেল। অকস্মাৎ সর্ব্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে আমার মনে পড়ে গেল সেই অতীতের সন্ধ্যাটিকে,—যেদিন এইরকমই দোর ঠেলে অজ্ঞাত ব্যক্তির আকস্মিক অভ্যুদয় ঘটেছিল। সেদিনও ঠিক এই রকমই আলো নিবেছিল এবং সেই সঙ্গে মুমূর্ষু ফকিরের কাছে পাওয়া সর্প-বিয়ের প্রতিষেধকের হাতে-কলমে পরীক্ষার সুযোগ ঘটে আমায় আজ একজন আবিষ্কারকের উচ্চ সম্মানে সম্মানিত ও অর্থসৌভাগ্যে সৌভাগ্যবান করে তুলেছে।

 কিন্তু অতীতকে স্মরণ করে আমি আনন্দের পরিবর্ত্তে একান্ত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেম, “কে? কে তুমি? শীগ্‌গির কথা কও, শীগ্‌গির বলো কে তুমি?”

 ঘন ঘন দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ বাতাসের শব্দে ঢাকা পড়েনি, তেমনি হাঁফ ধরার মধ্য দিয়ে উত্তর এলো, “আমি দিব্যেন্দু, কুঁজোর জলে মিশিয়ে রেখে আমায় কে কি খাইয়েছে।—“উঃ জ্বলে যাচ্ছি,— জ্বলে যাচ্ছি,—আগুনের চাইতেও বেশী জ্বালা—”

 আমার কণ্ঠ চিরে একটা অর্দ্ধস্ফুট ধ্বনি ব্যক্ত হতে না হতেই নিজেকে প্রাণান্ত বলে কঠিন করে নিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে গিয়ে ওকে টেনে এনে শুইয়ে দিলেম। দোর বন্ধ করে আলো জ্বাললেম। বিনা প্রশ্নে কোনদিকে চেয়ে না দেখেই আমার ডাক্তারী ব্যাগ খুলে প্রতিযেধক ওষুধটি বার করে কুঁজোর জল ঢেলে নিয়ে তাতে ফোঁটা ফেলতে ফেলতে এতক্ষণে দিব্যেন্দুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেম, “জল খেয়েছ কতক্ষণ?”

 “আন্দাজ দশ মিনিট হবে। উঃ! বুকের মধ্যের আগুন যেন ক্রমশঃ,—একি!—এ যে একটা বরফের চাঁই হার্টের উপর—”

 আর কিছু না শুনেই ছুটে এসে ইজিচেয়ারে এলিয়ে পড়া দিব্যেন্দুর মুখে জলশুদ্ধ ওষুধটা ঢেলে দিয়ে তার ডান কব্জীর নাড়ীটা চেপে ধরলুম।—কি জানি, সময় পেলেম কি?

 ঘড়ি টিক্ টিক্ টিক্ টিক্ অনর্গল বকেই চলেছে,— আমার সমস্ত মনপ্রাণ উদগ্র আগ্রহে ও আতঙ্কে স্তম্ভিত হয়ে রয়েছে, নিজের শরীরেও যেন বিষক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে মনে হচ্ছিল। অবসন্ন করাঙ্গুলি নাড়ীর গতি পর্য্যবেক্ষণ শক্তি হয়ত হারিয়েই ফেলেছিল, হঠাৎ মনে হলো নাড়ী নেই। হাতখানা হিমশিলার মত অসহ্য ঠাণ্ডা। আর এক ডোজ ওষুধ প্রায় বন্ধ চোয়ালের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে তাকে খাইয়ে দিলেম।

 এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ সেকেণ্ড, মিনিট, কোয়ার্টার কেটে গেল, নাড়ী ফিরে আসছে, শীতলতা আস্তে আস্তে বিদূরিত হয়ে আসছে,—আরো, আরো মিনিটের পর মিনিট কেটে চললো, ক্রমে ঘণ্টাও পূর্ণ হলো, দিব্যেন্দু গভীর শান্তির পূর্ণ শ্বাস গ্রহণ করে নিদ্রালুকণ্ঠে জড়িত স্বরে বলে উঠলো,—“বেঁচে গেছি! না রে?”

 অপরিসীম আনন্দে ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গভীর স্বরে বলে উঠলেম, “হ্যাঁ, ঈশ্বরকে মহা ধন্যবাদ।”

 “তোমাকেও সেই সঙ্গে—আঃ! ঘুমুই?”

 “ঘুমাও—” বলে ওর মাথার তলায় বালিশ দিয়ে পা দুটো তুলে একটা চেয়ারে ঠিক করে রেখে ভাল করে শুইয়ে দিলেম। একমুহূর্ত্ত পরেই ঘুমন্ত মানুষের মত সহজ শ্বাস-প্রশ্বাস বইতে লাগলো, পুনরুজ্জীবিত দিব্যেন্দু সুস্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

 ভগবানের সঙ্গে সেই মিশর-পিরামিডের ধারেই হঠাৎ পাওয়া আসন্নমৃত্যু ফকিরের উদ্দেশ্যেও গভীর কৃতজ্ঞ চিত্তে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেম! তাঁর কথা কয়টি মনের মধ্যে ধ্বনিত হয়ে উঠলো:

 “হিন্দু হও, মুসলমান বা খৃষ্টান হও, তুমি আল্লার প্রেরিত হয়ে এ-সময়ে যখন এসেছ আমার কাছে, নিশ্চয় সেই বিশ্বাসঘাতক সয়তানের দোসর হবে না। সে আমার শিষ্য সেজে এসেছিল, চুরি করে নিয়ে গেছে প্রাচীনকালের আবিষ্কৃত অতি ভয়ঙ্কর সর্প-বিষ হেমলক—যার এক তিল প্রমাণ খেলে সঙ্গে সঙ্গে বুকে আগুন জ্বলে উঠবে, আর পনের মিনিটের মধ্যে সেই আগুন হয়ে যাবে বরফ, তার এই প্রতিযেধক আমি সারা জীবন ধরে প্রাণপণ চেষ্টায় আবিষ্কার করেছি। এটা সে খুঁজে পায়নি, তাই নিতে পারেনি। আমার মাটিতে পোঁতা আসরফী আর ঐ বিষের কৌটা নিয়েই সে পালিয়ে গেছে। তুমি নাও এই অমৃত।—যখনই ঐ লক্ষণ দুটি দেখবে, বিনা দ্বিধায় অবিলম্বে দুটি ফেঁটা দিয়ে দেবে। অন্য বিষেও যদি ঐ লক্ষণ থাকে, ফল দিতেও পারে। এর ফরমূলাও আছে ওরই মধ্যে; যত্ন করে রেখ এবং আমার এই তপস্যার ফলকে ব্যর্থ হতে দিও না। এর বাড়া সুহৃদ মনুষ্য-সমাজে নেই বললেই চলে।”

 এ সেই ব্যক্তি,—যে ফকিরের আতিথ্যের প্রতিদানে তার সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করে ‘বিষ’ সংগ্রহ করে এনেছিল। এ সেই লোক যে একদা নিজেই ভুলক্রমে সেই বিষ খেয়ে ফেলে আমার কাছে প্রতিষেধক পাবার জন্য এসেছিল। জানি না, কি করে খবর পেয়েছিল ঐ বস্তুটি আমি আহরণ করতে পেরেছি। আর এই নির্জ্জন দ্বীপ-নিবাসের এই সকল ভয়াবহ রহস্যময় ব্যাপারের ব্যাপারীও সেই একই লোক। তা না হলে এই পিরামিড-বিষের উত্তরাধিকারী তো আজ পৃথিবীর মধ্যে আর দ্বিতীয় কেউ বর্ত্তমান নেই! এও সেই একই ব্যক্তি। ফকিরের সঙ্গে সঙ্গেই বাকশক্তি বিলুপ্ত না হলে এবং ঘণ্টা কয়েক পরেই মৃত্যু না ঘটলে তার সম্বন্ধে একটা দৈহিক বর্ণনা পেতে পারা যেতে পারতো, তাও তো ঘটেনি যে আমরা সেই আশ্চর্য্য আগন্তুককে চিনে নেবো!

 দিব্যেন্দু দিন, দুই অত্যন্ত দুর্ব্বল থেকে আস্তে আস্তে সামলে উঠতে লাগলো। আমি দিনরাত তাকে নিয়েই ব্যস্ত রইলেম। এর ভিতর একটি খাঁটি ইংলিশ লেডি (গবর্ণেস) বড় বড় সার্টিফিকেট নিয়ে এসে ডলির ভার তুলে নিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেম। বাড়ীতে যে রকম সর্প-যজ্ঞ চলেছে, এ বিদেশী মেয়ে আর যাই হোক কেন, যজ্ঞেশ্বরের প্রেরিত স্পাই ত আর হবে না। ইলাকেও একটু দেখাশোনা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই উনি করছেন দেখলাম। বয়স্কা মহিলা শিক্ষিতা, মনটিও হয়ত সহজাত সেবাধর্ম্মী।

 ইলাকে ইচ্ছা করেই আমি ওর স্বামীর ব্যাপারটা সমস্তই সঠিক জানিয়ে দিলেম। এর থেকে ওর মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। নিজের ভয় ভাবনা নিয়েই ও এলিয়ে থেকে স্বামীকে আদৌ গ্রাহ্য করে দেখছে না, সেই কথা মনে পড়লে নিজেকে শক্ত করে নিতে চেষ্টাও হয়ত মনে জাগবে। ফলেও ঠিক তাই-ই ঘটলো।

 আমায় ও এক সময় জিজ্ঞেস করলে, “আচ্ছা ওঁর হঠাৎ কি হ’ল বলুন ত? অসুখটা কি?”

 গম্ভীর মুখে জবাব দিলেম, “যে অসুখে তোমার খোকা গেছে, যার প্রভাবে তোমার ডলি আস্তে আস্তে যাচ্ছিল, সেই একই অসুখ। সাপের বিষ, মিশর-পিরামিডের থেকে পাওয়া প্রাচীন কালের এক অতি মহার্ঘ্য বস্তু—অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, ‘হেমলক’ নাকি ওর নাম।

 ইলা একটা অস্ফুট আর্ত্তনাদ করে উঠলো, “সয়তান! সয়তান! এত করেও ওর সাধ মিটলো না। আমার চূড়ান্ত সর্ব্বনাশ না করে ও ছাড়বে না সে আমি জানি, আমি তা’ জানি।”

 একান্ত গাম্ভীর্য্যপূর্ণ শান্ত স্বরে ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেম, “ও,—কে?”

 ইলা চোখ বুজে হাত দুটো কঠিন বলে মুঠো করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বোধ করি নিজের এতদিনকার ছড়িয়ে-পড়া স্নায়ুগুলোকেই শক্ত করে নিতে প্রাণপণে যুঝছিল, ঠিক সেই অবস্থার মধ্যে থেকেই কঠিন বলে উচ্চারণ করলে, “দাদা! মরার বাড়া তো আর গাল নেই,—এতদূরেই যখন এসে পৌঁচেছি তখন আর কিসের ভয়? সব কথাই আমি আপনাকে আজ খুলেই বলবো। তারপর যা’ হবার হয়েই যাক। শপথ ভঙ্গের পাপ যদি হয় নরকেই না হয় পচবো, তা’তেই বা কি? আর এমন করে দগ্ধাতে আমি পারছি নে। আপনি যদি এখানে না আসতেন, আজ আমার কি দশাই হতো!”

 ······না দাদা! বলা এত সহজ নয়! আমি আপনাকে সকল কথা লিখে জানাবো, মুখে বলতে বড্ড যেন বাধছে।”

 সংক্ষেপে উত্তর দিলাম, “বেশ।”

নয়

সবিনয় নিবেদন,

 পরম পূজনীয় দাদা! আপনাকে বলেছিলেম যে, ‘বলা সহজ নয়, লিখে জানাবো’, কিন্তু যার মূলেই প্রচণ্ড গলদ ও বিরাট লজ্জা বিপুল সঙ্কোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কেমন করে ভদ্রসমাজের লোকচক্ষে প্রকটিত হতে দিই বলুন তো? দ্বিধায় ঘৃণায় অপমানে ইচ্ছে করছে নিজ কুলের এই কলঙ্ক প্রচার করবার পূর্ব্বেই কেন আমি মরলেম না। যে এতগুলো হত্যা করতে পারলে সে ইচ্ছে করেই না আমায় দগ্ধ করবার নিষ্ঠুর আনন্দে আমায় একটুখানি তার সেই অব্যর্থ বিষ—সে বলেছিল, ক্লিওপেট্রা নাকি ঐ নাম দিয়েছিল এবং বহু ব্যাপারে ব্যবহারও করেছিল বিপক্ষতাকারীদের উপর, কোন্ বৈদ্যের কাছ থেকে চুরি করে ঐ বিষপাত্রটি সংগ্রহ করেছিল, আর ওরই জোরে নিজের অনভিপ্রেত অনেককেই ও নিঃশব্দে ও অসন্দিগ্ধভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে, আজও দিচ্চে অথচ আমায় যে দিচ্ছে না, একি আমার প্রতি করুণায়? না, না, সে-কথা ভুলেও ভাববেন না। কৃপা, করুণা ঐ পাষাণ-প্রকৃতি পাঠান-সর্দারের পুত্রের মনের একটা কোণাতেও ছিটে-ফোঁটা পর্য্যন্ত নেই। কর্কশ কঠোর ফ্রণ্টিয়ারের রুক্ষ পার্ব্বত্য-প্রকৃতির মতই তার দুর্দ্দান্ত সন্তান সে, যারা হাসতে হাসতে একটা মুরগীর বাচ্চার গলার চাইতেও মানুষের বুকে অনায়াস আনন্দে ছুরি বসিয়ে দেয়। মরণার্ত্ত শিকারকে পায়ে করে ঠেলে দিয়ে সেই কাঁচা রক্তমাখা ছুরি নিজের পাগড়ী দিয়ে মুছে প্রেম-সঙ্গীত গাইতে গাইতে ইচ্ছাসুখে মন্থর গতিতে প্রস্থান করে।

 ও আসলে তো তাদেরি একজন! সে রক্ত কোথায় যাবে? যদিও অতি শৈশব থেকে একান্ত ভদ্র বাঙালী পরিবারে পুত্রাধিক স্নেহে ও শিক্ষায় ও প্রতিপালিত হয়েছিল, কিন্তু একটু বড় হতে না হতে রক্তের গন্ধে বাঘের মতই মেতে উঠে নিজের পৈতৃক হিংস্র-প্রকৃতির সন্ধান ও খুঁজে পেলে। কার সাধ্য রক্তের বিষ শোধন করে,—রক্ত যে কথা কয়।

 সকল কথা একটু গোড়া থেকেই তা হলে বলি। আফ্রিদির যুদ্ধের সময় ইংরাজ বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে এদেশেই বহু সামরিক কর্ম্মচারী ফ্রণ্টিয়ারের বৃটিশ চাকরীতে চাকরী নিয়ে যায়। হাজরা সাহেব বা ক্যাপটেন হাজরাও তাদের মধ্যের একজন। তিনি শুদ্ধ রুগী বাঁচাবার বিদ্যায় নয়, নিরোগী জোয়ান যোদ্ধা মারবার বিদ্যাও বেশ ভালভাবে শিখেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে বহুবার তার পরীক্ষা দিয়ে বৃটিশ মহলে খুব নামও করেছিলেন। হ্যাভেলক সাহেবকে যখন আফ্রিদিরা চুরি করে নিয়ে যায়, সেই নিরুদ্দিষ্টের সার্চ-পার্টিতে তিনিও স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন। ইতিহাসই বলেছে, জানেন হয়ত, তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু যাকে এই অনুসন্ধানফলে না খুঁজতেই পাওয়া গেছলো তার কথা এ জগতে ক’জনই বা জানে। বহু গ্রাম ধ্বংস হলো, বহু দোষী-নির্দ্দোষী নির্ব্বিশেষে নিহত হলো,—তবু তখন এটম ছেড়ে মামুলী বম্বিংএরও কেউ স্বপ্ন দেখেনি। মেসিনগানই সেদিনে যথেষ্ট ছিল।

 এক গ্রাম্য-সর্দ্দারের সঙ্গে ক্যাপ্টেন হাজরার রীতিমত যুদ্ধ হয়, দুর্দ্ধর্ষ বিরাট মূর্ত্তি সাত ফুটের ওপর লম্বা—পাঠান হলে কি হয়, তার সেকেলে গাদা বন্দুক হাজরা সাহেবের মার্টিনী রাইফেলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে না, তাঁর অব্যর্থ গুলিতে সে মরলো।

 সেই সঙ্গে মহাকালের অদৃশ্য খাতায় আমার ভবিষ্যৎ আগুনের অক্ষরে লিখিত হয়ে গেল। তার ঘরে ছিল এক অপূর্ব্ব রূপসী হিন্দুযুবতী। তাকে হিন্দুগ্রাম থেকে তার আত্মীয়-পরিজন সব্বাইকে খুন করে তাকে হরণ করে এনেছিল ঐ পাঠান সর্দ্দার। মেয়েটি কাপ্টেনের পায়ের উপর আছড়ে পড়ে তাঁর স্মরণ চাইলে, যতক্ষণ না স্বীকার হলেন, পা ছেড়ে সে কিছুতেই উঠলো না। সে এক অপূর্ব্ব সুন্দরী পাঞ্জাবী কিশোরী, যোড়শ বৎসর অনুত্তীর্ণাপ্রায় বালিকা। তিনি অগত্যা তাকে তাঁর ক্যাম্পে নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে একটি মাস কয়েকের নেহাৎ অপোগণ্ড শিশু। তাকে শুদ্ধ না এনে উপায় রইলো না। ক্যাপ্টেন অনেক চেষ্টা করেও তাকে ফেলে অসতে কিছুতেই ওকে বাধ্য করতে পারলেন না। সে এক হাতে শিশুকে বুকে চেপে অন্য হাতে তাঁর পা চেপে পড়ে রইলো। মানুষের দুর্ব্বলতাই তার সবচেয়ে বড় শত্রু। যে আফ্রিদি সর্দ্দারকে তিনি নিজের হাতে হত্যা করেছেন, তারই পুত্রকে নিজের ঘরে স্থান দিলেন—নিজ হস্তে অতি বিষাক্ত বিষবৃক্ষের চারাটি রোপণ করলেন!

 যুদ্ধান্তে ওলপিণ্ডিতে ফিরে আর্য্য-সমাজী মতে শুদ্ধি করিয়ে সেই নিরপরাধ মহা-অপরাধিনী সমাজ স্বধর্ম্ম স্বজনবিচ্যুতা অভাগিনী মেয়েটিকে তিনি বাধ্য হয়ে নয়, ভালবেসেই বিয়ে করলেন। এই সত্যকার কাহিনী অবশ্য সাধারণ্যে গোপনই রইলো। ছেলেটিও শুদ্ধি হলো, তার নাম দেওয়া হয়েছিল সূর্য্যকান্ত হাজরা। স্ত্রীর সত্যাগ্রহে বিপন্ন হয়ে রূপমুগ্ধ পতি চন্দ্রকান্ত হাজরা নিজ পুত্র বলেই তাকে লোকসমাজে পরিচিত করলেন। এরপর গোমতী হাজরার একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। হাজরা সাহেব তাদের দুজনের জন্যেই একত্র একইভাবে লালন-পালন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজের বাঙ্গালীত্বের অভিমান তাঁর সুদৃঢ় ছিল। এত দূরেও তিনি এদের জন্যে বাংলা মাষ্টার রেখে দেন এবং উত্তম ইংরাজী শিক্ষার জন্য কনভেণ্টে ভর্ত্তি করেন। মা পাঞ্জাবী হলেও তারা যাতে বাংলা ও ইংরাজীতে সর্ব্বদা কথাবার্ত্তা কয় তার দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতেন। নিরক্ষরা স্ত্রীকেও লেখাপড়ার সঙ্গে পাঞ্জাবী বুলি পরিহার করাতে যথেষ্ট অধ্যবসায় দেখিয়েছিলেন। অতীতকে তিনি সম্পূর্ণ রূপে ধুয়ে ফেলতে চাইছিলেন।

 সূযি কিন্তু তার জাতীয় ধর্ম্ম পরিত্যাগ করতে পারলো না। যত বড় হতে লাগলো, ততই সে দুর্দ্দান্ত হয়ে উঠলো। প্রখর বুদ্ধি নিয়ে বিদ্যা ছেড়ে সে নিয়ত অবিদ্যারই চর্চ্চা করে চল্লো। তার পালক পিতা অনেক চেষ্টা করেও তাকে সেপথ থেকে ফেরাতে পারলেন না। তার মায়ের মেয়েকে সে দুটি চোখে দেখতে পারতো না। মৌখিকই নয়, যতদূর পারে শারীরিক অত্যাচারও তার উপর সে যৎপরোনাস্তি করে চলেছিল। তারপর···সংক্ষেপেই বলি, না হলে সত্তর পৃষ্ঠা লিখেও এ কাহিনী শেষ করতে পারব না। ছেলের অত্যাচারে অনাচারে মর্ম্মাহত মা একেবারে মর্ম্মে মরে গেলেন। ঐ ছেলের উপর কি জানি কেন যে তাঁর একটা উৎকট ভালবাসা ও অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। মেয়ের প্রতি যেন সে তুলনায় ঢের কম। যাই হোক, মাতৃস্নেহ হয়ত কুসন্তানের প্রতি সমধিক হয়েই থাকে,— এইটেই ত প্রসিদ্ধি। কিন্তু মেয়ের প্রতি যে নিদারুণ অভিশাপের মতই মৃত্যুমুহূর্ত্তে তাকে দিয়ে কঠিনতম দিব্য দিয়ে শপথ করিয়ে গেলেন, কোন মা অন্ততঃ বাংলা দেশের মা হলে হয়ত তা পারতেন না। ঐ ছেলের সমস্ত জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভার তার উপর ন্যস্ত করলেন। সে মেয়ের তখন বয়স বা কত, জীবনের অভিজ্ঞতাই বা কি, সে দাদাকে অন্তর দিয়েই ভালবাসে,—সহোদর ভাইয়ের প্রতি সোদরার অকৃত্রিম স্নেহ। অনায়াসেই মায়ের মাথায় হাত দিয়ে ও তাঁর বলা বুলি কপ্‌চিয়ে গেল। যতদিন বাঁচবে সূর্য্যকান্ত যাই করুক, তার কোন ক্ষতি সে হতে দেবে না। তার বিয়ে দিয়ে ভাল বউ আনবে, তাদের অর্থকষ্ট না হয় সে বিষয়েও দায় ঘাড়ে নেবে। সানন্দেই সেই নির্ব্বোধ বালিকা আসন্ন-মৃত্যু জননীকে এই সমস্ত স্বীকৃতি দান করে অন্তর হতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মহামন্ত্রের মতই এই মাতৃদীক্ষা গ্রহণ করলে। বিষবৃক্ষে ফুল ধরলো।—

 সঙ্গে সঙ্গে সূর্য্যকান্ত মায়ের সমস্ত সোনা, জহরৎ, রূপার তৈজসপত্র, হাজরা সাহেবের সোনার রিষ্ট-ব্যাণ্ড, বোম, পিস্তল, রাইফেল, বাড়ীর যাবতীয় মূল্যবান দ্রব্য এবং জাল সই-এ বাঙ্কের টাকাগুলি পর্য্যন্ত সমস্তই চুরি করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

 এরপর একদিকে অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে ক্যাপ্টেন হাজরা পেনসন্ নিয়ে সুদূর পাঞ্জাব হ’তে বহুদিন পরিত্যক্ত বাংলার গ্রামে চলে এলেন। মেয়েকে নিজেই শিক্ষা দিতেন ও শেষজীবনে কুলগুরুর কাছে প্রায়শ্চিত্ত বিধান নিয়ে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ পূর্ব্বক সাধন ভজনে মনোনিবেশ করলেন। বাড়ী-ঘর সম্পত্তি দখল করতে অবশ্য মামলা না করে উপায় ছিল না।

 কন্যার বিবাহ সহজেই জুটে গেল। বিবাহের অত্যল্পদিন পরে নিজের সঞ্চিত কিছু অর্থ প্রভৃতির সঙ্গে আজ যে-সব কথা আপনাকে লিখছি এই কাহিনী-লেখা একটি পত্র মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর পড়ে দেখো। সূযি তোমার ভাই নয়, কেউ নয়, শুধু তোমার মার জন্যই বাধ্য হয়ে তাকে আমি দুধ কলা দিয়ে কালসাপের মতই পুষেছিলেম। সাপের শোলুই সাপই হয়, এতদূর পালিয়ে এসেছি তার অত্যাচারের ভয়ে। হয়ত এখানে তার মুখ বার করবার সাহস হবে না।’

 কয়েকদিন পরে ক্যাপ্টেন হাজরা হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেলেন।

 স্বামীর সঙ্গে তাঁর বাড়ী যাবার দিন স্থির হয়েছে, হঠাৎ সূযি এসে দেখা দিল। তিন বৎসরে আরও রুক্ষ আরও বলিষ্ঠ সে হয়েছে। প্রথম সম্ভাষণে জানালে সে তার পৈতৃক সম্পত্তি দখল করতে এসেছে। আমি যাবার পূর্ব্বে যেন সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে যাই। সে বিবাহ করেছে, বউ আনবে। সামান্য নগদ টাকা এবং নিজস্ব বস্তুগুলি ছাড়া সমস্তই তার জন্যে রেখে বিদায় নিতে উদ্যত হলাম। মনে একটা বিজাতীয় ঘৃণা বোধ হতে থাকলেও মায়ের কাছের শপথ তো ভুলে যাবার নয়। ওঃ, মা হয়ে এত বড় শত্রুতা কেউ সন্তানের সঙ্গে করে?

 সূযি নগদ টাকার হিসাব চাইলে। টাকার দলিল-পত্র অতি সামান্যই, তাও তো আমার স্বামীর দেওয়া পাঁচ হাজারেরই অবশিষ্ট টুকু—স্বামীর সঙ্গে পূর্ব্বেই আমার নিজস্ব সামান্য সামান্য জিনিষগুলি পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, নিজেরা দুজনে তাঁর মোটরে একটু এখানে সেখানে দেখে শুনে যাবো বলে। সূয্যি সে কথা মানলে না, অকথ্য কটুবাক্যে গালাগালি দিয়ে নালিশ করার ভয় দেখালে, বললে, ‘জোচ্চর! সয়তানী! দেখাচ্চি তোকে মুখে লাথি মেরে, টাকা আমার আদায় হয় কি না। আমার পৈতৃক ধন, তুই নেবার কে?’

 আর সহ্য করা গেল না। উঃ, কি নিদারুণ ভুলই যে একটি মুহূর্ত্তের আত্মবিস্মৃতির বশে উন্মাদ হয়ে গিয়ে করে বসলাম! এই সমস্ত তারই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া মাত্র। সর্ব্বনাশ তখনই আমার ঘটে গিয়েছে। অপমানের জ্বালায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কি করতে কি করেছি! সবেগে বলে উঠলাম, “পৈতৃকটা কার, কে তোমার পিতা? তোমার বাপ তো একটা আফ্রিদি ডাকাত,—তাকে মেরে ফেলে মাকে আর তোমাকে উদ্ধার করে এনে আমার বাবাই তােমাদের দয়া করে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার যথেষ্ট ঋণ শােধ তো করেছ,—আর নয়, এই মুহূর্ত্তে চলে যাও। তােমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”

 অতি নিকটে বজ্রাঘাতের শব্দে মানুষ যেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে, সামান্য কয়টি মুহূর্ত্ত মাত্র তেমনি হতভম্ব হয়ে থেকে সূর্য্যকান্ত যেন প্রলয়াগ্নির মতই জ্বলে উঠল, “ইলা! মরবার সাধ হয়েছে? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। কেটে টুকরাে টুকরাে করে তাের হাড় মাস আঁস্তাকুড়ে ছড়িয়ে দেবাে, জানিস্!”

 আমারও কি জানি কেমন করেই তখন খুন ঘাড়ে চেপে গিয়েছে, সর্ব্বশরীর ভয়ে কেঁপে উঠলেও তখনও নিবৃত্ত হতে পারলেম না, নির্ম্মম হয়ে গিয়ে বলে উঠলেম, “নারী-হরণকারী নরঘাতক আফ্রিদি বর্ব্বরের ছেলে এ ছাড়া আর জানেই বা কি?—করবেই বা কোন ভাল কর্ম্ম।”

 হঠাৎ নিজেকে কতকটা সংযত করে নিয়ে সূর্য্যকান্ত সম্বিৎ স্বরে জিজ্ঞাসা করলাে, “বাপ তুলে বারে বারে গাল দিচ্চো বােন হয়ে, এ’ও কি সম্ভব? যা বলছো তার প্রমাণ দিতে পারবে?”

 আপদ চুকবে ভেবেই আর কিছু না ভেবে উৎসাহের সঙ্গেই উত্তরে বললাম, “বেশ, লিখিত প্রমাণই তােমায় দিচ্চি।” ছুটে গিয়ে বাবার সেই সাঙ্ঘাতিক স্বীকারােক্তি নিয়ে এসে ওর গায়ের উপর ছুঁড়ে দিলেম। তার পর দূরে সরে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে নিজেকে বিজয়ী-বােধে প্রতীক্ষার সঙ্গে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে আরম্ভ করেছি, কানের মধ্যে আগুনের একট। হল্কার মতই ছুটে এসে প্রবিষ্ট হ’ল—“বাঁচালে আমায় তুমি শ্রীমতী ইলা দেবী। আমি যে প্যানপেনে বাঙ্গালী কুত্তার বাচ্চা নই, খাঁটি সীমান্ত পাঠানদের খাঁটি আফ্রিদি বাচ্চা, এর চেয়ে প্রার্থনীয় আমার পক্ষে আর কিছুই হতে পারে না। ভেবে পাইনি কি করে কোথা থেকে ভেতো-বাঙ্গালী হয়ে আমার রক্তে এ খুনের জোয়ার বয়ে আসে! আমার এ রক্তে খুনের এ আগুন জ্বলে কোথা থেকে,—ভাঁটাপড়া পচা পুকুরের শ্যাওলা-পড়া পাঁকের বদলে! যাক বেঁচে গেছি। তোমার স্বামী, যদি সন্তান জন্মাতে সময় মেলে তো তারা, এবং অবশেষে তুমি হাজরা-বংশের ঝাড়ে-বংশে সক্কলেই আজ থেকে আমার পিতৃহত্যার পরিশোধে আমার ভিকটিম হয়ে খোদাতালার পায়ে উৎসর্গিত হয়ে রইলে। প্রতিশোধ—পিতৃহত্যার নির্ম্মম প্রতিশোধ!”

 সূর্য্যকান্ত দম্ভভরে জুতা ঠুকে চলতে উদ্যত হয়ে মুখ ফিরালো।

 এক মুহূর্ত্তে আমার চোখের সামনের সারা দুনিয়াটাই বিপুল বেগে ঘূর্ণিত হয়ে উঠলো। পায়ের তলায় পৃথিবী যেন ভীষণ ভূমিকম্পে প্রচণ্ড দুলে উঠল। উঃ, সর্ব্বনাশী আমি এ’কি করলেম? হা ঈশ্বর! এ কি মতিচ্ছন্ন ধরলো আমার? আকুল আর্ত্তনাদ করে ছুটে এলাম,—“দাদা! দাদা!—ক্ষমা করো, বুদ্ধিহীনা নারী আমি, আমার সর্ব্বস্ব তোমায় দান করছি, তুমি সব নাও—সব নাও—আরও যা চাও তাও দোব। ক্ষমা ক্ষমা—”

 কে কোথায়?

 অদূর হতে একটা হিংস্র তীব্র বৈশাখী ঝড়ের ঝাপটার মত রুদ্র জ্বালাময় বিদ্রূপ হাস্য ছুটে এসে আমার সর্ব্বশরীরে ও ভয়ার্ত্ত-চিত্তে অগ্নিবাণের মতই ঝাঁপিয়ে পড়লো, আমি সংজ্ঞাহারা হলাম।

 “ডাক্তার! ডাক্তার! অবিলম্বে তোমার অ্যানটি-হেমলক বার করো, শীগ্‌গির—শীগ্‌গির—শীগ্‌গির—”

 আকস্মিক সেই তথাকথিত অগ্নিবাণেরই একটা সুতীক্ষ্ণ শব্দশরের ফলা এসে তীব্রবেগে কানের মধ্যে বিঁধল। এই রহস্যঘন জীবন-কাহিনীর অদ্ভুত পরিবেশে মাথা কি আমার বিগড়িয়ে গেল নাকি? অথবা আমার অবচেতন মনের গুহায় রক্ষিত সেই পুরাতন দৃশ্যপট—

 “ডাক্তার! এক মিনিট সময় নষ্ট করবার অবসর আর নেই। হয় আমায় বাঁচাও, নয় নিজে মর!”

 একহাতে রিভলবার বাগানো, অপর হাতটা আর্ত্তভাবে নাড়া দিতে দিতে স্খলিত-কণ্ঠে সেই আমার হেমলক প্রতিষেধকের প্রথম রোগী আমার সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে কিন্তু এক লহমার দৃষ্টিতেই বুঝলাম, দাঁড়িয়ে থাকবার শক্তি তার আর তখন শরীরে অবশিষ্ট ছিল না, বেতসপত্রের মতই সুদীর্ঘ দেহটা সঘনে কম্পিত হচ্ছিল।

 একটা দারুণ আতঙ্কে আমার হৃৎপিণ্ড নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল, গভীর বিস্ময়ের তাড়না থেকে কোনক্রমে আত্মরক্ষা করে সাশ্চর্য্যে বলে উঠলেম, “এ কি! তুমি এই নিশ্ছিদ্র বন্ধ বাড়ীতে কি করে ঢুকলে?”

 ঘোর অমঙ্গল-ভরা বিদ্রূপপূর্ণ উচ্চ হাস্যধ্বনি উত্থিত হয়ে মধ্য পথেই যেন সহসা থেমে গেল। “নির্ব্বোধ! এ বাড়ীর প্রত্যেকটি রুদ্ধ দ্বার আমার গতি যদি রোধ করতে পারতো তা’হলে এত কাণ্ড করলাম কি করে? নীল গুদামের ভাঙ্গা বাড়ী দিয়ে এ বাড়ীর কর্ত্তার ঘর পর্য্যন্ত যে গুপ্তপথ আছে, তার খবর রাখো সার্লকহোম্‌স্? কেয়াতলার জমিতে তার একটা গুপ্ত দরজা আর ঐ—ঐ ঘরের পাশের করাইডরে দ্বিতীয় আর একটা। কিন্তু, করছো কি? ভেবেছ কি আমি যদি মরি তোমায় ছেড়ে রেখে যাবো? না, না, না,—”

 সূর্য্যকান্ত নলটা আমার ললাট লক্ষ্যে তুলে ধরল।

 “দেখছে না নিজের বিষে নিজেই জ্বরে’ যাচ্ছি! গোখরো সাপ কামড়েছে। তোমার জন্যে হেমলক চূর্ণে মেশাব বলে বিষদাঁত থেকে বিষ সংগ্রহ করছিলুম যাতে পনের মিনিট সময়ও না পাও। ভুক্তমাত্রেন—উঃ! ডাক্তার! শোন,—আমায় একবার তুমি বাঁচিয়েছিলে, আর একবার বাঁচাও, দয়া করো। শপথ করছি ইলাকে আমি ক্ষমা করবো। ভারতবর্ষ থেকে চলে যাব, ওঃ দোহাই আল্লার,” —সে সবেগে মাটিতে বসে পড়ল, বসে বসে ও মাতালের মত টলতে লাগল।

 আমার মানবিকতা প্রচণ্ড বলে আমার অন্তরে এসে আঘাত করলো। ফকিরের আদেশ মনে পড়লো। ‘সকল প্রকার বিষক্রিয়ায় এই ঔষধ মন্ত্রৌষধি হবে। শ্রুতমাত্র তুমি দিতে ঈশ্বরের কাছে বাধ্য থাকবে।’ দ্রুত উঠে পড়লাম। হয়ত সেই ঈশ্বরের কাছে এবং মানব সমাজের কাইে ঘোর অপরাধে অপরাধী হতে চলেছি জেনেও গুরুর আদেশ আমার বিবেক অগ্রাহ্য করতে পারল না। বললাম, “শোন সূর্য্যকান্ত! ওষুধ তোমায় আমি দোব, কিন্তু—”

 সূর্য্যকান্ত মরণাহত বাঘের মতই গর্জ্জে উঠল, “সূর্য্যকান্ত! কে তোমর সূর্য্যকান্ত? আমি গিয়াসউদ্দিন আব্বাস খান,—কাফেরের দেবতার নাম দিয়ে আমায় সয়তান বানাতে চেয়েছিল সেই বাঁদীর বাচ্চা বেঁড়ে সয়তানটা—ইয়া আল্লা! শালা সাপ আমায় কিনা শেষে তার কাছে হার মানালে।”

 সূর্য্যকান্ত অথবা গিয়াসউদ্দিন আব্বাস খান, অকস্মাৎ মর্ম্মান্তিক যন্ত্রণায় তীব্র একটা আর্ত্তরব করে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ল, তার শাকবর্ণ মুখ একবার সুতীব্র বিক্ষোভে আকুঞ্চিত হয়েই থেমে গেল। নীল ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে খানিকটা সাদা ফেনা গড়িয়ে পড়ল।