খুনী কে/প্রথম পরিচ্ছেদ

খুনী কে?

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 গ্রীষ্মকাল। বেলা প্রায় ছয়টা বাজিতে চলিল, তবুও রৌদ্রের উত্তাপ কমিল না। গরমের ভয়ে এতক্ষণ অফিস-ঘরের জানালাগুলি বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম, বেলা শেষ হইতেছে দেখিয়া, একে একে সকলগুলিই খুলিয়া দিয়া যেমন বসিতে যাইব, অমনি টুং টুং করিয়া টেলিফোঁর ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল।

 ঘণ্টার শব্দ শুনিয়াই মনে করিলাম, সাহেবের ডাক পড়িয়াছে। তাড়াতাড়ি যন্ত্রের নিকট যাইলাম। যাহা শুনিলাম, তাহাতে আমার ধারণাই সত্য হইল।

 সাহেব ডাকিয়াছেন, নিশ্চয়ই কোন হুকুম আছে। মনিবের হুকুম, আর দেরি করিতে পারিলাম না। তখনই সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত গমন করিলাম।

 সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তিনি একখানি কাগজ আমার হাতে দিয়া কহিলেন, “এইটী পড়িয়া দেখ।” আমি উহার আগাগোড়া পড়িলে পর, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই ঘটনা কি তুমি পূর্ব্ব শুনিয়াছ?”

 আমি সসম্ভ্রমে উত্তর করিলাম, “আজ্ঞা হাঁ, শুনিয়াছি।”

 সা। আমি এখন তোমার হাতে ইহার অনুসন্ধানের ভার দিতেছি, ইহার প্রকৃত অবস্থা কি, তাহা বাহির করিতে হইবে।

 আমার হাতে একটী কাজ ছিল। আবার সাহেবের হুকুম একেবারে অমান্য করিতেও সাহস করিলাম না। মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলাম, “আমার হাতে―”

 আমার কথায় বাধা দিয়া সাহেব সহাস্যবদনে বলিলেন, “তোমার হাতে যে কাজ আছে, তাহাতে দুই চারি দিন বিলম্ব হইলেও ক্ষতি হইবে না। তুমি অগ্রে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হও এবং যত শীঘ্র পার, এই কাজ শেষ করিতে চেষ্টা কর।”

 সাহেবের কথায় মনে বড় দুঃখ হইল। ভাবিলাম, লোকে যে বলে, চাকরে আর কুকুরে কোন প্রভেদ নাই, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। যখন চাকরের কার্য্য স্বীকার করিয়াছি, তখন আর দুঃখ করিলে চলিবে কেন। সাহেবের নিকট বিদায় লইয়া, এই নূতন কার্য্যের অনুসন্ধানের নিমিত্ত প্রস্থান করিলাম।

 সাহেব-প্রদত্ত কাগজখানি পাঠ করিয়া যাহা আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার একটু আভাষ এইস্থানে প্রদান করিতেছি।

 সহরতলীর এক স্থানের একজন আধুনিক জমিদারের নাম কেশবচন্দ্র দত্ত। এই কেশব বাবুর এক প্রজা সেদিন খুন হইয়াছে। প্রজার নাম দামোদর ঘোষ। দামোদরের একমাত্র পুত্র এখনও বর্ত্তমান, তাহার নাম যতীন্দ্র। স্থানীয় পুলিসের বিশ্বাস, যতীন্দ্রই পিতৃহত্যা করিয়াছেন। সুতরাং তিনি ধৃত হইয়াছেন। জমিদার মহাশয়ের সহিত দামোদরের বন্ধুত্ব থাকায় তিনি দামোদরকে কয়েক বিঘা জমি দান করিয়াছিলেন। কেশব বাবু তাহার জন্য কোনরূপ খাজনা লইতেন না। কেশব বাবুর একমাত্র কন্যা বর্ত্তমান, নাম অমলা। উভয়েরই স্ত্রী নাই। তাঁহার বাড়ী হইতে প্রায় এক মাইল দূরে একটা বিস্তৃত জলা আছে। দামোদর মধ্যে মধ্যে সেখানে পক্ষী শীকার করিতে যাইতেন। গত জ্যৈষ্ঠ মাসের তেস্‌রা তারিখে বেলা প্রায় তিন ঘটিকার সময়, দামোদর শীকার করিবার অভিপ্রায়ে সেই জলাতীরে উপস্থিত হন। সেই অবধি তিনি আর বাড়ীতে ফিরিয়া যান নাই। কিন্তু তাঁহার মৃতদেহ সেই জলার ধারেই পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে দুইজন সাক্ষী স্থানীয় পুলিস পাইয়াছেন। তাহাদিগের একজন জমীদার মহাশয়ের ভৃত্য, অপর—একজন প্রজা।

 ভৃত্য বলে যে, সে দামোদরকে মাঠ দিয়া বেলা তিনটার কিছু পূর্ব্বে যাইতে দেখিয়াছিল। দামোদরের যাইবার পরেই তাঁহার পুত্র যতীন্দ্র তাঁহার অনুসরণ করেন। কিন্তু ভৃত্যের মনে কোন সন্দেহ না হওয়ায়, সে তাঁহাদিগকে আর লক্ষ্য করে নাই।

 প্রজা কহে, যখন সে সেই জলার ধার দিয়া বাড়ী ফিরিতেছিল, সে পিতাকে পুত্রের সহিত বিবাদ করিতে দেখিতে পায়। কিন্তু সেও আর অধিক কোন কথা বলিতে পারে না। পুলিশ যখন যতীন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করে, তখন তিনি বলিয়াছেন যে, তিনি পুলিসের কার্য্যে কিছুমাত্র আশ্চর্য্য হন নাই। পুলিস যে তাঁহাকেই হত্যাকারী বলিয়া গ্রেপ্তার করিবে, ইহা তিনি জানিতেন।

 তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি গম্ভীরভাবে একবার উপর দিকে চাহিয়া, মস্তক অবনত করিলেন ও পরে বলিলেন, “যিনি খুন হইয়াছেন, আমি তাঁহারই একমাত্র পুত্র। বাবা যে দিন খুন হন, আমি তাহার পূর্ব্বের তিন দিন বাড়ীতে ছিলাম না। বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য আমায় কলিকাতায় যাইতে হইয়াছিল। সোমবার প্রাতে আমি কলিকাতা ত্যাগ করি। যখন আমি বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন বাবা বাড়ীতে ছিলেন না। শুনিলাম, তিনি তখনই পাখী শীকারে গিয়াছেন। বাবা শীকার করিতে বড় ভালবাসিতেন। আমি জানিতাম যে, তিনি জলার ধারেই শীকার করেন। সুতরাং আমিও বাড়ীর বাহির হইলাম, পথে আমাদের এক চাকরের সহিত দেখা হইল। সে আমায় নমস্কার করিল। কিন্তু সে যে বাবাকে আমার খানিক আগেই যাইতে দেখিয়াছে, সে কথা কিছু বলিল না। জলার নিকটে পৌঁছিয়া আমি বাবাকে দেখিতে পাইলাম। তাঁহার নিকটে যাইলাম। আমাকে হঠাৎ সেখানে দেখিয়া বাবার রাগ হইল। তিনি বিনা কারণে আমায় কতকগুলি তিরস্কার করিলেন। আমারও রাগ হইল। আমিও তাঁহাকে দুই চারিটী কথা বললাম। ইহাতে তিনি আরও ক্রোধান্ধ হইয়া, আমাকে মারিবার নিমিত্ত বন্দুক তুলিলেন। আমি পলায়ন করিলাম। জলা হইতে প্রায় অর্দ্ধ ক্রোশ দূরে আমাদের এক প্রজা আছে। আমি তাহারই বাড়ীতে যাইবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম কিন্তু কিছুদুর যাইতে না যাইতে পশ্চাতে এক ভয়ানক চীৎকার ধ্বনি শুনিতে পাইলাম। কণ্ঠস্বর বাবার বলিয়া বোধ হইল। আমি আর অগ্রসর হইতে পারিলাম না; দৌড়িয়া পুনরায় জলার ধারে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বাবার মাথার খুলি ফাটিয়া গিয়াছে। সর্ব্বাঙ্গ রক্তাক্ত। মাথা হইতে তখনও ভয়ানক রক্ত ঝরিতেছে। আমি পিতার নিকট যাইলাম। তাঁহাকে আস্তে আস্তে তুলিয়া কোলে লইলাম। যত পারিলাম, রক্ত মুছাইলাম। তিনি তখনও জীবিত। কিন্তু মৃত্যুর আর বেশী বিলম্ব ছিল না। দুই একটী অস্পষ্ট কথা কহিয়া, তিনি একবার দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরক্ষণেই তাঁহার প্রাণবায়ু দেহ হইতে বহির্গত হইল।

 মরিবার পূর্ব্বে তিনি অনেক কথা বলিবার চেষ্টা করেন, কিন্তু আমি তাঁহার কোন কথা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। তিনি সর্ব্বশেষে “আম্ সদ্দা” এইরূপ একটী কথা বলিয়া মরিয়া যান। ইহার পূর্ব্বে আর যে দুই একবার কথা কহিয়াছিলেন, তাহা এত অস্পষ্ট ও এত মৃদু যে, আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই। “আম্ সদ্দা” এই কথাটার কোন অর্থ নাই। আমিও উহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই। মনে করিয়াছিলাম, তিনি ভুল বকিতেছেন। যে বিষয় লইয়া আমাদিগের পিতাপুত্রের বিবাদ হয়, সে কথা বলিতে আমি ইচ্ছা করি না। তবে ঐ কথার সহিত এই খুনের কোন সম্বন্ধ নাই, এ কথা আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি।