খুনী কে/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
যে থানার এলাকায় এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, আমি সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। গাড়ী হইতে নামিয়াই দারোগা লালমোহন বাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “আপনি যে এই অনুসন্ধানে আসিবেন, তাহা আমি জানিতাম। লালমোহন বাবু আমার পরিচিত। তাঁহার বয়স ছাব্বিশ বৎসরের অধিক হইবে না। কিন্তু এই বয়সেই তিনি একজন বিখ্যাত দারোগা হইয়াছেন। তাঁহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ হইলেও সুপুরুষ বলিতে হইবে। তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও কার্য্যক্ষম।
লালমোহন বাবুর নিকট লইতে এই খুনি মকর্দ্দমার সমস্ত অবস্থা যাহা তিনি এ পর্য্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিলাম ও সেই ঘটনার স্থল পরীক্ষার জন্য বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময়ে, থানার দ্বারে একখানি গাড়ী আসিল।
একটী ভদ্র যুবক সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন এবং থানার ভিতর প্রবেশ করিয়া লালমোহনের নিকট আগমন করিলেন। লালমোহন তাঁহাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “এই যে আপনিও আসিয়াছেন! ভালই হইয়াছে।”
যুবকের বয়স পঁচিশ বৎসরের অধিক হইবে না। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, পুষ্টকায়, বলিষ্ঠ ও কার্য্যক্ষম। যৌবন-সুলভচপলতা তাঁহাতে দেখিতে পাই নাই। এ বয়সে তাঁহার ধীর ও প্রশান্ত মূর্ত্তি দেখিয়া আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। চারি চক্ষুর মিলন হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয় কি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন? আপনার নাম?”
যুবক ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, আজ্ঞা হাঁ, আমি আপনারই নিকট আসিয়াছি। শুনিলাম, আপনি এখানে আসিয়াছেন। সেই জন্য একেবারে থানায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। আমার নাম ভবানীপ্রসাদ, পিতৃহত্যাপরাধে যিনি অন্যায়রূপে বন্দী হইয়াছেন, আমি তাঁহারই এক বন্ধু। আপনার সহিত গোপনে আমার অনেক কথা আছে। শুনিয়াছি, আপনি একজন প্রসিদ্ধ গোয়েন্দা। লোকমুখে আপনার যথেষ্ট সুখ্যাতি শুনিয়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনিই আমার বন্ধুকে মুক্ত করিতে পারিবেন।”
ভবানী প্রসাদের মুখে সকল কথা শুনিবার ইচ্ছা হইল। আমি ভবানী প্রসাদকে অফিস-ঘরে ডাকিয়া আনিলাম। লালমোহনও আমাদের সহিত আসিলেন।
সকলে অফিসের টেবিলের চারিদিকে চেয়ারে ও বেঞ্চের উপর উপবেশন করিলে ভবানীপ্রসাদ আমাকে বলিলেন, “মহাশয়! যে লোক একদিন একটী পায়রার ছানা মরিয়া যাওয়ায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল, তাহাকে কি আপনি পিতৃঘাতী বলিয়া সন্দেহ করিতে পারেন? আমি ঈশ্বরের শপথ করিয়া বলিতে পারি, আমি স্বচক্ষে তাহাকে কাঁদিতে দেখিয়াছি। এখন আপনি একমাত্র ভরসা। আপনি কি আমার বন্ধুকে মুক্ত করিতে পারিবেন না?”
আমি ভবানী প্রসাদের কথায় মুগ্ধ হইলাম। বন্ধুর জন্য লোকে আজকাল যে এতটা করে, আমার বিশ্বাস ছিল না। আমি বলিলাম, “যথাসাধ্য চেষ্টা করিব, ফল ভগবানের হাতে। তবে আপনার বন্ধু যদি নিষ্পাপ হন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই মুক্তি লাভ করিবেন।”
ভ। আপনি অবশ্যই এই বিষয় সমস্ত শুনিয়াছেন। আপনার কি বোধ হয়? আমার বন্ধুর মুক্তির কি কোন উপায় আছে? আপনি নিজে তাহাকে নির্দ্দোষী বলিয়া মনে করেন না কি?
আ। সম্ভব?
আমার কথা শুনিবামাত্র ভবানীপ্রসাদ লালমোহনের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, “দেখিলেন মহাশয়, আপনি ত আমায় একেবারেই হতাশ করিয়াছিলেন।”
লালমোহন আশ্চর্য্য হইয়া আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। পরে বলিলেন, “আমার বিশ্বাস, উনি কিছু তাড়াতাড়ি নিজের মত প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছেন।”
আমি হাসিয়া উঠিলাম। ভবানীপ্রসাদ বলিয়া উঠিলেন, “উনিই সত্য বলিয়াছেন। আমি জানি, সে নির্দ্দোষী।”
আমি সে কথা চাপা দিয়া ভবানীপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার সহিত যতীন্দ্রনাথের কি কোন সম্পর্ক আছে?”
ভ। আজ্ঞা আছে;—যতীন আমার জ্ঞাতি ভাই।
আ। কি রকম জ্ঞাতি ভাই?
ভ। যতীনের পিতা ও আমার পিতা পরস্পর খুড়তত ভাই।
আ। আপনার এখন নিবাস কোথায়?
ভ। যতীনের বাড়ীর পার্শ্বে ই।
আ। শুনিলাম, যতীন্দ্রনাথ একটী প্রশ্নের উত্তর করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। আপনি সেই বিষয়ের কি কোন সংবাদ রাখেন? যতীন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার পিতার কোন্ বিষয় লইয়া বিবাদ হইয়াছিল জানেন? যতীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ প্রশ্নের উত্তরই বা কেন করেন নাই, বলিতে পারেন?
ভ। আজ্ঞা হাঁ—পারি; কিন্তু যে কথা যতীন স্বয়ং প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে নাই, সেই কথা আমি জানিলেও সকলের সমক্ষে বলিতে পারিব না।
আমি দারোগা বাবুকে দেখাইয়া বলিলাম, “লালমোহন বাবু ত এখানকার দারোগা। যাহা কিছু বলিবেন, উঁহার সমক্ষে বলিতেই হইবে। এখানে আর কেহ নাই। আপনি স্বচ্ছন্দে বলিতে পারেন।”
আমার কথা শুনিয়া ভবানীপ্রসাদ বলিলেন, “যতীনের পিতার আন্তরিক ইচ্ছা এই ছিল যে, তিনি জমীদারের একমাত্র কন্যাকে যতীনের সহিত বিবাহ দেন, যতীন তাহাতে সম্মত ছিল না। এই মতভেদই বিবাদের একমাত্র কারণ। পাছে অমলার নাম পুলিসে প্রকাশ করিতে হয়, এই ভয়ে যতীন সে কথা বলে নাই।”
আমি কিছু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “অমলার পিতা কি এই বিবাহে সম্মত ছিলেন?
ভ। আজ্ঞা না।
আ। তবে যতীন্দ্রনাথের পিতা ঐ স্থানে পুত্রের বিবাহ দিতে ইচ্ছা করিলে কি হইবে? তাঁহার এরূপ অন্যায় প্রস্তাবের কারণ কি জানেন?
ত। কারণ কি জানি না, তবে, তিনি জমীদারকে যাহা বলিতেন, তিনি তাহা না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। আ। ইহার কারণ কি?
ভ। সে কথা বলিতে পারিলাম না। দামোদর বাবুকে জমীদার মহাশয় যথেষ্ট অনুগ্রহ করিতেন।
অ। অনুগ্রহ করিতেন বলিয়া নিজের কন্যা দান করিবেন, এ বড় আশ্চর্য্য কথা!
ভবানীপ্রসাদ উত্তর করিলেন, “জানি না,—কেন তিনি জমীদার মহাশয়কে যাহা বলিতেন, জমীদার মহাশয় তাহা করিতে বাধ্য হইতেন।”
আ। কেশব বাবু বাড়ীতেই আছেন ত?
ভ। আজ্ঞা হাঁ। তিনি নড়িতে পারেন না। তাঁহার শরীর পূর্ব্ব হইতেই ভাঙ্গিয়া ছিল, সম্প্রতি বোধ হয় প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে একেবারে শয্যাগত হইয়াছেন। ডাক্তারেরা কাহাকেও নিকটে যাইতে দিতেছেন না।
আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলাম, “বটে! বন্ধুর মৃত্যু সংবাদে তাঁহার এমন অবস্থা হইয়াছে? ভাল, যতীন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে বোধ হয় বাধা নাই।”
লালমোহন আমার কথায় হাসিয়া উত্তর করিলেন, “না—যখনই বলিবেন, তখনই আমি আপনাকে সেখানে লইয়া যাইব।”
ভবানীপ্রসাদ তখন তাঁহার বন্ধুর মুক্তির জন্য আমায় বারম্বার অনুরোধ করিয়া থানা হইতে বাহির হইলেন।