খুনী কে/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
কেশব বাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন;—
“দামোদর সামান্য লোক নহে। সে মানবাকারে একজন দস্যু। এই বিশ বৎসর সে আমায় জ্বালাতন করিয়া আসিতেছে।
আমি তাঁহাকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি সেই দুর্দ্দান্ত লোকের বশীভূত হইলেন কিরূপে?”
কে। শুনুন, আমি সমস্তই বলিতেছি। ডাক্তার বাবু আপনি লিখিয়া যান। আমার বয়স যখন ত্রিশ বৎসর, তখন আমার পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর আমি তাঁহার বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইলাম। আমার আর কেহ ছিল না। মাথার উপর বাবা ছিলেন, তিনি মারা পড়িলেন। আমি সমস্ত বিষয় আশয় বিক্রয় করিয়া নগদ টাকা করিলাম। একে আমার যৌবনকাল, তাহার উপর হাতে বেশ টাকাও ছিল, এ অবস্থায় সচরাচর যাহা হয়, তাহাই ঘটিল। আমার অনেক সঙ্গী জুটিল। আমি মদ খাইতে শিখিলাম; এবং অতি অল্প দিনের মধ্যেই ঘোর বেশ্যাশক্ত হইয়া উঠিলাম। সর্ব্বশুদ্ধ আমার পাঁচ জন বন্ধু হইল। তাহারা আমার পয়সায় আমোদ-প্রমোদ করিতে লাগিল। দামোদর সেই পাঁচ জনের মধ্যে একজন। ক্রমে ক্রমে আমার সমস্ত অর্থ শেষ হইয়া গেল। আমার হাতে একটীও পয়সা রহিল না। তখন আমরা অর্থোপার্জ্জনের উপায় দেখিতে লাগিলাম।
আমরা সন্ধ্যার পর খিদিরপুর অঞ্চলে কোন নির্জ্জন স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতাম এবং সুবিধা পাইলে লোকজনের নিকট হইতে টাকা-কড়ি কাড়িয়া লইতে লাগিলাম। সেই অবধি সঙ্গীরা আমার নাম রাম সর্দ্দার রাখিল। এইরূপে অর্থোপার্জ্জন করিয়া, আমরা আমোদ করিতে লাগিলাম। লোকে আমাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ করিত না। একদিন শুনিলাম, কোন জমীদারের অনেক টাকা যাইবে। আমরা সেই টাকা লুঠ করিবার পরামর্শ করিলাম। আমরা সর্ব্বশুদ্ধ ছয় জন ছিলাম, কিন্তু পাছে সফল না হই, এই নিমিত্ত আরও জন কয়েক লোক সংগ্রহ করিলাম। রাত্রি নয়টার পর আমরা সেই অর্থ লাভ করিলাম। যাহাদিগকে আমাদের সাহায্যের জন্য সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহাদিগকে পুরস্কার দিয়া বিদায় করিলাম এবং অবশিষ্ট সমস্ত অর্থ আমাদের বাসায় লইয়া আসিলাম। অংশ লইয়া কথায় কথায় দামোদরের সহিত আমার বিবাদ হয়। আমার ভয়ানক রাগ হইয়াছিল, আমি দামোদরকে হত্যা করিতে এক লাঠি তুলিলাম। কিন্তু দামোদর আমার হাতে লাঠি দেখিয়া সম্পূর্ণ বশীভূত হইল এবং আমি যাহা দিলাম, তাহাতে বাহ্যিক সন্তুষ্ট হইয়া দল ছাড়িয়া প্রস্থান করিল। আমার অবশিষ্ট সঙ্গিগণ যথেষ্ট টাকা পাইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। আমিও এই জমীদারী কিনিয়া এখানে বাস করিতে লাগিলাম। এই জমীদারীর আয় সামান্য নহে। বাৎসরিক ছয় হাজার টাকা হইবে। এত টাকার মালিক হওয়ায় আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইল। আমি বিবাহ করিলাম এবং তিন বৎসর একরূপ নির্ব্বিবাদে সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করিলাম। বিবাহের তিন বৎসর পরে অমলার জন্ম হয়। অমলার বয়স যখন এক বৎসর, তখন তাহার মাতার মৃত্যু হয়। আমি অধিক বয়সে বিবাহ করিয়াছিলাম, সুতরাং আমার আর দ্বিতীয় বার বিবাহ করিবার ইচ্ছা ছিল না; অমলাকে নিজেই মানুষ করিতে লাগিলাম। অমলার বয়স যখন সাত বৎসর, তখন আমি একদিন হাট হইতে বাড়ী ফিরিতেছি, এমন সময়ে দামোরের সহিত সাক্ষাৎ হয়। দামোদরের পরিধানে একখানি ছেঁড়া কাপড়, পায়ে জুতা নাই, গায়ে জমা নাই, একখানি ছেঁড়া চাদরে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়াছিল। দামোদরকে দেখিয়া আমার দয়া হইল। কিন্তু আমি প্রথমে তাহাকে কোন কথা বলিতে সাহস করিলাম না। দামোদর আমার মনের ভাব বোধ হয় বুঝিতে পারিয়াছিল। সে আমাকে নির্জ্জনে ডাকিয়া লইয়া গেল এবং বলিল, ‘তার পর সর্দ্দার এখন তুমি বড় লোক—জমীদার। আর আমি ভিখারীর মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, এক সময়ে আমি তোমার কত উপকার করিয়াছি, আর এখন তুমি থাকিতে আমার এই দুর্দ্দশা! যদি ভাল চাও, আমার উপায় করিয়া দাও। নতুবা পূর্ব্ব কথা সমস্তই প্রকাশ করিয়া দিব।’ দামোদরের কথা শুনিয়া আমার ভয় হইল। আমি তাহাকে আশ্বাস দিলাম এবং খানিকটা জমী নিষ্কর ভোগ দখল করিতে দিলাম। দামোদর তখন সন্তুষ্ট হইল এবং একরূপ আনন্দে দিনপাত করিতে লাগিল। আমাকেই তাহার ও তাহার পুত্রের ভরণপোষণের অর্থ দিতে হইত। তা ছাড়া, যখনই দামোদরের টাকার দরকার হইত, তখনই সে আমার নিকট হাত পাতিত। আমিও ভয়ে তাহার অবশ্যক মত অর্থ দিতাম। ক্রমে তাহার সাহস বাড়িয়া উঠিল। তাহার পুত্র যতীন্দ্র বড় ভাল ছেলে। তাহার বয়স তখন বিশ বৎসর, আমার অমলা এগার বৎসরের। দামোদর কথায় কথায় একদিন তাহার পুত্র যতীন্দ্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহের কথা উত্থাপন করিল। আমি তাহার সাহসে আশ্চর্য্য হইলাম। বলিলাম, ‘তুমি যে দিন দিন বড় বাড়িয়া উঠিতেছ! তুমি কি মনে কর, তুমি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিবে? তোমার ন্যায় হতভাগ্যের পুত্রের সহিত জমীদার-কন্যার বিবাহ সম্ভবে না।’ দামোদর আমার কথায় হাসিয়া বলিল, ‘অত রাগ করিলে কি হইবে? তোমার পূর্ব্ব অপরাধ কি ভুলিয়া গিয়াছ? লোকে জানিলে কি হইবে, একবার ভাবিয়া দেখ?’ আমি বলিলাম, ‘বারম্বার একই কথায় আর আমার ভয় নাই। তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার। কিন্তু ইহা স্থির জানিও যে, তোমার পুত্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহ অসম্ভব।’ এইরূপ বিবাদ চলিতেছিল। দামোদরের সহিত দেখা হইলেই সে ঐ কথা উত্থাপন করে দেখিয়া, আমি আর তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতাম না। গত জ্যৈষ্ঠ মাহার তেস্রা দামোদর যখন শীকার করিতে যায়, আমি দেখিয়াছিলাম। দামোদরের উপর আমার বড় রাগ ছিল। তাহাকে একেবারে হত্যা করিতে না পারিলে আমার আর নিষ্কৃতি নাই দেখিয়া, আমি তাহাকে খুন করিতে মনস্থ করিলাম এবং সেই জন্য ঐ কার্য্যের উপযোগী একগাছি লাঠি লইয়া দামোদর যে জলার ধারে শীকার করিতে গিয়াছে, সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। যখন আমি জলার ধারে যাই, দেখিলাম—পিতা পুত্রে বিবাদ হইতেছে। আমি গোপনে তাহদের বিবাদের কারণ জানিতে পারিলাম। পুত্রের বিবাহে আদৌ ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু পিতা অমলার সহিত তাহার বিবাহ দিবার জন্য জেদ করিতেছিল। দামোদরের উদ্দেশ্য এই যে, তাঁহার পুত্র অমলাকে বিবাহ করিলে সেই এক সময়ে আমার সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবে। দামোদরের পরামর্শ শুনিয়া, আমার ভয়ানক ক্রোধ হইল, রাগে সর্ব্ব শরীর জ্বলিয়া উঠিল। দেখিলাম, যতীন্দ্র দামোদরের নিকট হইতে চলিয়া গেল। আমি তখন পা টিপিয়া টিপিয়া দামোদরের পশ্চাতে যাইলাম এবং সেই লাঠির দ্বার সজোরে তাহার মাথায় আঘাত করিলাম। দামোদর চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িল, আমিও পলায়ন করিলাম। বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া আমার চৈতন্য হইল। আমি যে ভয়ানক কার্য্য করিয়াছি তখন তাহা বুঝিতে পারিলাম। মহাশয়! এই আমি সমস্ত সত্য বলিলাম; ইহার মধ্যে একটুও মিথ্যা নাই।
আ। আপনি জমিদার, টাকা পয়সা ও লোকজনের অভাব নাই, তবে এ কার্য্য আপনি নিজ হস্তে সম্পন্ন করিলেন কেন?
কে। একবার দামোদরের সাহায্যে এক কার্য্য করিয়া এত দিবস পর্য্যন্ত সেই যন্ত্রণায় জ্বলিতেছিলাম, আবার এই কার্য্যের জন্য যদি কোন লোকের সাহায্য গ্রহণ করি, তাহা হইলে তাহার পরিণাম ফলও ঐরূপ দাঁড়াইবে; এই ভাবিয়া, কাহারও সাহায্য গ্রহণ না করিয়া, আমি নিজেই কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছি।
কেশব বাবুর কথা শেষ হইলে আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ডাক্তার বাবু! সব লিখিয়াছেন ত?”
ডা। হাঁ, সকলই লিখিয়াছি, কেবল জমীদার মহাশয়ের স্বাক্ষর বাকি।
আ। কি লিখিয়াছেন একবার পড়ন দেখি?
ডাক্তার বাবু তখন সেই কাগজ পড়িলেন এবং পড়া শেষ হইলে কাগজখানি আমার হাতে দিলেন, আমি কেশববাবুকে উহা সহি করিতে দিলাম, কেশব বাবু সই করিলে পর, আমি ডাক্তারকেও সাক্ষীস্বরূপ সহি করিতে বলিলাম।
ডাক্তার স্বাক্ষর করিলেন এবং কাগজখানি আমার হস্তে দিলেন। আমি উহা লইয়া কেশব বাবুর নিকট হইতে বিদায় লইলাম কিন্তু গোপনে কেশব বাবুর উপর পাহারা রাখিলাম।
প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের কার্য্য শেষ হইল। আমরা থানায় ফিরিয়া আসিলাম; এবং সেই কাগজখানি একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিলাম; ও তাঁহাকে কহিলাম, “পুলিস কর্ম্মচারীর অবর্ত্তমানে পুনরায় কেশব বাবুর নিকট গমন করিয়া তাঁহার সমস্ত কথা পুনরায় লিখিয়া লইতে আজ্ঞা হয়, কারণ যদি তিনি আরোগ্যলাভই করেন, তাহা হইলে এই খুনি মকর্দ্দমা তাঁহার উপর চালাইতে হইবে।”
আমাদিগের প্রার্থনামত ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব একজন সাহেব ডাক্তার সঙ্গে লইয়া সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার অতি অল্পক্ষণ পূর্ব্বে জমিদার মহাশয়ের মৃত্যু হয়। সুতরাং তিনি মকর্দ্দমার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন।
যতীন্দ্রনাথ যথাসময়ে নিষ্কৃতি লাভ করেন ও পরে শুনিয়াছিলাম, ঐ যতীন্দ্রনাথের সহিত অমলার বিবাহ হয়, ও তিনিই পরিশেষে কেশব বাবুর সমস্ত জমিদারীর অধিকারী হন। যে দরিদ্র কন্যাকে তিনি বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলেন, এই গোলোযোগের সময় সেই কন্যার অভিভাবকেরা অপরের সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন।
সমাপ্ত।
“বাঁশী”
যন্ত্রস্থ।