খুনী কে/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
তখনই দারোগা মহাশয়কে কেশব বাবুর শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। শুনিলাম, তাঁহার বাঁচিবার আশা নাই বটে কিন্তু তিনি লোকজনের সহিত এখনও বেশ কথাবার্ত্তা কহিতে পারেন,—তবে শয্যাগত। বিছানা হইতে নড়িবার শক্তি নাই। সুতরাং তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা হইল।
আমি কেশব বাবুর বাড়ী জানিতাম না। কেশব বাবু যেসে লোক নন্; দেশের জমীদার, সুতরাং কাহারও সাহায্য ব্যতীত তাঁহার বাড়ী চিনিতে পারিলেও, গ্রাম বেড়াইবার ছলে থানা হইতে বহির্গত হইলাম। লালমোহন আমার সঙ্গে রহিলেন, কিন্তু তাঁহাকে কোন কথা ভাঙ্গিলাম না।
থানা হইতে জমীদার বাটী প্রায় একক্রোশ, আমরা গল্প করিতে করিতে আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হইলাম। শুনিলাম, কেশব বাবু একটু ভাল আছেন।
বাড়ীর এক ভৃত্য আমাদিগকে তাঁহার গৃহে লইয়া গেল। ঘরে প্রবেশ করিলে কেশব বাবু হাত নাড়িয়া আমাদিগকে তাঁহার নিকটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। আমরা বসিলাম।
আমরা বসিলে পর, তিনি অতি ক্ষীণস্বরে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন? আপনার সঙ্গীটীই বা কে?”
আমি বলিলাম, “আমি একজন ডিটেকটিভ পুলিশ কর্ম্মচারী ও আমার সঙ্গী আপনাদিগের থানার দারোগা।”
আমি এই কথা বলিবামাত্র কেশব বাবু চমকিত হইলেন। তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। সমস্ত শরীর যেন কাঁপিতে লাগিল। তিনি অতি বিমর্ষভাবে আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।
তাঁহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমি তাঁহার মনের ভাব
৩ বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, “আমি দামোদরের খুনের বিষয় ও রাম সর্দ্দারের সমস্তই জানি।”
কেশব বাবু অতি মৃদুস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কি সর্ব্বনাশ!”
আমি কোন কথা কহিলাম না। তখন তিনি যেন আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বর যাহা করেন মঙ্গলের জন্য। যে দিন হইতে যতীন্দ্র জেলে গিয়াছে, সে দিন অবধি আমিও শয্যাগত হইয়াছি;—অনুতাপের জন্য নহে, কেবল আমার দোষে একজন নিরীহ প্রাণী শাস্তি পাইবে এই জন্য। শেষে এই সাব্যস্ত করিয়াছিলাম যে, যদি আমার জীবন থাকিতে থাকিতে যতীন্দ্রনাথের ফাঁসির হুকুম হয়, তাহা হইলে আমি স্বয়ং সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া নিজেই শাস্তি লইব।”
কেশব বাবুর কথায় আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলাম। বলিলাম, “আপনাকে এখনও সেইরূপই করিতে হইবে। যদি আমি আপনাকে বন্দী করিয়া লইয়া যাই, যদি রোগ হইতে আপনি মুক্ত হন, তাহা হইলে আপনার নিশ্চয়ই ফাঁসি হইবে। কিন্তু আপনার এখন যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, ও আপনার চিকিৎসকের নিকট হইতে আমি যতদুর জানিয়াছি, তাহাতে বেশ বুঝয়াছি, এ যাত্রা আপনার কোনরূপেই রক্ষা নাই। আপনার মৃত্যুকাল নিকটবর্ত্তী, কিন্তু মরিবার সময় একজন নিরপরাধী ব্যক্তির প্রাণ নাশ করাইয়া পরকালের পথ নষ্ট করেন কেন? ইহজন্মে যাহা কারবার করিয়াছেন, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে; এখন অকপট চিত্তে সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া, নিরপরাধী ব্যক্তির প্রাণ দান করিয়া, নিশ্চিন্তমনে ইহধাম পরিত্যাগ করুন।”
আমার কথা শুনিয়া লাহমোহন বাবু আমার কানে কানে কহিলেন, “আপনার অনুমান সত্য, ইনি লম্বাকৃতি, একটু খোঁড়া ও ইহার দক্ষিণ হস্তে সম্পূর্ণরূপ বল নাই।”
আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় কহিলেন, “আপনার কথা সত্য, এ যাত্রা এ পীড়া হইতে আমার রক্ষা নাই, সুতরাং এখন সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া একজন নিরপরাধীকে বাঁচানই আমার কর্ত্তব্য। কিন্তু আমার কন্যার জন্যই সেরূপ কার্য্য করিতে ইচ্ছা হইতেছে না।”
আ। কেন? আপনার কন্যার তাহাতে আপত্তি কি?
কে। তাহার আপত্তি নাই। সে এ পর্য্যন্ত আমার পাপের কথা জানে না। কিন্তু সে যদি আমায় খুনী বলিয়া জানিতে পারে, তাহার আর মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না।
আ। সে কি! আপনার কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।
কে। অমলা যদি জানিতে পারে যে, আমিই দামোদরকে খুন করিয়াছি, তাহা হইলে সে আত্মঘাতিনী হইবে।
আ। আপনি সেরূপ মনে করিতে পারেন কিন্তু আত্মহত্যা করা বড় সহজ কথা নয়।
কে। আপনি আমায় কি করিতে বলেন?
আ। সমস্ত কথা একখানি কাগজে লিখিয়া স্বাক্ষর করিয়া দিন। প্রয়োজন মত আমি উহা ম্যাজিষ্ট্রেটকে দেখাইয়া যতীন্দ্রের প্রাণরক্ষা করিব।
কে। অমলা জানিতে পারিবে?
আ। আপাততঃ যাহাতে আপনার কন্যা জানিতে না পারে তাহার চেষ্টা করিব; কিন্তু পরে সমস্তই জানিতে পারিবে।
কে। কত দিন পরে?
আ। সে কথা আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না।
কে। আমি শীঘ্রই ইহলোক ত্যাগ করিব। ডাক্তার কবিরাজ আমায় জবাব দিয়া গিয়াছেন, আমি মরিবার পর যদি এ কথা প্রকাশ হয়, তাহা হইলে আর কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হইবে না।
আ। তাহাই হইবে।
এই সময় তাঁহার চিকিৎক ডাক্তার আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, তিনিও সকল কথা শুনিলেন।
কেশব বাবু ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, “আমার এমন শক্তি নাই যে আমি স্বয়ং লিখিতে পারি। আমার কথা কহিতেও কষ্ট বোধ হয়।”
আমি উত্তর করিলাম, “আপনাকে লিখিতে হইবে না। আপনার চিকিৎসক এই ডাক্তার বাবু সে কার্য্য করিবেন। আপনি কেবল স্বাক্ষর করিলেই হইবে।”
ডাক্তার বাবু আমার কথা শুনিয়া নিতান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া একখানি কাগজ লইলেন। পরে বলিলেন, “কি বলিবেন বলুন, আমিই লিখিয়া দিতেছি।”