খুন না চুরি?/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
আমার কথা শুনিয়া শোভন সিং চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “মহাশয়! আমার একমাত্র সন্তান–ঐ কন্যা ভিন্ন আমার আর কোন সন্তানাদি হয় নাই। তাহার বিয়োগে আমি যে অত্যন্ত কাতর হইয়াছি এ কথা বলাই বাহুল্য।”
শোভন সিংএর অবস্থা দেখিয়া এবং তাঁহার কথাবার্ত্তা শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। তাঁহার বয়স প্রায় বিয়াল্লিশ বৎসর কিন্তু এই বয়সেই তাঁহার দেহের মাংস শিথিল হইয়াছে, সম্মুখে, উপর-পাটীর দুইটী দাঁত পড়িয়া গিয়াছে। গোঁপ শ্মশ্রু ও মস্তকের কেশ পাক ধরিয়াছে। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, তাঁহার দেহ দীর্ঘ ও শীর্ণ, হস্ত প্রায় আজানুলন্বিত, চক্ষু ক্ষুদ্র ও কোটরগ্রস্ত নাসিকা উন্নত এবং ললাট প্রশস্ত। মুখ দেখিয়াই কেমন ক্রূর প্রকৃতি বলিয়া বোধ হইল।
অপর কথায় সময় নষ্ট করিতেছেন দেখিয়া আমি বিরক্ত হইলাম। বলিলাম,—“আমি আপনার দুঃখের কথা শুনিতে আসি নাই। কন্যাবিয়োগে আপনি যে কাতর হইবেন, ইহাতে আর আশ্চর্য্য কি? এখন আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার উত্তর দিন; আপনার কন্যার লাস কোথায় বলুন?”
আত্ম সংবরণ করিয়া শোভন সিং বলিলেন,—“সেই কথাই বলিতেছি,—“রূপসীর লাস পাওয়া যাইতেছে না।”
আশ্চর্য্যান্বিতা হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—“সে কি! লাস পাওয়া যাইতেছে না কি?”
কাঁদ কাঁদ হইয়া শোভন সিং বলিলেন,—“এখান হইতে কিছু দূরে আমার এক আত্মীয় বাস করেন, রূপসী আজ প্রাতে তাঁহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল। বাছা আমার সেই অবধি আর ফিরে নাই”
আ। তবে খুন হইয়াছে বলিতেছেন কেন? আপনার কন্যা নিরুদ্দেশ হইয়াছে। হয় সে নিজে পলায়ন করিয়াছে, নচেৎ কোন লোক তাহাকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে।
শো। না মহাশয়! সকল কথআ শুনিলে বুঝিতে পারিবেন। রূপসী আর এ জগতে নাই।
এই বলিয়া শোভন সিং আবার চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলন। কন্যাবিয়োগে তিনি বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইয়া আবার বলিতে লাগিলেন,—“প্রাতে রূপসী একজন সঙ্গিনী লইয়া এ বাড়ী হইতে বাহির হয়। পথে এক বৃদ্ধা তাহার সহিত আলাপ করে এবং উভয়কেই ভুলাইয়া লইয়া যায়। যে রূপসীর সঙ্গে গিয়াছিল, অনেকক্ষণ পরে সে ফিরিয়া আসিয়াছে, কিন্ত রূপসী আর ফিরে নাই। গৌরীর মুখে যাহা এখন শুনিতেছি, তাহা বড়ই ভয়ানক!”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—“গৌরী কে?
শো। গৌরী আমার ভাগিনেয়ী, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে এখানে আসিয়াছে। গৌরীই রূপসীর সহিত প্রাতে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিল।
আ। সে কি বলে?
শো। আমি তাহাকে ডাকিয়া আনিতেছি, আপনি তাহার মুখেই সকল কথা শুনুন। এমন ইংরাজ রাজত্বে এখনও যে এই লোমহর্ষণ কাণ্ড ঘটিতে পারে, আমার এমন ধারণা ছিল না।
এই বলিয়া আমার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তিনি অন্দরে প্রবেশ করিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই এক খর্ব্বাকৃতি বালিকার হস্তধারণ করিয়া পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন,—“এই বালিকার নাম গৌরী, আপনি ইহার মুখেই সমস্ত জানিতে পাইবেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, গৌরী যখন ফিরিয়া আইসে, তখন তাহার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না সে যেন পাগলের মত হইয়া গিয়াছিল।”
গৌরীকে দেখিতে খর্ব্বাকৃতি হইলেও আমার অনুমানে তাহার বয়স অন্ততঃ পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার দেহ শীর্ণ, কিন্তু তাহাতে যৌবনের চিহ্নগুলি ক্রমেই ফুটিয়া উঠিতেছে। গৌরীর আয়ত চক্ষু সদাই চঞ্চল, মুখখানি কাঁদ কাঁদ।
গৌরীর যুখের দিকে চাহিয়া আমি বলিলাম,—“বল মা! কি জান বল?”
কাঁদ কাঁদ হইয়া গৌরী উত্তর করিল,—“খুব ভোরে আমরা এখান হইতে বাহির হই। পথে লোক ছিল না বলিলেও যেন বাহির হইলাম বটে, কিন্তু দুজনেরই গা কেমন ছম্ ছম করিতে লাগিল। যখন আমরা পদ্মপুকুরের ধারে গিয়আ উপস্থিত হই, দেখিলাম, এক বুড়ী যেন আমাদেরই দিকে আসিতেছে। কাছে আসিলে দেখিলাম, সে আমাদেরই দিকে কট্মট করিয়া চাহিয়া রহিয়াছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবা মাত্র বুড়ী এক গাল হাসিয়া আমাদের নিকটে আসিল এবং নিমেষ মধ্যে দুই হাতে দুইটী জবা বাহির করিয়া আমাদের উভয়ের নাসিকার নিকট ধরিয়া বলিল,—“দেখ দেখি, জবায় কেমন গোলাপ-গন্ধ? আর কখন এমন জবা দেখেছ কি?
“সত্যসত্যই গোলাপের গন্ধ পাইলাম, জবাফুলে গোলাপ-গন্ধ পাইয়া কেমন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। তখন উভয়েই সমস্ত কথা ভুলিয়া গেলাম। রূপসীর বিবাহের কথা ভুলিলাম, কোথায় যাইতেছিলাম ভুলিলাম, বাড়ী ভুলিলাম, এমন কি, আপনাদের অস্তিত্ব পর্য্যন্ত ভুলিলাম। রহিল কেবল সেই বৃদ্ধা। আমরা তাহার হাতের খেলনা স্বরূপ হইলাম। সে আমাদিগকে যাহা বলিতে লাগিল, আমরা অনায়াসে তাহা করিতে লাগিলাম। প্রথমে সে আমাদিগকে কিছুদুরে লইয়া গেল। সেখানে একখানি গাড়ী ছিল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। কতক্ষণ পরে বনের ভিতর একটা ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায় আসিয়া গাড়ী থামিয়া গেল। আমরা সকলেই গাড়ী হইতে নামিয়া সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটা প্রকাণ্ড ঘরের মধ্যে তিনজন সন্ন্যাসী একদৃষ্টে সম্মুখের প্রজ্জ্বলিত অগ্নির দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। সন্ন্যাসী তিনজনের মধ্যে একজনকে দেখিতে অতি ভয়ানক, অপর দুইজনকে তাহার শিষ্য বলিয়াই বোধ হইল।
“আমাদের পায়ের শব্দে সেই ভয়ানক সন্ন্যাসী উপরদিকে চাহিল এবং বুড়ীকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিয়া নিকটস্থ দুইথানি কুশাসন ইঙ্গিত করিয়া দেখাইয়া দিল। বৃদ্ধাও তাহার সঙ্কেত বুঝিতে পারয়া আমাদের দুইজনকে সেই দুইখানি আসনে বসিতে বলিয়া স্বরং নিকটে দাঁড়াইয়া রহিল।
“কতক্ষণ এইরূপে কাটিল বলিতে পারিনা। কিন্তু কিছু পরেই অপর দুই সন্ন্যাসী রূপসীর হাত ধরিয়া সেখান হইতে লইয়া গেল। আমি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলাম, কিন্তু আমার চীৎকারে কেহ ভ্রুক্ষেপও করিল না। আর কিছুক্ষণ এইরূপে অতিবাহিত হইল। তাহার পরে দেখিলাম, রূপসীর অচেতন দেহ সেই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। পরক্ষণেই বুড়ী আমার হাত ধরিয়া ঘর হইতে বাহিরে আনিল এবং কত পথ ঘুরাইয়া একটা বাগানের নিকট আমায় ছাড়িয়া দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।
“আমিও চীৎকার করতে লাগিলাম, কিন্ত যে স্থানে সেই বদ্ধা আমাকে ছাড়িয়া দিয়াছিল, সেখানে লোকজন নাই বলিলেও চলে। এত চীৎকার করিলাম, এত কাঁদিলাম, কেহই আমার সাহায্যের জন্য আসিল না। এই সময় হইতে আমার আর কিছুই মনে নাই। আমি তাহার পর কি করিলাম, কেমন করিয়া এখানে ফিরিয়া আসিলাম, এখানে আসিয়াই বা কি করিলাম, কিছুই জানি না। যখন রাত্রি হইল, বর আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন আমার জ্ঞান হইল; তখন আমি সমস্ত কথা প্রকাশ করিলাম।”
এই বলিয়া গৌরী স্থির হইল এবং একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া শোভন সিংকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—“আপনার কন্যার গাত্রে কোন অলঙ্কার ছিল কি?”
শো। আজ্ঞে হাঁ প্রায় দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার রূপসীর গাত্রে ছিল।
আ। আপনার ভাবী জামাতার মুখে শুনিলাম, আপনার আর্ধিক অবস্থা বড় ভাল নহে। আপনি এত টাকার গহনা কোথায় পাইলেন?
শো। আমার ভাবী জামাতা সত্য সত্যই বলিয়াছেন। আমি অত্যন্ত দরিদ্র। কিন্তু বিবাহের দুই দিন পুর্ব্বে আমার আত্মীয়গণ এখানে আসিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ধনবানের পত্নী। তাঁহারাই জোর করিয়া তাঁহাদের অলঙ্কারগুলি রূপসীকে পরাইয়া দিয়াছিল। আমি এখন ধনে প্রাণে মারা গেলাম।
আ। এ অঞ্চলে আপনার কেহ শত্রু আছে কি?
শোভন সিং কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, “আমারই এক আত্মীয় আমার ঘোর শত্রু ছিলেন। তাঁহারও নিবাস এই গ্রামে ছিল। কিন্তু এক বৎসর হইল, ভজন সিং কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছিলাম, তিনি না কি সন্ন্যাসী হইয়া দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।”
আ। তাহা হইলে যে সন্ন্যাসী রূপসীকে খুন করিয়াছে সেই হয় ত ভজন সিং—আপনার পূর্ব্ব শত্রু। এতদিন কোনরূপ সুবিধা করিতে না পারায় আপনার উপর কোনরূপ প্রতিহিংসা লইতে পারে নাই। আজ আপনার কন্যার গাত্রে অনেক টাকার গহনা দেখিয়া কৌশলে সেই বুড়িকে পাঠাইয়া দিয়াছিল।
শো। আপনার অনুমান সত্য হইলেও হইতে পারে।
আ। আপনার আর কোন আত্মীয় আছে?
শো। আত্মীয়ের মধ্যে আমার ভগ্নী—গৌরি তাহারই কন্যা।
আ। গহনাগুলিও কি তাঁহারই?
শো। আজ্ঞে না—সেও আমার মত দরিদ্রা, অত টাকার গহনা সে কোথায় পাইবে?
আ। তাঁহার নিবাস কোথায়?
শো। সিয়ালদহ ষ্টেশন হইতে কিছু দুরে।
আ। সধবা না বিধবা?
শো। আজ্ঞে সধবা—এই যে আমার ভগ্নিপতি আপনার সম্মুখেই দণ্ডায়মান।
এই বলিয়া শোভন সিং একজন বলিষ্ঠ যুবককে দেখাইয়া দিলেন।