খুন না চুরি?/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
শোভন সিংকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি গৌরীকে বলিলাম; “মা, আমাকে সেই ভাঙ্গা বাড়ীতে নিয়ে যেতে পার?”
কিছুক্ষণ ভাবিয়া গৌরী বলিল, “না—কোন্ রাস্তা দিয়ে যে সেই বুড়ি আমাদের দুজনকে নিয়ে গিয়েছিল, সে কথা আমার কিছুই মনে নাই। তা ছাড়া, তখন আমরা যে যে কার্য্য করেছি, যেন অজ্ঞান হয়েই করেছি।”
আ। তুমি ত বলেছিলে, গাড়ী করে গিয়েছিলে?
গৌ। আজ্ঞে হাঁ—গাড়ী ক’রেই গিয়েছিলাম।
আ। কোচমানকে চেন?
গৌ। দেখ্লে চিনতে পারি।
আ। গাড়ীখানা কোথাকার?
গৌরী বিরক্ত হইয়া বলিল, “সে কথা আমি কি জানি?”
গৌরীকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভাবিলাম, তাহার দ্বারা আমার কোন সাহায্য হইবে না। পদ্মপুকুর আমার জানা ছিল। সেখান হইতে কিছুদূরে আজ কাল যেখানে জগু বাবুর বাজার সেখানে একটা ঠিকা গাড়ীর আস্তাবলও ছিল। সেই আস্তাবলে গিয়া সন্ধান লইবার ইচ্ছা হইল।
আমি তখন লাল সিংকে আশ্বাস দিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম এবং শোভন সিং এর বাটী হইতে বাহির হইবার উদ্যোগ কারতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমার কাছে আসিয়া বলিলেন, “আমি ধনে প্রাণে মারা গেলাম। এই দুঃসময়ে লাল সিং আমাকে অন্যায় করিয়া যৎপরোনাস্তি অপমান করিতেছে। কিন্ত সে যাহাই হউক, আপনি আমার একটী উপকার করুন—যে ব্যাক্ত রূপসীকে খুন করিয়াছে তাহাকে ফাঁসী দিন। এখন আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমার সেই পুর্ব্বশত্রুই রূপসীকে খুন করিয়া তাহার গাত্রের অলঙ্কারগুলি আত্মসাৎ করিয়াছে। কিন্তু সে আপনাদিগের হস্ত হইতে পলায়ন করিতে পারিবে না, আপনাদের চক্ষে ধূলি দিতে পারিবে না। আজই হউক বা কালই হউক, সে নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে। আপনি তাহাকে ফাঁসী দিয়া আমার অন্তরের জ্বালা নিবারণ করুন।” এই বলিয়া চিৎকার করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। অনেক সান্ত্বনার পর তিনি কিছু সুস্থ হইলে আমি সেখান হইতে বাহির হইলাম।
রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন ভবানীপুর সহর হয় নাই। এখনকার মত এত লোকেরও বাস ছিল না। পথের দুই পার্শ্বে তৈলের আলো মিট্ মিট্ করিয়া জ্বলিতেছিল, দুই একটা কুকুর পথের আবর্জ্জনারাশির নিকট দাঁড়াইয়া আহারের দ্রব্য অন্বেষণ করিতেছিল; আর মধ্যে মধ্যে চীৎকার করিয়া পরস্পর বিবাদ করিতেছিল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমি আস্তাবলে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দুই তিন ব্যক্তি তখনই আমার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার গাড়ীর প্রয়োজন আছে কি না? আমারও গাড়ীর আবশ্যক ছিল, সেই মত উত্তর দিয়া একজনকে বলিলাম, “তোমাদের মধ্যে কেহ কি আজ প্রাতে দুইটা বালিকা ও একজন বৃদ্ধাকে এখান হইতে কোথাও লইয়া গিয়াছিলে?”
আমার প্রশ্ন শুনিয়া কিছুক্ষণ কেহ কোন কথা কহিল না; পরস্পর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিছু পরে একজন উত্তর করিল, “কই, না মহাশয়!”
তাহার কথায় আমার বিশ্বাস হইল না। আমি তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে, সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। বলিলাম,—“কেন বাপু মিথ্যা কথা বলিতেছ? ভাড়া পাইয়াছ, লইয়া গিয়াছ, কোন অন্যায় কাজ কর নাই, লুকাইবার প্রয়োজন কি?”
আমার কথায় আশ্বস্ত হইয়া একজন বলিয়া উঠিল—“আজ্ঞে সলামত কোচমান সে সওয়ারি নিয়ে গিয়েছিল। এখনও গাড়ী ফিরে আসে নি।”
এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীর শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরেই একখানা সেকেণ্ডক্লাস গাড়ী লইয়া সলামত উপস্থিত। তাহাকে দেখিয়া পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি বলিয়া উঠিল, “ইহারই লাম সলামত।”
আমার পোষাক দেখিয়া ও তাহার নাম শুনিয়া সলামতের ভয় হইল। সে লাগামটী গাড়ীর চালে বাঁধিয়া নামিয়া পড়িল। পরে আমার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—“কেন মশায়? আমাকে কি দরকার?”
আমি বলিলাম,—“আজ প্রাতে তুমি দুইটী বালিকা ও এক বৃদ্ধাকে যেখানে লইয়া গিয়াছিলে আমাকে এখনই সেখানে লইয়া চল।”
সলামত প্রথমে কোন উত্তর করিলনা। সে একমনে কি ভাবিতে লাগিল। আমি বলিলাম,—“তোমার ঘোড়া যদি ক্লান্ত হইয়া থাকে আর দুইটী ঘোড়া ভাড়া কর। আমি ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া দিব।”
তবুও সলামত উত্তর করিল না। সে কেবল আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—“কথার উত্তর দিতেছ না কেন? সহজে না রাজী হও অন্য উপায় দেখিব।”
অনেক কষ্টে সলামত উত্তর কারল,—“সে জায়গাটা আমার ঠিক মনে নাই।”
আমার রাগ হইল। আমি কর্কশ স্বরে বলিলাম,—“দেখ সলামত! এই কাজ অনেকদিন থেকে কর্ছি। তোমার মত অনেক লোক দেখেছি। তুমি একজন প্রবীণ লোক হ’য়ে মিথ্যা ক’রে বল, যে জায়গাটা মনে নাই? বিশেষ তুমি একজন পাকা কোচমান। একবার যে স্থান দেখ্বে সে আর জন্মে ভুল্বে না।”
আমার তোষামোদপূর্ণ কথায় সলামত ভুলিয়া গেল। বলিল, “হুজুর, আমি মিছা বলি নি। যে পথ দিয়ে বুড়ী আমাকে নিয়ে গেল, সে পথ আমি আগে দেখি নি। এখনও যে আপনাকে সহজে নিয়ে যেতে পারবো এমন বোধ হয় না। চলুন, আমার ঘোড়া আজ বড় বেশী খাটে নাই, পাঁচটার সময় ঘোড়া বদল করেছি।”
আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া সলামতের গাড়ীতে উঠিলাম। বাসায় যাইবার জন্য যে গাড়ী ঠিক করিতেছিলাম, তাহার কোচমান ভাড়া না পাওয়ায় আন্তরিক বিরক্ত হইল। গাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া সলামত অশ্বে কশাঘাত করিল। সেই রাত্রে বাসা ছাড়িয়া অন্যত্র যাইতে পক্ষীরাজদ্বয়ের ইচ্ছা ছিল না; তাহারা দু-একবার অনিচ্ছা প্রকাশ করিল কিন্তু উপর্য্যুপরি কশাঘাতে অগত্যা দৌড়িতে বাধ্য হইল।