খুন না চুরি?/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
সন্ন্যাসী ভজন সিংএর নিকট বিদায় লইয়া আমি তখনই একজন লোককে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম, দুইজন উপযুক্ত লোককে সন্ন্যাসীদিগের আড্ডায় গিয়া সেই ঘরটী বিশেষ করিয়া অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম এবং অপর একজনকে লাল সিংএর নিকট প্রেরণ করিলাম।
সন্ন্যাসী গ্রেপ্তার হইয়াছে শুনিয়া, শোভন সিং ভাগিনেয়ীকে লইয়া কিছুক্ষণ পরেই আমার নিকটে আসিলেন। আমি গৌরীকে সেই সন্ন্যাসিদিগের নিকট লইয়া গেলাম। গৌরী তাহাদিগকে দেখিয়াই চীৎকার করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করতঃ শোভন সিংএর পশ্চাতে গমন করিল। তাহার ভাব-গতিক দেখিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, সে ঐ সন্ন্যাসী তিনজনকেই দেখিয়াছিল।
শোভন সিং আমার নিকট যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন। এক রাত্রের মধ্যে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিয়াছি বলিয়া আমার যথেষ্ট সুখ্যাতি করিলেন। কিন্তু আমার সে সকল বড় ভাল বোধ হইল না। আমিও মিষ্ট কথায় তাঁহাকে বিদায় দিয়া বলিলাম, প্রয়োজন হইলে সংবাদ দিব।”
শোভন সিং চলিয়া গেলেন। প্রায় একঘণ্টা পরে যে দুইজন লোককে সন্ন্যাসীর সেই বাসস্থানে অন্বেষণ করিতে পাঠাইয়াছিলাম, তাহারাও ফিরিয়া আসিল এবং একছড়া স্বর্ণ-হার আমার হস্তে দিয়া বলিল যে, তাহারা সেই ঘরটী তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াছে কিন্তু ঐ একছড়া হার ভিন্ন আর কোন গহনা দেখিতে পায় নাই।
হারছড়া হাতে লইয়া আমি তাহাদিগকে বিদায় দিলাম। পরে একমনে ঐ সকল বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সন্ন্যাসীর কথা কোনরূপেই অবিশ্বাস করা যায় না। তিনি শোভন সিং সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহাও সত্য বলিয়া বোধ হইল। লোকটা তাঁহাকে উৎপীড়ন করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছে এবং এখনও যে করিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? কিন্তু এই হারছড়া কোথা হইতে আসিল? গত রাত্রে আমি স্বয়ং অন্বেষণ করিয়াছিলাম কিন্তু কই, তখন ত কিছুই দেখিতে পাই নাই। অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই যখন হারছড়া খুঁজিয়া পাইয়াছে, তখন ইহা বিশেষ লুকান ছিল এমন বোধ হয় না। একি রহস্য? তবে কি সত্যসত্যই সন্ন্যাসী হইয়া বালিকা হত্যা করিল?
কিছুক্ষণ এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই সত্য বলিয়াছেন। শোভন সিং লাল সিংএর সহিত যেমন ব্যবহার করিয়াছে, তাহাতে তাহাকেই শঠ ও প্রতারক বলিয়া বোধ হইতেছে। এরূপ অনেক দেখা গিয়াছে যে, প্রকৃত দোষী অপরের স্কন্ধে দোষারোপ করিবার জন্য অনেকপ্রকার উপায় অবলম্বন করিয়াছে। শোভন সিং যেরূপ প্রকৃতির লোক, তাহাতে তাহার পক্ষে উহা নিতান্ত অসম্ভব নহে।
এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে লাল সিং সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তাহাকে সমস্ত কথা প্রকাশ করিলাম। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন,—“আপনি যাহা অনুমান করিয়াছেন, তাহাই সম্পূর্ণ সত্য। শোভন সিং অত্যন্ত চতুর—তিনি না পারেন এমন কাজ অতি অল্প। সেই গত রাত্রে আপনার ফিরিয়া আসিবার পর কোনরূপে ঐ হারছড়াটী সেখানে রাখিয়া আসিয়াছে। যদি তাহা না হইবে, তাহা হইলে আপনি কালই রাত্রে ঐ হার পাইতেন।”
আ। যদিও আমি ভালরূপ অণ্বেষণ করিবার অবকাশ পাই নাই, তত্রাপি যখন দুই ব্যক্তি এত অল্প সময়ের মধ্যে এই হার বাহির করিতে পারিল, তখন আমি যে একেবারেই উহা দেখিতে পাইলাম না, ইহাও বিশ্বাসযোগ্য নহে। হারছড়া নিশ্চয়ই তখন সেখানে ছিল না, পরে রক্ষিত হইয়াছিল।
লা। ঠিক বলিয়ছেন—আমার বিশ্বাস রূপসী এখনও জীবিত আছে। কেবল আমাকে ফাঁকি দিবার জন্যই ঐ মিথ্যা কথা রাষ্ট্র করিয়াছে। বিবাহ না দিলে পাছে আমার টাকা ফেরৎ দিতে হয়, এই ভয়ে আপনার কন্যার মৃত্যু সংবাদ রাষ্ট্র করিয়াছে।
আ। আমারও সেইরূপ মনে হয়। কিন্তু যে বৃদ্ধা গৌরী ও রূপসীকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সে কে? তাহাকে ধরিতে না পারিলে এ রহস্য ভেদ করা অতীব দুরূহ হইবে। আপনি সে বুড়ীকে চেনেন? কোনপ্রকার অনুমান করিতে পারেন?
লাল সিং কিছুকাল কোন উত্তর করিলেন না; একমনে কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন,—“রূপবতী পত্নী সত্ত্বেও শুনিয়াছি, শোভন সিং অপর এক বেশ্যার প্রেমে মুগ্ধ হইয়াছিল। সে তাহারই সমবয়স্ক, দেখিতে নিতান্ত মন্দ নহে, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীর সহিত কোন বিষয়েই তাহার তুলনা হয় না। এ ছাড়া, আমি আর কোন রমণীর সহিত শোভন সিংএর ঘনিষ্টতা আছে কি না জানি না। একে বেশ্যা, তাহাতে বয়স হইয়াছে, তাহার উপর তাহার অবস্থাও এখন হীন হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং তাহাকে যে বুড়ীর মত দেখাইবে, আশ্চর্য্য কি? কিম্বা সে হয় ত বৃদ্ধার ছদ্মবেশ করিয়া থাকিবে। কেন না, গোপনে বালিকা ভুলাইয়া লইয়া যাওয়া বড় সহজ ব্যাপার নহে। যে সে লোকের উপর এমন কাজের ভার দেওয়া যায় না। আমার বোধ হয়, সেই মাগীরই এই কাজ।”
আ। আপনি তাহার বাড়ী জানেন?
লা। চেষ্টা করিয়া বাহির করিব। শুনিয়াছিলাম, মেছুয়াবাজারে তাহার বাসা। তাহার নাম কামিনী।
আমি সন্তুষ্ট হইলাম। তাঁহাকে কামিনীর সদ্ধান করিতে বলিলাম। লাল সিং তখনই বিদায় লইলেন।