খুন না চুরি?/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 বেলা প্রায় চারিটার সময় লাল সিং পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়াই আমি বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি কার্য্যে সফল হইয়াছেন।

 লাল সিং আমার নিকটে বসিয়া বলিলেন, তিনি কামিনীর সন্ধান পাইয়াছেন। বয়স অধিক না হইলেও বাতে তাহাকে বৃদ্ধা করিয়াছে। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কামিনীর পরিচিত কিনা? লাল সিং বলিলেন, বহুদিন পূর্ব্বে একবার মাত্র তিনি কামিনীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেই অবধি আর তাহাদের সাক্ষাৎ হয় নাই।

 লাল সিংএর কথা শুনিয়া আমি তখনই ছদ্মবেশ পরিধান করিলাম এবং তাঁহাকে লইয়া একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আরোহণ করিলাম, কামিনীর বাসা হইতে কিছুদুরে আমরা গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম এবং ধীরে ধীরে সেইদিকে যাইতে লাগিলাম।

 যখন বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সেদিন শনিবার। আমি বেশ বাবু সাজিয়া গিয়াছিলাম। একে শনিবার সন্ধ্যাকাল, তাহার উপর আমি একজন নব্য বাবু, তাহাতে আবার আমি অতি ধীরে ধীরে একটা বাড়ীর বারান্দার দিকে দেখিতে দেখিতে যাইতেছি। এতগুলি কারণ যখন একত্রিত হইল, তখন কার্য্য না হইয়া আর যায় কোথায়? একজন আধা বাবুগোচ লোক তখনই আমাদের নিকট আগমন করিয়া বলিল—“বাবু! ঐ বাড়ীতে যাবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।”

 আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি হাসিয়া বলিলাম,—“ও বাড়ীতে মানুষের মত কে আছে? ঐ ত সব বসে আছে?”

 আগন্তুক ঠকিবার পাত্র নয়। সেও হাসিয়া বলিল,—“আপনি রসিক বটে। কিন্তু এই সাঁঝের আঁধারে এতদূর থেকে কি ভাল দেখা যায়? বাড়ীর ভিতর চলুন।”

 আমি বুঝিলাম, আগন্তুক দালাল। কিছু পাইবার প্রত্যাশায় আমাকে লইয়া যাইতে চায়। বাড়ীর ভিতর যাওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে মনে করিয়া আমি বাহিরেই কামিনী সহ দেখা করিতে ইচ্ছা করিপাম। লোকটাকে বলিলাম,—“বাপু, তুমি আমাকে যা মনে ক’রেছ, আমি তা নয়। তবে যখন আমার কাছে এসেছ, তখন যদি আমার একটা কাজ কর, আমি তোমায় সন্তুষ্ট করিব।”

 শশব্যস্তে সে বলিয়া উঠিল,—“কি কাজ বলুন?”

 আমি বলিলাম, “ঐ বাড়ীতে কামিনী নামে একটা মেয়েমানুষ আছে জান?”

 সে যেন মুখ বিকৃত করিল। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, “আজ্ঞে হাঁ, জানি বই কি? আগে ছিল ভাল—এখন বাতে পঙ্গু।”

 আমি বলিলাম, “কামিনীকে কোনরূপে আমার কাছে আনিতে পার? আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিব না।”

 লোকটা কিছু কালা, আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে বলিল, “কি বলিয়া ডাকিয়া আনিব? আপনাকে সে কি চেনে?”

 আ। আমাকে সে চেনে না, কোন রকম কৌশল করিয়া তাহাকে আনিতে হইবে।

 লো। কোথা দেখা করিবেন? এই রাস্তায়?

 আ। না, তাহারও উপায় তোমায় করিতে হইবে।

 লো। কি উপায় করি?

 আ। তোমাদের কোন ঘর এখানে নাই?

 লো। আছে, কিন্ত সেখানে নিয়ে গেলে সকলকে অংশ দিতে হইবে। আমরা চারিজনে ঘরটা ভাড়া লইয়াছি।

 আ। ভাল, আমি তাহাদিগকেও স্বতন্ত্র দিব, তুমি কামিনীকে সেইখানে লইয়া যাইও। আপাততঃ সেই ঘরটা আমাদিগকে দেখাইয়া দাও।

 তাহাদের আড্ডা নিকটেই ছিল। লাল সিংকে লইয়া আমি সেই ঘরের ভিতর বসিলাম। যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাঁহাকেই কর্ত্তা বলিয়া বোধ হইল। সে সকলকে চুপিচুপি আমাদের সেখানে যাইবার কারণ বুঝাইয়া দিল—পুরষ্কারের কথাও ভুলিল না। লাভের আশা পাইয়া সকলেই আনন্দিত হইল এবং আমাদিগকে বথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করিতে লাগিল।

 অর্দ্ধ ঘণ্টা মধ্যেই কামিনীকে লইয়া পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি ফিরিয়া আসিল। তখন অপরাপর লোক সকল এক একটী অছিলা করিয়া সেখান হইতে বিদায় লইল। অবশেষে যে কামিনীকে আনিয়াছিল, সেও তামাক আনিবার নাম করিয়া সরিয়া পড়িল।

 আমি দেখিলাম, কামিনীর বয়স প্রায় চল্লিস বৎসর হইলেও তাহাকে বৃদ্ধা বলা যায়। যে কারণেই হউক, সে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না। কোমর বাঁকিয়া শরীরের উপরার্দ্ধ নত করিয়াছে। তাহার মাথার চুল অধিকাংশ কটা। শরীরের মাংস শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, চক্ষু কোটরে প্রবেশ করিয়াছে।

 অনেক কষ্টে আমার দিকে মুখ তুলিয়া কামিনী জিজ্ঞাসা করিল, “কি বাবা, তুমিই ডেকে পাঠিয়েছিলে?”

 আমি বলিলাম, “ছেলে মেয়ে ধরা ব্যবসা কবে থেকে আরম্ভ করেছ?”

 কামিনী চমকিয়া উঠিল! অনেক কষ্টে আত্ম সম্বরণ করিয়া চীৎকার করতঃ বলিল, “কি বল্‌ছো বাবা! আমি কানে একটু কম শুনি বাবা!”

 আমি চীৎকার করিয়া পুনর্ব্বার ঐ কথা বলিলাম। এবার সে তখনই কাঁদকাঁদ সুরে উত্তর করিল, “কোন্‌ ভালখাকি আমার নামে লাগিয়েছে? তার সর্ব্বনাশ হ’ক?”

 অনেক কষ্টে হাস্য সম্বরণ করিয়া আমি বলিলাম “আমি ম্বচক্ষে দেখেছি! কেহই আমাকে তোমার নামে কোন কথা বলে নাই। কেন বৃথা গালাগালি দিতেছ বাছা!”

 কামিনী আমার কথায় যেন সিহরিয়া উঠিল। কিন্তু সেবারও আত্ম সম্বরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে আমর দিকে চাহিয়া বলিল, “ও সকল কথা নিয়ে কি তামাসা ভাল দেখায়? তুমি না হয় ভাল মানুষের ছেলে, কোন কথা বলিবে না, কিন্তু কথায় কথায় পাঁচ কাণ হইলে ত সর্ব্বনাশ! কার মনে কি আছে কেমন করিয়া জানিব। ও সকল কথা ছেড়ে দাও—এখন যে জন্য ডেকেছ বল?”

 আমি কমিনীকে নিকটে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলাম, “আমাকে বড় সহজ লোক মনে করো না। আমাকে এখনো কি চিন্‌তে পার নাই? যদি বাঁচবার ইচ্ছা থাকে, সকল কথা প্রকাশ কর। তা না হলে তোমায় জেলে দিব। মেয়েমানুষ বলে ছেড়ে দিব না।”

 কামিনীর মুখ শুকাইয়া গেল। ভয়ে তাহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল, কিছুক্ষণ তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। সে আর দাঁড়াইতে না পারিয়া আমার পদতলে বসিয়া পড়িল।

 আমি তখন বলিলাম, “যখন কাজটা করেছিলে, তখন কি এ সকল কথা ভেবেছিলে? জান না কি, ইংরেজ রাজত্বে দোষ করিলে শাস্তি পাইতেই হইবে, কিছুতেই নিষ্কৃতি পাইবে না।”

 আমার কথায় কামিনী কাঁদিয়া উঠিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিল; “দোহাই বাবা! আমার বেশী দোষ নয় বাবা। পেটের দায়ে একটা হতভাগা সন্ন্যাসীর কথায় আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। কে জানে এমন হবে?”

 আমি ধমক দিয়া বলিলাম, “এখন কান্না রাখ, আমি যাহা বলি, তাহার উত্তর দাও। দুটী বালিকাকে নিয়ে গিয়েছিলে বটে, কিন্ত একটী ত ফিরে এসেছে। অপরটী কি হ’লো?

 কা। কেমন করে বলি? আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে দিয়ে চলে এসেছিলেম।

 আ। কত টাকা পেয়েছিলে?

 কা। দশ টাকা।

 আ। কে দিল?

 কা। সেই সন্ন্যাসী।

 আ। তাহাকে চিন্‌তে পার্‌বে।

 কা। হাঁ—দেখ লেই চিন্‌তে পার্‌বো।

 আ। সকল কথা গোড়া থেকে খুলে বল। কিন্তু সাবধান, মিথ্যা বলিও না। যদি জানিতে পারি যে, মিছা বল্‌ছো, তাহলেই তোমায় জেল দিব।

 কা। না বাবা, আমি মিছা বলবো না। সন্ন্যাসীর কথায় রাজী হয়ে আমি মেয়ে দুটীকে ধরিবার চেষ্টা করি। দুই দিন তাদের বাড়ীর কাছে কাছে ঘুরেও ধর্‌তে পারি নাই। শেষে একদিন ভোরে দুজনে মিলে বাড়ী থেকে বাহির হয়। আমি পাছ়ু নিই। যখন তাহারা পদ্মপুকুরের ধারে গেল, তখন আমি কৌশলে আরক মিশান দুটী জবাফুল তাদের নাকের কাছে ধরি। ফুলের গন্ধে তারা এক রকম পাগল হয়ে যায়। আমি যা বলি, তারাও তাই করে। এই সুবিধা পেয়ে দ্বিরুক্তি না করে, আমি তাহাদিগকে এক গাড়ীতে করে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যাই। তার পর সন্ন্যাসীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরে আসি। মেয়ে দুটীর কি হলো জানি না।

 আ। দুটী মেয়েকেই কি ধরিবার কথা ছিল?

 কা। না—কেবল একজনকে। কিন্ত যখন দুজনে এক সঙ্গে ছিল, তখন দুজনকেই ধরে নিয়ে গেলাম।

 আ। মেয়ে দুটী সন্ন্যাসীর কি দরকারে লেগেছিল?

 কা। জানি না। তবে শুনেছি, সেই সন্ন্যাসী না কি কাপালিক, অনেক নরহত্যা করেছে।

 আ। জেনে শুনে তুমি মেয়ে দুটীকে স্বচ্ছন্দে তার হাতে দিলে?

 কা। নিজের পেট কাঁদ্‌লে জ্ঞান থাকে না।

 আ। আচ্ছা—শোভন সিংকে চেন?

 কামিনী চমকিতা হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে শোভন সিং? আমি তাকে চিনি না।”

 আমি লালসিংএর দিকে চাহিলাম। তিনি আমার অভিপ্রায় বুঝিয়া কামিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন,“দেখ কামিনী, ইনি তোমার পুর্ব্ব কথা সমস্তই জানেন। তুমি যে এক সময়ে শোভন সিংএর রক্ষিতা ছিলে, ইনি তাহাও শুনিয়াছেন। এখনও মিথ্যা বলিতেছ?

 কামিনী আমার মুখের দিকে চাহিয়া কি বলিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। আমারও তাহা শুনিবার ইচ্ছা ছিল না। আমি বলিলাম, কামিনীকে এখনই আমার সহিত থানায় যাইতে হইবে।

 আমার কথায় কামিনীর ভয় হইল। সে রোদন করিতে লাগিল। আমি মিষ্ট কথায় কামিনীকে সান্ত্বনা করিয়া বলিলাম, “তোমার কোন ভয় নাই। যদি দোষ না থাকে, এখনই মুক্তি পাইবে।”

 কামিনী আমার শ্লেষ বাক্য বুঝতে পারিল না। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া লালসিং কর্ত্তৃক আনীত এ্রকখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আমরা সকলেই আরোহণ করিলাম। আড্ডার সকল লোককে পুরষ্কার দিয়া সন্তুষ্ট করত কোচমানকে আমাদের থানা যাইতে আদেশ করিলাম।

 থানায় আসিয়া কামিনী ভজনসিংকে সনাক্ত করিল। সে বলিল, তাঁহারই পরামর্শ মত সে দুই জন বালিকাকে ভুলাইয়া তাঁহার নিকট লইয়া যায়; এবং এই কার্য্যের জন্য সন্ন্যাসী তাহাকে দশটা টাকা দিয়াছেন।

 সৌভাগ্যক্রমে সন্ন্যাসীত্রয় তখন ধ্যানে নিমগ্ন—কেহই কামিনীর কথা শুনিতে বা বুঝিতে পারিলেন না।

 বালিকাদ্বয়কে ভুলাইয়া লইয়া যাইবার জন্য কামিনীকে গ্রেপ্তার করা হইল। যতদিন না বিচার শেষ হয়, ততদিন তাহাকে হাজতে রাখিবার বাবস্থা হইল। কামিনী অনেক কান্নাকাটি করিল, অনেক কাকুতি মিনতি করিল, অনেক গালি বর্ষণ করিল কিন্ত কিছুতেই কিছু হইল না।