গড্ডলিকা/ভুশণ্ডীর মাঠে
একদিন নৃত্যকালী গুজব শুনিল তার স্বামীর চরিত্রদোষ ঘটিয়াছে। সেদিনকার বচসা চরমে পৌঁছিল,—নৃত্যকালীর ঝাঁটা শিবুর পৃষ্ঠ স্পর্শ করিল। শিবু বেচারা ক্রোধে, ক্ষোভে, কষ্টে চোখের জল রোধ করিয়া কোনোগতিকে রাত কাটাইয়া পরদিন ভোর ছ’টার ট্রেনে কলিকাতা যাত্রা করিল।
শিয়ালদহ হইতে সোজা কালীঘাটে গিয়া শিবু নানা উপচারে পাঁচ টাকার পূজা দিয়া মানত করিল—“হে মা কালি, মাগীকে ওলাউঠোয় টেনে নাও মা। আমি জোড়া পাঁঠার নৈবিদ্যি দোবো। আর যে বরদাস্ত হয় না। একটা সুরাহা করে দাও মা যাতে আবার নতুন করে সংসার পাত্তে পারি। মাগীর ছেলেপুলে হল না, সেটাও ত দেখতে হবে। দোহাই মা।”
মন্দির হইতে ফিরিয়া শিবু বড় এক ঠোঙা তেলেভাজা খাবার, আধ সের দই এবং আধ সের অমৃতি খাইল। তারপর সমস্ত দিন জন্তুর বাগান, যাদুঘর, হগ সাহেবের বাজার, হাইকোর্ট ইত্যাদি দেখিয়া সন্ধ্যাবেলা বীডন স্ট্রীটের হোটেল-ডি-অর্থোডক্সে এক প্লেট কারী, দু প্লেট রোষ্ট ফাউল এবং আটখানা ডেভিল জলযোগ করিল। তারপর সমস্ত রাত থিয়েটার দেখিয়া ভোরে পেনেটী ফিরিয়া গেল।
মা কালী কিন্তু উল্টা বুঝিয়াছিলেন! বাড়ী আসিয়াই শিবুর ভেদবমী আরম্ভ হইল। ডাক্তার আসিল, কবিরাজ আসিল, ফলে কিছুই হইল না।—আট্ ঘণ্টা রোগে ভুগিয়া স্ত্রীকে পায়ে ধরাইয়া কাঁদাইয়া শিবু ইহলোক পরিত্যাগ করিল।
গ্রামে আর মন টিকিল না। শিবু সেই রাত্রেই গঙ্গা পার হইল। পেনেটীর আড়পার কোন্নগর। সেখান হইতে উত্তর মুখ হইয়া ক্রমে রিশ ড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটীর হাট, চাঁপদানীর চটকল ছাড়াইয়া আরো দু’তিন ক্রোশ দূরে ভুশণ্ডীর মাঠে পৌঁছিল। মাঠটি বহুদূর বিস্তৃত, জনমানবশূন্য। এককালে এখানে ইঁট্খোলা ছিল সেজন্য সমতল নয়, কোথাও গর্ত্ত, কোথাও মাটির ঢিবি। মাঝে মাঝে আস্শেওড়া, ঘেঁটু, বুনোওল, বাবলা প্রভৃতির ঝোপ। শিবুর বড়ই পছন্দ হইল। একটা বহুকালের পরিত্যক্ত ইঁটের পাঁজার এক পাশে একটা লম্বা তালগাছ সোজা হইয়া উঠিয়াছে, আর একদিকে একটা নেড়া বেলগাছ ত্রিভঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। শিবু সেই বেলগাছে ব্রহ্মদৈত্য হইয়া বাস করিতে লাগিল।
ষাঁরা স্পিরিচুয়ালিজম্ বা প্রেততত্ত্বের খবর রাখেন না তাঁহাদিগকে ব্যাপারটা সংক্ষেপে বুঝাইয়া দিতেছি। মানুষ মরিলে ভূত হয় ইহা সকলেই শুনিয়াছেন। কিন্তু এই থিওরীর সঙ্গে স্বর্গ, নরক, পুনর্জন্ম খাপ খায় কিরূপে? প্রকৃত তথ্য এই।—নাস্তিকদের আত্মা নাই। তাঁরা মরিলে অম্লজান, উজান, যবক্ষারজান প্রভৃতি গ্যাসে পরিণত হন। সাহেবদের মধ্যে যাঁরা আস্তিক, তাঁদের আত্মা আছে বটে, কিন্তু পুনর্জন্ম নাই। তাঁরা মৃত্যুর পর ভূত হইয়া প্রথমতঃ একটি বড় ওয়েটিং-রূমে জমায়েৎ হন। তথায় কল্পবাসের পর তাঁদের শেষ বিচার হয়। রায় বাহির হইলে কতকগুলি ভূত অনন্ত স্বর্গে এবং অবশিষ্ট সকলে অনন্ত নরকে আশ্রয়লাভ করেন। সাহেবরা জীবদ্দশায় যে স্বাধীনতা ভোগ করেন, ভূতাবস্থায় তাহা অনেকটা কমিয়া যায়। বিলাতী প্রেতাত্মা বিনা পাশে ওয়েটিং-রূম ছাড়িতে পারে না। যাঁরা seance দেখিয়াছেন, তাঁরা জানেন বিলাতী ভূত নামানো কি রকম কঠিন কাজ। হিন্দুর জন্য অন্যরূপ বন্দোবস্ত, কারণ আমরা পুনর্জন্ম, স্বর্গ, নরক, কর্ম্মফল, ত্বয়া হৃষিকেশ, নির্ব্বাণ, মুক্তি, সবই মানি। হিন্দু মরিলে প্রথমে ভূত হয় এবং যত্র তত্র স্বাধীনভাবে বাস করিতে পারে,——আবশ্যক-মত ইহলোকের সঙ্গে কারবারও করিতে পারে। এটা একটা মস্ত সুবিধা কিন্তু এই অবস্থা বেশী দিন স্থায়ী নয়। কেহ কেহ দু'চার দিন পরেই পুনর্জন্ম লাভ করে, কেউ বা দশ-বিশ বৎসর পরে, কেউ বা দু’তিন শতাব্দী পরে। ভূতদিগকে মাঝে মাঝে চেঞ্জের জন্য স্বর্গে ও নরকে পাঠানো হয়। এটা তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, কারণ স্বর্গে খুব ফূর্তিতে থাকা যায় এবং নরকে গেলে পাপ ক্ষয় হইয়া সুক্ষ্ম শরীর বেশ হাল্কা ঝরঝরে হয়, তা ছাড়া সেখানে অনেক ভাল ভাল লোকের সঙ্গে দেখা হইবার সুবিধা আছে। কিন্তু যাঁদের ভাগ্যক্রমে ৺কাশীলাভ হয়, অথবা নেপালে পশুপতিনাথ বা রথের উপর বামন-দর্শন ঘটে,—কিংবা যাঁরা স্বকৃত পাপের বোঝা হৃষিকেশের উপর চাপাইয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারেন,—তাঁদের পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে— একেবারেই মুক্তি।
দুতিন মাস কাটিয়া গিয়াছে। শিবু সেই বেলগাছেই থাকে। প্রথম প্রথম দিনকতক নূতন স্থানে নূতন অবস্থায় বেশ আনন্দে কাটিয়াছিল, কিন্তু এখন শিবুর বড়ই ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে। মেজাজটা যতই বদ্ হোক, নৃত্যর একটা আন্তরিক টান ছিল, শিবু এখন তাহা মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করিতেছে। একবার ভাবিল—দূর হোক্, না হয় পেনেটীতেই আড্ডা গাড়ি। তারপর মনে হইল— লোকে বলিবে বেটা ভূত হইয়াও স্ত্রীর আঁচল ছাড়িতে পারে নাই। নাঃ, এইখানেই একটা পছন্দমত উপদেবীর যোগাড় দেখিতে হইল।
ফাল্গুন মাসের শেষবেলা। গঙ্গার বাঁকের উপর দিয়া দক্ষিণা হাওয়া ঝির ঝির করিয়া বহিতেছে। সূর্য্যদেব জলে হাবুডুবু খাইয়া এইমাত্র তলাইয়া গিয়াছেন। ঘেঁটুফুলের গন্ধে ভুশণ্ডীর মাঠ ভরিয়া গিয়াছে। শিবুর বেলগাছে নূতন পাতা গজাইয়াছে। দূরে আকন্দ-ঝোপে গোটাকতক পাকা ফল ফট্ করিয়া ফাটিয়া গেল, একরাশ তুলার আঁশ হাওয়ায় উড়িয়া মাকশার কঙ্কালের মত ঝিক্মিক্ করিয়া শিবুর গায়ে পড়িতে লাগিল। একটা হলদে রঙের প্রজাপতি শিবুর সূক্ষ্ম শরীর ভেদ করিয়া উড়িয়া গেল। একটা কালো গুবরে পোকা ভরর করিয়া শিবুকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। অদূরে বাবলা গাছে এক জোড়া দাঁড়কাক বসিয়া আছে। কাক গলায় সুড়সুড়ি দিতেছে, কাকিনী চোখ মুদিয়া গদগদ স্বরে মাঝে মাঝে ক-অ-অ করিতেছে। একটা কট্কটে ব্যাং সদ্য ঘুম হইতে উঠিয়া গুটিগুটি পা ফেলিয়া বেলগাছের কোটর হইতে বাহিরে আসিল, এবং শিবুর দিকে ড্যাব্-ডেবে চোখ মেলিয়া টিট্কারী দিয়া উঠিল একদল ঝিঁ ঝিঁ পোকা সন্ধ্যার আসরের জন্য যন্ত্রে সুর বাঁধিতেছিল, এতক্ষণে সঙ্গৎ ঠিক হওয়ায় সমস্বরে রি রি-রি-রি করিয়া উঠিল।
শিবুর যদিও রক্ত-মাংসের শরীর নাই, কিন্তু মরিলেও অভাব যাইবে কোথা। শিবুর মনটা খাঁ খাঁ করিতে লাগিল। যেখানে হৃৎপিণ্ড ছিল সেখানটা ভরাট হইয়া ধড়াক্ ধড়াক্ করিতে লাগিল। মনে পড়িল,—ভূশণ্ডীর মাঠের প্রান্তস্থিত পিটুলী বিলের ধারে শ্যাওড়া গাছে একটি পেত্নী বাস করে। শিবু তাকে অনেকবার সন্ধ্যাবেলা পলো হাতে মাছ ধরিতে দেখিয়াছে। তার আপাদমস্তক ঘেরাটোপ দিয়া ঢাকা, একবার কেবল সে ঢাকা খুলিয়া শিবুর দিকে চাহিয়া লজ্জায় জিভ কাটিয়াছিল। পেত্নীর বয়স হইয়াছে, কারণ তার গাল একটু তোবড়াইয়াছে, এবং সাম্নের দুটা দাঁত নাই। তার সঙ্গে ঠাট্টা চলিতে পারে, কিন্তু প্রেম হওয়া অসম্ভব।
একটি শাঁকচুন্নী কয়েকবার শিবুর নজরে পড়িয়াছে। সে একটা গামছা পরিয়া আর একটা গামছা মাথায় দিয়া এলোচুলে বকের মত লম্বা পা ফেলিয়া হাতের হাঁড়ি হইতে গোবর-গোলা জল ছড়াইতে ছড়াইতে চলিয়া যায়। তার বয়স তেমন বেশী বোধ হয় না। শিবু একবার রসিকতার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু শাঁকচুন্নী ক্রুদ্ধ বিড়ালের মত ফ্যাঁচ্ করিয়া উঠে, অগত্যা শিবুকে ভয়ে চম্পট দিতে হয়।
শিবুর মন সবচেয়ে হরণ করিয়াছে এক ডাকিনী। ভুশণ্ডীর মাঠের পূর্ববদিকে গঙ্গার ধারে ক্ষীরি-বাম্নীর পরিত্যক্ত ভিটায় যে জীর্ণ ঘরখানি আছে, তাহাতেই সে অল্পদিন হইল আশ্রয় লইয়াছে। শিবু তাকে মাত্র
‘গোবর-গোলা জল ছড়াইয়া চলিয়া যায়’
একবার দেখিয়াছে এবং দেখিয়াই মজিয়াছে। ডাকিনী তখন একটা খেজুরের ডাল দিয়া র’ক ঝাঁট দিতেছিল। পরনে সাদা থান। শিবুকে দেখিয়া নিমেষের তরে ঘোমটা সরাইয়া ফিক্ করিয়া হাসিয়াই সে হাওয়ার সঙ্গে মিলাইয়া যায়। কি দাঁত! কি মুখ! কি রঙ! নৃত্যকালীর রঙ ছিল পানতুয়ার মত। কিন্তু এই ডাকিনীর রঙ যেন পানতুয়ার শাঁস।
শিবু একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া গান ধরিল
আহা, শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী
কারে রেখে কারে ফেলি।
সহসা প্রান্তর প্রকম্পিত করিয়া নিকটবর্ত্তী তালগাছের মাথা হইতে তীব্রকণ্ঠে শব্দ উঠিল—
চা রা রা রা রা রা
আরে ভজুয়াকে বহিনিয়া ভগ্লুকে বিটিয়া
কেকরাসে সাদিয়া হো কেকরাসে হো-ও-ও-ও—
শিবু চমকাইয়া উঠিয়া ডাকিল—“তালগাছে কে রে?”
উত্তর আসিল—“কারিয়া পিরেত বা।”
শিবু। কেলে ভূত? নেমে এস বাবা।
মাথায় পাগ্ড়ি, কালো লিক্লিকে চেহারা, কাঁকলাসের মত একটি জীবাত্মা সড়াক্ করিয়া তালগাছের মাথা হইতে নামিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল —“গোড় লাগি বরম্দেওজি।”
শিবু। জিতা রহো বেটা। একটু তামাক খাওয়াতে পারিস?
কারিয়া পিরেত। ছিলম্ বা?
শিবু। তামাকই নেই তা ছিলিম। যোগাড় কর না।
‘খেজুরের ডাল দিয়া র’ক ঝাঁট দিতেছিল’
প্রেত ঊর্দ্ধে উঠিল এবং অল্পক্ষণ-মধ্যে বৈদ্যবাটীর বাজার হইতে তামাক, টিকা, কলিকা আনিয়া ‘আগ্ শুল্গাইয়া’ শিবুর হাতে দিল। শিবু একটা কচুর ডাঁটার উপর কলিকা বসাইয়া টান দিতে দিতে বলিল —“তারপর, এলি কবে? তোর হাল-চাল সব বল্।”
কারিয়া পিরেত যে ইতিহাস বলিল তার সারমর্ম্ম এই।—তার বাড়ী ছাপরা জিলা। দেশে এককালে তার জরু, গরু, জমি, জেরাৎ সবই ছিল। তার স্ত্রী মুংরী অত্যন্ত মুখরা ও বদ্মেজাজী, বনিবনাও কখনো হইত না। একদিন প্রতিবেশী ভজুয়ার ভগ্নীকে উপলক্ষ করিয়া স্বামি-স্ত্রীতে বিষম ঝগড়া হয়, এবং স্ত্রীর পিঠে এক ঘা লাঠি কশাইয়া স্বামী দেশ ছাড়িয়া কলিকাতায় চলিয়া আসে। সে আজ ত্রিশ বৎসরের কথা। কিছুদিন পরে সংবাদ আসে মুংরী বসন্ত রোগে মরিয়াছে। স্বামী আর দেশে ফিরিল না, বিবাহও করিল না। নানা স্থানে চাকরী করিয়া অবশেষে চাঁপদানীর মিলে কুলীর কাজে ভর্ত্তি হয় এবং কয়েক বৎসরের মধ্যে সর্দ্দারের পদ পায়। কিছুদিন পূর্বের একটি লোহার কড়ি ‘হাফিজ’ অর্থাৎ কপিকলে উত্তোলন করিবার সময় তার মাথায় চোট লাগে। তারপর একমাস হাঁসপাতালে শয্যাশায়ী হইয়া থাকে। সম্প্রতি পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়া প্রেতরূপে এই তালগাছে বিরাজ করিতেছে।
শিবু একটা লম্বা টান মারিয়া কলিকাটি কারিয়া
‘সড়াক করিয়া নামিরা আসিল’
পিরেতকে দিবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময় মাটির ভিতর হইতে ভাঙা কাঁসরের মত আওয়াজ আসিল—“ভায়া, কল্কেটায় কিছু আছে না কি?”
বেলগাছের কাছে যে ইঁটের পাঁজা ছিল তাহা হইতে খানকতক ইঁট খসিয়া গেল এবং ফাঁকের ভিতর হইতে হামাগুড়ি দিয়া একটি মূর্ত্তি বাহির হুইল। স্থুল খর্ব্ব দেহ, থেলো হুঁকার খোলের উপর একজোড়া পাকা গোঁফ গজাইলে যে-রকম হয় সেই প্রকার মুখ, মাথায় টাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ে ঘুণ্টি-দেওয়া মের্জাই, পরনে গরদের ধুতি, পায়ে তালতলার চটি আগন্তুক শিবুর হাত হইতে কলিকাটি লইয়া বলিলেন—
“ব্রাহ্মণ? দণ্ডবৎ হই। কিছু সম্পত্তি ছিল, এইখানে পৌঁতা আছে। তাই যক্ষি হয়ে আগ্লাচ্চি। বেশী কিছু নয়—এই দু-পাঁচশো। সব বন্ধকী তমসুক দাদা—ইষ্টাম্বর কাগজে লেখা,—নগদ সিক্কা একটিও পাবে না। খবরদার, ওদিকে নজর দিও না—হাতে হাতকড়ি পড়বে। থুঃ থুঃ”
শিবুর মেঘদূত একটু আধটু জানা ছিল। সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিল—“যক্ষ মশায়, আপনিং কি কালিদাসের—”
যক্ষ। ভায়রাভাই। ‘কালিদাস আমার মাস্তুতো
‘সব বন্ধকী তমসুক দাদা’
শালীকে বে করে। ছোকরা হিজ্লিতে নিম্কির গোমস্তা ছিল, অনেক দিন মারা গেছে। তুমি তার নাম জান্লে কিসে হ্যা?
শিবু। আপনার এখানে কতদিন আগমন হয়েচে?
যক্ষ। আমার আগমন? হ্যা, হ্যা। আমি বলে গিয়ে সাড়ে তিন কুড়ি বচ্ছর এখানে আছি। কত এল দেখলুম, কত গেল তাও দেখলুম। আরে তুমি ত সেদিন এলে, কাটপিঁপড়ে তাড়িয়ে তিনবার হোঁচট্ খেয়ে গাছে উঠলে। সব দেখেচি আমি। তোমার গানের সক্ আছে দেখচি,—বেশ বেশ। ক্যালোয়াতি শিখতে যদি চাও ত আমার সারেদ হও দাদা। এখন আওয়াজটা যদিচ একটু খোনা হয়ে গেছে, তবু মরা হাতি লাখ টাকা।
শিবু। মশায়ের ভূতপূর্ব্ব পরিচয়টা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
যক্ষ। বিলক্ষণ। আমার নাম ৺নদের চাঁদ মল্লিক, পদরী বসু, জাতি কায়স্থ, নিবাস রিশ্ড়ে, হাল সাকিন এই পাঁজার মধ্যে। সাবেক পেশা দারোগাগিরি, এলাকা রিশ্ড়ে ইস্তক ভদ্রেশ্বর। জর্জ্জটি সাহেবের নাম শুনেচ? হুগলীর কালেক্টার,—ভারি ভালবাসত আমাকে। মুল্লুকের শাসনটা তামাম আমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল। নাদু মল্লিকের দাপটে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ত।
শিবু। মহাশয়ের পরিবারাদি কি?
যক্ষ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—“সব সুখ কি কপালে হয় রে দাদা। ঘর-সংসার সবই ত ছিল, কিন্তু গিন্নিটি ছিলেন খাণ্ডার। বলব কি মশায়, আমি হলুম গিয়ে নাদু মল্লিক,—কোম্পানির দেওয়ানী, ফৌজদারী, নিজামৎ আদালত যার মুঠোর মধ্যে,— আমারই পিঠে দিলে কিনা এক ঘা চেলা-কাঠ কশিয়ে। তারপরেই পালালো বাপের বাড়ী। তিনশ চব্বিশ ধারায় ফেল্তুম, কিন্তু কেলেঙ্কারীর ভয়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আর ছাড়লুম না। কিন্তু যাবে কোথা? গুরু আছেন, ধর্ম্ম আছেন। সাতচল্লিশ সনের মড়কে মাগী ফৌত হল। সংসার-ধর্ম্মে আর মন বস্ল না। জর্জ্জটি সাহেব বিলেত গেলে আমিও পেন্সন্ নিয়ে এক সখের যাত্রা খুল্লুম। তারপর পরমাই ফুরুলে এই হেথা আড্ডা গেড়েচি। ছেলেপুলে হয়নি তাতে দুঃখু নেই দাদা। আমি করব রোজগার, আর কোন্ আবাগের বেটা ভূত মানুষ হয়ে আমার ঘরে জন্ম নিয়ে সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে—সেটা আমার সইত না। এখন তোফা আছি, নিজের বিষয় নিজে আগ্লাই, গঙ্গার হাওয়া খাই আর বব বম্ করি। যাক্, আমার কথা ত সব শুনলে, এখন তোমার কেচ্ছা বল।”
শিবু নিজের ইতিহাস সমস্ত বিবৃত করিল, কারিয়া পিরেতের পরিচয়ও দিল। যক্ষ বলিলেন—“সব স্যাঙাতের একই হাল দেখ্চি। পুরানো কথা ভেবে মন খারাপ করে ফল নেই, এখন একটু গাওনা-বাজনা করি এস। পাখোয়াজ নেই,— তেমন জুৎ হবে না। আচ্ছা, পেট চাপ্ড়েই ঠেকা দিই। উহুঁ—ঢন্ ঢন্ কচ্চে। বাবা ছাতুখোর, একটু এঁটেল-মাটি চট্কে এই মধ্যিখানে থাব্ড়ে দে ত। ঠিক হয়েচে। চৌতাল বোঝো? ছ মাত্রা, চার তাল, দুই ফাঁক্। বোল্ শোনো—
ধা ধা ধিন্ তা কৎ তা গে, গিন্নি ঘা দেন কর্ত্তা কে।
ধরে তাড়া কোরে খিট্খিটে কথা কয়
ধূর্ত্তা গিন্নি কর্ত্তা গাধা রে।
ঘাড়ে ধরে ঘন ঘন ঘা কত ধুম্ ধুম্ দিতে থাকে
টুঁটি টিপে ঝুঁটি ধরে উল্টে পাল্টে ফ্যালে
গিন্নি ঘুঘুটির ক্ষমতা কম নয়।
ধাক্কা ধুক্কি দিতে ত্রুটি ধনি করে না
নগণ্য নির্ধন কর্ত্তা গাধা—
‘ধা’ এর ওপর সোম। ধিন্ তা তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা। এই ‘ধা’ ফস্কালেই সব মাটি। গলাটা ধরে আস্চে। বাবা খোট্টাভূত, আর এক ছিলিম সাজ্ বেটা।”
উদ্যোগী পুরুষের লক্ষ্মীলাভ অনিবার্য্য। অনেক কাকুতি-মিনতির পরে ডাকিনী শিবুর ঘর করিতে রাজি হইয়াছে। কিন্তু সে এখনো কথা বলে নাই, ঘোমটাও খোলে নাই, তবে ইসারায় সম্মতি জানাইয়াছে। আজ ভৌতিক পদ্ধতিতে শিবুর বিবাহ। সূর্য্যাস্ত হইবামাত্র শিবু সর্ববাঙ্গে গঙ্গা-মৃত্তিকা মাখিয়া স্নান করিল, গাবের আঠা দিয়া পৈতা মাজিল, ফনি-মনসার বুরুষ দিয়া চুল আঁচড়াইল, টিকিতে একটি পাকা তেলাকুচা বাঁধিল। ঝোপে ঝোপে বন-জঙ্গলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া এক রাশ ঘেঁটুফুল, বৈঁচি, কয়েকটি পাকা নোনা ও বেল সংগ্রহ করিল। তারপর সন্ধ্যায় শেয়ালের ঐকতান আরম্ভ হইতেই সে ক্ষীরি-বাম্নীর ভিটায় যাত্রা করিল।
সেদিন শুক্লপক্ষের চতুর্দ্দশী। ঘরের দাওয়ায় কচুপাতার আসনে ডাকিনীর সম্মুখে বসিয়া শিবু মন্ত্রপাঠের উদ্যোগ করিয়া উৎসুক চিত্তে বলিল—“এইবার ঘোম্টাটা খুল্তে হচ্চে।”
ডাকিনী ঘোমটা সরাইল। শিবু চমকিত হইয়া সভয়ে বলিল—অ্যাঁ! তুমি নেত্য?”
নৃত্যকালী বলিল—“হ্যাঁরে মিন্সে। মনে করেছিলে মরে আমার কবল থেকে বাঁচ্বে। পেত্নী শাঁকচুন্নীর পিছু পিছু ঘুরতে বড় মজা, না?”
শিবু। এলে কি করে? ওলাউঠোয় নাকি?
নৃত্যকালী। ওলাউঠো শত্তুরের হোক্। কেন, ঘরে কি কেরাসিন ছিল না?
শিবু। তাই চেহারাটা ফর্সাপানা দেখাচ্চে। পোড় খেলে সোণার জলুস বাড়ে। ধাতটাও একটু নরম হয়েছে নাকি?
শুভকর্ম্মে বাধা পড়িল। বাহিরে ও কিসের গোলযোগ? যেন একপাল শকুনি গৃধিনী ঝুটোপটি কাড়াকাড়ি ছেঁড়াছিঁড়ি করিতেছে। সহসা উল্কার মত ছুটিয়া আসিয়া পেত্নী ও শাকচুন্নী উঠানের বেড়ার আগড় ঠেলিয়া ভীষণ চেঁচামেচি আরম্ভ করিল। (ছাপাখানার দেবতাগণের সুবিধার জন্য চন্দ্রবিন্দু বাদ দিলাম, পাঠকগণ ইচ্ছামত বসাইয়া লইবেন)
পেত্নী। আমার সোয়ামী তোকে দেব কেন?
শাকচুন্নী। অ মর বুড়ি, ও যে তোর নাতির বয়সি।
পেত্নী। আহা, কি আমার কনে-বউ গা!
শাঁকচুন্নী। দূর্ মেছোপেত্নী, আমি যে ওর দুজন্ম আগেকার বউ।
পেত্নী। দূর্ গোবরচুন্নি, আমি যে ওর তিন জন্ম আগেকার বউ।
শাকচুন্নী। মর্ চেঁচিয়ে, ওদিকে ডাইনী মাগী মিন্সেকে নিয়ে উধাও হোক্।
তখন পেত্নী বিড় বিড় করিয়া মন্ত্র পড়িয়া আগড় বন্ধ করিয়া বলিল——“আগে তোর ঘাড় মট্কাবো তারপর ডাইনী বেটীকে খাবো।”
কাম্ড়া কাম্ড়ি চুলোচুলি আরম্ভ হইল। একা নৃত্যকালীতেই রক্ষা নাই, তার উপর পূর্ববর্তন দুই জন্মের আরো দুই পত্নী হাজির। শিবু হাতে পৈতা জড়াইয়া ইষ্টমন্ত্র জপিতে লাগিল। নৃত্যকালী রাগে ফুলিতে লাগিল।
এমন সময় নেপথ্যে যক্ষের গলা শোনা গেল—
ধনি, গুন্চ কিবা আন্মনে
ভাব্চ বুঝি শ্যামের বাঁশী ডাক্চে তোমায় বাঁশবনে।
ওটা যে খ্যাঁক্শেয়ালী, দিওনা কুলে কালি
রাত-বিরেতে শ্যাল্কুকুরের ছুঁচোপ্যাঁচার ডাক্ শুনে।
যক্ষ বেড়ার কাছে আসিয়া বলিলেন—“ভায়া এখানে। হচ্চে কি? অত গোল কিসের?”
কারিয়া পিরেত হাঁকিল—“এ বরম্ পিচাস, আরে দর্বাজা ত খোল।” শিবুর সাড়া নাই।
প্রচণ্ড ধাক্কা পড়িল, কিন্তু মন্ত্রবদ্ধ আগড় খুলিল না, বেড়াও ভাঙিল না। তখন কারিয়া পিরেত তারস্বরে উৎপাটন-মন্ত্র পড়িল—
মারে জ্ জুয়ান্—হেঁইয়া
আউর ভি থোড়া—হেঁইয়া
পর্ব্বত তোড়ি—হেঁইয়া
চলে ইঞ্জন—হেঁইয়া
ফটে বয়লট —হেঁইয়া
খবরদার—হা-ফিজ্।
মড় মড় করিয়া ঘরের চাল, দেওয়াল, বেড়া, আগড় সমস্ত আকাশে উঠিয়া দূরে নিক্ষিপ্ত হইল।
ডাকিনী, অর্থাৎ নৃত্যকালীকে দেখিয়া যক্ষ বলিলেন —“একি, গিন্নি এখানে! বেম্মদত্যিটার সঙ্গে! ছি ছি —লজ্জার মাথা খেয়েচ?” ডাকিনী ঘোমটা টানিয়া কাঠ হইয়া বসিয়া রহিল।
কারিয়া পিরেত বলিল—“আরে মুংরি, তোহর্ সরম নেহি বা?”
* * * *
তারপর যে ব্যাপার আরম্ভ হইল, তাহা মনে করিলেও কলমের কালি শুখাইয়া যায়। শিবুর তিন জন্মের তিন. স্ত্রী এবং নৃত্যকালীর তিন জন্মের তিন স্বামী,—এই ডবল ত্র্যহস্পর্শযোগে ভুশণ্ডীর মাঠে যুগপৎ জলস্তম্ভ, দাবানল ও ভূমিকম্প সুরু হইল। ভূত, প্রেত, দৈত্য, পিশাচ, তাল, বেতাল প্রভৃতি দেশী উপদেবতা যে যেখানে ছিল, তামাশা দেখিতে আসিল। স্পুক, পিক্সি, নোম, গব্লিন্ প্রভৃতি গোঁফ-কামানো বিলাতী ভূত বাঁশী বাজাইয়া নাচিতে লাগিল। জিন্, জান্, আফ্রিদ, মারীদ প্রভৃতি লম্বা দাড়িওয়ালা কাবুলী ভূত দাপাদাপি আরম্ভ করিল। চিং, চ্যাং, ফ্যাচাং ইত্যাদি মাকুন্দে চীনে-ভূত ডিগবাজী খাইতে লাগিল।
রাম রাম রাম। জয় হাড়িঝি চণ্ডি, আজ্ঞা কর মা! কে এই উৎকট দাম্পত্য সমস্যার সমাধান করিবে? আমার কম্ম নয়। ভূত জাতি অতি নাছোড়বান্দা, ন্যায্যগণ্ডা ছাড়িবে না। পুরুষের পুরুষত্ব, নারীর নারীত্ব, ভূতের ভূতত্ত্ব, পেত্নীর পেত্নীত্ব,—এ সব তারা বিলক্ষণ, বোঝে। অতএব সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ করিতেছি— শ্রযুক্ত শরৎ চাটুয্যে, চারু বাঁড়ু ষ্যে, নরেশ সেন এবং যতীন সিংহ মহাশয়গণ যুক্তি করিয়া একটা বিলি-ব্যবস্থা করিয়া দিন—যাতে এই ভূতের সংসারটি ছারেখারে না যায় এবং কোনোরকম নীতি-বিগর্হিত বিদ্কুটে ব্যাপার না ঘটে। নিতান্ত যদি না পারেন, তবে চাঁদা তুলিয়া গয়ায় পিণ্ড দিবার চেষ্টা দেখুন, যাতে বেচারারা অতঃপর শান্তিতে থাকিতে পারে।