গড্ডলিকা/লম্বকর্ণ
রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুর জমিন্দার এণ্ড অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট, বেলেঘাটা-বেঞ্চ, প্রত্যহ বৈকালে খালের ধারে হাওয়া খাইতে যান। চল্লিশ পার হইয়া ইনি একটু মোটা হইয়া পড়িয়াছেন; সেজন্য ডাক্তারের উপদেশে হাঁটিয়া এক্সারসাইজ করেন, এবং ভাত ও লুচি বর্জ্জন করিয়া দুবেলা কচুরী খাইয়া থাকেন।
কিছুক্ষণ পায়চারি করিয়া বংশলোচনবাবু ক্লান্ত হইয়া খালের ধারে একটা ঢিবির উপর রুমাল বিছাইয়া বসিয়া পড়িলেন। ঘড়ি দেখিলেন—সাড়ে ছ’টা বাজিয়া গিয়াছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ। সিলোনে মনসুন্ পৌঁছিয়াছে। এখানেও যে কোনোদিন হঠাৎ ঝড়জল হওয়া বিচিত্র নয়। বংশলোচন উঠিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া হাতের বর্ম্মাচুরুটে একবার জোরে টান দিলেন। এমন সময় বোধ হইল, কে যেন পিছু হইতে তাঁর জামার প্রান্ত ধরিয়া টানিতেছে এবং মিহি-সুরে বলিতেছে —হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ। ফিরিয়া দেখিলেন—একটি ছাগল।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছাগল। কুচ্কুচে কালো নধর দেহ, বড় বড় লট্পটে কাণের উপর কচি পটোলের মত দুটি শিং বাহির হইয়াছে। বয়স বেশী নয়, এখনো অজাতশ্মশ্রু। বংশলোচন বলিলেন—“আরে এটা কোথা থেকে এল? কার পাঁঠা? কাকেও ত দেখচি না।”
ছাগল উত্তর দিল না। কাছে ঘেঁসিয়া লোলুপনেত্রে তাঁহাকে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। বংশলোচন তার মাথায় ঠেলা দিয়া বলিলেন—“যাঃ পালা, ভাগো হিঁয়াসে।” ছাগল পিছনের দু পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল, এবং সাম্নের দু পা মুড়িয়া ঘাড় বাঁকাইয়া রায়-বাহাদুরকে ঢুঁ মারিল।
রায়-বাহাদুর কৌতুক বোধ করিলেন। ফের ঠেলা দিলেন। ছাগল আবার খাড়া হইল এবং খপ্ করিয়া তাঁর হাত হইতে চুরুটটি কাড়িয়া লইল। আহারান্তে বলিল—“অর্-র্-র্”, অর্থাৎ আর আছে?
বংশলোচনের সিগার-কেসে আর একটিমাত্র চুরুট ছিল। তিনি সেটি বাহির করিয়া দিলেন। ছাগলের মাথা-ঘোরা, গা-বমি বা অপর কোনো ভাব-বৈলক্ষণ্য প্রকাশ পাইল না। দ্বিতীয় চুরুট নিঃশেষ করিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল—“অর্-র্-র্?” বংশলোচন বলিলেন— “আর নেই। তুই এইবার যা। আমিও উঠি।”
ছাগল বিশ্বাস করিল না, পকেট তল্লাস করিতে লাগিল। বংশলোচন নিরুপায় হইয়া চামড়ার সিগারকেসটি খুলিয়া ছাগলের সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন—“না বিশ্বাস হয়, এই দেখ্ বাপু।” ছাগল এক লম্ফে সিগার-কেস কাড়িয়া লইয়া চর্ববণ আরম্ভ করিল। রায়বাহাদুর রাগিবেন কি হাসিবেন স্থির করিতে না পারিয়া বলিয়া ফেলিলেন—“শ্-শালা।”
অন্ধকার হইয়া আসিতেছে। আর দেরি করা উচিত নয়। বংশলোচন গৃহাভিমুখে চলিলেন। ছাগল কিন্তু তাঁর সঙ্গ ছাড়িল না। বংশলোচন বিব্রত হইলেন। কার ছাগল কি বৃত্তান্ত তিনি কিছুই জানেন না, নিকটে কোনো লোক নাই যে জিজ্ঞাসা করেন। ছাগলটাও নাছোড়বান্দা, তাড়াইলে যায় না। অগত্যা বাড়ী লইয়া যাওয়। ভিন্ন গত্যন্তর নাই। পথে যদি মালিকের সন্ধান পান ভালই, নতুবা কাল সকালে যা হোক একটা ব্যবস্থা করিবেন।
বাড়ী ফিরিবার পথে বংশলোচন অনেক খোঁজ লইলেন; কিন্তু কেহই ছাগলের ইতিবৃত্ত বলিতে পারিল না। অগত্যা তিনি হতাশ হইয়া স্থির করিলেন যে আপাততঃ নিজেই উহাকে প্রতিপালন করিবেন।
হঠাৎ বংশলোচনের মনে একটা কাঁটা খচ্ করিয়া উঠিল। তাঁর যে এখন পত্নীর সঙ্গে কলহ চলিতেছে। আজ পাঁচদিন হইল কথাবন্ধ। ইঁহাদের দাম্পত্য কলহ বিনা আড়ধরে নিষ্পন্ন হয়। সামান্য একটা উপলক্ষ্য, দু-চারটি নাতিতীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, তারপর দিনকতক অহিংস অসহযোগ, বাক্যালাপ বন্ধ,—পরিশেষে হঠাৎ একদিন সন্ধিস্থাপন ও পুনর্ম্মিলন। এ রকম প্রায়ই হয়, বিশেষ উদ্বেগের কারণ নাই। কিন্তু আপাততঃ অবস্থাটি সুবিধাজনক নয়। গৃহিণী জন্তু-জানোয়ার মোটেই পছন্দ করেন না। বংশলোচনের একবার কুকুরপোষার সখ হইয়াছিল, কিন্তু গৃহিণীর প্রবল আপত্তিতে তাহা সফল হয় নাই। আজ একে কলহ চলিতেছে, তার উপর ছাগল লইয়া গেলে আর রক্ষা থাকিবে না। একে মনসা তায় ধূনার গন্ধ।
চলিতে চলিতে রায়-বাহাদুর পত্নীর সহিত কাল্পনিক বাকযুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। একটা পাঁঠা পুষিবেন তাতে কার কি বলিবার আছে? তাঁর কি স্বাধীনভাবে একটা সখ মিটাইবার ক্ষমতা নাই? তিনি একজন মান্যগণ্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, বেলেঘাটা রোডে তাঁর প্রকাণ্ড অট্টালিকা, বিস্তর ভূ-সম্পত্তি। তিনি একজন খেতাবধারী অনারারি হাকিম,—পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, একমাস পর্য্যন্ত জেল দিতে পারেন। তাঁর কিসের দুঃখ, কিসের লজ্জা, কিসের নারভস্নেস্? বংশলোচন বারবার মনকে প্রবোধ দিলেন—তিনি কাহারো তোয়াক্কা রাখেন না।
বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানায় যে সান্ধ্য আড্ডা বসে, তাহাতে নিত্য বহুসংখ্যক রাজা-উজির বধ হইয়া থাকে। লাটসাহেব, সুরেন বাঁড়ুয্যে, মোহনবাগান, পরমার্থ-তত্ত্ব, প্রতিবেশী অধর বুড়োর শ্রাদ্ধ, আলিপুরের নূতন কুমীর,—কোনো প্রসঙ্গই বাদ যায় না। সম্প্রতি সাত দিন ধরিয়া বাঘের বিষয় আলোচিত হইতেছিল। এই সূত্রে গতকল্য বংশলোচনের শ্যালক নগেন এবং দূর-সম্পর্কের ভাগিনেয় উদয়ের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয়। অন্যান্য সভ্য অনেক কষ্টে তাহাদিগকে নিরস্ত করেন।
বংশলোচনের বৈঠকখানা ঘরটি বেশ বড় ও সুসজ্জিত; অর্থাৎ অনেকগুলি ছবি, আয়না, আলমারি, চেয়ার, ইত্যাদি জিনিষপত্রে ভর্ত্তি। প্রথমেই নজরে পড়ে একটি কার্পেটে-বোনা ছবি, কালো জমির উপর আসমানি রঙের বিড়াল। যুদ্ধের সময় বাজারে সাদা পশম ছিল না, সুতরাং বিড়ালটির এই দশা হইয়াছে। ছবির নীচে সর্ব্বসাধারণের অবগতির জন্য বড় বড় ইংরাজি অক্ষরে লেখা আছে— CAT. তার নীচে রচয়িত্রীর,নাম—মানিনী দেবী। ইনিই গৃহকর্ত্রী। ঘরের অপর দিকের দেওয়ালে একটি রাধাকৃষ্ণের তৈলচিত্র। কৃষ্ণ রাধাকে লইয়া কদমতলায় দাঁড়াইয়া আছেন,—একটি প্রকাণ্ড সাপ তাহাদিগকে পাক দিয়া পিষিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু রাধাকৃষ্ণের ভ্রুক্ষেপ নাই; কারণ, সাপটি বাস্তবিক সাপ নয়, ওঁ-কার মাত্র। তাছাড়া কতকগুলি মেমের ছবি আছে, তাদের অঙ্গে সিল্কের ব্রাহ্মসাড়ী এবং মাথায় কালো সুতার আলুলায়িত পরচুল! ময়দার কাই দিয়া আটিয়ে দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু তাতেও তাদের মুখের দুরন্ত মেম-মেম-ভাব ঢাকা পড়ে নাই, সেজন্য জোর করিয়া নাক বিধাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘরে দুটি দেওয়াল- আলমারিতে চিনামাটির পুতুল এবং কাচের খেলনা ঠাসা। উপরের শুইবার ঘরের চারটি আলমারি বোঝাই হইয়া যাহা বাড়তি হইয়াছে, তাহাই নীচে স্থান পাইয়াছে। ইহা ভিন্ন আরো নানা প্রকার আসবাব, যথা রাজা-রাণীর ছবি, রায়-বাহাদুরের পরিচিত ও অপরিচিত ছোট-বড় সাহেবের ফটোগ্রাফ, গিল্টির ক্রেমে বাঁধানো আয়না, আলমানাক্, ঘড়ি, রায়-বাহাদুরের সনদ, কয়েকটি অভিনন্দন-পত্র ইত্যাদি।
আজও যথাসময়ে আড্ডা বসিয়াছে। বংশলোচন এখনো বেড়াইয়া ফেরেন নাই। তার অন্তরঙ্গ বন্ধু বিনোদ উকীল ফরাসের উপর তাকিয়া ঠেস দিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন। বৃদ্ধ চাটুয্যে মহাশয় হুঁকো হাতে ঝিমাইতেছেন। নগেন ও উদয় অতি কষ্টে ক্রোধ রুদ্ধ করিয়া ওৎ পাতিয়া বসিয়া আছে, একটা ছুতা পাইলেই পরস্পরকে আক্রমণ করিবে।
আর চুপ করিয়া থাকিতে না পারিয়া উদয় বলিল- “যাই বল, বাঘের মাপ কখনই ল্যাজ-শুদ্ধ হতে পারে না। তা হলে মেয়েছেলেদের মাপও চুল-শুদ্ধ হবে না" কেন? আমার বোয়ের বিনুনীটাই ত তিন ফুট হবে। তবে কি বল্তে চাও, বউ আট ফুট লম্বা?”
নগেন বলিল-“দেখ উদো, তোর বোয়ের বর্ণন! আমরা মোটেই শুন্তে চাই না। বাঘের কথা বলতে হয় বল্।”
চাটুয্যে মহাশয়ের তন্দ্রী ছুটিয়া গেল। বলিলেন- “আঃ হা, তোমাদের এখানে কি বাঘ ছাড়া অন্য জানোয়ার নেই?”
এমন সময় বংশলোচন ছাগল লইয়া ফিরিলেন। বিনোদবাবু বলিলেন-বাহবা, বেশ পাঁঠাটি ত। কত, দিয়ে কিন্লে হে?”
বংশলোচন সমস্ত ঘটন? বিবৃত করিলেন। বিনোদ
‘দিব্বি পুরুষ্টু পাঁঠা’
বলিলেন—“বেওয়ারিস মাল, বেশীদিন ঘরে না রাখাই ভাল। সাবাড় করে ফেল,—কাল রবিবার আছে, লাগিয়ে দাও।”
চাটুয্যে মহাশয় ছাগলের পেট টিপিয়া বলিলেন—দিব্বি পুরুষ্টু পাঁঠা। খাসা কালিয়া হবে।”
নগেন ছাগলের ঊরু টিপিয়া বলিল— “উঁহু, হাঁড়িকাবাব। একটু বেশী করে আদা-বাঁটা আর প্যাজ।”
উদয় বলিল—“ওঃ, আমার বউ অ্যায়সা গুলি কাবাব করতে জানে!”
নগেন ভ্রূকুটি করিয়া বলিল— “উদো, আবার?”
বংশলোচন বিরক্ত হইয়া বলিলেন—“তোমাদের কি জন্তু দেখ্লেই খেতে ইচ্ছে করে? একটা নিরীহ অনাথ প্রাণী আশ্রয় নিয়েচে, তা কেবল কালিয়া আর কাবাব।”
ছাগলের সংবাদ শুনিয়া বংশলোচনের সপ্তম-বর্ষীয়া কন্যা টেঁপী এবং সর্ব্বকনিষ্ঠ পুত্র ঘেণ্টু ছুটিয়া আসিল। ঘেণ্টু বলিল—“ও বাবা, আমি পাঁঠা খাবো। পাঁঠার ম-ম-ম—"
বংশলোচন বলিলেন—“যা যাঃ, শুনে শুনে কেবল খাই খাই শিখ্চেন।”
ঘেণ্টু হাত-পা ছুড়িয়া বলিল— “হ্যাঁ আমি ম-ম-ম মেটুলী খাবো।”
টেঁপী বলিল—“বাবা, আমি পাঁঠাটাকে পুষবো একটু লাল ফিতে দাও না।”
বংশলোচন। বেশ ত একটু খাওয়া-দাওয়া করুক, তারপর নিয়ে খেলা করিস এখন।
টেঁপী। পাঁঠার নাম কি বল না?
বিনোদ বলিলেন—“নামের ভাবনা কি। ভাসুরক, দধিমুখ, মসীপুচ্ছ, লম্বকর্ণ—”
চাটুয্যে বলিলেন—“লম্বকর্ণ ই ভাল।”
বংশলোচন কন্যাকে একটু অন্তরালে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“টেঁপু, তোর মা এখন কি কচ্চে
টেঁপী। এক্ষুনি ত কল-ঘরে গেছে।
বংশলোচন। ঠিক জানিস্? তা হলে এখন এক ঘণ্টা নিশ্চিন্দি। দেখ্, ঝিকে বল্, চট্ করে ঘোড়ার ভেজানো-ছোলা চাট্টি এনে এই বাইরের বারান্দায় যেন ছাগলটাকে খেতে দেয়। আর দেখ্, বাড়ীর ভেতর নিয়ে যাস্নি যেন।
উৎসাহের আতিশয্যে টেঁপী পিতার আদেশ ভুলিয়া গেল। ছাগলের গলায় লাল ফিতা বাঁধিয়া টানিতে টানিতে অন্দর মহলে লইয়া গিয়া বলিল— “ও মা, শীগৃগির এস, লম্বকর্ণ দেখবে এস।”
মানিনী মুখ মুছিতে মুছিতে স্নানের ঘর হইতে বাহির হুইয়া বলিলেন—“আ মর্, ওটাকে কে আন্লে? দূর্ দূর্—ও ঝি, ও বাতাসি, শীগ্গির ছাগলটাকে বার করে দে,—ঝাঁটা মার্, ঝাঁটা মার্।”
টেঁপী বলিল—“বা রে, ওকে ত বাবা এনেচে, আমি পুষ্বো।”
ঘেণ্টু বলিল—“ঘোড়া ঘোড়া খেল্ব।”
মানিনী বলিলেন—“খেলা বার করে দিচ্চি। ভদ্দর লোকে আবার ছাগল পোষে! বেরো, বেরো—ও দরওয়ান, ও চুকন্দর সিং—”
“হজৌর” বলিয়া হাঁক দিয়া চুকন্দর সিং হাজির হইল। শীর্ণ খর্ব্বাকৃতি বৃদ্ধ, গালপাট্টা দাড়ি, পাকানে। গোঁফ, জাঁকালো গলা এবং ততোধিক জাঁকাল নাম,— ইহারই জোরে সে চোট্টা এবং ডাকুর আক্রমণ হইতে দেউড়ি রক্ষা করে।
অন্দরের মধ্যে হট্টগোল শুনিয়া রায়-বাহাদুর বুঝিলেন, যুদ্ধ অনিবার্য্য। মনে মনে তাল ঠুকিয়া বাড়ীর ভিতরে আসিলেন। গৃহিণী তাঁর প্রতি দৃক্পাত না করিয়া দরওয়ানকে বলিলেন—“ছাগলটাকে আভি নিকাল দেও, একদম ফটকের বাইরে। নেই ত এক্ষুনি ছিষ্টি নোংরা করেগা।”
চুকন্দর বলিল—“বহুৎ আচ্ছা।”
বংশলোচন পাল্টা হুকুম দিলেন—“দেখো চুকন্দর সিং, ‘এই বক্ড়ি গেটের বাইরে যাগা ত তোম্রা নোকরি ভি যাগা।”
চুকদর বলিল—“বহুৎ আচ্ছা।”
মানিনী স্বামীর প্রতি একটি অগ্নিময় নয়ন-বাণ হানিয়া বলিলেন—“হ্যাঁলা টেঁপী হতচ্ছাড়ি, রাত্তির হয়ে গেল —গিলতে হবে না? থাকিস্ তুই ছাগল নিয়ে, কাল যাচ্ছি আমি হাটখোলায়।” হাটখোলায় গৃহিণীর পিত্রালয়।
বংশলোচন বলিলেন—“টেঁপু, ঝিকে বলে দে, বৈঠকখানা ঘরে আমার শোবার বিছানা করে দেবে। আর সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। আর দেখ্, ঠাকুরকে বল্ আমি মাংস খাব না। শুধু খানকতক কচুরি, একটু ডাল আর পটলভাজা।”
পুরাকালে বড়লোকদের বাড়ীতে একটি করিয়া গোসা-ঘর থাকিত। ক্রুদ্ধা আর্য্যনারীগণ সেখানে আশ্রয় লইতেন। কিন্তু আর্যাপুত্রদের জন্য সে-রকম কোনো পাকা বন্দোবস্ত ছিল না, অগত্যা তাঁরা এক পত্নীর সহিত মতান্তর হইলে অপর এক পত্নীর দ্বারস্থ হুইতেন। আজকাল খরচ-পত্র বাড়িয়া ধাওয়ায় এই সকল সুন্দর প্রাচীন প্রথা লোপ পাইয়াছে। এখন মেয়েদের ব্যবস্থা শুইবার ঘরের মেঝের উপর মাদুর, অথবা তেমন তেমন হইলে বাপের বাড়ী। আর ভদ্রলোকদের একমাত্র আশ্রয় বৈঠকখানা।
আহারান্তে বংশলোচন বৈঠকখানা ঘরে একাকী শয়ন করিলেন। অন্ধকারে তাঁর ঘুম হয় না, এজন্য ঘরের এক কোণে পিলসুজের উপর একটা রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলিতেছে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করিয়া বংশলোচন উঠিয়া ইলেক্ট্রিক লাইট জ্বালিলেন এবং একখানি গীতা লইয়া পড়িতে বসিলেন। এই গীতাটি তাঁর দুঃসময়ের সম্বল,—পত্নীর সহিত অসহযোগ হইলে তিনি এটি লইয়া নাড়াচাড়া করেন এবং সংসারের অনিত্যতা উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করেন। কর্ম্মযোগ পড়িতে পড়িতে বংশলোচন ভাবিতে লাগিলেন—তিনি কি এমন অন্যায় কাজ করিয়াছেন, যার জন্য মানিনী এরূপ ব্যবহার করেন? বাপের বাড়ী যাবেন,—ইস্, ভারি তেজ! তিনি ফিরাইয়া আনিবার নামটি করিবেন না, যখন হইবে আপনিই ফিরিবে। গৃহিণী সখ করিয়া যে-সব জঞ্জাল ঘরে পোরেন, তাহা ত বংশলোচন নীরবে বরদাস্ত করেন। এই ত সেদিন পনরটা জলচৌকি, তেইশটা বঁটি এবং আড়াই শ টাকার খাগ্ড়াই বাসন কেনা হইয়াছে, আর দোষ হইল কেবল ছাগলের বেলা? হুঁঃ, যতো সব—। বংশলোচন গীতাখানি সরাইয়া রাখিয়া আলোর সুইচ্ বন্ধ করিলেন এবং ক্ষণকাল পরে নাসিকাধ্বনি করিতে লাগিলেন।
লম্বকর্ণ বারান্দায় শুইয়া রোমন্থন করিতেছিল। দুটা বর্ম্মা চুরুট খাইয়া তার ঘুম চটিয়া গিয়াছে। রাত্রি একটা আন্দাজ জোরে হাওয়া উঠিল। ঠাণ্ডা লাগায় সে বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল। বৈঠকখানা ঘর হইতে মিট্মিটে আলো দেখা যাইতেছে। লম্বকর্ণ তার বন্ধন-রজ্জু চিবাইয়া কাটিয়া ফেলিল, এবং দরজা খোলা পাইয়া নিঃশব্দে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল।
আবার তার ক্ষুধা পাইয়াছে। ঘরের চারিদিকে ঘুরিয়া একবার তদারক করিয়া লইল। ফরাসের এক কোণে একগোছা খবরের কাগজ রহিয়াছে। চিরাইয়া দেখিল, অত্যন্ত নীরস। অগত্যা সে গীতার তিন অধ্যায় উদরস্থ করিল। গীতা খাইয়া গলা শুখাইয়া গেল। একটা উঁচু তেপায়ার উপর এক কুঁজা জল আছে; কিন্তু তাহা নাগাল পাওয়া যায় না। লম্বকর্ণ তখন প্রদীপের কাছে গিয়া রেড়ির তেল চাখিয়া দেখিল, বেশ সুস্বাদু। চক্ চক্ করিয়া সবটা খাইল। নিবিল।
বংশলোচন স্বপ্ন দেখিতেছেন, সন্ধিস্থাপন হইয়া গিয়াছে। হঠাৎ পাশ ফিরিতে তাঁর একটা নরম গরম স্পন্দনশীল স্পর্শ অনুভব হইল। নিদ্রা-বিজড়িত স্বরে বলিলেন—“কখন এলে?” উত্তর পাইলেন—“হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ।”
হুলস্থুল কাণ্ড। চোর চোর—বাঘ হ্যায়—এই চুকন্দর সিং—জল্দি আও— নগেন—উদো—শীগ্গির আয়— মেরে ফেল্লে।
চুকন্দর তার মুঙ্গেরী বন্দুকে বারুদ ভরিতে লাগিল। নগেন ও উদয় লাঠি ছাতা টেনিস ব্যাট যা পাইল তাই লইয়া ছুটিল। মানিনী ব্যাকুল হইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে নামিয়া আসিলেন। বংশলোচন ক্রমে প্রকৃতিস্থ হইলেন। লম্বকর্ণ দু’এক ঘা মার খাইয়া ব্যা ব্যা করিতে লাগিল। বংশলোচন ভাবিলেন, বাঘ বরঞ্চ ছিল ভাল। মানিনী ভাবিলেন, ঠিক হয়েচে।
ভোর বেলা বংশলোচন চুকন্দরকে পাড়ায় খোঁজ লইতে বলিলেন—কোনো ভালা আদমি ছাগল পুষিতে রাজি আছে কি না। যে-সে লোককে তিনি ছাগল দিবেন না। এমন লোক চাই, যে যত্ন করিয়া প্রতিপালন করিবে, টাকার লোভে বেচিবে না, মাংসের লোভে মারিবে না।
আটটা বাজিয়াছে। বংশলোচন বহির্ব্বাটীর বারান্দায় চেয়ারে বসিয়া আছেন, নাপিত কামাইয়া দিতেছে। বিনোদবাবু ও নগেন অমৃতবাজারে ড্যালহাউসি ভার্সস্ মোহনবাগান পড়িতেছেন। উদয় ল্যাংড়া আমের দর করিতেছে। এমন সময় চুকন্দর আসিয়া সেলাম করিয়া বলিল—“লাটুবাবু আয়ে হেঁ।”
তিনজন সহচরের সহিত লাটুবাবু বারান্দায় আসিয়া নমস্কার করিলেন। তাঁহাদের প্রত্যেকের বেশভূষা প্রায় একই প্রকার,—ঘাড়ের চুল আমুল ছাঁটা, মাথার উপর পর্ব্বতাকার তেড়ি, রগের কাছে দু গোছা চুল ফণা ধরিয়া আছে। হাতে রিষ্ট-ওয়াচ, গায়ে আগুল্ফলম্বিত পাতলা পাঞ্জাবী, তার ভিতর দিয়া গোলাবী গেঞ্জির আভা দেখা যাইতেছে। পায়ে লপেটা, কাণে অর্দ্ধদগ্ধ সিগারেট।
বংশলোচন বলিলেন—“আপনাদের কোত্থেকে আসা হচ্চে?”
লাটুবাবু বলিলেন—“আমরা বেলেঘাটা কেরাসিন ব্যাণ্ড। ব্যাণ্ড-মাষ্টার লটবর লন্দী —অধীন। লোকে লাটুবাবু বলে ডাকে। শুন্লুম, আপনি একটি পাঁঠা বিলিয়ে দেবেন, তাই সঠিক খবর লিতে এসেচি।”
বিনোদ বলিলেন—“আপনারা বুঝি কানেস্তারা বাজান?”
লাটু। কালেস্তারা কি মশায়? দস্তুরমত কল্সাট। এই ইনি লবীন লিয়োগী ক্লারিয়লেট,—এই লরহরি লাগ ফুলোট,—এই লবকুমার লন্দন ব্যায়লা। তা ছাড়া কর্লেট, পিক্লু, হারমোনিয়া, ঢোল, কত্তাল সব লিয়ে ঊলিশজন আছি। বর্ম্মা অয়েল কোম্পানির ডিপোয় আমরা কাজ করি। ছোট-সাহেবের সেদিন বে হল, ফিষ্টি দিলে, আমরা বাজালুম, সাহেব খুশী হয়ে টাইটিল দিলে—কেরাসিন ব্যাণ্ড।
বংশলোচন। দেখুন, আমার একটি ছাগল আছে, সেটি আপনাকে দিতে পারি, কিন্তু—
লাটু। আমরা হলুম ঊলিশটি প্রালী, একটা পাঁঠায় কি হবে মশায়? কি বল হে লরহরি?
নরহরি। লস্যি, লস্যি।
বংশলোচন। আমি এই সর্ত্তে দিতে পারি যে, ছাগলটিকে আপনি যত্ন করে মানুষ করবেন, বেচতে পারবেন না, মারতে পারবেন না।
লাটু। এ যে আপনি লতুন কথা বল্চেন মশায়। ভদ্দর লোকে কখনো ছাগল পোষে?
নরহরি। পাঁঠি নয় যে দুধ দেবে।
নবীন। পাখী লয় যে পড়বে।
নবকুমার। ভেড়া লয় যে কম্বল হবে।
বংশলোচন। সে যাই হোক। বাজে কথা বলবার আমার সময় নেই। নেবেন কি না বলুন।
লাটুবাবু ঘাড় চুলকাইতে লাগিলেন। নরহরি বলিলেন—“লিয়ে লাও হে লাটুবাবু লিয়ে লাও। ভদ্দর নোক বলচেন অভ করে।”
বংশলোচন। কিন্তু মনে থাকে যেন, বেচতে পারবে না, কাটতে পারবে না।
লাটু। সে আপনি ভাববেন না। লাটুলন্দীর কথার লড়চড় লেই।
লম্বকর্ণকে লইয়া বেলেঘাটা কেরাসিন ব্যাণ্ড চলিয়া গেল। বংশলোচন বিমর্ষচিত্তে বলিলেন—“ব্যাটাদের দিয়ে ভরসা হচ্চে না।” বিনোদ আশ্বাস দিয়া বলিলেন —“ভেবো না হে, তোমার পাঁঠা গন্ধর্ব্বলোকে বাস করবে। ফাঁকে পড়লুম আমরা।”
সন্ধ্যার আড্ডা বসিয়াছে। আজও বাঘের গল্প চলিতেছে। চাটুয্যে মহাশয় বলিতেছিলেন—“সেটা তোমাদের ভুল ধারণা। বাঘ ব’লে একটা ভিন্ন জানোয়ার নেই। ও একটা অবস্থার ফের, আরসোলা হতে যেমন কাঁচপোকা। আজই তোমরা ডারউইন্ শিখেচ,— আমাদের ওসব ছেলেবেলা থেকেই জানা আছে। আমাদের রায় বাহাদুর ছাগলটা বিদেয় করে খুব ভাল কাজ করেচেন। কেটে খেয়ে ফেলতেন ত কথা ছিল না, কিন্তু বাড়ীতে রেখে বাড়তে দেওয়া,—উহু।”
বংশলোচন একখানি নূতন গীতা লইয়া নিবিষ্টচিত্তে অধ্যয়ন করিতেছেন—নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ, অর্থাৎ কিনা আত্মা একবার হইয়া আর যে হুইবে না তা নয়। অজো নিত্যঃ—অজো কিনা—ছাগলং। ছাগলটা যখন বিদায় হইয়াছে, তখন আজ সন্ধিস্থাপনা হইলেও হইতে পারে।
বিনোদ বংশলোচনকে বলিলেন—“হে কৌন্তেয়, তুমি শ্রীভগবানকে একটু থামিয়ে রেখে একবার চাটুয্যে মশায়ের কথাটা শোনো। মনে বল পাবে।”
উদয় বলিল—“আমি সেবার যখন সিমলেয় যাই—”
নগেন। মিছে কথা বলিস্ নি উদো। তোর দৌড় আমার জানা আছে, লিলুয়া অব্ধি।
উদয়। বাঃ, আমার দাদাশ্বশুর যে সিমলেয় থাকতেন। বউ ত সেইখানেই বড় হয়। তাই ত রং অত—
নগেন। খবরদার উদো।
চাটুয্যে। যা বল্ছিলুম শোনো। আমাদের মজিলপুরের চরণ ঘোষের এক ছাগল ছিল, তার নাম ভুটে। ব্যাটা খেয়ে খেয়ে হল ইয়া লাস, ইয়া শিং, ইয়া দাড়ি। একদিন চরণের বাড়ীতে ভোজ,—লুচি, পাঁঠার কালিয়া, এই সব। আঁচাবার সময় দেখি, ভুটে পাঁঠার মাংস খাচ্চে। বল্লুম—দেখ্চ কি চরণ, এখুনি ছাগলটাকে বিদেয় কর,—কাচ্চাবাচ্ছা নিয়ে ঘর কর, প্রাণে ভয় নেই? চরণ শুনলে না। গরীবের কথা বাসি হলে ফলে। তার পরদিন থেকে ভুটে নিরুদ্দেশ। খোঁজ খোঁজ কোথা গেল। এক বচ্ছর পরে —মশায় সেই ছাগল সোঁদর-বনে পাওয়া গেল। শিং নেই বল্লেই হয়, দাড়ি প্রায় খসে গেছে, মুখ একবারে হাঁড়ি, বর্ণ হয়েচে যেন কাঁচা হলুদ, আর তার ওপর দেখা দিয়েচে মশায় —আঁজি আঁজি ডোরা ডোরা। ডাক! হল—ভুটে,
‘ভুটে বল্লে—হালুম্’
ভুটে। ভুটে বল্লে—হালুম্। লোকজন দূর থেকে নমস্কার ফরে ফিরে এল।
“লাটুবাবু আয়ে হেঁ।”
সপারিষদ্ লাটুবাবু প্রবেশ করিলেন। লম্বকর্ণও সঙ্গে আছে। বিনোদ বলিলেন—“কি ব্যাণ্ড-মাষ্টার, আবার কি মনে করে?”
লাটুবাবুর আর সে লাবণ্য নাই। চুল উস্ক খুস্ক, চোখ বসিয়া গিয়াছে, জামা ছিঁড়িয়া গিয়াছে। সজলনয়নে হাঁউ মাউ করিয়া বলিলেন—“সর্ব্বনাশ হয়েচে মশায়, ধনে প্রাণে মেরেচে। ও হোঃ হোঃ হো।”
নরহরি বলিলেন—“আঃ কি কর লাটুবাবু একটু থির হও। হুজুর যখন রয়েচেন, তখন একটা বিহিত করবেনই।”
বংশলোচন ভীত হইয়া বলিলেন—“কি হয়েচে—ব্যাপার কি?”
লাটু। মশায়, ওঁই পাঁঠাটা—
চাটুয্যে বলিলেন—“হুঁ, বলেছিলুম কি না?”
লাটু। ঢোলের চামড়া কেটেচে, ব্যায়লার তাঁত খেয়েচে, হারমোনিয়ার চাবী সমস্ত চিবিয়েচে। আর —আর—আমার পাঞ্জাবীর পকেট কেটে লব্বই টাকার লোট—ও হো হো হো।
নরহরি। গিলে ফেলেচে। পাঁঠা নয় হুজুর
‘মরচি টাকার শোকে, আর আপনি বল্চেন জোলাপ খেতে?’
সয়তান। সর্ব্বস্ব গেছে, লাটুর প্রাণটি কেবল আপনার ভরসায় এখনো ধুক্পুক্ করচে।
বংশলোচন। ফ্যাসাদে ফেল্লে দেখচি।
নরহরি। দোহাই হুজুর, লাটুর দশাটা একবার দেখুন, একটা ব্যবস্থা করে দিন,—বেচারা মারা যায়।
বংশলোচন ভাবিয়া বলিলেন—“একটা জোলাপ দিলে হয় না?”
লাটুবাবু উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলিলেন—“মশায়, এই কি আপনার বিবেচনা হল? মরচি টাকার শোকে, আর আপনি বলচেন জোলাপ খেতে?”
বংশলোচন। আরে তুমি খাবে কেন,—ছাগলটাকে দিতে বল্চি।
নরহরি। হায় হায়, হুজুর এখনো ছাগল চিন্লেন না। কোন্ কালে হজম করে ফেলেচে। লোট ত লোট,—ব্যায়লার তাঁত, ঢোলের চামড়া, হারমোনিয়ার চাবী, মায় ইষ্টিলের কত্তাল।
বিনোদ। লাটুবাবুর মাথাটি কেবল আস্ত রেখেচে।
বংশলোচন বলিলেন—“যা হবার তা ত হয়েছে। এখন বিনোদ, তুমিই একটা খেসারৎ ঠিক করে দাও। (বেচারার লোকসান যাতে না হয়, আর আমার ওপর বেশী জুলুমও না হয়।’ ছাগলটা বাড়ীতেই থাকুক, কাল যা হয় করা যাবে।”
অনেক দরদস্তুরের পর এক শ টাকায় রফা হইল। বংশলোচন বেশী কষাকষি করিতে দিলেন না। লাটুবাবুর দল টাকা লইয়া চলিয়া গেল।
লম্বকর্ণ ফিরিয়াছে শুনিয়া টেঁপী ছুটিয়া আসিল। বিনোদ বলিলেন—“ও ঢেঁপুরাণী, শীগ্গির গিয়ে তোমার মাকে ব’ল কাল আমরা এখানে খাবো, —লুচি, পোলাও, মাংস—”
টেঁপী। বাবা আর মাংস খায় না।
বিনোদ। বল কি! হ্যাঁ হে বংশু, প্রেমটা একটা পাঁঠা থেকে বিশ্ব-পাঁঠায় পৌঁছেচে না কি? আচ্ছা, তুমি না খাও, আমরা আছি। যাও ত টেঁপু, মাকে বল সব যোগাড় করতে।
টেঁপী। সে এখন হচ্চে না। মা বাবার ঝগড়া চলচে, কথাটি নেই।
বংশলোচন ধমক দিয়া বলিলেন—“হ্যাঁ হ্যাঁ—কথাটি নেই,—তুই সব জানিস। যা যাঃ, ভারি জ্যাঠা হয়েছিস।”
টেঁপী। বা-রে, আমি বুঝি কিছু টের পাই না? তবে কেন মা খালি খালি আমাকে ব’লে —টেঁপী, পাখাটা মেরামত করাতে হবে, —টেঁপী, এমাসে আরো দু’শ টাকা চাই। তোমাকে বলে না কেন?
বংশলোচন। থাম্ থাম্, বকিস্ নি।
বিনোদ। হে রায় বাহাদুর, কন্যাকে বেশী ঘাঁটিও না, অনেক কথা ফাঁস করে দেবে। অবস্থাটা সঙীন হয়েচে বল?
বংশলোচন। আরে এতদিন ত সব মিটে যেত, ঐ ছাগলটাই মুস্কিল বাধালে।
বিনোদ। ব্যাটা ঘরভেদী বিভীষণ। তোমারই বা অত মায়। কেন? খেতে না পার বিদেয় করে দাও। জলে বাস কর, কুমীরের সঙ্গে বিবাদ কোরো না।
বংশলোচন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—“দেখি, কাল যা হয় করা যাবে।”
এ রাত্রিও বংশলোচন বৈঠকখানায় বিরহ-শয়নে যাপন করিলেন। ছাগলটা আস্তাবলে বাঁধা ছিল, উপদ্রব করিবার সুবিধা পায় নাই।
পরদিন বৈকালে সাড়ে পাঁচটার সময় বংশলোচন বেড়াইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া একবার এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিলেন, কেহ তাঁকে লক্ষ্য করিতেছে কি না। গৃহিণী ও ছেলেমেয়েরা উপরে আছে। ঝি-চাকর অন্দরে কাজকর্ম্মে ব্যস্ত। চুকন্দর সিং তার ঘরে বসিয়া আটা সানিতেছে। লম্বকর্ণ আস্তাবলের কাছে বাঁধা আছে এবং দড়ির সীমার মধ্যে যথাসম্ভব লম্ফঝম্ফ করিতেছে। বংশলোচন দড়ি হাতে করিয়া ছাগলকে লইয়া আস্তে আস্তে বাহির হইলেন।
পাছে পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হয় সেজন্য বংশলোচন সোজা রাস্তায় না গিয়া গলি-ঘুঁজির ভিতর দিয়া চলিলেন। পথে এক ঠোঙা জিলিপী কিনিয়া পকেটে রাখিলেন। ক্রমে লোকালয় হইতে দূরে আসিয়া জনশূন্য খালধারে পৌঁছিলেন।
আজ তিনি স্বহস্তে লম্বকর্ণকে বিসর্জ্জন দিবেন, যেখানে পাইয়াছিলেন আবার সেখানেই ছাড়িয়া দিবেন, —যা থাকে তার কপালে। যথাস্থানে আসিয়া বংশলোচন জিলিপীর ঠোঙাটি ছাগলকে খাইতে দিলেন। পকেট হইতে এক টুকরা কাগজ বাহির করিয়া তাহাতে লিখিলেন
এই ছাগল বেলেঘাটা খালের ধারে কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। প্রতিপালন করিতে না পারায় আবার সেখানেই ছাড়িয়া দিলাম। আল্লা কালী যিশুর দিব্য ইহাকে কেহ মারিবেন না।
লেখার পর কাগজ ভাঁজ করিয়া একটা ছোট টিনের —কৌটায় ভরিয়া লম্বকর্ণের গলায় ভাল করিয়া বাঁধিয়া দিলেন। তারপর বংশলোচন শেষবার ছাগলের গায়ে হাত বুলাইয়া আস্তে আস্তে সরিয়া পড়িলেন। লম্বকর্ণ তখন আহারে ব্যস্ত।
দূরে আসিয়াও বংশলোচন বারবার পিছু ফিরিয়া দেখিতে লাগিলেন। লম্বকর্ণ আহার শেষ করিয়া এদিক ওদিক চাহিতেছে। যদি তাঁহাকে দেখিয়া ফেলে এখনি পশ্চাদ্ধাবন করিবে। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। বংশলোচন জোরে জোরে চলিতে লাগিলেন।
আর পারা যায় না, হাঁফ ধরিতেছে। পথের ধারে একটা তেঁতুল গাছের তলায় বংশলোচন বসিয়া পড়িলেন। লম্বকর্ণকে আর দেখা যায় না। এইবার তাঁর মুক্তি,— আর কিছুদিন দেরি করিলে জড়ভরতের অবস্থা হইত। ঐ হতভাগা কৃষ্ণের জীবকে আশ্রয় দিতে গিয়া তিনি নাকাল হইয়াছেন। গৃহিণী তার উপর মর্মান্তিক রুষ্ট, আত্মীয়স্বজন তাকে খাইবার জন্য হাঁ করিয়া আছে,— তিনি একা কাঁহাতক সামলাইবেন? হায় রে সত্যযুগ, যখন শিবিরাজা শরণাগত কপোতের জন্য প্রাণ দিতে গিয়াছিলেন,—মহিষীর ক্রোধ, সভাসদ্বর্গের বেয়াদবি, কিছুই তাঁকে ভোগ করিতে হয় নাই।
দ্রুম দুদ্দুড়ূ দুড়ূ জুড় দড়ড়ড় ড়। আকাশে কে ঢেঁটরা পিটিতেছে? বংশলোচন চমকিত হইয়া উপরে চাহিয়া দেখিলেন, অন্তরীক্ষের গম্বুজে এক পোঁচ সীসা-রঙের অস্তর মাখাইয়া দিয়াছে। দূরে এক ঝাঁক সাদা বক জোরে পাখা চালাইয়া পলাইতেছে। সমস্ত চুপ,— গাছের পাতাটি নড়িতেছে না। আসন্ন দুর্যোগের ভয়ে স্থাবর জঙ্গম হতভম্ব হইয়া গিয়াছে। বংশলোচন উঠিলেন, কিন্তু আবার বসিয়া পড়িলেন। জোরে হাঁটার ফলে তাঁর বুক ধড়ফড় করিতেছিল।
সহসা আকাশ চিড় খাইয়া ফাটিয়া গেল। এক ঝলক বিদ্যুৎ, —কড় কড় কড়াৎ,—ফাটা আকাশ আবার বেমালুম জুড়িয়া গেল। ঈশানকোণ হইতে একটা ঝাপসা পর্দ্দা তাড়া করিয়া আসিতেছে। তার পিছনে যা কিছু সমস্ত মুছিয়া গিয়াছে, সামনেও আর দেরি নাই। ঐ এল, ঐ এল! গাছপালা শিহরিয়া উঠিল। লম্বা লম্বা তালগাছগুলা প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়া আপত্তি জানাইল। কাকের দল আর্ত্তনাদ করিয়া উড়িবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ঝাপ্টা খাইয়া আবার গাছের ডাল আঁকড়াইয়া ধরিল। প্রচণ্ড ঝড়, প্রচণ্ডতর বৃষ্টি। যেন এই নগণ্য উইঢিবি,—এই ক্ষুদ্র কলিকাতা সহরকে ডুবাইবার জন্য স্বর্গের তেত্রিশ কোটি দেবতা সার বাঁধিয়া বড় বড় ভৃঙ্গার হইতে তোড়ে জল ঢালিতেছেন। মোটা নিরেট জলধারা, তার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ফোঁটা। সমস্ত শূন্য ভরাট হইয়া গিয়াছে।
মান-ইজ্জৎ কাপড়-চোপড় সবই গিয়াছে, এখন প্রাণটা রক্ষা পাইলে হয়। হা রে হতভাগা ছাগল, কি কুক্ষণে,
বংশলোচনের চোখের সামনে একটা উগ্র বেগুনি আলো খেলিয়া গেল— সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সঞ্চিত বিশ লক্ষ ভোল্ট, ইলেক্ট্রিসিটি অদূরবর্ত্তী একটা নারিকেল গাছের ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করিয়া বিকট নাদে ভূগর্ভে প্রবেশ। করিল।
রাশি রাশি সরিষার ফুল। জগৎ লুপ্ত, তুমি নাই, আমি নাই। বংশলোচন সংজ্ঞা হারাইয়াছেন।
বৃষ্টি থামিয়াছে কিন্তু এখনো সোঁ সোঁ করিয়া হাওয়া চলিতেছে। ছেঁড়া মেঘের পর্দ্দা ঠেলিয়া দেবতারা দু’চারটা মিট্মিটে তারার লণ্ঠন লইয়া নীচের অবস্থা তদারক করিতেছেন।
বংশলোচন কর্দ্দম-শয্যায় শুইয়া ধীরে ধীরে সংজ্ঞা লাভ করিলেন। তিনি কে? রায় বাহাদুর। কোথায়? খালের নিকট। ও কিসের শব্দ? সোনাব্যাং। তাঁর নষ্টস্মৃতি ফিরিয়া আসিয়াছে ছাগলটা?
মানুষের স্বর কাণে আসিতেছে। কে তাঁকে ডাকিতেছে? “মামা-জামাইবাবু—বংশু আছ?— হজৌর—"
অদূরে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। জনকতক লোক লণ্ঠন লইয়া ইতস্ততঃ ঘুরিতেছে এবং তাঁহাকে ডাকিতেছে। একটি পরিচিত নারীকণ্ঠে ক্রন্দনধ্বনি উঠিল।
রায় বাহাদুর চাঙ্গা হইয়া বলিলেন—“এই যে আমি এখানে আছি—ভয় নেই—”
মানিনী বলিলেন—“আজ আর দোতলায় উঠে কাজ নেই। ও ঝি, এই বৈঠকখানা ঘরেই বড় করে বিছানা করে দে ত। আর দেখ, আমার বালিসটাও দিয়ে যা। আঃ, চাটুয্যে মিন্সে নড়ে না। ও কি—সে হবে না, এই গরম লুচি ক’খানি খেতেই হবে, মাথা খাও। তোমার সেই বোতলটায় কি আছে— তাই একটু চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেব নাকি?”
হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ—”
বংশলোচন লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন—“অ্যাঁ, ওটা আবার এসেচে? নিয়ে আয় ত লাঠিটা—” মানিনী বলিলেন—“আহা করো কি, মেরো না। ও বেচারা বৃষ্টি থাম্তেই ফিরে এসে তোমার খবর দিয়েচে। তাইতেই তোমায় ফিরে পেলুম। ওঃ, হরি মধুসূদন!”
লম্বকর্ণ বাড়ীতেই রহিয়া গেল, এবং দিন দিন শশিকলার ন্যায় বাড়িতে লাগিল। ক্রমে তার আধ হাত দাড়ি গজাইল। রায়-বাহাদুর আর বড়-একটা খোঁজখবর করেন না, তিনি এখন ইলেকশন্ লইয়া ব্যস্ত। মানিনী লম্বকর্ণের শিং কেমিক্যাল সোণা দিয়া বাঁধাইয়া দিয়াছেন। তার জন্য সাবান ও ফিনাইল ব্যবস্থা হইয়াছে, কিন্তু বিশেষ ফল হয় নাই। লোকে দূর হইতে তাকে বিদ্রূপ করে। লম্বকর্ণ গম্ভীরভাবে সমস্ত শুনিয়া যায়,—নিতান্ত বাড়াবাড়ি করিলে বলে—“ব-ব-ব”—অর্থাৎ, যত ইচ্ছা হয় বকিয়া যাও, আমি ও-সব গ্রাহ্য করি না।