বক্তৃতা-গৃহ। উচ্চ বেদীর উপর আচার্য্যের আসন। বেদীর নীচে ছাত্রদের জন্য শ্রেণীবদ্ধ চেয়ার ও বেঞ্চ।

প্রথম শ্রেণীতে আছেন—

হোমরাও সিং
চোমরাও আলি
খুদীন্দ্রনারায়ণ
মিষ্টার গ্র্যাব
মিষ্টার হাউলার

মহারাজা
নবাব
জমিদার
বণিক
সম্পাদক ইত্যাদি

দ্বিতীয় শ্রেণীতে—

মিষ্টার গুহা
নিতাইবাবু
প্রফেসার গুঁই
রূপচাঁদ
লুটবেহারী
গাঁট্টালাল
তেওয়ারী

রাজনীতিজ্ঞ
সম্পাদক
অধ্যাপক
বণিক
ইনসল্‌ভেণ্ট
গেঁড়াতলার সর্দার
জমাদার ইত্যাদি

তৃতীয় শ্রেণীতে—

মিষ্টার গুপ্টা
সরেশচন্দ্র
নিরেশচন্দ্র
দীনেশচন্দ্র

বিশেষজ্ঞ
নূতন গ্রাজুয়েট
 
কেরাণী ইত্যাদি

চতুর্থ শ্রেণীতে—

পাঁচু মিয়া
গবেশ্বর
কাঙালীচরণ
আরো অনেক লোক।

মজুর
মাষ্টার
নিষ্কর্ম্মা

প্রথম শ্রেণীর কথা

 মিষ্টার গ্র্যাব। হ্যাল্লো মহারাজা, আপনিও দেখচি ক্লাসে জয়েন করেচেন।

 হোমরাও সিং। হ্যাঁ, ব্যাপারটা জানবার জন্য বড়ই কৌতূহল হয়েচে। আচ্ছা, এই জগদ‍্গুরু লোকটি কে?

 গ্র্যাব। কিছুই জানি না। কেউ বলে, এঁর নাম ভ্যাণ্ডারল্যুট্, আমেরিকা থেকে এসেছেন; আবার কেউ বলে, ইনিই প্রফেসার ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন্। ফাদার ও’ব্রায়েন্ সেদিন বল্‌ছিলেন, লোকটি devil himself—সয়তান স্বয়ং। অথচ রেভারেণ্ড ফিগস্ বলেন, ইনি পৃথিবীর বিজ্ঞতম ব্যক্তি, একজন superman. একটা কমপ্লিমেণ্টারি টিকিট পেয়েছি, তাই মজা দেখতে এলুম।

 মিষ্টার হাউলার। আমিও একখান পেয়েচি।

 হোমরাও। বটে? আমরা ত টাকা দিয়ে কিনেচি, তাও অতি কষ্টে। হয় ত জগদ‍্গুরু জানেন যে আপনাদের শেখবার কিছু নেই, তাই কমপ্লিমেণ্টারি টিকিট দিয়েছেন।

 খুদীন্দ্রনারায়ণ। শুনেচি লোকটি না কি বাঙালি, বিলাত থেকে ভোল ফিরিয়ে এসেচে। আচ্ছা,বলশেভিক নয় ত?

 চোমরাও আলি। না না, তা হলে গভমেণ্ট এ লেক্‌চার বন্ধ করে দিতেন। আমার মনে হয়, জগদ‍্গুরু তুর্কি থেকে এসেচেন।

 হাউলার। দেখাই যাবে লোকটি কে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর কথা

 নিতাইবাবু। জগদ‍্গুরু কোথা উঠেচেন জানেন কি? একবার ইণ্টারভিউ করতে যাব।

 মিষ্টার গুহা। শুনেচি, বেঙ্গল ক্লাবে আছেন।

 রূপচাঁদ। না—না, আমি জানি, পগেয়াপটিতে বাসা নিয়েচেন।

 লুটবেহারী। আচ্ছা, উনি যে মহাবিদ্যার ক্লাস খুল্‌চেন, সেটা কি? ছেলেবেলায় ত পড়েছিলুম—কালী, তারা, মহাবিদ্যা—

 প্রফেসার গুঁই। আরে, সে বিদ্যা নয়। মহাবিদ্যা—কি না সকল বিদ্যার সেরা বিদ্যা, যা আয়ত্ত হলে মানুষের অসীম ক্ষমতা হয়, সকলের উপর প্রভুত্ব লাভ হয়।

 রূপচাঁদ। এখানে ত দেখচি হাজারো লোক লেক্‌চার শুন‍্তে এসেচে। সকলেরই যদি প্রভুত্ব লাভ হয়, তবে ফরমাস খাটবে কে?

 গাঁট্টালাল। এইজন্যে ভাবচেন? আপনি হুকুম দিন, আমি আর তেওয়ারী দুই দোস্ত্ মিলে সবাইকে হাঁকিয়ে দিচ্চি। কিছু পান খেতে দেবেন—

 তেওয়ারী। না—না, এখন গগুগোল বাধিও না,— সাহেবরা রয়েছেন।

তৃতীয় শ্রেণীর কথা

 সরেশ। আপনিও বুঝি এই বৎসর পাশ করেচেন? কোন্ লাইনে যাবেন, ঠিক করলেন?

 নিরেশ। তা কিছুই ঠিক করিনি। সেজন্যই ত মহাবিদ্যার ক্লাসে ভর্তি হয়েচি,—যদি একটা রাস্তা পাওয়া যায়। আচ্ছা, এই কোর্স অফ লেকচার্স আয়োজন করলে কে?

 সরেশ। কি জানি মশায়। কেউ বলে, বিলাতের কোন দয়ালু ক্রোরপতি জগদ‍্গুরুকে পাঠিয়েচেন। আবার শুনতে পাই, ইউনিভার্সিটিই না কি লুকিয়ে এই লেক্‌চারের খরচ জোগাচ্চে।

 মিষ্টার গুপ্টা। ইউনিভার্সিটির টাকা কোথা? যেই টাকা দিক, মিথ্যে অপব্যয় হচ্ছে। এ রকম লেক‍্চারে দেশের উন্নতি হবে না। ক্যাপিট্যাল চাই, ব্যবসা চাই।

 দীনেশ। তবে আপনি এখানে এলেন কেন? এই সব রাজা-মহারাজারাই বা কিজন্য ক্লাস অ্যাটেণ্ড করচেন? নিশ্চয়ই একটা লাভের প্রত্যাশা আছে। এই দেখুন না, আমি সামান্য মাইনে পাই তবু ধার করে লেক্‌চারের ফি জমা দিয়েচি। যদি কিছু অবস্থার উন্নতি করতে পারি।

 সরেশ। জগদ‍্গুরু আসবেন কখন? ঘণ্টা যে কাবার হয়ে এল।

চতুর্থ শ্রেণীর কথা

 গবেশ্বর। কিহে পাঁচুমিয়া, এখানে কি মনে করে?”

 পাঁচুমিয়া। বাবুজি, এক টাকা রোজে আর দিন চলে না। তাই থারিয়া-লোটা বেচে একটা টিকিট কিনেচি, যদি একটা হদিস পাই। তা আপনারা এত পিছে বসেচেন কেন হুজুর? সাম‍্নে গিয়ে বাবুদের সাথ বসুন না।

 কাঙালীচরণ ভয় করে।

 গবেশ্বর। আমরা বেশ নিরিবিলিতে আছি। পাঁচু, তুমি যদি বক্তৃতার কোনো যায়গা বুঝতে না পার, ত আমাকে জিজ্ঞেসা কোরো।

 ঘণ্টাধ্বনি। জগদ্গুরুর প্রবেশ। মাথায় সোনার মুকুট, মুখে মুখোস, গায়ে গেরুয়া আলখাল্লা। তিনি আসিয়া বহির্ব্বাস খুলিয়া ফেলিলেন। মাথা কামানো, গায়ে তেল, পরনে লেংটি, ডানহাতে বরাভয়, বাঁ-হাতে সিঁদকাঠি। পট্‌-পট হাততালি।


 হোমরাও। লোকটির চেহারা কি বীভৎস! চেনেন নাকি মিষ্টার গ্র্যাব?

 গ্র্যাব। চেনা চেনা বোধ হচ্চে।

 জগদ‍্গুরু। হে ছাত্রগণ, তোমাদের আশীর্ববাদ করচি, জগজ্জয়ী হও। আমি যে বিদ্যা শেখাতে এসেচি, তার জন্য অনেক সাধনা দরকার,—তোমরা একদিনে সব বুঝতে পারবে না। আজ আমি কেবল ভূমিকা মাত্র বল‍্ব। হে বালকগণ, তোমরা মন দিয়ে শোনো,—যেখানে খট‍্কা ঠেকবে, আমাকে নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করবে।

 প্রফেসার গুঁই। আমি strongly আপত্তি করচি—জগদ‍্গুরু কেন আমাদের ‘বালকগণ—তোমরা’ বলবেন; ‘আমরা কি স্কুলের ছোকরা? এটা একটা respectable gathering. এই মহারাজা হোমরাও সিং, নবার চোমরাও আলি রয়েছেন। পদমর্যাদা যদি না ধরেন, বয়সের একটা সম্মান ত আছে। আমাদের মধ্যে অনেকের বয়স ষাট পেরিয়েচে।

 হাউলার। আপনাদের বাংলা ভাষার দোষ। জগদ‍্গুরু বিদেশী লোক, ‘আপনি’ ‘তুমি' গুলিয়ে ফেলেচেন। আর ‘বালক’ কথাটা কিছু নয়, ইংরাজির ওল্ড বয়।

 খুদীন্দ্র। বাংলা ভাল না জানেন ত ইংরাজিতে বলুন না।

 গুৎই। যাই হোক, আমি আপত্তি করচি।

 মিষ্টার গুহা। আমি আপত্তির সমর্থন করচি।

 জগদ‍্গুরু সহাস্যে। বৎস, উতলা হয়ো না। আমি বাংলা ভালই জানি। বাংলা, ইংরাজি, ফরাসী, জাপানী, সবই আমার মাতৃভাষা। আমি প্রবীণ লোক, দশ-বিশ হাজার বৎসর ধরে এই মহাবিদ্যা শেখাচ্চি। তোমরা আমার স্নেহের পাত্র, ‘তুমি’ বল‍্বার অধিকার আমার আছে।

 লুটবেহারী। নিশ্চয় আছে। আপনি আমাদের ‘তুমি-তুই’ যা খুশী বলুন। আমি ওসব গ্রাহ্য করি না। মোদ্দা, শেষকালে ফাঁকি দেবেন না।

 জগদ‍্গুরু। বাপু, আমি কোনো জিনিষ দিই না, শুধু শেখাই মাত্র। যা হোক, তোমাদের দেখে আমি বড়ই প্রীত হয়েচি। এমন সব সোণার চাঁদ ছেলে,—কেবল শিক্ষার অভাবে উন্নতি করতে পারচ না।

 মিষ্টার গুপ্টা। ভণিতা ছেড়ে কাজের কথা বলুন।

 জগদ‍্গুরু। হে ছাত্রগণ, মহাবিদ্যা না জানলে মানুষ সুসভ্য, ধনী, মানী হতে পারে না, —তাকে চিরকাল কাঠ কাটতে, আর জল তুল‍্তে হয়। কিন্তু এটা মনে রেখো যে, সাধারণ বিদ্যা আর মহাবিদ্যা এক জিনিষ নয়। তোমরা পদ্যপাঠে পড়েচ—

এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে,
যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।

এই কথা সাধারণ বিদ্যা সম্বন্ধে খাটে, কিন্তু মহাবিদ্যার বেলা নয়। মহাবিদ্যা কেবল নিতান্ত অন্তরঙ্গ-জনকে অতি সন্তর্পণে শেখাতে হয় বেশী প্রচার হলে সমূহ ক্ষতি। বিদ্বানে-বিদ্বানে সঙ্ঘর্ষ হলে একটু বাক্যব্যয় হয় মাত্র; কিন্তু মহাবিদ্বানুদের ভিতর ঠোকাঠুকি বাধলে সব চুরমার। তার সাক্ষী এই ইউরোপের যুদ্ধ। অতএব মহাবিদ্বান‍্দের একজোট হয়েই কাজ করতে হবে।

 হাউলার। আমি এই লেকচারে আপত্তি করচি। এ দেশের লোকে এখনো মহাবিদ্যা লাভের উপযুক্ত হয় নি। আর আমাদের মহাবিদ্বারা দেশী মহাবিদ্বান‍্দের সঙ্গে বনিয়ে চলতে পারবে না। মিথ্যা একটা অশান্তির সৃষ্টি হবে।

 গ্র্যাব। চুপ কর হাউলার। মহাবিদ্যা শেখা কি এ দেশের লোকের কর্ম্ম? লেক্‌চার শুনে হুজুকে পড়ে যদি মহাবিদ্যা নিয়ে লোকে একটু ছেলেখেলা আরম্ভ করে, মন্দ কি? একটু অন্যদিকে distraction হওয়া দেশের পক্ষে এখন দরকার হয়েচে।

 হাউলার। সাধারণ বিদ্যা যখন এদেশে প্রথম চালানো হয়, তখনো আমরা ব্যাপারটাকে ছেলেখেলা মনে করেছিলুম। এখন দেখচ ত ঠেলা? জোর করে টেক্সট্ বুক থেকে এটা সেটা বাদ দিয়ে কি আর সাম‍্লানো যাচ্চে?

 খুদীন্দ্র। মিষ্টার হাউলার ঠিক বল্‌চেন। আমারো ভাল ঠেকচে না।

 চোমরাও আলি। ভাল-মন্দ গভর্মেণ্ট বিচার করবেন। তবে মহাবিদ্যা যদি শেখাতেই হয়, মুসলমানদের জন্য একটা আলাদ—

 হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।

 জগদ‍্গুরু। সাধারণ বিদ্য! মোটামুটি জানা না থাকলে, মহাবিদ্যায় ভাল রকম ব্যুৎপত্তি লাভ হয় না। পাশ্চাত্য দেশে দুই বিদ্যার মণিকাঞ্চন যোগ হয়েচে। দেশেও যে মহাবিদ্বান্ নেই, তা নয়—

 গাঁট্টালাল। হুঁ—হুঁ, গুরুজি আমাকে মালুম কচ্চেন।

 রূপচাঁদ। দূর, তোকে কে চেনে? আমার দিকে চাইচেন।

 জগদ‍্গুরু। তবে মূর্খ লোকে মহাবিদ্যার প্রয়োগটা আত্মসম্ভ্রম বাঁচিয়ে করতে পারে না। পাশ্চাত্য দেশ এ বিষয়ে অত্যন্ত উন্নত। জরির খাপের ভিতর যেমন তলোয়ার ঢাকা থাকে, মহাবিদ্যাকেও তেম্‌নি সাধারণ বিদ্যা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। মহাবিদ্যার মূল সূত্রই হচ্চে—যদি না পড়ে ধরা।

 প্রফেসার গুঁই। আপনি কি-সব খারাপ কথা বল্‌চেন?

 অনেকে। শেম্, শেম্।

 জগদ‍্গুরু। বৎস, লজ্জিত হয়ো না। তোমাদেরই এক পণ্ডিত বলেন—একাং লজ্জাং পরিত্যজ্য ত্রিভুবনবিজয়ী ভব। যদি মহাবিদ্যা শিখতে চাও, তবে সত্যের উলঙ্গ মূর্ত্তি দেখে ডরালে চলবে না। যা বলছিলুম শোনো।—এই মহাবিদ্যা যখন মানুষ, প্রথমে শেখে, তখন সে আনাড়ী শিকারীর মত এ বিদ্যার অপপ্রয়োগ করে। যেখানে ফাঁদ পেতে কার্যসিদ্ধি হতে পারে, সেখানে সে কুস্তি লড়ে বাঘ মারতে যায়। দু’চারটে বাঘ হয় ত মরে; কিন্তু শিকারীও শেষে ঘাল হয়। বিদ্যাগুপ্তির অভাবেই এই বিপদ হয়। মানুষ যখন আর একটু চালাক হয়, তখন সে ফাঁদ পাত‍্তে আরম্ভ করে, নিজে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু গোটাকতক বাঘ ফাঁদে পড়লেই, আর সব বাঘ ফাঁদ চিনে ফেলে, আর সে দিকে আসে না, আড়াল থেকে টিট‍্কারী দেয়, শিকারীরও ব্যবসা বন্ধ হয়। ফাঁদটা এমন হওয়া চাই, যেন কেউ ধরে না ফেলে। মহাবিদ্যাও সেই রকম গোপন রাখা দরকার। তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয় ত নিজের অজ্ঞাতসারে, কেবল সংস্কারবশে মহাবিদ্যার প্রয়োগ কর। এতে কখনো উন্নতি হবে না। পরের কাছে প্রকাশ করা নিষেধ; কিন্তু নিজের কাছে লুকোলে মহাবিঘায় মর‍্চে পড়বে। সজ্ঞানে ফলাফল বুঝে মহাবিদ্য। চালাতে হয়।

 গুঁই। বড়ই গোলমেলে কথা।

 লুটবেহারী। কিছু না, কিছু না। জগদ‍্গুরু নূতন কথা আর কি কচেন। প্র্যাক‍্টিস আমার সবই জানা আছে, তবে থিওরিটা শেখ‍্বার তেমন সময় পাই নি।

 গুহা। এতদিন ছিলে কোথা হে?

 লুটবেহারী। শ্বশুরবাড়ী। সেদিন খালাস পেয়েচি।

 গুহা। নাঃ, তোমার দ্বারা কিছু হবে না। এই ত ধরা দিয়ে ফেল্লে।

 লুটবেহারী। আপনাকে বলতে আর দোষ কি দুজনেই মহাবিদ্বান্—অন্তরঙ্গ মাস্তুতো ভাই।

 হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।

 গুহা। আচ্ছা গুরুদেব, মহাবিদ্যা শিখ‍্লে কি আমাদের দেশের সকলেরই উন্নতি হবে?

 জগদ‍্গুরু। দেখ বাপু, পৃথিবীর ধনসম্পদ্ যা দেখচ, তার একটা সীমা আছে, বেশী বাড়ানো যায় না। সকলেই যদি সমান ভাগে পায়, তবে কারোই পেট ভরে না। যে জিনিষ সকলেই অবাধে ভোগ করতে পারে, সেটা আর সম্পত্তি বলে গণ্য হয় না। কাজেই, জগতের ব্যবস্থা এই হয়েছে যে, জনকতক ভোগদখল করবে, বাকী সবাই যুগিয়ে দেবে। চাই গুটিকতক মহাবিদ্বান, আর একগাদা মহামুর্খ।

 খুদীন্দ্র। শুন্‌চেন মহারাজা? এই কথাই ত আমরা বারাবর বলে আসচি। আরিষ্টোক্রাসি না হলে সমাজ টিকবে কিসে? লোকে আবার আমাদের বলে মূর্খ—অযোগ্য। হুঁঃ!

 জগদ‍্গুরু। ভুল বুঝলে, বৎস। তোমার পূর্ব্বপুরুষই মহাবিদ্বান্ ছিলেন, তুমি নও। তুমি কেবল অতীতে অর্জ্জিত বিদ্যার রোমন্থন করচ। তোমার আশে-পাশে মহাবিদ্বানরা ওৎ পেতে বসে আছেন। যদি তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না শেখ, তবে শীঘ্রই গাদায় গিয়ে পড়বে।

 প্রফেসার গুঁই। পরিষ্কার করেই বলুন না, মহাবিদ্যাটা কি।

 তৃতীয় শ্রেণী হইতে। বলে ফেলুন সার, বলে ফেলুন। ঘণ্টা বাজতে বেশী দেরি নেই।

 জগদ‍্গুরু। তবে বলচি শোনো। মহাবিদ্যায় মানুষের জন্মগত অধিকার; কিন্তু একে ঘষে-মেজে, পালিশ করে, সভ্যসমাজের উপযোগী করে নিতে হয়। ক্রমোন্নতির নিয়মে মহাবিদ্যা এক স্তর হতে উচ্চতর স্তরে পৌঁছেচে। জানিয়ে-শুনিয়ে সোজাসুজি কেড়ে নেওয়ার নাম ডাকাতি—

 ছাত্রগণ। সেটা মহাপাপ,—চাই না, চাই না।

 জগদ‍্গুরু। দেশের জন্য যে ডাকাতি, তার নাম বীরত্ব—

 ছাত্রগণ। তা আমাদের দিয়ে হবে না, হবে না।

 হাউলার। Bally rot.

 জগদ‍্গুরু। নিজে লুকিয়ে থেকে কেড়ে নেওয়ার নাম চুরি—

 ছাত্রগণ। ছ্যা—হ্যা, আমরা তাতে নেই, তাতে নেই।

 লুটবেহারী। কিহে গাঁট্টালাল, চুপ করে কেন? সায় দাও না।

 জগদ‍্গুরু। ভালমানুষ সেজে কেড়ে নিয়ে, শেষে ধরা পড়ার নাম জুয়াচুরি—

 ছাত্রগণ। রাম কহ, তোবা, থুঃ।

 গুহা। কি লুটবেহারী চোখ বুঁজে কেন?

 জগদ‍্গুরু। আর যাতে ঢাক পিটিয়ে কেড়ে নেওয়া যায়, অথচ শেষ পর্যন্ত নিজের মান-সম্ভ্রম রজায় থাকে,—লোকে জয়জয়কার করে, সেটা মহাবিদ্যা।

 ছাত্রগণ। জগদ‍্গুরু কি জয়! আমরা তাই চাই, তাই চাই।

 গুঁই। কিন্তু ঐ কেড়ে নেওয়া কথাটা একটু আপত্তিজনক।

 লুটবেহারী। আপনার মনে পাপ আছে, তাই খট্‌কা বাধ‍্চে। কেড়ে নেওয়া পছন্দ না হয়, বলুন ভোগা দেওয়া।

 গুঁই। কে হে বেহায়া তুমি? তোমার conscience নেই?

 জগদ‍্গুরু। বৎস, কেড়ে নেওয়াটা রূপকমাত্র। সাদা কথায় এর মানে হচ্চে—সংসারের মঙ্গলের জন্য লোককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু আদায় করা।

 লুটবেহারী। আমার ত সবে একটি সংসার। কিছু আদায় করতে পারলেই ছছল বছল। নবাব-সাহেবের বরঞ্চ—

 হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।

 গুঁই। দেখুন জগদ‍্গুরু, আমার দ্বারা বিবেক-বিরুদ্ধ কাজ হবে না। কিন্তু ঐ যে আপনি বল্লেন—সংসারের মঙ্গলের জন্য, সেটা খুব মনে লেগেচে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি—

 লুটবেহারী। মশায়, ভগবান বেচারাকে নিয়ে যখনতখন টানাটানি করবেন না,—চটে উঠবেন।

 নিতাই। আচ্ছা, সকলেই যদি মহাবিদ্যা শিখে ফেলে, তা হলে কি হবে?

 জগদ‍্গুরু। সে ভয় নেই। তোমরা প্রত্যেকে যদি প্রাণপণে চেষ্টা কর, তা’হলেও মাত্র দু’চারজন ওৎরাতে পার।

 সরেশ। সার, একবার টেষ্ট করে নিন না।

 জগদ‍্গুরু। এখন পরীক্ষা করলে বিশেষ ভাল ফল পাওয়া যাবে না। অনেক সাধনা দরকার।

 নিরেশ। কিছু মার্কও কি পাব না?

 জগদ‍্গুরু। কিছু-কিছু পাবে বৈ কি। কিন্তু তাতে এখন করে-খেতে পারবে না।

 নিরেশ। তবে না হয় আমাদের কিছু হোম-এক‍্সারসাইজ দিন।

 জগদ‍্গুরু। বাড়ীতে ত সুবিধা হবে না বাছা। এখন তোমরা নিতান্ত অপোগণ্ড। দিনকতক দল বেঁধে মহাবিদ্যার চর্চা কর।

 খুদীন্দ্র। ঠিক বলেচেন। আসুন মহারাজা, আপনি, আমি আর নবাব-সাহেব মিলে একটা অ্যাসোসিয়েশন্ করা যাক।

 প্রফেসার গুঁই। আমাকেও নেবেন,—আমি স্পীচ্ লিখে দোবো।

 মিষ্টার গুহা। নিতাইবাবু, আমি ভাই তোমার সঙ্গে আছি।

 লুটবেহারী। আমি একাই এক শ। তবে রূপচাঁদবাবু যদি দয়া করে সঙ্গে নেন।

 রূপচাঁদ। খবরদার, তুমি তফাৎ থাক।

 লুটবেহারী। বটে? তোমার মত ঢের-ঢের বড়লোক দেখেচি।

 গাঁট্টালাল। আমরা কারে| তোয়াক্বা রাখি না— কি বল তেওয়ারিজি?

 মিষ্টার গুপ্টা। ভাবনা কি সরেশবাবু, নিরেশবাবু। আমি টেক‍্নিক্যাল ক্লাস খুলচি, ভর্ত্তি হোন। তরল আলতা, গোলাবী বিড়ি, ঘড়ি-মেরামত, ঘুড়ি-মেরামত, দাঁত-বাঁধানো, ধামা বাঁধানো—সব শিখিয়ে দেবো।

 দীনেশ। গুরুদেব, চুপি-চুপি একটা নিবেদন করতে পারি কি?

 জগদ‍্গুরু। বল বৎস।

 দীনেশ। দেখুন, আমি নিতান্তই মুরুব্বিহীন। মহাবিদ্যার একটা সোজা তুকতাক্‌— বেশী নয়, যাতে লাখখানেক টাকা আসে,—যদি দয়া করে গরীবকে শিখিয়ে দেন।

 জগদ‍্গুরু। বাপু, তোমার গতিক ভাল বোধ হচ্চে না। মহাবিদ্বান অপরকেই তুকতাক্ শেখায়,—নিজে ওসবে বিশ্বাস করে না।

 দীনেশ। টিকিটের টাকাটাই নষ্ট। তার চেয়ে ডার্ব্বির টিকিট কিনলে বরং কিছুদিন আশায় আশায় কাটাতে পারতুম।

 গবেশ্বর। আমার কি হবে প্রভু? কেউ যে দলে নিচ্চে না।

 জগদ‍্গুরু। তুমি ছেলে তৈরি কর। তাদের শেখাও —মহাবিদ্যা শেখে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।

 পাঁচুমিয়া। আমার কি করলেন ধর্মাবতার?

 জগদ‍্গুরু। তুমি এখানে এসে ভাল করনি বাপু। তোমার গুরু রুষিয়া থেকে আসবেন, এখন ধৈর্য্য ধরে থাক।

 গুহা। দশ হাজার টাকা চাঁদা তুলতে পারিস? ইউনিয়ন্‌ খুলে এমন হুড়ো লাগাব যে, এখনি তোদের পাঁচগুণ মজুরী হয়ে যাবে।

 মিষ্টার গ্র্যাব। সাবধান, আমার চটকলের ত্রিসীমানার মধ্যে যেন এস না।

 গুহ। (চুপি-চুপি) তবে আপনার বাড়ী গিয়ে দেখা করব কি?

 কাঙালীচরণ। দেবতা, আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?

 জগদ‍্গুরু। তোমার আবার কি চাই? বলে ফেল।

 কাঙালী। যদি কখনো মহাবিদ্যা ধরা পড়ে যায়, তখন অবস্থাটা কি রকম হবে?

 জগদ্‌গুরু। (ঈষৎ হাসিয়া বেদী হইতে নামিয়া পড়িলেন)

ঘণ্টা ও কোলাহল