গল্পকল্প/চিরঞ্জীব
চিরঞ্জীব
পূজোর ছুটিতে দুই বন্ধু হরিহর বসু আর তারক গুপ্ত পশ্চিমে বেড়াতে যাচ্ছেন। দিল্লি মেল ছাড়বার দেড় ঘণ্টা আগে তাঁরা হাওড়া স্টেশনে এলেন এবং প্ল্যাটফর্মে গাড়ি লাগতেই একটা সেকেণ্ড ক্লাস কামরায় উঠে পড়লেন। তাঁদের সীট আগে থেকেই রিজার্ভ করা ছিল।
হরিহরবাবু তাড়াতাড়ি তাঁর বিছানা পেতে গট হয়ে ব’সে বললেন, দেখ তারক, যে ক দিন কলকাতার বাইরে থাকব সে ক দিন বাঙালীর সঙ্গে মোটেই মিশব না। মেশবার দরকারও হবে না, কারণ দিল্লিতে আমরা লালা গজাননজীর বাড়িতে উঠছি। আগরাতেও তাঁর গদি আছে, সেখানেও আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করেছেন। অতি ভাল লোক গজাননজী।
তারকবাবু সিগারেট ধরিয়ে বললেন, লোক তো ভাল, কিন্তু তাঁর বাড়িতে নিরামিষ খেতে হবে।
হরিহরবাবু বললেন, ওই তো বাঙালীর মহা দোষ, মাছের জন্যে বেরালের মতন ছোঁকছোঁক করে। তুমি আবার বাঙাল, আরও লোভী।
— আচ্ছা বাপু, পনর দিন না হয় বিধবার মতন থাকা যাবে। কিন্তু তুমিও তো প্রচণ্ড গোস্তখোর।
— ক্রমশ মাছ মাংস ত্যাগ করছি। নিখিল ভারতের ভদ্রশ্রেণীর সঙ্গে আমাদের সাজাত্য হওয়া দরকার।
— সাজাত্য আপনিই হচ্ছে, লালাজী শেঠজী চোবেজী সবাই মুরগি খেতে শিখছেন। মহামতি গোখলে ঠিকই ব’লে গেছেন—what Bengal thinks today India thinks tomorrow | বাঙালীর আর কষ্ট ক’রে সাত্ত্বিক হবার দরকার নেই।
—খুব দরকার আছে। উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ গুজরাট মহারাষ্ট্র অন্ধ্র তামিলনাড প্রভৃতি রাজ্যের উচ্চ সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের সর্বাঙ্গীণ মিলন হওয়া দরকার। খাদ্য পরিচ্ছদ আর ভাষা বদলাতে হবে, নইলে মচ্ছি-চাওর-খোর বংগালী অপাংক্তেয় হয়ে থাকবে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায় ঠিক বলেছেন—বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি। আমাদের পূর্বমর্যাদা স্মরণ ক’রে পূর্বসম্বন্ধ পুনস্থাপন করতে হবে।
—পূর্বসম্বন্ধটা কিরকম? আমরা সবাই আর্য-খোট্টা এই সম্বন্ধ?
— তার চাইতে নিকটতর। আদিশূরের রাজত্বকালে কান্যকুব্জ থেকে যে পাঁচ জন কায়স্থ বাংলা দেশে এসেছিলেন তাঁদের নেতার নাম দশরথ বসু। তিনি আমার ছাব্বিশতম পূর্বপুরুষ আসলে আমি বাঙালী নই, কনৌজী লালা কায়েত। তুমিও বাঙালী নও।
— বল কি হে!
— তুমি হচ্ছ কর্ণাটী ব্রহ্মক্ষত্রিয়, বল্লালসেনের স্বজাতি। ইতিহাস প’ড়ে দেখো।
— আমি তো জানতুম আমি চন্দ্রগুপ্ত সমুদ্রেগুপ্তের জ্ঞাতি। তোমাদের কথা শুনেছি বটে, আদিশূর কনৌজ থেকে পাঁচ জন বেদজ্ঞ আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ আনিয়েছিলেন, তাঁদের তল্পিদার হয়ে পাঁচ কায়স্থ এসেছিল।
— ভুল শুনেছ। আদিশূর রাজ্যশাসনের জন্য পাঁচ জন উচ্চবংশীয় ক্ষত্রকায়স্থ আনিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পাঁচটি পাচক ব্রাহ্মণ এসেছিল।
হরিহরবাবু তাঁর ঘড়িতে দেখলেন গাড়ি ছাড়তে আর পনর মিনিট মাত্র দেরি আছে। তাঁর ব্যাগ খুলে দুটি খন্দরের পি যার করলেন। একটি নিজে পরলেন, আর একটি তারকবাবুকে দিয়ে বললেন, নাও, মাথায় দাও।
তারকবাবু বললেন, টুপি পরব কেন, শুধু শুধু, মাথা গরম করা। এই তো তুমি বললে যে আমি কর্ণাটী, অর্থাৎ মাদ্রাজ প্রদেশের লোক। আমরা টুপি পরি না, তার সাক্ষী রাজাজী। বরঞ্চ কাছার একটা খুঁট খলে রাখছি।
গাড়িতে হুড়মুড় করে লোক উঠতে লাগল। হরিহরবাবুদের কামরা ভ’রে গেল, বাঙালী বিহারী উত্তরপ্রদেশী মারোয়াড়ী গুজরাটী প্রভৃতি নানা জাতের লোক উঠে বেঞ্চিতে ঠাসাঠাসি করে বসে পড়ল। একটি বাঙালী যুবক একজন স্থবিরের হাত ধ’রে তাঁকে এক কোণে বসিয়ে দিয়ে বললে, হালদার মশায়, আপনাকে এখন একট; কষ্ট সইতে হবে। ঘণ্টা তিন চার পরেই লোক ক’মে যাবে, তখন আপনার বিছানা পেতে দেব।
বুদ্ধ হালদার মশায় বললেন, আমার জন্য ব্যস্ত হয়ো না শরৎ। বয়স হলেও তোমাদের চাইতে শক্ত আছি। দাঁত নেই, কিন্তু এখনও একটি আস্ত ইলিশ মাছ হজম করতে পারি।
তারকবাবু বললেন, বাঃ, আপনি মহাপুরুষ। বড্ড ভিড়, নইলে আপনার পায়ের ধুলো নিতুম হালদার মশায়।
হালদার খুশী হয়ে বললেন, তবে বলি শোন। মুঙ্গের জেলায় খরকপুরে থাকতে দু বেলায় একটি আস্ত পাঁঠা সাবাড় করতুম। চার আনায় একটি নধর বকড়ি, আবার তার চামড়া বেচলে পুরোপরি চার আনাই ফিরে আসত। একবার একটি সিকি খরচ করলে ক্রমান্বয়ে পাঁঠার পর পাঁঠা মুফ্তে পাওয়া যেত। ভারী লোভ হচ্ছে, নয়? এখন আর সে দিন নেই রে দাদা। ষাট বৎসর আগেকার কথা।
গার্ডের বাঁশি ফুরর ক’রে বেজে উঠল। একজন প্রকাণ্ড পুরুষ দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন। হরিহরবাবু বললেন, আর জায়গা নেহি হ্যায়, দুসরা কামরায় যাইয়ে।
গাড়ি চলতে লাগল। আগন্তুকের বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ, বৃষকন্ধ শালপ্রাংশু, কালবৈশাখীর মেঘের মতন গায়ের রং, বাবরি চুল, গাল পর্যন্ত জুলফি, মোটা গোঁফের নীচে পরে ঠোঁট। পরনে মিহি ধুতি, কাছার এক কোণ ঝুলছে। গায়ে লম্বা রেশমী কোট, তার উপর ভাঁজ করা আজানলম্বিত জরিপাড় উড়ুনি। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, দুই কানে হীরের ফুল, আঙুলে অনেকগুলি নীলা চুনি পান্নার আংটি, পায়ে পনর নম্বর চম্পল।
ঝকঝকে সাদা দাঁত বার ক’রে হেসে আগন্তুক পরিষ্কার বাংলায় হরিহরবাবুকে বললেন, ঘাবড়াবেন না মশায়, আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকব। পান খেয়ে পিক ফেলব না, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ব না, আশ্চর্য মাজন বেচব না, বন্যা ভূমিকম্পের চাঁদা চাইব না, সর্বহারার গানও গাইব না। যদি পরে ভিড় কমে তবে একটু বসবার জায়গা করে নেব। যদি অনুমতি দেন তবে আলাপ ক’রে আপনাদের খুশী করবার চেষ্টা করব।
শরৎ নামক ছেলেটি বললে, কতক্ষণ কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আপনি আমার পাশে বসুন। আগন্তুক কৃতজ্ঞতাসূচক নমস্কার ক’রে ব’সে পড়লেন।
হালদার মশায় বললেন, মহাশয়ের নামটি কি? নিবাস কোথায়? কি করা হয়? কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
আগন্তুক উত্তর দিলেন, আমার নাম লংকুস্বামী কর্বূরঙ্গ রেড্ডি। আদি নিবাস ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন ভারতের নানা স্থানে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু, করি না, মহাদেব আর রামচন্দ্রের কৃপায় আমার কোনও অভাব নেই। এখন আসানসোলে শ্বশুরের কাছে যাচ্ছি, কাল অযোধ্যাপুরী রওনা হব, নবরাত্রি উৎসব দেখতে।
হরিহরবাবু বললেন, আপনি রেড্ডি? ক্ষত্রিয়?
— ব্রাহ্মণও বটি ক্ষত্রিয়ও বটি।
— ও, আপনি ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়, আমাদের এই তারক গুপ্তর সজাতি?
—তা বলতে পারি না।
হরিহরবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, তবেই তো সমস্যায় ফেললেন মশায়। আপনি শর্মা, না বর্মা, না দাশ তালব্য-শ, না দাস দন্ত্য-স?
— আমি শর্মা-বর্মা-দাষ, দ-এ আকার মূর্ধন্য ষ। আমি জাতিতে মূর্ধাভিষিক্ত। পিতা ব্রাহ্মণ, মাতা রক্ষঃক্ষত্রিয়া রাজকন্যা। রেড্ডি আমার আসল উপাধি নয়, শুনতে মিষ্ট ব’লে নামের শেষে যোগ করি।
হালদার মশায় বললেন, আহা, কেন ভদ্রলোককে জেরা ক’রে বিব্রত কর, দেখতেই তো পাচ্ছ ইনি মাদ্রাজী। আরও পরিচয়ের দরকার কি। আপনি তো খাসা বাংলা বলেন মশায়! শিখলেন কোথায়?
লংকুস্বামী হেসে বললেন, আমার বর্তমানা পত্নী আট বৎসর শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তাঁর কাছেই বাংলা শিখেছি।
হরিহরবাবু বললেন, বর্তমানা পত্নী?
— আজ্ঞে হাঁ। পত্নীদেরও ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান আছে।
হালদার মশায় বললেন, এই সোজা কথাটা বুঝলে না? ইনি অনেক বার সংসার করেছেন। এই আমার মতন আর কি। চার বার বিবাহ করেছি, কলাগাছ নিয়ে পাঁচ। কিন্তু এখন গৃহ শূন্য। আবার বিবাহ করবার ইচ্ছা আছে, কিন্তু শেষ পক্ষের সম্বন্ধী এই শরৎ শালার জন্যে তা হচ্ছে না, কেবলই ভাংচি দেয়।
লংকুস্বামী বললেন, মহাশয়ের বয়স কত হয়েছে?
— চার কুড়ি পুরতে এখনও ঢের বাকী।
শরৎ ব’লে উঠল, মিথ্যে বলবেন না হালদার মশায়, সেই কবে আশি পেরিয়েছেন!
— তুই চুপ কর ছোঁড়া। বুঝলেন লংকুবাবু, বয়স যতই হ’ক খুব শক্ত আছি। এখনও একটি আস্ত ইলিশ হজম করতে পারি।
লংকুস্বামী বললেন, তবে আর ভাবনা কি। আপনি তো বালক বললেই হয়, এক শ বার বিবাহ করতে পারেন।
—হেঁ হেঁ। বালক নই, তবে জোয়ান বলতে পারেন। মহাশয় ক বার সংসার করেছেন?
লংকুস্বামী পকেট থেকে একটি নোটবুক বার ক’রে দেখে বললেন, এখন ঊনবিংশতাধিক-শততম সংসার চলছে।
— তার মানে?
— অর্থাৎ এখন পর্যন্ত এক শ উনিশ বার বিবাহ করেছি।
হালদার মশায় চোখ কপালে তুলে বললেন, প্রত্যেক বারে দশ বিশ গণ্ডা বিবাহ করেছিলেন নাকি?
—না না, বহুবিবাহে আমার ঘোর আপত্তি, যদিও আমার বড়-দা আর মেজ-দার অনেক পত্নী ছিলেন। আমি চিরকালই একনিষ্ঠ, এক-একটি পত্নী গত হ’লে আবার একটির পাণিগ্রহণ করেছি।
একজন গুজরাটী যাত্রী সশব্দে হেসে বললেন, বুঝছেন না হালদার মোসা, ইনি আপনাকে বিয়া পাগলা বুঢ়া ঠহরেছেন, তাই আপনার পয়ের খিঁচছেন, যাকে বলে লেগ পুলিং।
লংকুস্বামী তাঁর বৃহৎ জিহ্বা দংশন ক’রে বললেন, রাম রাম, আমি ঠাট্টা করছি না, সত্য কথাই বলছি।
গাড়ি বর্ধমানে পৌঁছল, অনেক যাত্রী নেমে গেল। লংকুম্বামী বললেন, এখন একটু জায়গা হয়েছে, আপনাদের যদি অসুবিধা না হয় তবে আমার স্ত্রীকে মহিলাকামরা থেকে নিয়ে আসি। সেখানে বড় ভিড়, তাঁর কষ্ট হচ্ছে। ঘণ্টা দুই পরেই আমরা আসানসোলে নেমে যাব।
শরৎ বললে, কোনও অসুবিধা হবে না, আপনি তাঁকে নিয়ে আসুন।
লংকুম্বামী তাঁর পত্নীকে নিয়ে এলেন। বয়স আন্দাজ পঁচিশ, সুশ্রী তন্দ্বী শ্যামা, কাছা দিয়ে শাড়ি পরা, মাথা খোলা, দুই কানে আর নাকের দুই পাশে হীরে ঝকমক করছে। লংকুস্বামী পরিচয় দিলেন, এই ইনিই আমার এক শ উনিশ নম্বরের স্ত্রী, এ’র নাম সুরাম্মা বাই। সুরাম্মা স্মিতমূখে সকলের উদ্দেশে নমস্কার করলেন।
হালদার মশায় চুলবুল করছেন আর তাঁর ঠোঁট বার বার নড়ছে দেখে লংকুস্বামী বললেন, আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান কি? স্বচ্ছন্দে বলুন, আমার স্ত্রীর জন্য কোনও দ্বিধা করবেন না।
হালদার মশায় বললেন, এক শ উনিশ বার বিবাহ করা চাট্টিখানি কথা নয়। আপনার বয়স কত হবে লংকুবাবু?
—আপনি আন্দাজ করুন না।
— আমার চাইতে কম। এই পঞ্চাশের মধ্যে আর কি।
— হল না, আরও উঠুন।
—ষাট?
—আরও, আরও।
— সত্তর? আশি?
তারকবাবু হেসে বললেন, আপনার কাজ নয় হালদার মশায়। নিলামের দর চড়ানো আমার অভ্যাস আছে। লংকুস্বামীজী, আপনার বয়স এক শ।
— হ’ল না, আরও উঠুন।
—পাঁচ শ? হাজার? দু হাজার?
— আরও, আরও।
— চার হাজার? পাঁচ হাজার?
লংকুস্বামী বললেন, এইবারে কাছাকাছি এসেছেন। সুরাম্মা, তুমি তো সেদিন হিসেব করেছিলে তোমার চাইতে আমি ক বছরের বড়। তুমিই বাবুমশায়দের শুনিয়ে দাও আমার বয়স কত।
সুরাম্মা সহাস্যে মৃদুম্বরে বললেন, পাঁচ হাজার পাঁচ শ পঞ্চান্ন।
হালদার মশায় হাঁ ক’রে নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। হরিহরবাবু হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলেন, স্বপ্ন দেখছি, না জেগে আছি? অন্য যাত্রীরা নির্বাক হয়ে রইল, কেউ কেউ বোকার মতন হাসতে লাগল।
তারকবাবু বললেন, ক বছর অন্তর বিবাহ করেছিলেন মশায়?
লংকুস্বামী আবার তাঁর নোটবুক দেখে বললেন, গড়ে ছেচল্লিশ বৎসর অন্তর। আমার স্ত্রীদের আয়ু তো আমার মতন ছিল না, সকলেই যথাকালে গত হয়েছিলেন। অষ্টম হেনরির মতন আমি স্ত্রীবধ করি নি, স্ত্রীত্যাগও করি নি। আমার সকল স্ত্রীই সতীলক্ষ্মী।
হালদার মশায় ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করলেন, সন্তানাদি কতগুলি?
—সুরাম্মার এখনও কিছু হয় নি। আমার পূর্ব পূর্ব পক্ষের সন্তানদের হিসেব রাখি নি, রাখা সাধ্যও নয়। বিস্তর জন্মেছিল, বিস্তর ম’রে গেছে, তবু জীবিত বংশধরদের সংখ্যা এখন কয়েক লাখ হবে।
তারকবাবু বললেন, যত রেড্ডি পিল্লে মেনন নাইডু নায়ার চেট্টি আয়ার আয়েঙ্গার সবাই আপনার বংশধর নাকি?
— শুধু ওরা কেন। চাটুজ্যে বাঁড়ুজ্যে ঘোষ বোস সেন আছে, সিং কাপুর চোপরা মেটা দেশাই আছে, শেখ সৈয়দ আছে, হোর লাভাল কুইসলিং আছে, চ্যাং কিমাগুসা ভডকুইস্কি প্রভৃতিও আছে। সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসরে মানুষের জাতিগত পরিবর্তন অনেক হয়।
— আপনি তা হলে মহেঞ্জোদাড়ো হারাম্পা যুগের লোক?
—তা বলতে পারেন। ওইসব দেশবাসীর সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষদের কুটুম্বিতা ছিল। আমার বৃদ্ধপ্রমাতামহীর নাম সালকটংকটা, তিনি হারাম্পার রাজবংশের কন্যা ছিলেন।
হরিহরবাবু এতক্ষণে একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বললেন, উঃ, দীর্ঘ জীবনে আপনার বিস্তর স্বজনবিয়োগ হয়েছে, কতই না শোক পেয়েছেন!
—শোক পাব কেন। কৃষকের আয়ু ধানগাছের চাইতে বেশী। ধানগাছ শস্য দিয়ে ম’রে যায়, তার জন্য কৃষক কিছুমাত্র শোক করে না, আবার বীজ ছড়ায়।
হরিহরবাবু বললেন, ওঃ, সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসরের ইতিহাস আপনার চোখের সামনে ঘটে গেছে!
—হাঁ। পলাসীর যুদ্ধ, পৃথ্বীরাজের পরাজয়, হর্ষবর্ধনের দিগ্বিজয়, আলেকজাণ্ডারের আগমন, বুদ্ধদেবের জন্ম, কুরক্ষেত্র-যুদ্ধ, সবই আমি দেখেছি।
— রাম-রাবণের যুদ্ধেও দেখেছেন?
লংকুস্বামী গম্ভীর হয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাও দেখতে হয়েছে। শুধু দেখা নয়, লড়তেও হয়েছে। ও কথা আর তুলবেন না।
হরিহরবাবু রোমাঞ্চিত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় ক’রে প্রশ্ন করলেন, আপনি কে প্রভু?
গুজরাটী ভদ্রলোকটি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন। দুই ঊরুতে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে বললেন, ও হো হো হো! আমি বুঝে লিয়েছি, আপনি হচ্ছেন বিভীখন মহারাজ, রামচন্দ্রের বরে চিরঞ্জীব হয়েছেন। এখন একটি বাত বলছি শুনেন। আমার নাম শুনে থাকবেন, লগনচাঁদ বজাজ, নয়নসুখ ফিলিম কম্পনির মালিক। নয়া ফিলিম বানাচ্ছি— রাবণ-সন্হার। রোশেনারা পকৌড়িলাল সাগরবালা এঁরা সব নামছেন। আপনারা আমার কম্পনিতে জইন করুন। খুদ আমি রামচন্দ্রের পার্ট লিব। আপনি বড়দাদা রাবণের পার্ট লিবেন, সুরাম্মা বাই সীতার পার্ট লিবেন। হাজার টাকা করে মহীনা দিব। এই আমার কার্ড। বিচার ক’রে দেখবেন, রাজী হন তো এক হপ্তার অন্দর এই ঠিকানায় আমাকে তার ভেজবেন। অচ্ছা?
লংকুস্বামী একবার কটমট করে তাকালেন। লগনচাঁদ খতমত খেয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর হাত থেকে কার্ডখানা খ’সে প’ড়ে গেল।
এই সময়ে গাড়ি আসানসোলে এসে থামল। সস্ত্রীক লংকুস্বামী কোনও কথা না ব’লে যুক্তকরে বিদায় নিলেন এবং বাঘের মতন নিঃশব্দে পা ফেলে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লেন।
১৩৫৭