গল্পকল্প/সিদ্ধিনাথের প্রলাপ

সিদ্ধিনাথের প্রলাপ

ন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় পাশের বাড়িতে পো ঁক’রে শাঁখ বেজে উঠল। সিদ্ধিনাথবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আর একটি বেকারের আগমন হ’ল।

 গৃহস্বামী গোপাল মুখুজ্যে বললেন, সিধু, তুমি দিন দিন দুর্মুখ হচ্ছ। কত হোম যাগ আর মানত ক’রে বুড়ো বয়সে মল্লিক মশায় একটি বংশধর লাভ করলেন। প্রতিবেশীর সৌভাগ্যে আমাদের সকলেরই খুশী হবার কথা, আর তুমি ধ’রে নিচ্ছ যে ছেলেটি বেকার হবে!

 আবার একটি নিঃশ্বাস ফেলে সিদ্ধিনাথ বললেন, দেশবাসীর আধপেটা অন্নের আর এক জন ভাগীদার জুটল।


 ঘরে চার জন আছেন। গোপালবাবু উকিল, বয়স চল্লিশ, বেশ পসার করেছেন। সিদ্ধিনাথ তাঁর সমবয়সী বাল্যবন্ধু, গোপালবাবুর বাড়ির পিছনেই তাঁর বাড়ি। পূর্বে সরকারী কলেজে প্রোফেসারি করতেন, বিদ্যার খ্যাতিও ছিল, কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় চাকরি গেছে। এখন আগের চাইতে অনেক ভাল আছেন, কিন্তু মাথার গোলমাল সম্পূর্ণ দূর হয় নি। সামান্য পেনশনে এবং বাড়িতে দু-চারটি ছাত্র পড়িয়ে কোনও রকমে সংসার চালান। তৃতীয় লোকটি রমেশ ডাক্তার, বয়স ত্রিশ, কাছেই বাড়ি, সম্প্রতি গোপালবাবুর শালী অসিতার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। রমেশ তার স্ত্রীর সঙ্গে রোজ এই সান্ধ্য আড্ডায় আসে। আজও দুজনে এসেছে।

 অসিতা সিদ্ধিনাথের কাছে পড়েছে, তাঁকে শ্রদ্ধাও করে। সবিনয়ে বললে, সার, মল্লিক মশায়ের ছেলে বেকার হ’তে যাবে কেন? পৈতৃক ব্যাবসাতে ভাল রোজগারও তো করতে পারে। পরের অন্নেই বা ভাগ পাড়বে কেন, তার বাপের তো অভাব নেই।

 সিদ্ধিনাথ বললেন, মল্লিকের ছেলে হাইকোর্টের জজ হ’তে পারে, জওহরলাল বা বিড়লা-ডালমিয়াও হ’তে পারে, বহ লোককে অন্নদানও করতে পারে। কিন্তু আমি শ‍ুধু, তাকে উদ্দেশ করে বলি নি, যারা জন্মাচ্ছে তাদের অধিকাংশের যে দশা হবে তাই ভেবে বলেছি।

 গোপালবাবু বললেন, দেখ সিধু, আমরা তোমার মতন পণ্ডিত নই, কিন্তু এটুকু জানি, দেশে যে খাদ্য জন্মায় তাতে সকলের কুলয় না, আর লোকসংখ্যাও অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার অবশ্যই করতে হবে, তার চেষ্টাও হচ্ছে। কিন্তু হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। যিনি জীবের সৃষ্টিকর্তা তিনিই রক্ষাকর্তা এবং আহারদাতা।

 সিদ্ধিনাথ। সৃষ্টিকর্তা সব সময় রক্ষা করেন না, আহারও দেন না। পঞ্চাশ ষাট বৎসর আগে ওসব মোলায়েম কথা বলা চলত, যখন দেশ ভাগ হয় নি, লোকসংখ্যাও অনেক কম ছিল। তখন এক কবি সুজলাং সুফলাং শস্যশ্যামলাং ব’লে জন্মভূমির বন্দনা করেছিলেন, আর এক কবি গেয়েছিলেন —চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য, দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন। এখন দেশ বিদেশ থেকে অন্ন আমদানি করতে হচ্ছে।

 গোপাল। সরকার ফসল বাড়াবার যে পরিকল্পনা করেছেন তাতে এক বছরের মধ্যেই আমরা নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে পারব।

 সিদ্ধিনাথ। হাঁ, যদি কর্তাদের উপদেশ অনুসারে চাল আটার বদলে টাপিওকা রাঙা আলু আর মহামূল্য ফল খেয়ে পেট ভরাতে পার। যদি ঘাস হজম করতে শেখ, আসল দুধের বদলে সয়া বীন বা চীনে বাদাম গোলা জলে তুষ্ট হও, যদি উপোসী বেরালের মতন মাছের অভাবে আরসোলা টিকটিকি খেতে পার তবে আরও চটপট স্বয়ম্ভর হ’তে পারবে।

 গোপাল। শ‍ুনছি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে দুগ্ধতরু আসছে, যা পয়ম্বিনী গাভীর মতন দুগ্ধ ক্ষরণ করে।

 সিদ্ধিনাথ। আরও কত কি শুনবে। রাশিয়া থেকে এক্সপার্ট আসবেন যিনি ব্যাং থেকে রুই কাতলা তৈরি করবেন। শোন গোপাল, কর্তারা যতই বলুন, লোক না কমালে খাদ্যাভাব যাবে না।

 রমেশ ডাক্তার লাজুক লোক, পত্নীর ভূতপূর্ব শিক্ষককে একটু ভয়ও করে। আস্তে আস্তে বললে, আমার মতে জন— সাধারণকে বার্থ কনট্রোল শেখাবার জন্য হাজার হাজার ক্লিনিক খোলা দরকার।

 সিদ্ধিনাথ। তাতে ছাই হবে। শিক্ষিত অবস্থাপন্ন লোকদের মধ্যে কিছ, ফল হ’তে পারে, কিন্তু আর সকলেই বেপরোয়া বংশবৃদ্ধি করতে থাকবে। যত দুর্দশা বাড়বে ততই মা ষষ্ঠীর দয়া হবে, কেল্টে ভূল্টু বুঁচী পেঁচীতে ঘর ভ’রে যাবে। বহংকাল পূর্বেই হার্বার্ট স্পেনসার আবিষ্কার করেছিলেন যে যারা ভাল খায় তাদের সন্তান অল্প হয়, যাদের অন্নাভাব তাদেরই বংশবৃদ্ধি বেশী।

 গোপাল। তা তুমি কি করতে বল?

 সিদ্ধিনাথ। প্রাচীন কালে গ্রীসে স্পার্টা প্রদেশের কি প্রথা ছিল জান? সন্তান ভূমিষ্ঠ হ’লেই তার বাপ তাকে একটা চাঙারিতে শ‍ুইয়ে পাহাড়ের ওপর রেখে আসত। পরদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তাকে ঘরে আনা হ’ত। এর ফলে খুব মজবুত শিশুরোই রক্ষা পেত, রোগা পটকারা বেঁচে থেকে সুস্থ বলিষ্ঠ প্রজার অন্নে ভাগ বসাত না। এদেশেও সেইরকম একটা কিছু ব্যবস্থা দরকার।

 গোপাল। কি রকম ব্যবস্থা চাও ব’লে ফেল।

 সিদ্ধিনাথ। কোনও লোকের দুটোর বেশী সন্তান থাকবে না—

 গোপাল। ব্রহ্মচর্য চালাতে চাও নাকি?

 সিদ্ধিনাথ। পুলিস বাড়ি বাড়ি খানাতল্লাশ ক’রে বাড়তি ছেলেমেয়ে কেড়ে নেবে, যেমন মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে বেওয়ারিস কুকুর ধ’রে নিয়ে যায়। তার পর লিথাল ভ্যানে—

 গোপাল। মহাভারত! তোমার যদি ছেলেপিলে থাকত তবে এমন বীভৎস কথা মুখে আনতে পারতে না।

 সিদ্ধিনাথ। রাষ্ট্রের মঙ্গলের কাছে সন্তানস্নেহ অতি তুচ্ছ। আমি যা বললাম তাই হচ্ছে একমাত্র কার্যকর উপায়। এর ফলে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই সন্তান নিয়ন্ত্রণের জন্য উঠে প’ড়ে লাগবে। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক আরও কিছু করতে হবে। ডাক্তারদের দমন করা দরকার।

 অসিতা। বেওয়ারিস কুকুরের মতন ঠেঙিয়ে মারবেন নাকি?

 সিদ্ধিনাথ। তোমার ভয় নেই। ভবিষ্যতে মেডিক্যাল কলেজে খুব কম ভরতি করলেই চলবে।

 অসিতা। ডাক্তারদের দ্বারা জগতের কত উপকার হয়। জানেন? বসন্তের টিকে, কলেরার স্যালাইন, তার পর ইনসুলিন পেনিসিলিন—আরও কত কি। প্রতি বৎসরে কত লোকের প্রাণরক্ষা হচ্ছে খবর রাখেন?

 সিদ্ধিনাথ। ও, তুমি তোমার বরের কাছে এইসব শিখেছ বুঝি? প্রাণরক্ষা ক’রে কৃতার্থ করেছেন! কতকগুলো ক্ষীণজীবী লোক, রোগের সঙ্গে লড়বার যাদের স্বাভাবিক শক্তি নেই, তাদের প্রাণরক্ষায় সমাজের লাভ কি? বিস্তর টাকা খরচ ক’রে ডিসপেপসিয়া ডায়াবিটিস ব্লাডপ্রেশার থ্রম্বোসিস আর প্রস্টেট রোগগ্রস্ত অকর্মণ্য লোকদের বাঁচিয়ে রাখলে দেশের কোন্ উপকার হয়? যারা স্বাস্থ্যবান পরিশ্রমী কাজের লোক, যারা বীর বিধান প্রজ্ঞাবান কবি কলাবিৎ, কেবল তাদেরই বাঁচবার অধিকার আছে। তাদের সেবা করতে সমর্থ স্ত্রীলোকেরও বাঁচা দরকার। তা ছাড়া আর সকলেই আগাছার মতন উৎপাটিতব্য।

 গোপাল। ওহে রমেশ, এবারে সিধুবাবুর হাঁপানির টান হ’লে ওষুধ দিও না, বিছানা থেকে উৎপাটিত ক’রে একটা রিকশয় তুলে কেওড়াতলায় ফেলে দিও।

 সিদ্ধিনাথ। আমার কথা আলাদা, বেঁচে থাকলে জগতের লাভ। আমার মতন স্পষ্টবাদী জ্ঞানী উপদেষ্টা এদেশে আর নেই।


গোপালবাবুর গৃহিণী নমিতাদেবী একটা ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বয়স বেশী না হ'লেও এ’র ধাতটি সেকেলে। অসিতা তার দিদিকে আধুনিকী করবার জন্য অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। নমিতা এই সান্ধ্য আড্ডাটির উপর খুশী নন, বিশেষত সিদ্ধিনাথকে তিনি চক্ষে দেখতে পারেন না; বলেন, পাগল না হাতি, শুধ, ভিটকিলিমি, কুকথার ধুকড়ি। গত কাল সেকরা নমিতার ফরমাশী নথ দিয়ে গিয়েছিল। তা দেখতে পেয়ে সিদ্ধিনাথ কিঞ্চিৎ অপ্রিয় মন্তব্য করেছিলেন। তারই শোধ তোলবার জন্য আজ নমিতা যুদ্ধের সাজে দর্শন দিলেন। নাকে নথ, কানে মাকড়ি, গলায় চিক, হাতে অনন্ত আর বালা, কোমরে গোট। কোথা থেকে একটা বাঁকমলও যোগাড় ক’রে পায়ে পরেছেন।

 সিদ্ধিনাথ বললেন, আসুন মিসেস মুখুজ্যে।

 নমিতা। মিসেস আবার কি? আমি ফিরিঙ্গী হয়ে গেছি নাকি? বউদিদি বলতে মুখে বাধল কেন?

 সিদ্ধিনাথ। আর বলা চলবে না, এত দিন ভুল ধারণার বশে বলেছি। আজ সকালে হিসেব ক’রে দেখলুম গোপাল আমার চাইতে আট দিনের ছোট। যদি অনুমতি দেন তো এখন থেকে বউমা বলতে পারি।

 নমিতা। বেশ, তাই না হয় বলবেন।

 সিদ্ধিনাথ। বউমা, একটু সামনে দাঁড়াও তো।

 নমিতা কোমরে হাত দিয়ে বীরাঙ্গনার মতন সগর্বে দাঁড়ালেন। সিদ্ধিনাথ এক মিনিট নিরীক্ষণ ক’রে চোখ বুজলেন। নমিতা বললেন, চোখ ঝলসে গেল নাকি?

 সিদ্ধিনাথ। উঁহ‍ু, আমি এখন ধ্যানস্থ। বিশ হাজার বৎসর পূর্বের ব্যাপার মানসনেত্রে দেখতে পাচ্ছি। মানুষ তখন বন্য, গ‍ুহায় বাস করে, পাথর আর হাড়ের অস্ত্র দিয়ে শিকার করে। জনসংখ্যা খুব কম, গৃহিণী সহজে জোটে না, জবরদস্তি ক’রে ধ’রে আনতে হয়। দেখছি—একটা ষণ্ডা লেংটা পুর‍ুষ, আমাদের গোপালের সঙ্গে একটু আদল আছে, কিন্তু মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, মাথায় জটা, পড়া চুল, হাতে একটা হাড়ের ডাণ্ডা। সে বউ খুঁজতে বেরিয়েছে। নদীর ধারে একটা মেয়ে গ‍ুগলি কুড়চ্ছে, এই বউমার সঙ্গে একটু মিল আছে। পুরুষটা কোনও প্রেমের কথা বললে না, উপহার দিলে না, খোশামোদও করলে না, এসেই ধাঁই ক’রে এক ঘা লাগালে। মেয়েটা মুখে থুবড়ে পড়ল, কপাল ফেটে রক্ত পড়তে লাগল। তার পর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে লোকটা নিজের আস্তানায় এল এবং নাকে বেতের আংটা পরিয়ে তাতে দড়ি লাগিয়ে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিলে, যেমন বলদকে বাঁধা হয়। তব্দ মেয়েটা পালাবার চেষ্টা করছে দেখে তার পায়ের পাতা চিরে রক্তপাত করলে, দদ কান ফুঁড়ে কড়া পরিয়ে দিলে, গলায় হাতে কোমরে আর পায়ে চামড়ার বেড়ি লাগিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেললে। এইরকম আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধনের পর ক্রমে ক্রমে মেয়েটা পোষ মানল, স্বামীর ওপর ভালবাসাও হ’ল। অল্প কালের মধ্যে সকল মেয়েরই ধারণা হ’ল যে নির্যাতনের চিহ্নই হচ্ছে অলংকার আর সৌভাগ্যবতীর লক্ষণ। তার পর হাজার হাজার বৎসর কেটে গেল, ঘরে বউ আনা সহজ হ’ল, সোনা রূপোর গহনার চলন হ’ল, কিন্তু প্রসাধনের রীতি আর গহনার ছাঁদে আদিম বর্বরতার ছাপ রয়ে গেল। সেকালে যা কপালের রক্ত ছিল তা হ’ল সিঁদুর, পায়ের রক্ত হ’ল আলতা। পূর্বে যা বউ বাঁধবার আংটা কড়া আর বেড়ি ছিল, পরে তা নথ মাকড়ি হার বালা গোট আর মলে পরিবর্তিত হ’ল। সংস্কৃতে ‘নাথ’-এর একটি অর্থ বলদের নাকের দড়ি। তা থেকেই নথ আর নথি শব্দ হয়েছে। আজকালকার যা শৌখিন গহনা তাতেও বর্বর যুগের ছাপ আছে। বউমা, জন্মান্তরের ইতিহাস শ‍ুনে চটে গেলে নাকি? তোমার বাপ মা নিশ্চয় সব জানতেন, তাই সার্থক নাম রেখেছেন নমিতা, অর্থাৎ যাকে নোয়ানো হয়েছে।

 নমিতা বললেন, আপনার বাপ মাও সার্থক নাম রেখেছিলেন। সিদ্ধিনাথের বদলে গাঁজানাথ নাম হ’লে আরও ঠিক হ’ত। এখানে যা সব বললেন বাড়ি গিয়ে গিন্নীর কাছে বলুন না, মজা টের পাবেন। এই ব’লে নমিতা চ’লে গেলেন।


গোপালবাবু বললেন, ওহে সিদ্ধিনাথ, বক্তৃতার চোটে আমার গিন্নীকে তো ঘর থেকে তাড়ালে, এইবার শালীটিকে একটা লেকচার দাও, ছাত্রী ব’লে দয়া ক’রো না।

 সিদ্ধিনাথ অসিতার দিকে চেয়ে বললেন, হাত দুটো অমন ক’রে ঘোরাচ্ছ কেন?

 অসিতা। ঘোরাচ্ছি আবার কোথা। দেখছেন না, একটা মফলার বুনছি। আপনারই জন্য।

 সিদ্ধিনাথ। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। হাত সুড়সুড় করছে ব’লেই বুনছ, আমাকে দেবে সে একটা উপলক্ষ মাত্র। লেস-পশম বোনা, চরকা কাটা, মালা জপা, বাঁয়া তবলায় চাঁটি লাগানো, গল্প কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, ইও ইও ঘোরানো—এসবের কারণ একই। দরকারী জিনিস তৈরি করছি, দেশের মঙ্গল করছি, ভগবানের নাম নিচ্ছি, কলা চর্চা করছি, সাহিত্য রচনা করছি—এসব ছুতো মাত্র, আসল কারণ হাত সুড়সুড় করছে। এই সমস্ত কাজের মধ্যে ইও ইও ঘোরানোই নির্দোষ। কোনও ছল নেই, শুধুই খেলা।

 পাশের ঘর থেকে নমিতা বললেন, মফলারটা খবরদার ওকে দিস নি অসিতা, বিশ্বনিন্দুক নিমকহারাম লোক।

 সিদ্ধিনাথ। আমার চেয়ে যোগ্য পাত্র পাবে কোথা। আমার যদি ঠাণ্ডা না লাগে, হাঁপানি যদি না বাড়ে, তবে সকল লোকেরই লাভ। অসিতাও এই ভেবে কৃতার্থ হবে ষে একজন অসাধারণ গুণী লোকের জন্যই সে মফলার বুনছে।

 গোপাল। ওসব বাজে কথা রাখ। নমিতাকে দেখে তো পুরাকালের ইতিহাস আবিষ্কার ক’রে ফেললে। এখন অসিতাকে দেখে কি মনে হয় বল।

 সিদ্ধিনাথ নিজের মনে বলে যেতে লাগলেন, হাজার হাজার বৎসরেও মেয়েরা সাজতে শিখল না, কেবল ফ্যাশনের অন্ধ নকল। ঠোঁটে রং দেওয়ার ফ্যাশনটাই ধর। যারা চম্পকগৌরী অল্পবয়সী তাদেরই বিম্বাধর মানায়। সাদা বা কালোকে বা বুড়ীকে মানায় না। আজ বিকেলে চৌরঙ্গী রোডে দুটি অদ্ভুত প্রাণী দেখেছি। একজন বড়ী মেম, চুল পেকে শণের নুড়ি হয়ে গেছে, গাল তুবড়ে চামড়া কুঁচকে গেছে, তবু ঠোঁটে রগরগে লাল রং লাগিয়েছে। দেখাচ্ছে যেন তাড়কা রাক্ষসী, সদ্য ঋষি খেয়েছে। আর এক জন বাঙালী যুবতী, বেশ মোটা, অসিতার চাইতেও কালো, সেও ঠোঁটে লাল রং দিয়েছে।

 অসিতা। কেমন দেখাচ্ছে?

 সিদ্ধিনাথ। যেন ভাল্লুকে রাঙা আলু খাচ্ছে।

 অসিতা। সার, আমি কখনও ঠোঁটে রং লাগাই না।

 সিদ্ধিনাথ। তোমার বুদ্ধি আছে, আমার ছাত্রী তো! কালো মেয়ের যদি অধরচর্চা করবার শখ হয় তবে ঠোঁটে সোনালী তবক এঁটে দিলেই পারে, দামী পানের খিলির ওপর যা থাকে।

 অসিতা। কি ভয়ানক!

 সিদ্ধিনাথ। ভয়ানক কেন? মা কালীর যদি সোনার চোখ আর সোনার জিব মানায় তবে কালো মেয়ের সোনালী ঠোঁট নিশ্চয় মানাবে। তুমি পরীক্ষা ক’রে দেখতে পার।

 অসিতা। কি যে বলেন আপনি।

 সিদ্ধিনাথ। অর্থাৎ নতুন ফ্যাশন চালাবার সাহস তোমার নেই। কিন্তু সিনেমার অমুকা দেবী বা অমুক মন্ত্রীর কন্যা যদি ঠোঁটে সোনালী তবক আঁটে তবে তোমরাও আঁটবে। আচ্ছা, ডাক্তার বাবাজী, তুমি এই কালো মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?

 রমেশ তার লজ্জা দমন ক’রে বললে, কালো তো নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

 সিদ্ধিনাথ। ডাক্তার, তুমি চশমা বদলাও। তোমার বউ মোটেই উজ্জ্বল নয়, দস্তুর মতন কালো। কালোকেই লোকে আদর ক’রে শ্যামবর্ণ বলে। তবে হাঁ, তেল মেখে চুকচুকে হ’লে উজ্জ্বল বলা যেতে পারে।

 অসিতা। জানেন, একটি খুব ফরসা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ওঁর সম্বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু তাকে ছেড়ে আমাকেই পছন্দ করলেন।

 সিদ্ধিনাথ। শ‍ুনে খুশী হল‍ুম, ডাক্তারের আর্টিস্টিক বুদ্ধি আছে। গৌর বর্ণের ওপর লোকের ঝোঁক একটা মস্ত কুসংস্কার, স্নবারিও বটে। লোকে কি শ‍ুধু, সাদা কুকুর সাদা গরু সাদা ঘোড়া পোষে? মারবেলের মূর্তির চাইতে কষ্টি পাথর আর ব্রোঞ্জের মূর্তির আদর বেশী কেন? প্রাচ্যদেশবাসী খুব ফরসা হ’লে কুশ্রী দেখায়, গায়ের রং আর কালো চুলের কনট্রাস্ট দৃষ্টিকটু হয়। তার চাইতে কুচকুচে কালো বরং ভাল, যদিও চোখ আর দাঁত বেশী প্রকট হয়। আমাদের অসিতা হচ্ছে কপিলা গাইএর মতন সুন্দরী। গায়ে আরসোলা বসলে টের পাওয়া যায় না, কিন্তু ডেয়ে পিঁপড়ে বসলে বোঝা যায়।

 গোপাল। অসিতার ভাগ্য ভাল, অল্পেই রেহাই পেয়েছে, আবার সুন্দরী সার্টিফিকেটও আদায় করেছে।

দূ থেকে একটা কাঁসির খ্যানখেনে আওয়াজ এল। সিদ্ধিনাথ চমকে উঠলেন। নমিতা ঘরে এসে বললেন, শ‍ুনতে পাচ্ছেন না? যান ধান দৌড়ে যান, নইলে গিন্নী আপনার দফা সারবে।

সিদ্ধিনাথের পত্নী রান্না হয়ে গেলেই স্বামীকে ডাকবার জন্য একটা ভাঙা কাঁসি বাজান। সিদ্ধিনাথ তাঁর মুখেরা গৃহিণীকে ভয় করেন। বিনা বাক্যব্যয়ে হনহন ক’রে বাড়ির দিকে চললেন।

১৩৫৭