পরশ পাথর

রেশবাবু একটি পরশ পাথর পেয়েছেন। কবে পেয়েছেন, কোথায় পেয়েছেন, কেমন ক’রে সেখানে এল, আরও পাওয়া যায় কিনা— এসব খোঁজে আপনাদের দরকার কি। যা বলছি শুনে যান।

 পরেশবাবু মধ্যবিত্ত মধ্যবয়স্ক লোক, পৈতৃক বাড়িতে থাকেন, ওকালতি করেন। রোজগার বেশী নয়, কোনও রকমে সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়। একদিন আদালত থেকে বাড়ি ফেরবার পথে একটি পাথরের নাড়ি কুড়িয়ে পেলেন। জিনিসটি কি তা অবশ্য তিনি চিনতে পারেন নি, একটু নূতন রকম পাথর দেখে রাস্তার এক পাশ থেকে তুলে নিয়ে পকেটে পুরলেন। বাড়ি এসে তাঁর অফিস-ঘরের তালা খোলবার জন্য পকেট থেকে চাবি বার ক’রে দেখলেন তার রং হলদে। পরেশবাবু আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, ঘরের চাবি তো লোহার, পিতলের হ’ল কি করে? হয়তো চাবিটা কোনও দিন হারিয়েছিল, গৃহিণী তাঁকে না জানিয়েই চাবিওয়ালা ডেকে এই পিতলের চাবিটা করিয়েছেন, এত দিন পরেশবাবুর নজরে পড়ে নি।

 পরেশবাবু ঘরে ঢুকে মনিব্যাগ ছাড়া পকেটের সমস্ত জিনিস টেবিলের উপর ঢাললেন, তার পর দোতলায় উঠলেন। চাবির কথা তাঁর আর মনে রইল না। জলযোগ এবং ঘণ্টা খানিক বিশ্রামের পর তিনি মোকদ্দমার কাগজপত্র দেখবার জন্য আবার নীচের ঘরে এলেন এবং আলো জ্বাাললেন। প্রথমেই পাথরটি নজরে পড়ল। বেশ গোলগাল চকচকে নুড়ি, কাল সকালে তাঁর ছোট খোকাকে দেবেন, সে গ‍ুলি খেলবে। পরেশবাবু তাঁর টেবিলের দেরাজ টেনে পাথরটি রাখলেন। তাতে ছুরি কাঁচি পেনসিল কাগজ খাম প্রভৃতি নানা জিনিস আছে। কি আশ্চর্য! ছুরি আর কাঁচি হলদে হয়ে গেল। পরেশবাবু পাথরটি নিয়ে তাঁর কাচের দোয়াতে ঠেকালেন, কিছুই হ’ল না। তার পর একটা সীসের কাগজ-চাপায় ঠেকালেন, হলদে আর প্রায় ডবল ভারী হয়ে গেল। পরেশবাবু কাঁপা গলায় তাঁর চাকরকে ডেকে বললেন, হরিয়া, ওপর থেকে আমার ঘড়িটা চেয়ে নিয়ে আয়। হরিয়া ঘড়ি এনে দিয়ে চ’লে গেল। নিকেলের সম্ভা হাত-ঘড়ি, তাতে চামড়ার ফিতে লাগানো। পাথর ছোঁয়ানো মাত্র ঘড়ি আর ফিতের বকলস সোনা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটা বন্ধ হ’ল, কারণ স্প্রিংও সোনা হয়ে গেছে, তার আর জোর নেই।

 পরেশবাবু কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলেন। ক্রমশ তাঁর জ্ঞান হ’ল যে তিনি অতি দুর্লভ পরশ পাথর পেয়েছেন যা ছোঁয়ালে সব ধাতুই সোনা হয়ে যায়। তিনি হাত জোড় ক’রে কপালে বার বার ঠেকাতে ঠেকাতে বললেন, জয় মা কালী, এত দয়া কেন মা? হরি, তুমিই সত্য তুমিই সত্য, একি লীলা খেলছ বাবা? স্বপ্ন দেখছি না তো? পরেশবাবু তাঁর বাঁ হাতে একটি প্রচণ্ড চিমটি কাটলেন, তবু ঘুম ভাঙল না, অতএব স্বপ্ন নয়। তাঁর মাথা ঘারতে লাগল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। শকুন্তলার মতন তিনি বুকে হাত দিয়ে বললেন, হৃদয়, শান্ত হও; এখনই যদি ফেল কর তবে এই দেবতার দান কুবেরের ঐশ্বর্ষ ভোগ করবে কে? পরেশবাবু শুনেছিলেন, এক ভদ্রলোক লটারিতে চার লাখ টাকা পেয়েছেন শ‍ুনে আহ্লাদে এমন লাফ মেরেছিলেন যে কড়ি কাঠে লেগে তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল। পরেশবাবু নিজের মাথা দু হাত দিয়ে চেপে রাখলেন, পাছে লাফ দিয়ে ফেলেন।

ত্যন্ত দুঃখের মতন অত্যন্ত আনন্দও কালক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যায়। পরেশবাবু শীঘ্রই প্রকৃতিস্থ হলেন এবং অতঃপর কি করবেন তা ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ জানাজানি হওয়া ভাল নয়, কোন্ শত্রু কি বাধা দেবে বলা যায় না। এখন শ‍ুধু, তাঁর গৃহিণী গিরিবালাকে জানাবেন, কিন্তু মেয়েদের পেটে কথা থাকে না। পরেশবাব, দোতলায় গিয়ে একটু একটু করে সইয়ে সইয়ে পত্নীকে তাঁর মহা সৌভাগ্যের খবর জানালেন এবং তেত্রিশ কোটি দেবতার দিব্য দিয়ে বললেন, খবরদার, যেন জানাজানি না হয়।

 গৃহিণীকে সাবধান করলেন বটে, কিন্তু পরেশবাবু নিজেই একটু অসামাল হয়ে পড়লেন। শোবার ঘরের একটা লোহার কড়িতে পরশ পাথর ঠেকালেন, কড়িটা সোনা হওয়ার ফলে নরম হ’ল, ছাত বসে গেল। বাড়িতে ঘটি বাটি থালা বালতি যা ছিল সবই সোনা ক’রে ফেললেন। লোকে দেখে আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, এসব জিনিস গিলটি করা হ’ল কেন? ছেলে মেয়ে আত্মীয় বন্ধু নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল। পরেশবাবু ধমক দিয়ে বললেন, যাও যাও, বিরক্ত ক’রো না, আমি যাই করি না কেন তোমাদের মাথাব্যথা কিসের? প্রশ্নের ঠেলায় অস্থির হয়ে পরেশবাবু লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা প্রায় বন্ধ ক’রে দিলেন, মক্কেলরা স্থির করলে যে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

 এর পর পরেশবাবু ধীরে ধীরে অগ্রসর হ’তে লাগলেন, তাড়াতাড়ি করলে বিপদ হ’তে পারে। কিছু সোনা বেচে নোট পেয়ে ব্যাংকে জমা দিলেন, কম্পানির কাগজ আর নানারকম শেয়ারও কিনলেন। বালিগঞ্জে কুড়ি বিঘা জমির উপর প্রকাণ্ড বাড়ি আর কারখানা করলেন, ইট সিমেণ্ট লোহা কিছুরই অভাব হ’ল না, কারণ, কর্তাদের বশ করা তাঁর পক্ষে অতি সহজ। এক জায়গায় রাশি রাশি মরচে পড়া মোটরভাঙা লোহার টুকরো প’ড়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কত দর? লোহার মালিক অতি নির্লোভ, বললে, জঞ্জাল তুলে নিয়ে যান বাবু গাড়ি ভাড়াটা দিতে পারব না। পরেশবাবু রোজ দশ-বিশ মন উঠিয়ে আনতে লাগলেন। খাস কামরায় লুকিয়ে পরশ পাথর ছোঁয়ান আর তৎক্ষণাৎ সোনা হয়ে যায়। দশ জন গ‍ুর্খা দারোয়ান আর পাঁচটা বুলডগ কারখানার ফটকে পাহারা দেয়, বিনা হ‍ুকুমে কেউ ঢুকতে পায় না।

 সোনা তৈরি আর বিক্রি সব চেয়ে সোজা কারবার, কিন্তু রাশিপরিমাণে উৎপাদন করতে গেলে একলা পারা যায় না। পরেশবাবু কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন এবং অনেক দরখাস্ত বাতিল করে সদ্য এম. এস-সি পাস প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসকে দেড় শ টাকায় বাহাল করলেন। তার আত্মীয় স্বজন বিশেষ কেউ নেই, সে পরেশবাবুর কারখানাতেই বাস করতে লাগল। প্রিয়তোষ প্রাতঃকৃত্য স্নান আহার ইত্যাদির জন্য দৈনিক এক ঘণ্টার বেশী সময় নেয় না, সাত ঘণ্টা ঘুময়, আট ঘণ্টা কারখানার কাজ করে, বাকী আট ঘণ্টা সে তার কলেজের সহপাঠিনী হিন্দোলা মজুমদারের উদ্দেশে বড় বড় কবিতা আর প্রেমপত্র লেখে এবং হরদম চা আর সিগারেট খায়। অতি ভাল ছেলে, কারও সঙ্গে মেশে না, রবিবারে গির্জেতেও যায় না, কোনও বিষয়ে কৌতূহল নেই, কখনও জানতে চায় না এত সোনা আসে কোথা থেকে। পরেশবাবু মনে করেন, তিনি পরশ পাথর ছাড়া আর একটি রত্ন পেয়েছেন—এই প্রিয়তোষ ছোকরা। সে বৈদ্যুতিক হাপরে বড় বড় মুচিতে সোনা গলায় আর মোটা মোটা বাট বানায়। পরেশবাবু তা এক মারোয়াড়ী সিণ্ডিকেটকে বেচেন আর ব্যাংকের খাতায় তাঁর জমা অঙ্কের পর অঙ্ক বাড়তে থাকে। পরেশ-গৃহিণীর এখন ঐশ্বর্যের সীমা নেই। গহনা প’রে প’রে তাঁর সর্বাঙ্গে বেদনা হয়েছে, সোনার উপর ঘেন্না ধ’রে গেছে, তিনি শ‍ুধু দু হাতে শাঁখা এবং গলায় রুদ্রাক্ষ ধারণ করতে লাগলেন।


কিন্তু পরেশবাবুর কার্যকলাপ বেশী দিন চাপা রইল না। বাংলা সরকারের আদেশে পুলিসের লোক পিছনে লাগল। তারা সহজেই বশে এল, কারণ রামরাজ্যের রীতিনীতি এখনও তাদের রপ্ত হয় নি, দশ-বিশ ভরি পেয়েই তারা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বিজ্ঞানীর দল আহার নিদ্রা ত্যাগ ক’রে নানারকম জল্পনা করতে লাগলেন। যদি তাঁরা দু শ বৎসর আগে জন্মাতেন তবে অনায়াসে বুঝে ফেলতেন যে পরেশবাবু পরশ পাথর পেয়েছেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে পরশ পাথরের স্থান নেই, অগত্যা তাঁরা সিদ্ধান্ত করলেন যে পরেশবাবু কোনও রকমে একটা পরমাণু ভাঙবার যন্ত্র খাড়া করেছেন এবং ভাঙা পরমাণুর টুকরো জুড়ে জুড়ে সোনা তৈরি করছেন, যেমন ছেড়া ঁকাপড় থেকে কাঁথা তৈরি হয়। মুশকিল এই, যে পরেশবাবুকে চিঠি লিখলে উত্তর পাওয়া যায় না, আর প্রিয়তোষটা ইডিয়ট বললেই হয়, নিতান্ত পীড়াপীড়ি করলে বলে, আমি শ‍ুধু সোনা গলাই, কোথা থেকে আসে তা জানি না। বিদেশের বিজ্ঞানীরা প্রথমে পরেশবাবুর ব্যাপার গুজব মনে ক’রে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অবশেষে তাঁরাও চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

 বিশেষজ্ঞদের উপদেশে ঘাবড়ে গিয়ে ভারত সরকার স্থির করলেন যে পরেশবাবু ডেঞ্জারস পার্সন, কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না, কারণ পরেশবাবু কোনও বেআইনী কাজ করছেন না। তাঁকে গ্রেপতার এবং তাঁর কারখানা ক্লোক করবার জন্য একটা অর্ডিনান্স জারির প্রস্তাবও উঠল, কিন্তু ক্ষমতাশালী দেশী ও বিদেশী লোকদের আপত্তির জন্য তা হ’ল না। ব্রিটেন ফ্রান্স আমেরিকা রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের ভারতস্থ দূতেরা পরেশবাবুর উপর কড়া সুনজর রাখেন, তাঁকে বার বার ডিনারের নিমন্ত্রণ করেন। পরেশবাবু চুপচাপ খেয়ে যান, মাঝে মাঝে ইয়েস-নো বলেন, কিন্তু তাঁর পেটের কথা কেউ বার করতে পারে না, শ্যাম্পেন খাইয়েও নয়। বাংলা দেশের কয়েক জন কংগ্রেসী নেতা তাঁকে উপদেশ দিয়েছেন —রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য আপনার রহস্য শুধু আমাদের কজনকে জানিয়ে দিন। কয়েক জন কমিউনিস্ট তাঁকে বলেছেন—খবরদার, কারও কথা শুনবেন না মশায়, যা করছেন করে যান, তাতেই জগতের মঙ্গল হবে।

 আত্মীয় বন্ধু আর খোশামদের দল ক্রমেই বাড়ছে, পরেশবাবু তাঁদের যথাযোগ্য পারিতোষিক দিচ্ছেন, তবু কেউ খুশী হচ্ছে না। শত্রুর দল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চুপ ক’রে আছে। ঐশ্বর্যবৃদ্ধি হলেও পরেশবাবু তাঁর চাল বেশী বাড়ান নি, তাঁর গৃহিণীও সেকেলে নারী, টাকা ওড়াবার কায়দা জানেন না। তথাপি পরেশবাবুর নাম এখন ভুবনবিখ্যাত, তিনি নাকি চারটে নিজামকে পুষতে পারেন। তিনি কি খান কি পরেন কি বলেন তা ইওরোপ আমেরিকার সংবাদপত্রে বড় বড় হরপে ছাপা হয়। সম্প্রতি দেশবিদেশ থেকে প্রেমপত্র আসতে আরম্ভ করেছে। সুন্দরীরা নিজের নিজের ছবি পাঠিয়ে আর গ‍ুণবর্ণনা ক’রে লিখছেন, ডিয়ারেস্ট সার, আপনার পুরাতন পত্নীটি থাকুন, তাতে আমার আপত্তি নেই। আপনি তো উদারপ্রকৃতি হিন্দু, আমাকে শ‍ুদ্ধি ক’রে আপনার হারেমে ভরতি কর‍ুন, নয়তো বিষ খাব। এই রকম চিঠি প্রত্যহ রাশি রাশি আসছে আর গিরিবালা ছোঁ মেরে কেড়ে নিচ্ছেন। তিনি একটি মেম সেক্রেটারি রেখেছেন। সে প্রত্যেক চিঠির তরজমা শোনায় এবং গিরিবালার আজ্ঞায় জবাব লেখে। গিরিবালা রাগের বশে অনেক কড়া কথা ব’লে যান, কিন্তু মেমের বিদ্যা কম, শব্দ একটি কথা লেখে— ড্যাম, অর্থাৎ দূর মুখপড়ী, গলায় দেবার দড়ি জোটে না তোর? ইওরোপের দশজন নামজাদা বিজ্ঞানী চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে পরেশবাবু যদি সোনার রহস্য প্রকাশ করেন তবে তাঁরা চেষ্টা করবেন যাতে তিনি রসায়ন পদার্থ বিদ্যা আর শান্তি এই তিনটি বিষয়ের জন্য নোবেল প্রাইজ এক সঙ্গেই পান। এ চিঠিও পরেশ-গৃহিণী প্রেমপত্র মনে ক’রে মেমের মারফত জবাব দিয়েছেন- ড্যাম।

রেশবাবু সোনার দর ক্রমেই কমাচ্ছেন, বাজারে একশ পনর টাকা ভরি থেকে সাত টাকা দশ আনায় নেমেছে। ব্রিটিশ সরকার সস্তায় সোনা কিনে আমেরিকার ডলার-লোন শোধ করেছেন। আমেরিকা খুব রেগে গেছে, কিন্তু আপত্তি করবার যুক্তি স্থির করতে পারছে না। ভারতের স্টারলিং ব্যালান্সও ব্রিটেন কড়ায় গণ্ডায় শোধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু এদেশের প্রধান মন্ত্রী উত্তর দিয়েছেন—আমরা তোমাদের সোনা ধার দিই নি, ডলারও দিই নি; যুদ্ধের সময় জিনিস সরবরাহ করেছি, সেই দেনা জিনিস দিয়েই তোমাদের শ‍ুধতে হবে।

 অর্থনীতি আর রাজনীতির ধুরন্ধরগণ ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়েছেন, কোনও সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না। যদি এটা সত্য ত্রেতা বা দ্বাপর যুগে হ’ত তবে তাঁরা তপস্যা করে ব্রহ্মা বিষ্ণু, বা মহেশ্বরের সাহায্যে পরেশবাবুকে জব্দ করে দিতেন। কিন্তু এখন তা হবার জো নেই। কোনও কোনও পণ্ডিত বলছেন, প্লাটিনম আর র‍ূপো চালাও। অন্য পণ্ডিত বলছেন, উঁহ‍ু, তাও হয়তো সম্ভায় তৈরি হবে; রেডিয়ম বা ইউরেনিয়ম ট্যানডাড করা হক, কিংবা প্রাচীন কালের মতন বিনিময় প্রথায় লেন-দেন চলুকে।

 চার্চিলকে আর সামলানো যাচ্ছে না, তিনি খেপে গিয়ে বলছেন, আমরা কমনওয়েল‍্থের সর্বনাশ হ’তে দেব না, ইউএন-ওর কাছে নালিশ ক’রে সময় নষ্টও করব না। ভারতে আবার ব্রিটিশ শাসন স্থাপিত হ’ক, আমাদের ফৌজ গিয়ে ওই পরেশটাকে ধ’রে আনুক, আইল-অভ-ওআইটে ওকে নজরবন্দী করে রাখা হ’ক। সেখানে সে যত পারে সোনা তৈরি কর‍ুক, কিন্তু সে সোনা এম্পায়ার-সোনা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রসংঘের সম্পত্তি, আমরাই তার বিলি করব।

 বার্নার্ড শ বলেছেন, সোনা একটা অকেজো ধাতু, তাতে লাঙল কাস্তে কুড়ুল বয়লার এঞ্জিন কিছুই হয় না। পরেশবাবু সোনার মিথ্যা প্রতিপত্তি নষ্ট ক’রে ভাল করেছেন। এখন তিনি চেষ্টা কর‍ুন যাতে সোনাকে ইস্পাতের মতন শক্ত করা যায়। সোনার ক্ষুর পেলেই আমি দাড়ি কামাব।

 রাশিয়ার এক মুখপাত্র পরেশবাবুকে লিখেছেন, মহাশয়, আপনাকে পরম সমাদরে নিমন্ত্রণ করছি, আমাদের দেশে এসে বাস কর‍ুন, খাসা জায়গা। এখানে সাদায় কালোয় ভেদ নেই, আপনাকে মাথার মণি ক’রে রাখব। দৈবক্রমে আপনি আশ্চর্য শক্তি পেয়েছেন, কিন্তু মাপ করবেন, আপনার বুদ্ধি তেমন নেই। আপনি সোনা করতেই জানেন, কিন্তু তার সদ‍্ব্যবহার জানেন না। আমরা আপনাকে শিখিয়ে দেব। যদি আপনার রাজনীতিক উচ্চাশা থাকে তবে আপনাকে সোভিয়েট রাষ্ট্রমণ্ডলের সভাপতি করা হবে। মস্কো শহরে এক শ একার জমির উপর একটি সুন্দর প্রাসাদ আপনার বাসের জন্য দেব। আর যদি নিরিবিলি চান তবে সাইবিরিয়ায় থাকবেন, একটি আস্ত নগর আপনাকে দেব। চমৎকার দেশ, আপনাদের শাস্ত্রে যার নাম উত্তরকুর‍ু। এই চিঠিও গিরিবালা প্রেমপত্র ধ’রে নিয়ে জবাব দিয়েছেন—ড্যাম।


রেশবাবু সোনার দাম ক্রমশ খুব কমিয়েছেন, এখন সাড়ে চার আনা ভরি। সমস্ত পৃথিবীতে খনিজ সোনা প্রতি বৎসরে আন্দাজ বিশ হাজার মন উৎপন্ন হয়, এখন পরেশবাবু একাই বৎসরে লাখ মন ছাড়ছেন। গোল্ড স্ট্যানডার্ড অধঃপাতে গেছে। সব দেশেই ভীষণ ইনফ্লেশন, নোট আর ধাতুমুদ্রা খোলাম কুচির সমান হয়েছে। মজুরি আর মাইনে বহ‍ু গ‍ুণ বাড়িয়েও লোকের দুর্দশা ঘুচছে না। জিনিসপত্র অগ্নিমমূল্য, চারিদিকে হাহাকার পড়ে গেছে।

 ভিন্ন ভিন্ন দলের দশ জন অনশনব্রতী মৃত্যুপণ ক’রে পরেশবাবুর ফটকের সামনে শ‍ুয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি বেনামা চিঠি পাচ্ছেন— তুমি জগতের শত্রু, তোমাকে খুন করব। পরেশবারও ঐশ্বর্ষে অরুচি ধ’রে গেছে। গিরিবালা কান্নাকাটি আরম্ভ করেছেন, কেবলই বলছেন, যদি শান্তিতে থাকতে না পারি তবে ধনদৌলত নিয়ে কি হবে। সর্বনেশে পাথরটাকে বিদায় কর, সব সোনা গঙ্গায় ফেলে দিয়ে কাশীবাস করবে চল।


রেশবাবু মনস্থির করে ফেললেন। সকালবেলা প্রিয়তোষকে সোনা তৈরির রহস্য জানিয়ে দিলেন।

 প্রিয়তোষ নির্বিকার। পরেশবাবু তাকে পরশপাথরটা দিয়ে বললেন, এটাকে আজই ধ্বংস ক’রে ফেল, পুড়িয়ে, অ্যাসিডে গলিয়ে, অথবা অন্য যে কোনও উপায়ে পার। প্রিয়তোষ বললে, রাইট-ও।

 বিকালবেলা একজন দারোয়ান দৌড়ে এসে পরেশবাবুকে বললে, জলদি আসুন হ‍ুজুর, বিসোআস সাহেব পাগলা হয়ে গেছেন, আপনাকে ডাকছেন। পরেশবাবু তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলেন, প্রিয়তোষ তার শোবার ঘরে খাটিয়ায় শুয়ে কাঁদছে। পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কি? প্রিয়তোষ উত্তর দিলে, এই চিঠিটা প’ড়ে দেখুন সার। পরেশবাবু পড়লেন —

 প্রিয় হে প্রিয়, বিদায়। বাবা রাজী নন, তাঁর নানা রকম আপত্তি। তোমার চাল-চুলো নেই, পরের বাড়িতে থাক, মোটে দেড় শ টাকা মাইনে পাও, তার ওপর আবার জাতে খীষ্টান, আবার আমার চাইতে বয়সে এক বৎসরের ছোট। বললেন, বিয়ে হতেই পারে না। আর একটি খবর শোন। গুঞ্জন ঘোষের নাম শনেছ? চমৎকার গায়, সুন্দর চেহারা, কোঁকড়া চুল। সিভিল সম্পাইএ ছ শ টাকা মাইনে পায়, বাপের একমাত্র ছেলে, বাপ কনট্রাকটারি ক’রে নাকি কোটি টাকা করেছে। সেই গ‍ুঞ্জনের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দঃখ ক’রো না, লক্ষ্মীটি। বকুল মল্লিককে চেন তো? আমার চেয়ে তিন বছরের জুনিয়ার, ডায়োসিসানে এক সঙ্গে পড়েছি। আমার কাছে দাঁড়াতে পারে না, তা হ’ক, অমন মেয়ে হাজারে একটি পাবে না। বকুলকে বাগাও, তুমি সখী হবে। প্রিয় ডারলিং, এই আমার শেষ প্রেমপত্র, কাল থেকে তুমি আমার ভাই, আমি তোমার স্নেহময়ী দিদি। ইতি। আজ পর্যন্ত তোমারই —হিন্দোলা।

 চিঠি প’ড়ে পরেশবাবু বললেন, তুমি তো আচ্ছা বোকা হে! হিন্দোলা নিজেই স’রে পড়ছে, এ তো অতি সুখবর, এতে দুঃখ কিসের? তোমার আবার কালীঘাটে পূজো দেওয়া চলবে না, না হয় গির্জেয় দুটো মোমবাতি জ্বেলে দিও। নাও, এখন ওঠ, চোখে মুখে জল দাও, চা আর খানকতক লুচি খাবে এস। হাঁ, ভাল কথা —পাথরটার কোনও গতি করতে পারলে?

 প্রিয়তোষ করুণ স্বরে বললে, গিলে ফেলেছি সার। এ প্রাণ আর রাখব না, আপনার পাথর আমার সঙ্গেই কবরে যাবে। ওঃ, এত দিনের ভালবাসার পর এখন কিনা গ‍ুঞ্জন ঘোষ!

 পরেশবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, পাথরটা গিললে কেন? বিষ নাকি?

 প্রিয়তোষ বললে, কম্পোজিশন তো জানা নেই সার, কিন্তু মনে হচ্ছে ওটা বিষ। যদি বিষ নাও হয়, যদি আজ রাত্রির মধ্যে না মরি, তবে কাল সকালে নিশ্চয় দশ গ্রাম পটাশ সায়ানাইড খাব, আমি ওজন ক’রে রেখেছি। আপনি ভাববেন না সার, আপনার পাথর আমার সঙ্গেই কবরস্থ হয়ে থাকবে, সেই ডে অভ জজমেণ্ট পর্যন্ত।

 পরেশবাবু বললেন, আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে! ওসব বদখেয়াল ছাড়, আমি চেষ্টা করব যাতে হিন্দোলার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়। ওর বাপ জগাই মজুমদার আমার বাল্যবন্ধু, ঘুঘু লোক। তোমাকে আমি ভাল রকম যৌতুক দেব, তা শুনলে হয়তো সে মেয়ে দিতে রাজী হবে। কিন্তু তুমি যে খীষ্টান —

 — হিদুঁ, হব সার।

 — একেই বলে প্রেম। এখন ওঠ, ডাক্তার চ্যাটার্জির কাছে চল, পাথরটাকে তো পেট থেকে বার করতে হবে।


রেশবাবু জানালেন যে প্রিযতোষ অন্যমনস্ক হয়ে একটা পাথরের নুড়ি গিলে ফেলেছে। ডাক্তারের উপদেশে পরদিন এক্স রে ফোটো নেওয়া হ’ল। তা দেখে ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, এমন কেস দেখা যায় না, কালই আমি লানসেটে রিপোর্ট পাঠাব। এই ছোকরার অ্যাসেণ্ডিং কোলনের পাশ থেকে ছোট্ট একটি সেমিকোলন বেরিয়েছে, তার মধ্যে পাথরটা আটকে আছে। হয়তো আপনিই নেমে যাবে। এখন যেমন আছে থাকুক, বিশেষ কোনও ক্ষতি হবে না। যদি খারাপ লক্ষণ দেখা দেয় তবে পেট চিরে বার করে দেব।


রেশবাবুর চিঠি পেয়ে জগাই মজমদার তাড়াতাড়ি দেখা করতে এলেন এবং কথাবার্তার পর ছুটে গিয়ে তাঁর মেয়েকে বললেন, ওরে দোলা, প্রিয়তোষ হিন্দ, হ’তে রাজী হয়েছে, তাকেই বিয়ে কর। দেরি নয়, ওর শ‍ুদ্ধিটা আজই হয়ে যাক, কাল বিয়ে হবে।

 হিন্দোলা আকাশ থেকে পড়ে বললে, কি তুমি বলছ বাবা! এই পরশু বললে গ‍ুঞ্জন ঘোষ, আবার আজ বলছ প্রিয়তোষ! এই দেখ, গ‍ুঞ্জন আমাকে কেমন হীরের আংটি দিয়েছে। বেচারা মনে করবে কি? তুমি তাকে কথা দিয়েছ, আমিও দিয়েছি, তার খেলাপ হ’তে পারে না। গ‍ুঞ্জনের কাছে কি প্রিয়তোষ? কিসে আর কিসে!

 জগাইবাবু বললেন, যা যাঃ, তুই তো সব বুঝিস। প্রিয়তোষ এখন হিরণ্যগর্ভ হয়েছে, তার পেটে সোনার খনি। যবে হ’ক একদিন বেরবেই, তখন সেই পরশ পাথর তোরই হাতে আসবে। পরেশবাবু সেটা আর নেবেন না, প্রিয়তোষকে যৌতুক দিয়েছেন। ফেরত দে ওই হীরের আংটী, অমন হাজারটা আংটি প্রিয়তোষ তোকে দিতে পারবে। এমন সুপাত্রের কাছে কোথায় লাগে তোর গ‍ুঁজে ঘোষ আর তার কনট্রাকটার বাপ? আর কথাটি নয়, প্রিয়তোষকেই বিয়ে কর্।

 অশ্রগদ‍্গদকণ্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হিন্দোলা বললে, তাকেই তো ভাল বাসতুম। কিন্তু বড্ড যে বোকা!

 জগাইবাবু বললেন, আরে বোকা না হলে তোকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? যার পেটে পরশ পাথর সে তো ইচ্ছে করলেই পৃথিবীর সেরা সুন্দরীকে বিয়ে করতে পারে।

প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসের মনে বিন্দুমাত্র অভিমান নেই। তার শ‍ুদ্ধি হ’ল, এক সের ভেজিটেব‍্ল ঘি দিয়ে হোম হ’ল, পাঁচ জন ব্রাহ্মণ লুচি-ছোঁকা-দই-বোঁদে খেলে। তার পর শভ লগ্নে হিন্দোলা-প্রিয়তোষের বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু জগাইবাবু আর তাঁর কন্যার মনস্কামনা পূর্ণ হল না, পাথরটা নামল না। কিছুদিন পরে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল —পরেশবাবুর তৈরি সমস্ত সোনার জেল্লা ধীরে ধীরে ক’মে যেতে লাগল, মাস খানিক পরে যেখানে যত ছিল সবই লোহা হয়ে গেল।

 ব্যাখ্যা খুব সোজা। সকলেই জানে যে ব্যর্থ প্রেমে স্বাস্থ্য যেমন বিগড়ে যায়, তৃপ্ত প্রেমে তেমনি চাঙ্গা হয়, দেহের সমস্ত যন্ত্র চটপট কাজ করে, অর্থাৎ মেটাবলিজম বেড়ে যায়। প্রিয়তোষ এক মাসের মধ্যে পরশ পাথর জীর্ণ ক’রে ফেলেছে, এক্স রে-তে তার কণামাত্র দেখা যায় না। পাথরের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে পরেশবাবুর সমস্ত সোনা পূর্বরূপ পেয়েছে।

 হিন্দোলা আর তার বাবা ভীষণ চটে গেছেন। বলছেন, প্রিয়তোষটা মিথ্যাবাদী ঠক জোচ্চোর। ধাপ্পায় বিশ্বাস ক’রে তাঁরা আশায় আশায় এত দিন বৃথাই ওই খীষ্টানটার ময়লা ঘেঁটেছেন। কিন্তু পরশ পাথর হজম ক’রে প্রিয়তোষ মনে বল পেয়েছে, তার বুদ্ধিও বেড়ে গেছে, পত্নী আর শ্বশ‍ুরের বাক্যবাণ সে মোটেই গ্রাহ্য করে না। এমন কি, হিন্দোলা যদি বলে, তোমাকে তালাক দেব, তবু সে সায়ানাইড খাবে না। সে বুঝেছে যে সেণ্ট ফ্রানসিস আর পরমহংস দেব খাঁটী কথা ব’লে গেছেন, কামিনী আর কাঞ্চন দইই রাবিশ; লোহার তুল্য কিছ নেই। এখন সে পরেশবাবুর নূতন লোহার কারখানা চালাচ্ছে, রোজ পঞ্চাশ টন নানা রকম মাল ঢালাই করছে, এবং বেশ ফুর্তিতে আছে।

১৩৫৫