গল্পকল্প/রামরাজ্য
রামরাজ্য
জেলা জজ সুবোধ রায় সম্প্রতি অবসর নিয়ে কলকাতায় বাস করছেন। তিনি এখন গীতা পড়েন, সম্প্রীক ঘন ঘন সিনেমা দেখেন, বন্ধুদের সঙ্গে ব্রিজ খেলেন এবং রাজনীতি নিয়ে তর্ক করেন। তাঁর আর একটি শখ আছে —প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে একটি সেয়াঁস বা প্রেতচক্রের অধিবেশন হয়। এই চক্রের সদস্য সাত জন, যথা—
সুবোধ রায় নিজে,
বিপাশা দেবী—তাঁর পত্নী,
হরিপদ কবিরত্ন—অধ্যাপক,
কানাই গাঙ্গুলী —প্রবীণ দেশপ্রেমী,
ভুজঙ্গ ভঞ্জ—নবীন দেশপ্রেমী,
অবধবিহারী লাল —কারবারী দেশপ্রেমী,
ভূতনাথ নন্দী—বিখ্যাত মিডিয়ম।
ভূতনাথ গুণী লোক। তিন মিনিট আবাহন করতে না করতে তার উপর পরলোকবাসীর ভর হয় এবং তার মুখ দিয়ে অনর্গল অলৌকিক বাণী বেরুতে থাকে। ভূতনাথের বয়স ত্রিশের মধ্যে। শোনা যায় পূর্বে সে স্কুলমাষ্টার ছিল, তার পর গল্প নাটক ও কবিতা লিখত, তার পর থিয়েটার সিনেমায় অভিনয় করত। এক কালে তার একটা কুস্তির আখড়াও ছিল। সম্প্রতি নিজের আশ্চর্য ক্ষমতা আবিষ্কার ক’রে সে পেশাদার মিডিয়ম হয়েছে, সবোধবাবু তার একজন বড় মক্কেল।
প্রেতচক্রের মামুলী পদ্ধতি হচ্ছে—অন্ধকার ঘরে সদস্যগণ টেবিলের চারিধারে বসেন এবং সকলে হাত ধরাধরি ক’রে কোনও পরলোকবাসীকে একমনে ডাকেন। কিন্তু সবোধবাবু খুঁতখুঁতে লোক। অন্ধকারে অন্য পুরুষ —বিশেষ ক’রে ওই ভুজঙ্গ ছোকরা— তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্থীর হাত ধ’রে থাকবে, এ তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। ভাগ্যক্রমে ভূতনাথকে পেয়ে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। লোকটির আশ্চর্য ক্ষমতা, প্রেতাত্মার দল যেন তার পোষ মানা। সে যেখানে মিডিয়ম হয় সেখানে হাত ধরার দরকার হয় না, অন্ধকার না হ’লেও চলে। এমন কি প্রেতাত্মার কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের মধ্যে গল্প করা চলে, চা সিগারেট পান খেতেও বাধা নেই।
আজ শনিবার সন্ধ্যাবেলায় নীচের বড় ঘরে যথারীতি প্রেতচক্রের বৈঠক বসেছে, সকল সদস্যই উপস্থিত আছেন। ঘরে আলো জ্বলছে, কিন্তু সব দরজা জানালা বন্ধ, পাছে কোনও উটকো লোক এসে বিঘ্ন ঘটায়।
পূর্বে কয়েকটি অধিবেশনে চন্দ্রগুপ্ত সিরাজদ্দৌলা নেপোলিয়ন হিটলার প্রভৃতি নামজাদা লোক এবং পরলোকগত অনেক আত্মীয় স্বজন ভূতনাথের মারফত তাঁদের বাণী বলেছেন। সবোধবাবু প্রশ্ন করলেন, আজ কাকে ডাকা হবে?
ভুজঙ্গ ভঞ্জ বললে, আমার দাদামশাইকে একবার ডাকুন। তাঁর ভিকটোরিয়া মার্কা গিনিগুলো কোথায় রেখে গেছেন খুঁজে পাচ্ছি না।
অবধবিহারী লাল বললে, দাদা চাচা মামু মৌসা উ সব ছোড়িয়ে দেন, মহাৎমাজীকো বোলান। দেখছেন তো, দেশ জহান্নামে যাচ্ছে, তিনি একটা সলাহ্ দেন জৈসে তুরন্ত্ রামরাজ্য হইয়ে যায়।
কানাই গাঙ্গুলী বললে, তাঁকে আর কষ্ট দেওয়া কেন, ঢের ক’রে গেছেন, এখন বিশ্রাম করুন।
ভুজঙ্গ ভঞ্জ বললে, মহাত্মাজীকে ডেকে লাভ নেই, তিনি কি বলবেন তা তো জানাই আছে। —চরকা চালাও, মাইনে কম নাও, হাইস্কি ছাড়, বান্ধবীদের তাড়াও, ৱহ্মচর্য পালন কর। এসব শুনতে গেলে কি রাজ্য চালানো যায়। কি বলেন কানাই-দা?
বিপাশা দেবী বললেন, আচ্ছা, মহাত্মাজীর যিনি ইষ্টদেব সেই রামচন্দ্রকে ডাকলে হয় না?
অবধবিহারী। বহুত অচ্ছি বাত বোলিয়েছেন, রামচন্দ্রজীকোই বোলান।
সুবোধ। সেই ভাল, রামরাজ্যের ফার্স্টহ্যাণ্ড খবর মিলবে।
ভুজঙ্গ। তাঁকে কোথায় পাবেন? তিনি ঐতিহাসিক পুরুষ কিনা তারই ঠিক নেই। ভূতনাথবাবু কি বলেন?
ভূতনাথ। চেষ্টা ক’রে দেখা যেতে পারে।
বিপাশা দেবীর প্রস্তাব সোৎসাহে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হ’ল। তখন সকলে গুনগুন ক’রে ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ গাইতে লাগলেন। দ্যুমিনিট পরে ভূতনাথ চোখ কপালে তুলে মুখ উঁচু ক’রে চেয়ারে হেলে পড়ল এবং অস্ফূট গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। সবোধবাবু সসম্ভ্রমে বললেন, কনট্রোল এসে গেছেন,—অর্থাৎ মিডিয়মের উপর অশরীরী, আত্মার আবেশ হয়েছে। অবধবিহারী ব’লে উঠল, রাজা রামচন্দ্রজীকি জয়!
ভূতনাথের মুখ থেকে শব্দ হ’ল—খ্যাঁক খ্যাঁক। সবোধবাবু বললেন, কে আপনি প্রভু?
অবধবিহারী। রাষ্ট্রভাষা হিন্দীমে পুছিয়ে, রামচন্দ্রজী বাংলা সমঝেন না। অপ কৌন হৈঁ মহারাজ?
আবার খ্যাঁক খ্যাঁক। কবিরত্ন হাতজোড় ক’রে সবিনয়ে বললেন, প্রভু, যদি আমাদের অপরাধ হয়ে থাকে তো মার্জনা করুন। কৃপাপূর্বক বলুন কে আপনি।
ভূতনাথের মুখ থেকে উত্তর বেরুল— অহম্মারুতিঃ।
অবধবিহারী। আরে, ই তো চীনা বোলি বোলছে!
কবিরত্ন। চীনা নয়, দেবভাষায় বলছেন —আমি মারুতি। স্বয়ং পবননন্দন শ্রীহনুমানের আবির্ভাব হয়েছে।
অবধবিহারী। জয় বজরঙ্গবলী মহাবীরজী!—
রাম কাজ লগি তব অবতারা।
কনক বরন তন পর্বতাকারা॥
প্রভু, অপ হিন্দীমে কহিয়ে, রামরাজ্যকি ভাষা।
ভূতনাথের জবানিতে মহাবীর আর একবার সজোরে খ্যাঁক ক’রে উঠলেন, তার পর বললেন, রামরাজ্যের ভাষার তুমি কি জান হে? এখন গন্ধমাদনে থাকি, কিন্তু আমার আদি নিবাস কিষ্কিন্ধ্যা, মাইসোরের কাছে বেলারি জেলায়। আমার মাতৃভাষাই জগতের আদি ও বনিয়াদী ভাষা। যদি সে ভাষায় কথা বলি তবে তোমাদের রাজাজী আর পট্টভিজী হয়তো একটু আধটু বুঝবেন, কিন্তু জহরলালজী রাজেন্দ্রজী আর তোমরা বিন্দুবিসর্গও বুঝবে না।
বিপাশা। যাক যাক। আপনি যখন বাংলা জানেন তখন বাংলাতেই বলুন।
মহাবীর। কিরকম বাংলা? ঢাকাই, না মানভূমের, না বাগবাজারী, না বালিগঞ্জী?
বিপাশা। আপনি মাঝামাঝি ভবানীপুরী বাংলায় বলুন, তা হ’লে আমরা সবাই বুঝতে পারব।
কবিরত্ন। প্রভু মারুতি, আপনার আগমনে আমরা ধন্য হয়েছি, কিন্তু ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এলেন না কেন?
মহাবীর। তাঁর আসতে বয়ে গেছে। তোমাদের কিএমন পুণ্য আছে যে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চাও? তাঁর আজ্ঞায় আমি এসেছি। এখন কি জানতে চাও চটপট ব’লে ফেল, আমার সময় বড় কম।
সুবোধ। শুনুন মহাবীরজী। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু আর কিছুই পাই নি।—
কবিরত্ন। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, গৃহ নেই, ধর্ম নেই, সত্য নেই, ত্যাগ নেই, বিনয় নেই, তপস্যা নেই—
অবধবিহারী। বিলকুল চোর, ডাকু, লুটেরা, কালাবাজারুয়া, গাঁঠ-কটৈয়া—
ভুজঙ্গ। পুঁজিপতির অত্যাচার, সর্বহারার আর্তনাদ, জুলুম, ফাসিজ্ম, ধাপ্পাবাজি, কথার তুবড়ি, ভাইপো-ভাগনে-শালা-শালী-পিসতুতো-মাসতুতো-ভরণতন্ত্র —
কানাই। বিদেশী গরুর প্ররোচনায় স্বদেশদ্রোহিতা, ভারতের আদর্শ বিসর্জন, স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যার প্রচার, কিষান-মজুদরকে কুমন্ত্রণা, বোকা ছেলেমেয়েদের মাথা খাওয়া, পিস্তল, বোমা—
মহাবীর। থাম থাম। কি চাও তাই বল।
অবধবিহারী। হামি বোলছি, শুনেন মহাবীরজী।— চারো তরফ ঘূস-খবৈয়া, সব মুনাফা ছিনিয়ে লিচ্ছে। বড় কষ্টে রহেছি, যেন দাঁতের মাঝে জিভ। বিভীখনজী জৈসা বোলিয়েছেন—
সুনহু পবনসুতে রহনি হমারী।
জিমি দসনন্হি মহু জীভ বিচারী॥
প্রভু, এক মুক্কা মার কে ইয়ে সব দাঁত তোড়িয়ে দেন।
কবিরত্ন। তুমি একটু চুপ কর তো বাপ। মহাবীরজী, আমরা কেবল রামরাজ্য চাই, তা হ’লেই সব হবে। সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতদের বিনাশ, প্রজার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল।
কানাই। পণ্ডিত মশাই, ব্যস্ত হ’লে চলবে না, রাষ্ট্রশাসনের ভার কদিনই বা আমরা পেয়েছি। মহাবীরজীর কৃপায় যদি দেশদ্রোহীদের জব্দ করতে পারি তবে দেখবেন শীঘ্রই কিষান-মজদার-রাজ হবে।
কবিরত্ন। কিষান-মজদুর সেক্রেটেরিয়েটে বসে রাজকার্য চালাবে?
ভুজঙ্গ। শোনেন কেন ওসব কথা, শখ, ভোট বজায় রাখবার জন্য ধাপাবাজি।
কানাই। ভাই হে, ধাপ্পাবাজির ওস্তাদ তো তোমরা, তোমাদেরই গুটিকতক বুলি আমরা শিখেছি।
সুবোধ। থাম, এখন ঝগড়া ক’রো না। মহাবীরজী, দলাদলিতে দেশ উৎসন্নে যাচ্ছে, আপনি প্রতিকারের একটা উপায় বলুন। আমরা চাই বিশুদ্ধ ডিমোক্রেসি অর্থাৎ গণতন্ত্র, কিন্তু নানা দলের নানা কথা শুনে লোকে ঘাবড়ে যাচ্ছে, ডিমোক্রেসি দানা বাঁধতে পাচ্ছে না।
মহাবীর। একটি প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন।— গোনর্দ দেশের রাজা গোবর্ধনের এক লক্ষ গরু ছিল, তারা রাজধানীর নিকটস্থ অরণ্যে চ’রে বেড়াত, জনকতক গোপ তাদের পালন করত। কি একটা মহাপাপের জন্য অগস্ত্য মুনি শাপ দেন, তার ফলে রাজা এবং বিস্তর প্রজার মৃত্যু হ’ল, অবশিষ্ট সকলে পালিয়ে গেল। রাজার গরুর পাল রক্ষকের অভাবে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ল এবং হিংস্র জন্তুর আক্রমণে বিনষ্ট হ’তে লাগল। তখন একটি বিজ্ঞ বৃষ বললে, এরকম অরাজক অবস্থায় তো আমরা বাঁচতে পারব না, ওই পর্বতের গুহায় পশুরাজ সিংহ থাকেন, চল আমরা তাঁর শরণাপন্ন হই। গরুদের প্রার্থনা শুনে সিংহ বললে, উত্তম প্রস্তাব, আমি তোমাদের রাজা হলুম, তোমাদের রক্ষাও করব। কিন্তু আমাকেও তো জীবনধারণ করতে হবে, অতএব তোমরা রাজকর স্বরূপ প্রত্যহ একটি নধর গরু আমাকে পাঠাবে। গরুর দল রাজী হয়ে প্রণাম ক’রে চ’লে গেল এবং সিংহকে রাজকর দিতে লাগল। কিছুকাল পরে সিংহ মাতব্বর গরুদের ডেকে আনিয়ে বললে, দেখ, একটি গরুতে আর কুলচ্ছে না, রাজ্যশাসনের জন্য অনেক অমাত্য পাত্র মিত্র বাহাল করতে হয়েছে। আমিও সংসারী লোক, পুত্রকন্যা ক্রমেই বাড়ছে, তাদেরও তো খাওয়াতে হবে। অতএব রাজকর বাড়াতে হচ্ছে, এখন থেকে তোমরা প্রত্যহ দশটি গরু, পাঠাও। গরুরা বিষণ্ণ হয়ে যে আজ্ঞে ব’লে চলে গেল। আরও কিছুকাল পরে সিংহ বললে, ওহে প্রজাবৃন্দ, দশটি গরুতে আর চলে না, রাজ্যশাসন সোজা কাজ নয়। আর তোমরাও অতি বেয়াড়া প্রজা, তোমাদের দমনের জন্য বিস্তর কর্মচারী রাখতে হয়েছে। অতএব এখন থেকে প্রতিদিন কুড়িটি গরু পাঠাও। গরুর মুখপাত্ররা উপায়ান্তর না দেখে এবারেও বললে, যে আজ্ঞা মহারাজ; তার পর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল। তখন সেই বিজ্ঞ বৃষ বললে, এই অরণ্যের উত্তর প্রান্তে এক মহাস্থবির তপস্বী বৃষ আছেন। পূর্বজন্মে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন, অখাদ্য ভোজনের ফলে বৃষত্ব পেয়েছেন। এখন তিনি তপস্যা ক’রে গবর্ষি হয়েছেন। তিনি মহাজ্ঞানী, চল তাঁকে আমাদের দুঃখ জানাই। গরুরা গবর্ষির আশ্রমে গিয়ে তাদের দুঃখের কথা বললে। কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ থেকে গবর্ষি বললেন, আমি তোমাদের একটি মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি, এটি তোমরা নিরন্তর জপ কর— গোহিতায় গোভির্গবাং শাসনম্।
বিপাশা। মানে কি হ’ল?
কবিরত্ন। অর্থাৎ গরুর হিতের নিমিত্ত গরু কর্তৃক গরু শাসন।
বিপাশা। আশ্চর্য! ঠিক যেন government of the people, by the people, for the people.
মহাবীর। তার পর শোন। গবর্ষি বললেন, এই মন্ত্রটি তোমরা সর্বত্র প্রচার করবে, এক মাস পরে আবার আমার কাছে আসবে। গরুর দল মন্ত্র পেয়ে তুষ্ট হয়ে চলে গেল এবং এক মাস পরে আবার এল। গবর্ষি প্রশ্ন করলেন, তোমাদের সংখ্যা কত? গরুরা বললে, প্রায় এক লক্ষ; সিংহ অনেককে খেয়েছে, নয়তো আরও বেশী হ’ত। গবর্ষি বললেন, সিংহ আর তার অনুচরবর্গের সংখ্যা কত? গরুরা বললে, শ-খানিক হবে। গবর্ষি বললে, মন্ত্র জপ ক’রে তোমাদের তেজ বৃদ্ধি পেয়েছে, এখন এক কাজ কর—সকলে মিলে শিং উঁচিয়ে চারিদিক থেকে তেড়ে গিয়ে সিংহদের গুঁতিয়ে দাও। গরুর দল মহা উৎসাহে সিংহদের আক্রমণ করলে, গোটাকতক গরু মরল, কিন্তু সিংহের দল একবারে ধ্বংস হ’ল।
বিপাশা। কিন্তু আবার তো অরাজক হ’ল?
মহাবীর। উঁহু। গরুরা গণতন্ত্রের মন্ত্র শিখেছে, তারা নিজেদের মধ্য থেকে কয়েকটি চালাক উদ্যমশীল গরু, নির্বাচন ক’রে তাদের উপর প্রজাশাসনের ভার দিলে। কিছুকাল পরে দেখা গেল, সেই শাসক-গরুদের খাড়া খাড়া গোঁফ বেরিয়েছে, শিং খ’সে গেছে, খুরের জায়গায় থাবা আর নখ হয়েছে। তাদের কেউ বাঘের, কেউ শেয়ালের, কেউ ভালুকের রূপ পেয়েছে। প্রজা-গরুরা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ভাই সব, এ কি দেখছি? কোন্ পাপে তোমাদের এই শ্বাপদ-দশা হ’ল? শাসক-গরুরা উত্তর দিলে, হুঁ হুঁ, পাপ নয়, আমরা ক্ষত্রিয় হয়েছি, ঘাস খেয়ে রাজকার্য করা চলে না, জাবর কাটতে বৃথা সময় নষ্ট হয়। এখন আমরা আমিষাহারী। ঘরেবাইরে শত্রুরা ওত পেতে আছে, তোমাদের রক্ষণ আর সেবার জন্য বিস্তর কর্মচারী রাখতে হয়েছে। আমাদের প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়, সেজন্য ক্ষুধাও প্রবল। বনের সব মৃগ আমরা খেয়ে ফেলেছি। যদি সুশাসন চাও তবে তোমরা সকলে কিঞ্চিৎ স্বার্থত্যাগ ক’রে আমাদের উপযুক্ত আহার যোগাও, যেমন সিংহের আমলে যোগাতে। গরুরা রাজী হ’ল। কিন্তু গুটি কতক ধূর্ত গরু, ভাবলে, বাঃ, এরা তো বেশ আছে, সর্দারি করে বেড়াচ্ছে, ঘাস খুঁজতে হচ্ছে না, জাবর কাটতে হচ্ছে না, আমাদেরই হাড় মাস কড়মড় ক’রে খাচ্ছে। আমরাই বা ফাঁকে পড়ি কেন? এই স্থির ক’রে তারা দল বেঁধে শ্বাপদ গরুদের গুঁতিয়ে তাড়িয়ে দিলে এবং নিজেরাই শাসক হ’ল। কিছুকাল পরে তারাও শ্বাপদ হয়ে গেল এবং তাদের দেখে অন্য গরুদেরও প্রভুত্বের লোভ হ’ল। এই রকমে সমস্ত গরু গুঁতোগুঁতি কামড়াকামড়ি ক’রে ম’রে গেল, গোনর্দ দেশ একটি গোভাগাড়ে পরিণত হ’ল।
কানাই। আপনার এই গল্পের মরাল কি? আপনি কি বলতে চান গণতন্ত্র খারাপ?
মহাবীর। তন্ত্রে রাজ্যশাসন হয় না, মানুষেই রাজ্য চালায়। গণতন্ত্র বা যে তন্ত্রই হ’ক, তা শব্দ মাত্র, লোকে ইচ্ছানসারে তার ব্যাখ্যা করে।
সুবোধ। ঠিক বলেছেন। ব্রিটেন আমেরিকা রাশিয়া প্রত্যেকেই বলে যে তাদের শাসনতন্ত্রই খাঁটী ডিমোক্রাসি।
মহাবীর। শাসনপদ্ধতির নাম যাই হ’ক দেশের জনসাধারণ রাজ্য চালায় না, তারা কয়েকজনকে পরিচালক রূপে নিযুক্ত করে, অথবা ধাপ্পায় মুগ্ধ হয়ে একজনের বা কয়েক জনের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। এই কর্তারা যদি সুবুদ্ধি সাধু নিঃস্বার্থ ত্যাগী কর্মপটু হয় তবে প্রজারা সুখে থাকে। কিন্তু কর্তারা যদি মূর্খ হয়, অথবা ধূর্ত অসাধু স্বার্থপর ভোগী আর অকর্মণ্য হয় তবে প্রজারা কষ্ট পায়, কোনও তন্ত্রেই ফল হয় না।
ভুজঙ্গ। আপনার রামরাজ্য কি ছিল? একবারে অটোক্রাসি, স্বৈরতন্ত্র, প্রজাদের কোনও ক্ষমতা ছিল না।
মহাবীর। কে বললে ছিল না? কোশলরাজমহিষী সীতার বনবাস হ’ল কাদের জন্য? শম্বুককে মারা হ’ল কাদের কথায়?
বিপাশা। কিন্তু রামচন্দ্রের এইসব কাজ কি ভাল?
মহাবীর। ভালই হ’ক আর মন্দই হ’ক রামচন্দ্র লোকমত মেনেছিলেন। তখনকার ভাল মন্দের বিচার করা এখনকার লোকের সাধ্য নয়। লোকমত সৃষ্টি করেন প্রভাবশালী সুবুদ্ধি সাধুগণ, অথবা ধূর্ত অসাধুগণ। রামচন্দ্র নিজের মতে চলতেন না। নিঃস্বার্থ জ্ঞানী ঋষিরা কর্তব্য অকর্তব্য বেঁধে দিয়েছিলেন, রামচন্দ্র তাই মানতেন, প্রজারাও তাই মানত। এখনকার বিচারে ঋষিদের অনেক বিধানে এুটি বেরবে, কিন্তু তাঁরা ঐশ্বর্যকামী বা প্রভুত্বকামী ছিলেন না, রাজার কর্তব্য-অকর্তব্য সম্বন্ধেও সকলে প্রায় একমত ছিলেন, সেজন্য কেউ তাঁদের ছিদ্র পেত না, বিপক্ষও হ’ত না।
সুবোধ। অর্থাৎ রামরাজ্য মানে ওআন পার্টি ঋষিতন্ত্র। এখন সেরকম ঋষি যোগাড় করা যায় কি ক’রে?
মহাবীর। ঋষি চাই না। যাঁদের হাতে দেশশাসনের ভার এসেছে তাঁরা যদি বুদ্ধিমান সাধু নিঃস্বার্থ ত্যাগী কর্মী হন তবে লোকমত তাঁদের অনুসরণ করবে।
সুবোধ। কিন্তু ধূর্ত অসাধুরা তাঁদের পিছনে লাগবে, ভাঁওতা দিয়ে স্বপক্ষে ভোট যোগাড় করবে, কর্তৃত্ব দখল করবে।
মহাবীর। কত দিন তা পারবে? স্বাধীনতালাভের চেষ্টায় তোমাদের বহু লোক বহু বাধা পেয়েছেন, জীবনপাতও করেছেন। তাঁরা স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেন নি, কিন্তু তাঁদের সাধনা সফল হয়েছে। রামরাজ্য অর্থাৎ সাধুজনপরিচালিত রাজ্যের প্রতিষ্ঠাও সেই রকমে হবে। এই ব্রত যাঁরা নেবেন তাঁরা নিজের আচরণ দ্বারা প্রজার বিশ্বাসভাজন হবেন, উপস্থিত সুবিধার জন্য কুটিল পথে যাবেন না, লোভী ধনপতি অথবা অসাধু সহকর্মীদের সঙ্গে রফা করবেন না, দুষ্কর্ম উপেক্ষা করবেন না। বার বার পরাভূত হ’লেও তাঁদের চেষ্টা কালক্রমে সফল হবেই। যত দিন একদল লোক এই ব্রত না নেবেন তত দিন শাসনতন্ত্রের নাম দিয়ে তর্ক করা বৃথা।
কানাই। মহাবীরজী, আপনার ব্যবস্থা এখন অচল, ওতে গণতন্ত্র হবে না। এ যুগে ধর্মপুত্র যধিষ্ঠির কেউ নেই।
মহাবীর। তবে সেই গরুদের মতন গুঁতোগুঁতি কামড়াকামড়ি ক’রে মর গে।
সুবোধ। ব্রিটিশ জাতির মধ্যে কি অসাধুতা আর অপটুতা নেই? তাদের দেশে তো গণতন্ত্র অচল হয় নি।
মহাবীর। বিদেশে তারা যতই অন্যায় করুকে, নিজের দেশ শাসনের জন্য যে সাধুতো আর পটতা আবশ্যক তা তাদের আছে।
কানাই। যাই বলুন মহাবীরজী, আগে এই ভুজঙ্গ ভায়ার দলটিকে শায়েস্তা করতে হবে, যত সব ঘরভেদী বিভীষণ, দাঙ্গাবাজ খুনে ডাকাত, কুচক্রী কমবক্ত কমরেড।
ভুজঙ্গ। মহাবীরজী, এই কানাইদার দলটিকে ধ্বংস না করলে কিছুই হবে না, যত সব ভেকধারী ভণ্ড, ক্রোড়পতির কুত্তা।
কানাই। মুখ সামলে কথা বল ভুজঙ্গ!
ভুজঙ্গ। যত সব মিটমিটে শয়তান, বিড়াল-তপস্বী, রক্তচোষা বাদুড়।
কানাই গাঙ্গুলি অত্যন্ত চ’টে উঠে ঘুষি তুলে মারতে এল, ভুজঙ্গ তার হাত ধ’রে ফেললে। দুজনে ধস্তাধস্তি হ’তে লাগল।
সুবোধবাবু বিব্রত হয়ে বললেন, তোমাদের কি স্থান কাল জ্ঞান নেই, এখন মারামারি করছ? ওহে অবধবিহারী, থামিয়ে দাও না।
অবধবিহারী। হামি আজ একাদ্সি কিয়েছি বাবুজী, বহুত কমজোর আছি।
বিপাশা। মহাবীরজী, আপনি উপস্থিত থাকতে এই সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই হবে?
ভূতনাথ তড়াক ক’রে লাফিয়ে উঠল এবং নিমেষের মধ্যে পিছন থেকে লাথি মেরে কানাই আর ভুজঙ্গকে ধরাশায়ী ক’রে দিলে। তার পর আবার নিজের চেয়ারে বসে চোখ কপালে তুলে সমাধিস্থ হ’ল।
গায়ের ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে ভুজঙ্গ বললে, সুবোধবাবু, আপনার বাড়িতে এই অপমান সইতে হবে?
পাছায় হাত বুলুতে বুলুতে কানাই বললে, কুমোরের পুত্তুর ভুতো নন্দী ব্রাহ্মণের গায়ে লাথি মারবে?
অবধবিহারী। এ বাবু গুস্সা করবেন না।
লাত তো ভূতনাথবাবুর থোড়াই আছে, খুদ মহাবীরজী লাত লাগিয়েছেন।
কবিরত্ন। ঠিক কথা, ভূতনাথের সাধ্ন্য কি। স্বয়ং শ্রীহনুমান কলহ নিবারণের জন্য লাখি ছুড়েছেন। দেবতার পদাঘাতে চিত্তশুদ্ধি হয়, তাতে অপমান নেই।
বিপাশা। যেতে দিন, যেতে দিন। মহাবীরজী, কিছ মনে করবেন না।
অবধবিহারী। আচ্ছা মহাবীরজী, বোলেন তো, রামরাজ্য হোনে সে শেয়ার মার্কিট কুছ তেজ হোবে? বড়া নুকসান যাচ্ছে।
মহাবীর উত্তর দিলেন না।
ভূতনাথের মাথা ধীরে ধীরে সোজা হ’তে লাগল। লক্ষণ দেখে সুবোধবাবু বললেন, কনট্রোল ছেড়ে গেছেন। একটু পরে ভূতনাথ হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বললে, দাদা, একটু চা আনতে বলুন।
অবধবিহারী। আরে ভূতনাথবাবু, মহাবীরজী তো বহুত ঝঞ্জাট কি বাত বোলিয়েছেন, লাত ভি মারিয়েছেন। ভূতনাথ। বলেন কি! লাথি মেরেছেন? কাকে? আমাদের কানাইদা আর ভুজঙ্গদাকে? সর্বনাশ, ইশ, বড় অপরাধ হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না দাদারা—আমার কি আর হুঁশ ছিল! দিন, পায়ের ধুলো দিন।
১৩৫৬