গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)/ফেল

ফেল

লেজা এবং মা, বই এবং কেতু, পরস্পরের সঙ্গে আড়াআড়ি করিলে যেমন দেখিতে হইত এও ঠিক সেইরকম। প্রাচীন হালদার-বংশ দুই খণ্ডে পৃথক হইয়া প্রকাণ্ড বসতবাড়ির মাঝখানে এক ভিত্তি তুলিয়া পরপর পিঠাপিঠি করিয়া বসিয়া আছে। কেহ কাহারও মখদর্শন করে না।

 নবগােপালের ছেলে নলিন এবং ননীগােপালের ছেলে নন্দ একবংশজাত, একবয়সি, এক ইকুলে যায় এবং পারিবারিক বিদ্বেষ ও রেষারেষিতেও উভয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ ঐক্য।

 নীলনের বাপ নবগােপাল অত্যন্ত কড়া নােক। ছেলেকে হাঁপ ছাড়িতে দিতেন না, পড়াশুনা ছাড়া আর কথা ছিল না। খেলা খাদ্য ও সাজসজ্জা সধে ছেলের সর্বপ্রকার শখ তিনি খাতাপত্র ও ইকুল-বইয়ের নীচে চাপিয়া রাখিয়াছিলেন।

 নন্দর বাপ ননীগােপালের শাসনপ্রণালী অত্যন্ত শিথিল ছিল। মা তাহাকে অত্যন্ত ফিটফাট করিয়া সাজাইয়া ইস্কুলে পাঠাইতেন, আনা-তিনেক জলপানিও সঙ্গে দিনে; নন্দ ভাজা মসলা ও কুলপির বরফ, লাঠিম ও মালগলিক ইমত ভােগবিতরণের দ্বারা যশবী হইয়া উঠিয়াছিল।

 মনে মনে পরাভব অনুভব করিয়া নলিন কেবলই ভাবিত, নন্দর বাবা যদি আমার বাবা হইত এবং আমার বাবা যদি নন্দর পিতৃস্থান অধিকার করিত, তাহা হইলে নন্দকে মজা দেখাইয়া দিতাম।

 কিন্তু, সেরুপ সুযোেগ ঘটিবার পূর্বে ইতিমধ্যে নন্দ বৎসরে বৎসরে প্রাইজ পাইতে লাগিল; নলিন রিক্তহস্তে বাড়ি আসিয়া ইস্কুলের কর্তৃপক্ষদের নামে পক্ষপাতের অপবাদ দিতে লাগিল। বাপ তাহাকে অন্য ইস্কুলে দিলেন, বাড়িতে অন্য মাস্টার রাখিলেন, ঘুমের সময় হইতে একঘণ্টা কাটিয়া পড়ার সময়ে যােগ করিলেন, কিন্তু ফলের তারতম্য হইল না। ন পাস করিতে করিতে বি. এ. উত্তীর্ণ হইয়া গেল, নলিন ফেল করিতে করিতে এনষ্টান্স-ক্লাসে জাঁতিকলের ইদুরের মতাে আটক পড়িয়া রহিল।

 এমন সময় তাহার পিতা তাহার প্রতি দয়া করিলেন। তিনি মরিলেন। তিন বৎসর মেয়াদ খাটিয়া এনট্রান্সক্লাস হইতে তাহার মুক্তি হইল এবং স্বাধীন নলিন আংটি, বােতাম, ঘড়ির চেনে আদ্যোপান্ত ঝকমক করিয়া নন্দকে নিরতিশয় নিষ্প্রভ করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এ -ফেলের জুড়ি চৌঘড়ি, বি. এ.-পাসের একঘােড়র গাড়িকে অনায়াসে ছড়াইয়া যাইতে লাগিল; বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্নি ওয়েলায়ঘােড়র সহিত সমান সলে চলিতে পারিল না। এ দিকে নলিন এবং নন্দর বিবাহের জন্য পাত্রীর মন, চলিতেছে। নলিনের প্রতি, সে এমন কন্যা বিবাহ করিবে যাহার উপমা মেলা ভার, তাহার জড়ি এবং তাহার ঘর কাছে নক্ষকে হার মানতেই হবে। সবচেয়ে ভালাের জন্য বাহার আকাক্ষা, অনেক ভালো তাহাকে পরিত্যাগ করিতে হয়। কাছাকাছি কোনাে মেয়েকেই নলিন পছন্দ করিয়া খতম করিতে সাহস করিল না, পাছে আরও ভালাে তাহাকে ফাঁকি দিয়া আরকাহারও ভাগ্যে জোটে।

 অবশেষে খবর পাওয়া গেল, রাওলপিণ্ডিতে এক প্রবাসী বাঙালির এক পরসুন্দরী মেয়ে আছে। কাছের সুন্দরীর চেয়ে দরের সুন্দরীকে বেশি লােভনীয় বলিয়া মনে হয়। নলিন মতিয়া উঠিল, খরচপত্র দিয়া কন্যাকে কলিকাতায় আনাননা হইল। কন্যটি সুন্দরী বটে। নলিন কহিল, “যিনি যাই করুন, ফস করিয়া রাওলপিণ্ডি ছাড়াইয়া যাইবেন এমন সাধ্য কাহারও নাই। অন্তত এ কথা কেহ বলিতে পারিবেন না যে, এ মেয়ে তাে আমরা পর্বেই দেখিয়াছিলাম, পছন্দ হয় নাই বলিয়া সব করি নাই।”

 কথাবার্তা তাে প্রায় একপ্রকার স্থির, পানপত্রের আয়ােজন হইতেছে, এমন সময় একদিন প্রাতে দেখা গেল, ননীগােপালের বাড়ি হইতে বিচিত্র থালার উপর বিবিধ উপঢৌকন লইয়া দাসীচাকরের দল সার বাঁধিয়া চলিয়াছে।

 নলিন কহিল, “দেখে এসাে তাে হে, ব্যাপারখানা কী।”

 খবর আসিল, নন্দর ভাবী বধুর জন্য পানপত্র যাইতেছে।

 নলিন তৎক্ষণাৎ গুড়গুড়ি টানা বন্ধ করিয়া সচকিত হইয়া উঠিয়া বসিল; বলি, “খবর নিতে হচ্ছে তাে।”

 তৎক্ষণাৎ গাড়ি ভাড়া করিয়া ছড়ছড়, শব্দে হতে দুটিল। বিপিন হাজরা ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কলকাতার মেয়ে, কিন্তু খাসা মেয়ে।”

 নলিনের বুক দমিয়া গেল; কহিল, “বল কী হে!”

 হাজরা কেবলমাত্র কহিল, “খাসা মেয়ে।”

 নলিন বলিল, “এ তাে দেখতে হচ্ছে।”

 পারিষদ বলিল, “সে আর শক্তটা কী।” বলিয়া তর্জনী ও অষ্ঠে একটা কাল্পনিক টাকা বাজাইয়া দিল।

 সুযোেগ করিয়া নমিন মেয়ে দেখিল। যতই মনে হইল, এ মেয়ে নন্দর জন্য একেবারে স্থির হইয়া গেছে, ততই বােধ হইতে লাগিল, মেয়েটি রাওলপিণ্ডজার চেয়ে ভালাে দেখিতে। দ্বিধাপীড়িত হইয়া নলিন পারিষদকে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন ঠেকছে হে।”

 হজরা কহিল, “আয়ে, আমাদের চোখে তাে ভালােই ঠেকছে।”

 নলিন কহিল, “সে ভালাে কি এ ভালাে।” হাজরা বলিল, “এই ভালাে।”

 তখন নলিনের বােধ হইল, ইহার চোখের পলৰ তাহার চেয়ে আরও একট, ফেন ঘন; তাহার রঙটা ইহার চেয়ে একট, যেন বেশি ফ্যাকাসে, ইহার গোলে একট, যেন হলদে আভায় সােনা মিশাইয়াছে। ইহাকে তাে হাতছাড়া করা যায় না।

 নলিন বিমর্ষভাবে চিত্ত হইয়া গুড়গুড়ি টানিতে টনিতে কহি, “ওতে হাজরা, কী করা যায় বলাে তাে।”

 হজরা বলিল, “মহারাজ, শক্তটা কী।” বলিয়া পুনশ্চ অঙ্গুষ্ঠে তর্জনীরতে কাল্পনিক টাকা বাজাইয়া দিল।

 টাকাটা এখন সত্যই সশব্দে বাজিয়া উঠিল তখন বধ্যেচিত্ত কল্প হইতে বিলম্ব হইল না। কন্যার পিতা একটা অকারণ ছুতো করিয়া বরের পিতার সহিত ঝগড়া বাধাইলেন। বরের পিতা বলিলেন, “তােমার কন্যার সহিত আমার পুত্রের যদি। বিবাহ দিই তবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

 কন্যার পিতা আরও একগুণ অধিক করিয়া বলিলেন, “তােমার পুত্রের সহিত আমার কন্যার যদি বিবাহ দিই তবে—” ইত্যাদি ইত্যাদি।

 অতঃপর আর বিলমাত্র না করিয়া নলিন নন্দকে ফাঁকি দিয়া শুভলগ্নে শুভ বিবাহ সত্বর সম্পন্ন করিয়া ফেলিল। এবং হাসিতে হাসিতে হাজরাকে বলিল, “বি. এ. পাস করা তাে একেই বলে। কী বলল হে হাজরা! এবারে আমাদের ও বাড়ির বড়ােবাব, ফেল।”

 অনতিকাল পরেই ননীগােপালের বাড়িতে একদিন ঢাক ঢোল সানাই বাজিয়া উঠিল। নন্দর গায়ে-হলদে।

 নলিন কহিল, “ওহে হাজরা, খবর লও তাে পাত্রীটি কে।”

 হাজরা আসিয়া খবর দিল, পাত্রীটি সেই রাওলপিণ্ডির মেয়ে।

 রাওলপিণ্ডির মেয়ে! হাঃ হাঃ হাঃ। নলিন অত্যন্ত হাসিতে লাগিল। ও বাড়ির বড়ােবাবু, আর কন্যা পাইলেন না, আমাদেরই পরিত্যত পাত্রীটিকে বিবাহ করিতেছেন। হাজরাও বিস্তর হাসিল।

 কিন্তু, উত্তরােত্তর নলিনের হাসির আর জোর রহিল না। তাহার হাসির মধ্যে কীট প্রবেশ করিল। একটি ক্ষুদ্র সংশয় তীক্ষ। ঘরে কানে কানে বলিতে লাগিল, “আহা, হাতছাড়া হইয়া গেল! শেষকালে নন্দর কপালে জটিল!” ক্ষুদ্র সংশয় ক্রমশই রক্তক্ষীত জোঁকের মতাে বড়াে হইয়া উঠিল, তাহার কণ্ঠস্বরও মােটা হইল। সে বলিল, “এখন আর কোনােমতেই ইহাকে পাওয়া যাইবে না, কিন্তু আসলে ইহাকেই দেখিতে ভালাে। ভারি ঠকিয়াছ।”

 অন্তঃপুরে নলিন যখন খাইতে গেল তখন তাহার স্ত্রীর ছােটোখাটো সমস্ত খুত মস্ত হইয়া তাহাকে উপহাস করিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, স্ত্রীরা তাহাকে ভয়ানক ঠকাইয়াছে।

 রালপিণ্ডিতে যখন সম্বন্ধ হইতেছিল তখন নলিন সেই কন্যার যে ফোটো পাইয়াছিল সেইখানি বাহির করিয়া দেখিতে লাগিল। “বাহবা, অপরুপ রুপমাধুরী। এমন লক্ষীকে হাতে পাইয়া ঠেলিয়াছি, আমি এতবড়ো গাধা!” |

 বিবাহসন্ধ্যায় আলাে জালাইয়া বাজনা বাজাইয়া জুড়িতে চড়িয়া বর বাহির হইল। নলিন শুইয়া পড়িয়া গুড়গুড়ি হইতে যৎসামান্য সাক্ষন আকর্ষণের নিফল চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় হাজরা প্রসন্নবদনে হাসিতে হাসিতে আসিয়া নন্দকে লক্ষ্য করিয়া পরিহাস জমাইবার উপক্রম করিল।

 নলিন হাঁকিল, “দারােয়ান!”

 হাজরা তটস্থ হইয়া দরােয়ানকে ডাকিয়া দিল।

 বাবু, হাজরাকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, “আব্‌হি ইস্কো কান পাকড়্‌কে বাহার নিকাল দো।”

 আশ্বিন ১৩০৭