গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)/দুর্বুদ্ধি
দুর্বুদ্ধি
ভিটা ছাড়িতে হইল। কেমন করিয়া তাহা খােলসা করিয়া বলিব না, আভাস দিব মাত্র।
আমি পাড়াগে'য়ে নেটিভ ডাক্তার, পুলিসের থানার সম্মুখে আমার বাড়ি। যমরাজের সহিত আমার যে পরিমাণ আনুগত্য ছিল দারােগাবাবুদের সহিত তাহা অপেক্ষা কম ছিল না, সুতরাং নর এবং নারায়ণের দ্বারা মানুষের যত বিবিধরকমের পীড়া ঘটিতে পারে তাহা আমার সুগােচর ছিল। যেমন মণির বারা বলয়ের এবং বলয়ের দ্বারা মণির শােভা বৃদ্ধি হয় তেমনি আমার মধ্যস্থতায় দারােগার এবং দারােগার মধ্যস্থতায় আমার উত্তরােত্তর আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটিতেছিল।
এই-সকল ঘনিষ্ঠ কারণে হাল নিয়মের কৃতবিদ্য দায়ােগা ললিত চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার একট, বিশেষ বধুত্ব ছিল। তাঁহার একটি অরক্ষণীয়া আত্মীয়া কন্যার সহিত বিৰাহের জন্য মাঝে মাঝে অনুরােধ করিয়া আমাকেও প্রায় তিনি অরক্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু, শশী আমার একমাত্র কন্যা, মাতৃহীনা, তাহাকে বিমাতার হাতে সমর্পণ করিতে পারিলাম না। বর্ষে বর্ষে নতন পঞ্জিকার মতে বিবাহের কত শুভলগ্নই ব্যর্থ হইল। আমারই চোখের সম্মুখে কত যােগ্য এবং অযােগ্য পাত্র চতুর্দোলায় চড়িল, আমি কেবল বরযাত্রীর দলে বাহির-বাড়িতে মিষ্টান্ন খাইয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
শশীর বয়স বারাে হইয়া প্রায় তেরাে পড়ে। কিছু সুবিধামত টাকার জোগাড় করিতে পারিলেই মেয়েটিকে একটি বিশিষ্ট বড়ােঘরে বিবাহ দিতে পারিব, এমন আশা পাইয়াছি। সেই কর্মটি শেষ করিতে পারিলে অবিলম্বে আর-একটি শুভকর্মের আয়ােজনে মনােনিবেশ করিতে পারি।
সেই অত্যাবশ্যক টাকাটার কথা ধ্যান করিতেছিলাম, এমন সময় তুলসীপাড়ার হরিনাথ মজুমদার আসিয়া আমার পায়ে ধরিয়া কাঁদিয়া পড়িল। কথাটা এই, তাহার বিধবা কন্যা রাত্রে হঠাৎ মারা গিয়াছে, শতপক্ষ গর্ভপাতের অপবাদ দিয়া দারােগার কাছে বেনামি পত্র লিখিয়াছে। এক্ষণে পুলিস তাহার মৃতদেহ লইয়া টানাটানি করিতে উদ্যত।
সদ্য কন্যাশােকের উপর এতবড়ো অপমানের আঘাত তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়াছে। আমি ডাকারও বটে, দমােগার বন্ধুও বটে, কোনোমতে উদ্ধার করিতে হইবে।
লক্ষী যখন ইচ্ছা করেন তখন এমনি করিয়াই কখনও সদয় কখনও খিড়কি-দরজা দিয়া অনাহত আসিয়া উপস্থিত হন। অমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, “ব্যাপারটা বড়ো গুরুতর।” দুটো-একটা কল্পিত উদাহরণ প্রয়ােগ করিলাম, কম্পমান বল হরিনাথ শিশুর মতাে কাঁদিতে লাগিল।
বিস্তারিত বলা বাহুল্য, কন্যার অত্যষ্টি-সৎকারের সুযোেগ করিতে হরিনাথ ফতুর হইয়া গেল।
আমার কন্যা শশী করুণ স্বরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, ঐ বুড়ো তােমার, পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাঁদিতেছি।
আমি তাহাকে ধমক দিয়া বলিলাম, “যা যা, তাের এত খবর দরকার কী।” এইবার সংপাত্রে কন্যাদানের পথ সুপ্রশস্ত হই। বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল। একমাত্র কন্যার বিবাহ, ভােজের আনােজন প্রচুর করিলাম। বাড়িতে গৃহিণী নাই, প্রতিবেশীরা দয়া করিয়া আমাকে সাহায্য করিতে আসিল। সর্বস্বান্ত কত হরিনাথ দিনরাত্রি খাটিতে লাগিল।
গায়ে-হলুদের দিনে রাত তিনটার সময় হঠাৎ শশীকে ওলাউঠায় ধরিল। রােগ উত্তরােত্তর কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল। অনেক চেষ্টার পর নিস্ফল ঔষধেয় শিশিলা ভূতলে ফেলিয়া ছুটিয়া গিয়া হরিনাথের পা জড়াইয়া ধরিলাম। কহিলাম, “আপ করে, দাদা, এই পাষণ্ডকে মাপ করে। আমার একমাত্র কন্যা, আমার আর কেহ নাই।”
হরিনাথ শশব্যস্ত হইয়া কহিল, “ডাক্তারবাবু, করেন কী করেন কী। আপনার কাছে আমি চিরঋণী, আমার পায়ে হাত দিবেন না।”
আমি কহিলাম, “নিরবে আমি তােমার সর্বনাশ করিয়াছি, সেই পাপে আমার কন্যা মরিতেছে।”
এই বলিয়া সর্বলােকের সমক্ষে আমি চীৎকার করিয়া বলিলাম, “ওগাে, আমি এই বন্ধুর সর্বনাশ করিয়াছি, আমি তাহার দণ্ড লইতেছি; ভগবান আমার শশীকে রক্ষা করুন।”
বলিয়া হরিনাথের চটিজুতা খুলিয়া লইয়া নিজের মাথায় মারিতে লাগিলাম; বৃদ্ধ ব্যস্তসমস্ত হইয়া আমার হাত হইতে জুতা কাড়িয়া লইল।
পরদিন দশটা-বেলায় গায়ে-হলুদের হরিদ্রাচিহ্ন লইয়া শশী ইহসংসার হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিল।
তাহার পরদিনেই দারােগাবাবু কহিলেন, “ওহে, আর কেন, এইবার বিবাহ করিয়া ফেলাে। দেখাশুনার তাে একজন লােক চাই।”
মানুষের মর্মান্তিক দুঃখশােকের প্রতি এরপ নিষ্ঠর অশ্র শয়তানকেও শােভা পায় না। কিন্তু, নানা ঘটনায় দারােগার কাছে এমন মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়াছিলাম যে, কোনাে কথা বলিবার মুখ ছিল না। দারােগার বন্ধু সেই দিন যেন আমাকে চাবুক মারিয়া অপমান করিল।
হদয় যতই ব্যথিত থাক, কর্মচঞ্জ চলিতেই থাকে। আগেকার মতােই কাের আহার, পরিধানের বস্তু, এমন-কি চুলায় কাষ্ঠ এবং তার ফিতা পর্যন্ত পরিপ উদ্যমে নিয়মিত সংগ্রহ করিয়া ফিরিতে হয়।
কাজের অবকাশে যখন একলা ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকি তখন মাঝে মাঝে কানে সেই কণ কণ্ঠের প্রন বাজিতে থাকে, “বাবা, ঐ বুড়ো তােমার পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাঁদিতেছিল।” দরিদ্র হরিনাথের জীর্ণ ঘর নিজের ব্যয়ে ছাইয়া দিলাম, আমার দখবতী গাভীটি তাহাকে দান করিলাম, তাহায় ফধক জোমা মহাজনের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া দিলাম।
কিছুদিন সদ্যশশাকের দুঃসহ বেদনায় নির্জন সন্ধ্যায় এবং অনি আর কেবলই মনে হইত, আমার কোমলহদয়া মেয়েটি সংসারলীলা শেষ করিয়া তাহার বাপের নিষ্ঠ কমে পরলােকে কোননামতেই শান্তি পাইতেছে না। সে কেন ব্যথিত হইয়া কেবলই আমাকে প্রশ্ন করিয়া ফিরিতেছে, “বাবা, কেন এমন কবি।”
কিছুদিন এমনি হইয়াছিল, গরিবের চিকিৎসা করিয়া টাকার জন্য তাগিদ করিতে পারিতাম না। কোনাে ছোটো মেয়ের ব্যামাে হইলে মনে হইত, আমার শশীই যেন পল্লির সমস্ত রগ্ন বালিকার মধ্যে রােগ ভােগ করিতেছে।
তখন পুরাে বর্ষায় পল্লী ভাসিয়া গেছে। ধানের খেত এবং গৃহের অঙ্গনপার্শ্ব দিয়া নৌকায় করিয়া ফিরিতে হয়। ভােররাত্রি হইতে বষ্টি শুরু হইয়াছে, এখনও বিরাম নাই।
জমিদারের কাছারিবাড়ি হইতে আমার ডাক পড়িয়াছে। বাবুদের পান্সির মাঝি সামান্য বিসঘটকু সহ্য করতে না পারিয়া উদ্ধত হইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছে।
ইতিপূর্বে এরূপ দুর্যোগে যখন আমাকে বাহির হইতে হইত তখন একটি লােক ছিল যে আমার পুরাতন ছাতাটি খুলিয়া দেখিত, তাহাতে কোথাও ছিদ্র আছে কি না এবং একটি ব্যগ্র কণ্ঠ বাদলার হাওয়া ও বৃষ্টির ছাট হইতে সযত্নে আত্মরক্ষা করিবার জনা আমাকে বারবার সতর্ক করিয়া দিত। আজ শন্য নীরব গহ হইতে নিজের ছাতা নিজে সধান করিয়া লইয়া বাহির হইবার সময় তাহার সেই স্নেহময় মুখখানি স্মরণ করিয়া একটুখানি বিলম্ব হইতেছিল। তাহার রন্ধে শয়নঘরটার দিকে তাকাইয়া ভাবিতেছিলাম, যে লোেক পরের দুঃখকে কিছুই মনে করে না তাহার সুখের জন্য ভগবান ঘরের মধ্যে এত স্নেহের আয়ােজন কেন রাখিবেন। এই ভাবিতে ভাবিতে সেই শন্য ঘরটার দরজার কাছে আসিয়া বুকের মধ্যে হু হু করিতে লাগিল। বাহিরে বড়ােলােকের ভৃত্যের তর্জনম্বর শনিয়া তাড়াতাড়ি শােক সম্বরণ করিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম॥
নৌকায় উঠিবার সময় দেখি, থানার ঘাটে ভােঙা বাঁধা, একজন চাষা কৌপীন পরিয়া বৃষ্টিতে ভিজিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কী রে।” উত্তরে শনিলাম, গতরাত্রে তাহার কন্যাকে সাপে কাটিয়াছে, থানায় রিপাের্ট করিবার জন্য হতভাগ্য তাহাকে দরগ্রাম হইতে বাহিয়া আনিয়াছে। দেখিলাম, সে তাহার নিজের একমাত্র গাত্রবস্ত্র খুলিয়া মৃতদেহ ঢাকিয়া রাখিয়াছে। জমিদারি কাছারির অসহিষ্ণ, মাঝি নৌকা ছাড়িয়া দিল।
বেলা একটার সময় বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখি, তখনও সেই লােক বুকের কাছে হাত পা গুটাইয়া বসিয়া বসিয়া ভিজিতেছে; দারােগাবাবর দর্শন মেলে নাই। আমি তাহাকে আমার রন্ধন-অন্নের এক অংশ পাঠাইয়া দিলাম। সে তাহা ছুইল না।
তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া কাছারির রােগীর তাগিদে পুনর্বার বাহির হইলাম। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়া দেখি তখনও লােকটা একেবারে অভিভূতের মতাে বসিয়া আছে। কথা জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দিতে পারে না, মুখের দিকে তাকাইয়া থাকে। এখন তাহার কাছে এই নদী, ঐ গ্রাম, ঐ থানা, এই মেঘাচ্ছন্ন আর্থ পকিল পৃথিবীটা স্বপ্নের মতাে। বারবার প্রশ্নের দ্বারা জানিলাম, একবার একজন কনস্টেবল আসিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ট্যাকে কিছু আছে কি না। সে উত্তর করিয়াছিল, সে নিতান্তই গরিব, তাহার কিছু নাই। কনস্টেবল বলিয়া গেছে, “থাক্ বেটা, তবে এখন বসিয়া থাক্।”
এমন দৃশ্য পর্বেও অনেকবার দেখিয়াছি, কখনও কিছুই মনে হয় নাই। আজ কোনােমতেই সহ্য করিতে পারিলাম না। আমার শশীর করুণাগদগদ অব্যক্ত কণ্ঠ সমস্ত বাদলার আকাশ জুড়িয়া বাজিয়া উঠিল। ঐ কন্যাছারা বাক্যহীন চাষার অপরিমেয় দুঃখ আমার বুকের পাঁজরগুলােকে যেন ঠেলিয়া উঠিতে লাগিল।
দারােগাবাব, বেতের মােড়ায় বসিয়া আরামে গুড়গড়ি টানিতেছিলেন। তাঁহার কন্যাদায়গ্রস্ত আত্মীয় মেসোটি আমার প্রতি লক্ষ করিয়াই সম্প্রতি দেশ হইতে আসিয়াছেন; তিনি মাদুরের উপর বসিয়া গল্প করিতেছিলেন। আমি একদমে ঝড়ের বেগে সেখানে উপস্থিত হইলাম। চীৎকার করিয়া বলিলাম, “আপনারা মানুষ না পিশাচ?” বলিয়া আমার সমস্ত দিনের উপার্জনের টাকা ঝনাৎ করিয়া তাহার সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া কহিলাম, “টাকা চান তাে এই নিন, যখন মরিকে সঙ্গে লইয়া যাইবেন; এখন এই লােকটাকে ছুটি দিন, ও কন্যার সৎকার করিয়া আসুক।”
বহ, উৎপীড়িতের অশ্রসেচনে দারােগার সহিত ডাক্তারের যে প্রণয় বাড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহা এই ঝড়ে ভূমিসাৎ হইয়া গেল।
অনতিকাল পরে দারােগার পায়ে ধরিয়াছি, তাঁহার মহাশয়তার উল্লেখ করিয়া অনেক স্তুতি এবং নিজের বুদ্ধিভ্রংশ লইয়া অনেক আত্মধিক্কার প্রয়ােগ করিয়াছি, কিন্তু শেষটা ভিটা ছাড়িতে হইল।
ভাদ্র ১৩০৭