গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)/উদ্ধার
উদ্ধার
গৌরী প্রাচীন ধনীবংশের পরমাদরে পালিতা সুন্দরী কন্যা। স্বামী পরেশ হীনাবস্থা হইতে সম্প্রতি নিজের উপার্জনে কিঞ্চিৎ অবস্থার উন্নতি করিয়াছে। যতদিন তাহার দৈন্য ছিল ততদিন কন্যার কষ্ট হইবে ভয়ে শ্বশুর সাশুড়ি স্ত্রীকে তাঁহার বাড়িতে পাঠান নাই। গৌরী বেশ-একটু বয়স্ক হইয়াই পতিগৃহে আসিয়াছিল।
বােধ করি এই-সকল কারণেই পরেশ সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তগম্য বলিয়া বােধ করিতেন না। এবং বােধ কৰি সন্দিগ্ধ স্বভাৰ তাঁহার একটা ব্যাধির মধ্যে।
পরেশ পশ্চিমে একটি ক্ষুদ্র শহরে ওকালতি করিতেন; ঘরে আত্মীয়স্বজন বড়াে কেহ ছিল না, একাকিনী স্ত্রীর জন্য তাঁহার চিত্ত উদ্বিগ্ন হইয়া থাকিত। মাঝে মাঝে এক-একদিন হঠাৎ অসময়ে তিনি আদালত হইতে বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইতেন। প্রথম প্রথম স্বামীর এইরুপ আকস্মিক অভ্যুদয়ের কারণ গৌরী ঠিক বুঝিতে পারিত না।
মাঝে মাঝে অকারণ পরেশ এক-একটা করিয়া চাকর ছাড়াইয়া দিতে লাগিলেন। কোনাে চাকর তাহার আর দীর্ঘকাল পছন্দ হয় না। বিশেষত অসুবিধার আশঙ্কা করিয়া যে চাকরকে গৌরী রাখিবার জন্য অধিক আগ্রহ প্রকাশ করিত তাহাকে পরেশ এক মুহুর্ত স্থান দিতেন না। তেজস্বিনী গৌরী ইহাতে যতই আঘাত বােধ করিত স্বামী ততই অস্থির হইয়া এক-এক সময়ে অদ্ভুত ব্যবহার করিতে থাকিতেন।
অবশেষে আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া যখন দাসীকে গােপনে ডাকিয়া পরেশ নানাপ্রকার সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন তখন সে-সকল কথা গৌরীর কর্ণগােচর হইতে লাগিল। অভিমানিনী স্বল্পভাষিণী নারী অপমানে আহত সিংহিনীর ন্যায় অন্তরে অন্তরে উদ্দীপ্ত হইতে লাগিলেন এবং এই উন্মত্ত সন্দেহ দম্পতির মাঝখানে প্রলয়খন্সের মতাে পড়িয়া উভয়কে একেবারে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল।
গৌরীর কাছে তাঁহার তীব্র সন্দেহ প্রকাশ পাইয়া যখন একবার লজ্জা ভাঙিয়া গেল তখন পরেশ স্পষ্টতই প্রতিদিন পদে পদে আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়া স্ত্রীর সহিত কলহ করিতে আরম্ভ করিল এবং গৌরী যতই নিরুত্তর অবজ্ঞা এবং কষাঘাতের ন্যায় তীক্ষা কটাক্ষ দ্বারা তাহাকে আপাদমস্তক যেন ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিল ততই তাঁহার সংশয়মত্ততা আরও যেন বাড়িবার দিকে চলিল।
এইরুপ স্বামীসখ হইতে প্রতিহত হইয়া পুত্রহীনা তরুণী ধর্মে মন দিল। হরিসভার নবীন প্রচারক ব্রহচারী পরমানন্দস্বামীকে ডাকিয়া মন্ত্র লইল এবং তাঁহার নিকট ভাগবতের ব্যাখ্যা শুনিতে আরম্ভ করিল। নারীহদয়ের সমস্ত ব্যর্থ স্নেহ প্রেম কেবল ভক্তি-আকারে পুঞ্জীভূত হইয়া গুরুদেবের পদতলে সমর্পিত হইল।
পরমানন্দের সাধু চরিত্র সম্বন্ধে দেশে বিদেশে কাহারও মনে সংশয়মাত্র ছিল না। সকলে তাহাকে পুজা করিত। পরেশ ইহার সম্বধে মুখ ফটিয়া সংশয় প্রকাশ করিতে পারিতেন না বলিয়াই তাহা গন্ত ক্ষতের মতাে ক্রমশ তাঁহার মর্মের নিকট পর্যন্ত খনন করিয়া চলিয়াছিল। গল্পগুচ্ছ একদিন সামান্য কারণে বিষ উদ্গীরিত হইয়া পড়িল। স্ত্রীর কাছে পরমানন্দকে উল্লেখ করিয়া ‘দুশ্চরিত্র ভণ্ড’ বলিয়া গালি দিলেন এবং কহিলেন, “তােমার শালগ্রাম স্পর্শ করিয়া শপথপূর্বক বলো দেখি, সেই বকধার্মিককে তুমি মনে মনে ভালােবাস না।”
দলিত ফণিনীর ন্যায় মুহুর্তের মধ্যেই উদগ্র হইয়া মিথ্যা স্পর্ধা দ্বারা স্বামীকে বিদ্ধ করিয়া গৌরী রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “ভালােবাসি, তুমি কী করিতে চাও করাে!” পরেশ তৎক্ষণাৎ ঘরে তালাচাবি লাগাইয়া তাহাকে রুদ্ধ করিয়া আদালতে চলিয়া গেল।
অসহ্য রােষে গৌরী কোনােমতে দ্বার উন্মােচন করাইয়া তৎক্ষণাৎ বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।
পরমানন্দ নিভৃত ঘরে জনহীন মধ্যাহ্নে শাস্ত্রপাঠ করিতেছিলেন। হঠাৎ অমেঘবাহিনী বিদ্যুল্লতার মতাে গৌরী ব্রাহ্মচারীর শাস্ত্রধ্যয়নের মাঝখানে আসিয়া ভাঙিয়া পড়িল।
গুরু কহিলেন, “এ কী।”
শিষ্য কহিল, “গুরুদেব, অপমানিত সংসার হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলো, তােমার সেবাব্রতে আমি জীবন উৎসর্গ করিব।”।
'পরমানন্দ কঠোর ভৎসনা করিয়া গৌরীকে গৃহে ফিরিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু, হায় গুররদেব, সেদিনকার সেই অকস্মাৎ ছিন্নবিচ্ছিন্ন অধ্যয়নসত্র আর কি তেমন করিয়া জোড়া লাগিতে পারিল।
পরেশ গহে আসিয়া মুক্তদ্বার দেখিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কে আসিয়াছিল।”
স্ত্রী কহিল, “কেহ আসে নাই, আমি গুরুদেবের গহে গিয়াছিলাম।”
পরেশ মহতকাল পাংশু এবং পরক্ষণেই রক্তবর্ণ হইয়া কহিলেন, “কেন গিয়াছিলে।”
গৌরী কহিল, “আমার খুশি।”
সেদিন হইতে পাহারা বসাইয়া স্ত্রীকে ঘরে রন্ধে করিয়া পরেশ এমনি উপদ্রব আরম্ভ করিলেন যে, শহরময় কুৎসা রটিয়া গেল।
এই-সকল কুৎসিত অপমান ও অত্যাচারের সংবাদে পরমানন্দের হরিচিন্তা দূরে হইয়া গেল। এই নগর অবিলম্বে পরিত্যাগ করা তিনি কর্তব্য বােধ করিলেন অথচ উৎপীড়িতকে ফেলিয়া কোনােমতেই দরে যাইতে পারিলেন না।সন্ন্যাসীর এই কয়দিনকার দিনরাত্রের ইতিহাস কেবল অন্তর্যামীই জানেন।
অবশেষে অবরােধের মধ্যে থাকিয়া গৌরী একদিন পত্র পাইল, “বৎসে, আলােচনা করিয়া দেখিলাম, ইতিপূর্বে অনেক সাধী সাধকরমণী কৃষ্ণপ্রেমে সংসার ত্যাগ করিয়াছেন। যদি সংসারের অত্যাচারে হরিপাদপদ্ম হইতে তােমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে তবে জানাইলে ভগবানের সহায়তায় তাঁহার সেবিকাকে উদ্ধার করিয়া প্রভুব অভয় পদারবিন্দে উৎসর্গ করিতে প্রয়াসী হইব। ২৬শে ফাগুন বুধবারে অপরাহু ২ ঘটিকার সময় ইচ্ছা করিলে তােমাদের পুষ্করিণীতীরে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারিবে।”
গৌরী পত্রখানি কেশে বাঁধিয়া খোঁপার মধ্যে ঢাকিয়া রাখিল। ২৬শে ফাগুন মধ্যাহ্নে স্নানের পূর্বে চুল খুলিবার সময় দেখিল, চিঠিখানি নাই। হঠাৎ সন্দেহ হইল, হয়তাে চিঠিখানি কখন বিছানায় খলিত হইয়া পড়িয়াছে এবং তাহা তাহার স্বামীর হস্তগত হইয়াছে। স্বামী সে পত্র-পাঠে ঈর্ষায় দগ্ধ হইতেছে মনে করিয়া গৌরী মনে মনে একপ্রকার জালাময় আনন্দ অনুভব করিল; কিন্তু তাহার শিরােভূষণ পত্রখানি পাষণ্ডহস্তপর্শে লাঞ্ছিত হইতেছে, এ কল্পনাও অহার সহ্য হইল না। দুতপদে স্বামীগৃহে গেল।
দেখিল, স্বামী ভূতলে পড়িয়া গোঁ গোঁ করিতেছে, মুখ দিয়া ফেনা পড়িতেছে, চক্ষুতারকা কপালে উঠিয়াছে। দক্ষিণ বদ্ধমষ্টি হইতে পদ্মখানি ছাড়াইয়া লইয়া তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকিয়া পাঠাইল।
ডাক্তার আসিয়া কহিল, আপােস্পেক্সি—তখন রােগীর মৃত্যু হইয়াছে।
সেইদিন মফস্বলে পরেশের একটি জরুরি মকদ্দমা ছিল। সন্ন্যাসীর এতদন পতন হইয়াছিল যে, তিনি সেই সংবাদ লইয়া গৌরীর সহিত সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন।
সদ্যবিধবা গৌরী যেমন বাতায়ন হইতে গুদেবকে চোরের মতাে পুস্করিণীর তটে দেখিল, তৎক্ষণাৎ বজ্রচকিতের ন্যায় দৃষ্টি অবনত করিল। গুরু যে কোথা হইতে কোথায় নামিয়াছেন, তাহা যেন বিদ্যােলােকে সহসা এই মুহুর্তে তাহার হদয়ে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
গুরু ডাকিলেন, “গৌরী।”
গৌরী কহিল, “আসিতেছি, গুরুদেব।”
মত্যুসংবাদ পাইয়া পরেশের বন্ধুগণ যখন সৎকারের জন্য উপস্থিত হইল, দেখিল, গৌরীর মৃতদেহ স্বামীর পাবে শয়ান। সে বিষ খাইয়া মরিয়াছে। আধুনিক কালে এই আশ্চর্য সহমরণের দৃষ্টান্তে সতীমাহাত্যে সকলে স্তম্ভিত হইয়া গেল।
শ্রাবণ ১৩০৭