গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)/সদর ও অন্দর
সদর ও অন্দর
বিপিনকিশাের ধনীগহে জন্মিয়াছিলেন, সেইজন্য ধন যে পরিমাণে ব্যয় করিতে জানিতেন তাহার অর্ধেক পরিমাণেও উপার্জন করিতে শেখেন নাই। সুতরাং যে গৃহে জন্ম সে গৃহে দীর্ঘকাল বাস করা ঘটিল না।
সুন্দর সুকুমারমূর্তি তরল যুবক, গানবাজনায় সিদ্ধহস্ত, কাজকর্মে নিরতিশয় অপটু; সংসারের পক্ষে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক; জীবনযাত্রার পক্ষে জগন্নাথদেবের রথের মতাে অচল; যেরুপ বিপুল আয়ােজনে চলিতে পারেন সেরুপ আয়ােজন সম্প্রতি বিপিনকিশােরের আয়ত্তাতীত।
সৌভাগ্যক্রমে রাজা চিত্তরঞ্জন কোট্ অফ ওয়ার্ডস্ হইতে বিষয় প্রাপ্ত হইয়া শখের থিয়েটার ফাঁদিবার চেষ্টা করিতেছেন এবং বিপিনকিশােরের সুন্দর চেহারা ও গান গাহিবার ও গান তৈয়ারি করিবার ক্ষমতায় মুগ্ধ হইয়া তাহাকে সাদরে নিজের অনুচরশ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া লইয়াছেন।
রাজা বি.এ পাস। তাঁহার কোনােপ্রকার উচ্ছলতা ছিল না। বড়োমানুষের ছেলে হইয়াও নিয়মিত সময়ে, এমন-কি, নির্দিষ্ট স্থানেই শয়ন ভােজন করিতেন। বিপিনকিশােরকে হঠাৎ তাঁহার নেশার মতাে লাগিয়া গেল। তাঁহার গান শুনিতে ও তাঁহার রচিত গীতিনাট্য আলােচনা করিতে করিতে ভাত ঠাণ্ডা হইতে থাকে, রাত বাড়িয়া যায়। দেওয়ানজি বলিতে লাগিলেন, তাঁহার সংযতস্বভাব মনিবের চরিত্রদোষের মধ্যে কেবল ঐ বিপিনকিশােরের প্রতি অতিশয় আসক্তি। রানী বসন্তকুমারী স্বামীকে তর্জন করিয়া বলিলেন, “কোথাকার এক লক্ষীছাড়া বানর আনিয়া শরীর মাটি করিবার উপক্রম করিয়াছ, ওটাকে দুর করিতে পারিলেই আমার হাড়ে বাতাস লাগে।”
রাজা যুবতী স্ত্রীর ঈর্ষায় মনে মনে একট, খুশি হইতেন, হাসিতেন; ভাবিতেন, মেয়েরা যাহাকে ভালােবাসে কেবল তাহাকেই জানে। জগতে যে আদরের পাত্র অনেক গুণী আছে, স্ত্রীলােকের শাস্ত্রে সে কথা লেখে না। যে লােক তাহার কানে বিবাহের মন্ত্র পড়িয়াছে সকল গুণ তাহার এবং সকল আদর তাহারই জন্য। স্বামীর আধঘণ্টা খাবার সময় অতীত হইয়া গেলে অসহ্য হয়; আর, স্বামীর আশ্রিতকে দুর করিয়া দিলে তাহার একমষ্টি অন্ন জুটিবে না, এ সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। স্ত্রীলােকের এই বিবেচনাহীন পক্ষপাত দুষণীয় হইতে পারে, কিন্তু চিত্তরঞ্জনের নিকট তাহা নিতান্ত অপ্রীতিকর বােধ হইল না। এইজন্য তিনি যখন-তখন বেশিমাত্রায় বিপিনের গুণগান করিয়া স্ত্রীকে খেপাইতেন ও বিশেষ আমােদ বােধ করিতেন।
এই রাজকীয় খেলা বেচারা বিপিনের পক্ষে সুবিধাজনক হয় নাই। অন্তঃপুরের বিমুখতায় তাঁহার আহারাদির ব্যবস্থায় পদে পদে কণ্টক পড়িতে লাগিল। ধনীগহের ভৃত্য আশ্রিত ভদ্রলােকের প্রতি স্বভাবতই প্রতিকল; তাহারা রানীর আক্রোশে সাহস পাইয়া ভিতরে ভিতরে বিপিনকে অনেকপ্রকার উপেক্ষা দেখাইত।
রানী একদিন পুঁটোকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, “তােকে যে কোনাে কাজেই পাওয়া যায় না, সমস্ত দিন করিস কী।” সে কহিল, রাজার আদেশে বিপিনবাবুর সেবাতেই তাহার দিন কাটিয়া যায়।
রানী কহিলেন, “ইস, বিপিনবাব, যে ভারি নবাব দেখিতেছি।”
পরদিন হইতে পুঁটে বিপিনের উচ্ছিষ্ট ফেলিয়া রাখিত; অনেকসময় তাঁহার অন্ন ঢাকিয়া রাখিত না। অনভ্যস্ত হস্তে বিপিন নিজের অন্নের থালি নিজে মাজিতে লাগিল এবং মাঝে মাঝে উপবাস দিল; কিন্তু ইহা লইয়া রাজার নিকট নালিশ ফরিয়াদ করা তাহার স্বভাববিরুদ্ধ। কোনাে চাকরের সহিত কলহ করিয়া সে আত্মাবমাননা করে নাই। এইরূপে বিপিনের ভাগ্যে সদর হইতে আদর বাড়িতে লাগিল, অন্দর হইতে অবজ্ঞার সীমা রহিল না।
এ দিকে সুভদ্রাহরণ গীতিনাট্য রিহার্শাল-শেষে প্রস্তুত। রাজবাটির অঙ্গনে তাহার অভিনয় হইল। রাজা স্বয়ং সাজিলেন কৃষ্ণ, বিপিন সাজিলেন অর্জুন। আহা, অর্জুনের যেমন কণ্ঠ তেমনি রূপ। দর্শকগণ ‘ধন্য ধন্য করিতে লাগিল।
রাত্রে রাজা আসিয়া বসন্তকুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন অভিনয় দেখিলে।”
রানী কহিলেন, “বিপিন তাে বেশ অর্জন সাজিয়াছিল। বড়ােঘরের ছেলের মতাে তাহার চেহারা বটে, এবং গলার সুরটিও তত দিব্য!”
রাজা বলিলেন, “আর, আমার চেহারা বুঝি কিছুই নয়, গলাটাও বুঝি মন্দ?”
রানী বলিলেন, “তােমার কথা আলাদা।” বলিয়া পুনরায় বিপিনের অভিনয়ের কথা পাড়িলেন।
রাজা ইহা অপেক্ষা অনেক উচ্ছসিত ভাষায় রানীর নিকট বিপিনের গুণগান করিয়াছেন; কিন্তু অদ্য রানীর মুখের এইটকুমাত্র প্রশংসা শুনিয়া তাহার মনে হইল, বিপিনটার ক্ষমতা যে পরিমাণে, অবিবেচক লােকে তদপেক্ষা তাহাকে ঢের বেশি বাড়াইয়া থাকে। উহার চেহারাই বা কী, আর গলাই বা কী এমন। কিয়ৎকাল পর্বে তিনিও এই অবিবেচকশ্রেণীর মধ্যে ছিলেন; হঠাৎ কী কারণে তাঁহার বিবেচনাশক্তি বাড়িয়া উঠিল।
পরদিন হইতে বিপিনের আহারাদির সুব্যবস্থা হইল। বসন্তকুমারী রাজাকে কহিলেন, “বিপিনকে কাছারি-ঘরে আমলাদের সহিত বাসা দেওয়া অন্যায় হইয়াছে। হাজার হউক, এক সময়ে উহার অবস্থা ভালাে ছিল।”
রাজা কেবল সংক্ষেপে উড়াইয়া দিয়া কহিলেন, “হাঃঁ!”
রানী অনুরােধ করিলেন, “খােকার অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আর-একদিন থিয়েটার দেওয়া হউক।” রাজা কথাটা কানেই তুলিলেন না।
একদিন ভালাে কাপড় কোঁচানো হয় নাই বলিয়া রাজা পুটে চাকরকে ভৎসনা করাতে সে কহিল, “কী করিব, রানীমার আদেশে বিপিনবাবুর বাসন মাজিতে ও সেবী করিতেই সময় কাটিয়া যায়।”
রাজা রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “ইস, বিপিনবাব, তাে ভারি নবাব হইয়াছেন, নিজের বাসন বুঝি নিজে মাজিতে পারেন না!”
বিপিন পুনমর্ষিক হইয়া পড়িল।
রানী রাজাকে ধরিয়া পড়িলেন, সন্ধ্যাবেলায় তাঁহাদের সংগীতালােচনার সময় পাশের ঘরে থাকিয়া পর্দার আড়ালে তিনি গান শুনিবেন, বিপিনের গান তাহার ভালাে লাগে। রাজা অনতিকাল পরেই পূর্ববৎ অত্যন্ত নিয়মিত সময়ে শয়ন ভােজন আরম্ভ করিলেন। গানবাজনা আর চলে না।
রাজা মধ্যাহে জমিদানি-কাজ দেখিতেন। একদিন সকাল-সকাল অন্তঃপুরে গিয়া দেখিলেন, রানী কী-একটা পড়িতেছেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কী পড়িতেছ।”
রানী প্রথমটা একটু অপ্রতিভ হইয়া কহিলেন, “বিপিনবাবুর একটা গানের খাতা আনাইয়া দুটো-একটা গানের কথা মখস্থ করিয়া লইতেছি; হঠাৎ তােমার শখ মিটিয়া গিয়া আর তাে গান শনিবার জো নাই!” বহুপর্বে শখটাকে সমূলে বিনাশ করিবার জন্য রানী যে বহুবিধ চেষ্টা করিয়াছিলেন, সে কথা কেহ তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিল না॥
পরদিন বিপিনকে রাজা বিদায় করিয়া দিলেন; কাল হইতে কী করিয়া কোথায় তাঁহার অনুমষ্টি জুটিবে সে সম্বন্ধে কোনাে বিবেচনা করিলেন না।
দুঃখ কেবল তাহাই নহে, ইতিমধ্যে বিপিন রাজার সহিত অকৃত্রিম অনুরাগে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন; বেতনের চেয়ে রাজার প্রণয়টা তাঁহার কাছে অনেক বেশি দামি হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু, কী অপরাধে যে হঠাৎ রাজার হদ্যতা হারাইলেন, অনেক ভাবিয়াও বিপিন তাহা ঠিক করিতে পারিলেন না। এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তাঁহার পুরাতন তম্বুরাটিতে গেলাপ পরাইয়া বন্ধুহীন বহৎ সংসারে বাহির হইয়া পড়িলেন; যাইবার সময় রাজভৃত্য পুটেকে তাঁহার শেষ সম্বল দুইটি টাকা পুরস্কার দিয়া গেলেন।
আষাঢ় ১৩০৭