চন্দনী

 জান’ই তো সেদিন কী কাণ্ড। একেবারে তলিয়ে গিয়েছিলেম আরকি, কিন্তু তলায় কোথায় যে ফুটো হয়েছে তার কোনো খবর পাওয়া যায় নি। না মাথা ধরা, না মাথা ঘোরা, না গায়ে কোথাও ব্যথা, না পেটের মধ্যে একটুও খোঁচাখুঁচির তাগিদ। যমরাজার চরগুলি খবর-আসার সব দরজাগুলো বন্ধ ক’রে ফিস্ ফিস্ ক’রে মন্ত্রণা করছিল। এমন সুবিধে আর হয় না। ডাক্তারেরা কলকাতায়— নব্বই মাইল দূরে। সেদিনকার এই অবস্থা।

 সন্ধে হয়ে এসেছে। বারান্দায় বসে আছি। ঘন মেঘ ক’রে এল। বৃষ্টি হবে বুঝি। আমার সভাসদরা বললে, ঠাকুরদা, একসময় শুনেছি তুমি মুখে মুখে গল্প ব’লে শোনাতে, এখন শোনাও-না কেন।

 আর-একটু হলেই বলতে যাচ্ছিলুম, ক্ষমতায় ভাঁটা পড়েছে ব’লে।

 এমন সময় একটি বুদ্ধিমতী বলে উঠলেন, আজকাল আর বুঝি তুমি পার না?

 এটা সহ্য করা শক্ত। এ যেন হাতির মাথায় অঙ্কুশ! আমি বুঝলুম, আজ আমার আর নিস্তার নেই। বললুম, পারি নে তা নয়— পারি। তবে কিনা—

 বাকিটা আর বলা হল না। মনে মনে তখন রাজপুতনা থেকে গল্প তলপ করতে আরম্ভ করেছি। খানিকটা বললুম। একবার বললুম, রোসে, একবার একটুখানি দেখে আসি, কে যেন এল।

 কেউ আসে নি। শেষকালে বসতে হল।

 যমদূতগুলো মোটের উপরে হাঁদা। একটু নড়তে গেলেই ধুপধাপ ক’রে শব্দ করে, আর তাদের শেল শূল-ছুরি-ছোরাগুলো ঝন্ঝনিয়ে ওঠে। সেদিন কিন্তু একেবারে নিঃশব্দ।

 সন্ধ্যা হয়েছে, পথিক চলেছেন গোরুর গাড়িতে করে। পরদিন সকালে রাজমহলে পৌঁছলে নেীকে নিয়ে তিনি যাত্রা করবেন পশ্চিমে। তিনি রাজপুত, তাঁর নাম অরিজিৎ সিংহ। বাংলাদেশে ছোটাে কোনো রাজার ঘরে সেনাপতির কাজ করতেন। ছুটি নিয়ে চলেছেন রাজপুতনায়। রাত্রি হয়ে এসেছে। গাড়িতে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ একসময় জেগে উঠে দেখলেন, গাড়ি চলেছে বনের মধ্যে। গাড়োয়ানকে বললেন, ঘাটের রাস্ত ছেড়ে এখানে কেন।

 গাড়োয়ান বললে, আমাকে চিনলেই বুঝবেন কেন।

 তার পাগড়িটা অনেকখানি আড় ক’রে পরা ছিল। সোজা ক’রে পরতেই অরিজিৎ বললেন, চিনেছি। ডাকাতের সর্দার পরাক্রম সিংহের চর তুমি। অনেকবার তোমার হাতে পড়েছিলুম, এড়িয়ে এসেছি।

 সে বললে, ঠিক ঠাওরেছেন, এবার এড়াতে পারছেন না। চলুন আমার মনিবের কাছে।

 অরিজিৎ বললেন, উপায় নেই, যেতেই হবে। কিন্তু, তোমাদের ইচ্ছে পূর্ণ হবে না।

 গাড়ি চলল বনের মধ্যে। এর আগের কথাটা এবার খুলে বলা যাক।

 অরিজিৎ বড়ো ঘরের ছেলে। মোগল সম্রাট তার রাজ্য নিলে কেড়ে, তিনি এলেন বাংলাদেশে পালিয়ে। এখান থেকে তৈরি হয়ে একদিন তাঁর রাজ্য ফিরে নেবেন, এই ছিল তাঁর পণ। এ দিকে পরাক্রম সিং মুসলমানদের হাতে তাঁর বিষয়সম্পত্তি হারিয়ে ডাকাতের দল বানিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ের বিবাহের বয়স হয়েছে; অরিজিতের সঙ্গে বিবাহ হয়, এই ছিল তাঁর চেষ্টা। কিন্তু, জাতিতে তিনি অরিজিতের সমান দরের ছিলেন না, তার ঘরের মেয়েকে বিবাহ করতে অরিজিৎ রাজী নন।

 রাত্রি ভোর হয়ে এসেছে। তাঁকে পরাক্রমের দরবারে এনে দাঁড় করালে পরাক্রম বললেন, ভালো সময়েই এসেছ, বিয়ের লগ্ন পড়বে আর দুদিন পরে। তোমার জন্য বরসজ্জা সব তৈরি।

 অরিজিৎ বললেন, অন্যায় করবেন না। সকলেই জানে, আপনার গুষ্টিতে মুসলমান রক্তের মিশল ঘটেছে।

 পরাক্রম বললেন, কথাটা সত্য হতেও পারে, সেইজন্যেই তোমার মতো উচ্চ কুলের রক্ত মিশল ক’রে আমার বংশের রক্ত শুধরে নেবার জন্যে এতদিন চেষ্টা করেছি। আজ সুযোগ এল। তোমার মানহানি করব না। বন্দী করে রাখতে চাই নে, ছাড়া থাকবে। একটা কথা মনে রেখো, এই বন থেকে বেরোবার রাস্তা না জানলে কারোর সাধ্যি নেই এখান থেকে পালায়। মিছে চেষ্টা কোরো না, আর যা ইচ্ছা করতে পার।

 রাত্রি অনেক হয়েছে। অরিজিতের ঘুম নেই, বসেছেন এসে কাশিনী নদীর ঘাটে বটগাছের তলায়। এমন সময় একটি মেয়ে, মুখ ঘোমটায় ঢাকা, তাঁকে এসে বললে, আমার প্রণাম নিন। আমি এখানকার সর্দারের মেয়ে। আমার নাম রঙনকুমারী। আমাকে সবাই চন্দনী ব’লে ডাকে। আপনার সঙ্গে পিতাজি আমার বিবাহ অনেকদিন থেকে ইচ্ছা করেছেন। শুনলেম, আপনি রাজী হচ্ছেন না। কারণ কী বলুন আমাকে। আপনি কি মনে করেন আমি অস্পৃশ্য।

 অরিজিৎ বললেন, কোনো মেয়ে কখনো অস্পৃশ্য হয় না, শাস্ত্রে বলেছে।

 তবে কি আমাকে দেখতে ভালো নয় ব’লে আপনার ধারণা।

 তাও নয়, আপনার রূপের সুনাম আমি দূর থেকে শুনেছি।

 তবে আপনি কেন কথা দিচ্ছেন না।

 অরিজিৎ বললেন, কারণটা খুলে বলি। করঞ্জরের রাজকন্যা নির্মলকুমারী আমার বহুদূর-সম্পর্কের আত্মীয়া। তাঁর সঙ্গে ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলা করেছি। তিনি আজ বিপদে পড়েছেন। মুসলমান নবাব তাঁর পিতার কাছে তাঁর জন্যে দূত পাঠিয়েছিলেন। পিতা কন্যা দিতে রাজী না হওয়াতে যুদ্ধ বেধে গেল। আমি তাঁকে বাঁচিয়ে আনব, ঠিক করেছি। তার আগে আর-কোথাও আমার বিবাহ হতে পারবে না, এই আমার পণ। করঞ্জর রাজ্যটি ছোটো, রাজার শক্তি অল্প। বেশি দিন যুদ্ধ চলবে না, জানি, তার আগেই আমাকে যেতে হবে। চলেছিলেম সেই রাস্তায়, পথের মধ্যে তোমার পিতা আমাকে ঠেকিয়ে রাখলেন। কী করা যায় তাই ভাবছি।

 মেয়েটি বললে, আপনি ভাববেন না। এখান থেকে আপনার পালাবার বাধা হবে না, আমি রাস্তা জানি। আজ রাত্রেই আপনাকে বনের বাহিরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেব। কিছু মনে করবেন না, আপনার চোখ বেঁধে নিয়ে যেতে হবে, কেননা এ বনের পথের সংকেত বাইরের লোককে জানতে দিতে চণ্ডেশ্বরীদেবীর মানা আছে; তা ছাড়া আপনার হাতে পরাব শিকল। তার যে কী দরকার পথেই জানতে পারবেন।

 অরিজিৎ চোখ-বাঁধা হাত-বাঁধা অবস্থায় ঘন বনের মধ্যে দিয়ে চন্দনীর পিছন-পিছন চললেন। সে রাত্রে ডাকাতের দল সবাই ভাঙ খেয়ে বেহোঁশ। কেবল পাহারায় যে সর্দার ছিল সেই ছিল জেগে। সে বললে, চন্দনী, কোথায় চলেছ।

 চন্দনী বললে, দেবীর মন্দিরে।

 ঐ বন্দীটি কে।

 বিদেশী, ওকে দেবীর কাছে বলি দেব। তুমি পথ ছেড়ে দাও।

 সে বললে, একলা কেন।

 দেবীর আদেশ, আর-কাউকে সঙ্গে নেওয়া নিষেধ।

 ওরা বনের বাইরে গিয়ে পৌছল, তখন রাত্রি প্রায় হয়েছে ভোর। চন্দনী অরিজিৎকে প্রণাম করে বললে, আপনার আর ভয় নেই। এই আমার কঙ্কণ, নিয়ে যান, দরকার হলে পথের মধ্যে কাজে লাগতে পারে।

 অরিজিৎ চললেন দূর পথে। নানা বিঘ্ন কাটিয়ে যতই দিন যাচ্ছে ভয় হতে লাগল, সময়মত হয়তো পৌঁছতে পারবেন না। বহুকষ্টে করঞ্জর রাজ্যের যখন কাছাকাছি গিয়েছেন খবর পেলেন, যুদ্ধের ফল ভালো নয়। দুর্গ বাঁচাতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক, মুসলমানের দখল করে নিতে পারবে, তাতে সন্দেহ নেই। অরিজিৎ আহার নিদ্রা ছেড়ে প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে যখন দুর্গের কাছাকাছি গিয়েছেন দেখলেন, সেখানে আগুন জ্বলে উঠেছে। বুঝলেন মেয়ের জহরব্রত নিয়েছে। হার হয়েছে, তাই সকলে চিতা জ্বালিয়েছে মরবার জন্যে। অরিজিৎ কোনোমতে দুর্গে পৌছলেন। তখন সমস্ত শেষ হয়ে গিয়েছে। মেয়েরা আর কেউ নেই। পুরুষরা তাদের শেষ লড়াই লড়ছে। নির্মলকুমারী রক্ষা পেল, কিন্তু সে মৃত্যুর হাতে, তাঁর হাতে নয়— এই দুঃখ। তখন মনে পড়ল চন্দনী তাকে বলেছিল, তোমার কাজ শেষ হয়ে গেলে পর তোমাকে এখানেই ফিরে আসতে হবে; সেজন্যে, যতদিন হোক, আমি পথ চেয়ে থাকব।

 তার পর দুই মাস চলে গেল। ফাল্গুনের শুক্লপক্ষে অরিজিৎ সেই বনের মধ্যে পৌঁছলেন। শাঁখ বেজে উঠল, সানাই বাজল, সবাই পরল নতুন পাগড়ি লাল রঙের, গায়ে ওড়ালো বাসন্তী রঙের চাদর। শুভলগ্নে অরিজিতের সঙ্গে চন্দনীর বিবাহ হয়ে গেল।

 এই পর্যন্ত হল আমার গল্প। তার পরে বরাবরকার অভ্যাসমত শোবার ঘরে কেদারায় গিয়ে বসলুম। বাদলার হাওয়া বইছিল। বৃষ্টি হবে-হবে করছে। সুধাকান্ত দেখতে এলেন, দরজা জানালা ঠিকমত বন্ধ আছে কি না। এসে দেখলেন, আমি কেদারায় বসে আছি। ডাকলেন, কোনো উত্তর নেই। স্পর্শ করে বললেন, ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, চলুন বিছানায়।

 কোনো সাড়া নেই। তার পরে চৌষট্টি ঘণ্টা কাটল অচেতনে।