ক্ষমা।

অক্রোধেন জয়েৎ ক্রোধং অসাধুং সাধুনা জয়েৎ।
জয়েৎ কদর্য্যং দানেন জয়েৎ সত্যেন চানৃতং।

 ক্ষমা দ্বারা ক্রোধকে জয় করিবেক, সাধুতা দ্বারা অসাধুতাকে জয় করিবেক, উপকার দ্বারা অপকারীকে জয় করিবেক, এবং সত্য দ্বারা মিথ্যাকে জয় করিবেক।


 সংসারের সকলেই ক্ষমার প্রত্যাশী। ইচ্ছা করিয়াই হউক আর অনিচ্ছাতেই হউক পরস্পর সকলেই সকলের নিকট কোন না কোন সময়ে অপরাধী হইয়াই থাকে। কিন্তু প্রত্যেকেই যদি প্রত্যেকের অপরাধের প্রতিশোেধ গ্রহণ করেন তাহা হইলে সংসার কি অশান্তির আলয় হইয়া উঠে! বস্তুতঃ সংসারে ক্ষমা পাওয়া যায় বলিয়াই সংসারে শান্তি আছে।

 অন্যকে ভালবাসিতে পারিলে ক্ষমা করা অতি সহজ। আমরা আপনার লোকদিগকে ভালবাসি তাই তাহাদিগকে সর্ব্বদাই ক্ষমা করিয়া থাকি। যাঁহারা মহৎ লোক তাঁহারা পরকেও আপনার মত ভালবাসেন, তাই শত্রুকেও তাঁহারা ক্ষমা করেন,—অপকারীর উপকার করিয়া তাঁহারা তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। ইহাই যথার্থ প্রতিশোধ, কেন না এইরূপ প্রতিশোধে শত্রুও মিত্র হয়।

 তুমি যদি অন্যের নিকট ক্ষমা পাইতে চাহ তবে অন্যকে ক্ষমা করিতে শিখ। যদি শত্রুকেও মিত্র করিতে চাও তবে উপকার করিয়া তৎকৃত অপকারের প্রতিশোধ প্রদান কর।

 রায়পুরের বাগানটির বড় শোভা হইয়াছে। গাছে গাছে লতা উঠিয়াছে, পাতায় পাতায় বিকাল বেলার সূর্য্যের সোনার কিরণ ঝিকঝিক করিতেছে,বকুল ও কামিনীর তলায় ফুলের তারা ফুটিতে আরম্ভ হইয়াছে। বাগানের মাঝে মাঝে দুর্ব্বাদলের ঘন বনগুলি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদিগের জন্য বিছানা পাতিয়া রাখিয়াছে। রায়পুরের যত বালিকা এসময় এখানে খেলিতে আসিয়াছে। কেহবা ফুল কুড়াইতেছে, কেহবা ঘুটিম খেলিতেছে, কেহবা গাছের তলায় ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে।

 ঐখানে একটি বকুল গাছের তলায় অমলা ও বিমলা ফুল কুড়াইতে মত্ত। টুপ! টাপ করিয়া একবার এখানে একবার ওখানে, একবার অমলার মাথায়, একবার বিমলার গায়ে ফুল পড়িতেছে। তাহারা একটি তুলিতে গিয়া একটি মাড়াইতেছে, কতক গুলি আঁচলে রাখিবার সময় কতকগুলি ফেলিয়া দিতেছে।

 ফুল তুলিতে তুলিতে বিমলা সহসা একবার সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া ত্রস্তে বলিয়া উঠিল—“ও অমলা, ঐ দিকে চল ভাই, ঐ আস্‌চে।” অমলা মুখ তুলিয়া দেখিল লক্ষ্মী আসিতেছে, ভয়ে অমলার আঁচল হইতে ফুল পড়িয়া গেল, পা আর সরিল না, থতমত খাইয়া দাঁড়াইল।

 দেখিতে দেখিতে লক্ষ্মী আসিয়া উপস্থিত হইল। লক্ষ্মী অন্য বালিকাদের প্রতি বড় অত্যাচার করিত। সেই জন্য তাহাকে সকলে ভয় করে, তাহাকে সকলে যমের মত দেখে। কিন্তু লক্ষ্মীর পিতা গ্রামের মধ্যে ধনী, সেই জন্য লক্ষ্মী যাহাই করুক অন্য কেহ তাহাতে কথা কহিতে সাহস পায় না—লক্ষ্মীও দেখে কিছুতেই তাহার শাস্তি হয় না, সেও নির্ভয়ে যাহা ইচ্ছা করে।

 লক্ষ্মী আসিয়া মুখ বাঁকাইয়া, চোখ রাঙ্গাইয়া, অমলার হাত ধরিয়া হড় হড় করিয়া টানিতে টানিতে বিমলাকে বলিল “বলি, বিমলা, তােদের কি বুকের পাটা? সেদিন বারণ করেছি এ গাছের তলায় তােরা কেউ ফুল কুড়াবি নে, আবার এসেছিস্? এবার এখানে দেখ্‌তে পেলে হাড় ভেঙ্গে দেব।” অমলা ভয়ে কাঁদিয়া ফেলিল, বিমলা আস্তে আস্তে অমলার, হাত ধরিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল। লক্ষ্মী তাহাদের আঁচলের ফুল আপনার আঁচলে লইয়া চারিদিকে ছড়াইতে ছড়াইতে কিছু দূরে যেখানে কয়েকটি বালিকা ঘুটিম খেলিতেছিল, সেইখানে আসিয়া দাঁড়াইল। লক্ষ্মীকে দেখিয়া বালিকাগুলি একটু ভয়ে ভয়ে খেলিতে লাগিল।

 লক্ষ্মী বলিল, “আমি খেলব”।

 এক জন আস্তে আস্তে বলিল, “এ হাতটা আগে হার জিৎ হয়ে যাক।”

 লক্ষ্মীর রাগ হইল। সে বলিল, “কি? আমাকে নিয়ে খেলবি নে? দেখব তােদের এহাত কে খেলতে দেয়”! বলিয়া সমস্ত ঘুটি গুলি চারিদিকে ফেলিয়া দিয়া রাগে গর্ গর্ করিতে করিতে চলিয়া গেল। সে মুখ ফিরাইবা মাত্র তাহার পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া মারিবার ছলে সকল বালিকারা হাত উঠাইয়া আস্তে আস্তে গালি দিতে লাগিল। তাহার সাক্ষাতে ত ভয়ে কিছু বলিতে পারে না, কাজেই সকলে তাহার পশ্চাতে এইরূপে শােধ তুলিয়া থাকে।

 লক্ষ্মী সেখান হইতে চলিয়া আসিয়া দেখিল, কুসুম পুকুরধারের কেয়াফুলের গাছ হইতে ফুল ছিঁড়িতেছে। লক্ষ্মী একে রাগিয়া আছে, তাহাতে আবার কুসুমকে কেয়াফুল ছিঁড়িতে দেখিয়া আরও জ্বলিয়া উঠিল। লক্ষ্মী, জানে সে বাগানের ফুলে লক্ষ্মী ভিন্ন, আর কাহারও অধিকার নাই, কিছু না কহিয়া না বলিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়াই লক্ষ্মী কুসুমকে এক চড় মারল, কিন্তু চড় মারিয়া হাত সরাইয়া লইবার সময় সেই ফুলগাছের পাতার কাঁটায় তাহার হাত ছড়িয়া গেল, ছড়িয়া রক্ত পড়িতে লাগিল।

 কুসুমের প্রাণে বড় বেদনা লাগিল ও লক্ষ্মী যে তাহাকে মারিয়াছে, লক্ষ্মী যে তাহার প্রতি অত্যাচার করে সে তাহা ভুলিয়া গেল। কাঁদ কাঁদ চোখে কুসুম লক্ষ্মীকে ধরিয়া পুষ্করিণীর তীরে আনিয়া বসাইল, তাহার পর আপনার আঁচল ভিজাইয়া তাহার হাতে বার বার জল দিতে লাগিল।

 লক্ষ্মী কাহারাে নিকট এরূপ প্রতিশােধ পায় নাই, লজ্জায় অনুতাপে সে মরিয়া গেল। কুসুমের ব্যবহারে তাহার হৃদয়ের একটি লুক্কায়িত তারে আঘাত লাগিল, এতদিন অন্য কেহ সে তার স্পর্শ করিতে পারে নাই। সে যেন আজ সহসা দিব্য জ্ঞান লাভ করিয়া কিয়ৎক্ষণ পরে বলিল—“কুসুম, আজ তুমি আমাকে যাহা শিক্ষা দিলে এ পর্য্যন্ত তাহা আমাকে কেহ শিখায় নাই। তােমার এ উপকার আমি জন্মে ভুলিব না; এই ব্যাপার মনে করিয়া আমি এখন হইতে তােমার মত হইতে চেষ্টা করিব।”

 সেই পর্য্যন্ত সত্যই লক্ষ্মীর স্বভাব একেবারে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। আর লক্ষ্মীকে কাহারাে প্রতি অত্যাচার করিতে দেখা যায় না। যখনি অভ্যাস বশতঃ লক্ষ্মী কাহাকেও মারিতে যায়, অমনি সেই দিনকার ঘটনাটি মনে পড়ে, অমনি তাহার মনে অনুতাপ জাগিয়া উঠে, এবং তৎক্ষণাৎ অন্যায় কর্ম্ম হইতে বিরত হইয়া কুসুমের মত ভাল হইতে সংকল্প করে।

 এইরূপে ক্রমে লক্ষ্মী যথার্থই লক্ষ্মী হইয়া দাঁড়াইল।

 * * * *

 * * * *

 ইহার পর কত দিন চলিয়া গিয়াছে, লক্ষ্মীর এখন বিবাহ হইয়া গিয়াছে। কত দিন পরে লক্ষ্মী শ্বশুরালয় হইতে পিত্রালয়ে আসিয়াছে। লক্ষ্মী এখন সকলকে ভাল বাসিতে শিখিয়াছে, লক্ষ্মীকেও এখন সকলে ভালবাসে। লক্ষ্মীর আগেকার যত সমবয়সী সকলেই তাহাকে দেখিতে আসিয়াছে, কেবল কুসুম আসে নাই। কুসুম কোথায়? কুসুম বুঝি এখন আর এ পৃথিবীর মেয়ে নয়, সে স্বর্গে ফুটিতে গিয়াছে।

 লক্ষ্মী বিকালে সেই ছেলেবেলার বাগানটিতে আসিল, বাগানের চারিদিকে বিষণ্ণমনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, বাগানে সেই পরিচিত বৃক্ষাবলী, সেই ঘাসের বন, সেই ফুলের শোভা; এ সমস্তই তাহাকে তাহার বাল্যক্রীড়া স্মরণ করাইয়া দিতে লাগিল। লক্ষ্মী আস্তে আস্তে সেই পুকুর ধারের কেয়াগাছটির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল,—এইখানেই তাহার জীবনের প্রথম শিক্ষা। এই পুকুরধারে কত যত্ন করিয়া কুসুম তাহার আহত হস্তে জল দিয়া দিয়াছিল, কিরূপ প্রতিশোেধ দিয়া লক্ষ্মীকে সে ভাল করিয়াছে! এই সমস্ত মনে করিয়া অশ্রুজলে লক্ষ্মীর বুক ভাসিয়া গেল। লক্ষ্মী মনে মনে বলিল “কুসুম কোথায় তুমি! তোমাকে আর পৃথিবীতে দেখিতে পাইলাম না, তুমি এখন স্বর্গের দেবী; কিন্তু লক্ষ্মীর হৃদয়ে তুমি চিরকালই ফুটিয়া থাকিবে।”