গল্পস্বল্প/সাররত্ন
সাররত্ন।
সংসারে যে এত ঈর্ষা দ্বেষ নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি দেখা যায় তাহার কারণ কি? ভালবাসার অভাবই তাহার প্রকৃত কারণ। আমরা যাহাদিগকে ভালবাসি তাহাদিগের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করিতে আমাদের প্রাণে ব্যথা লাগে, তাহাদিগের মঙ্গল কামনা করিয়া, তাহাদিগের অভাব দূর করিয়া আমরা নিজে সন্তোষ অনুভব করি, আর যাহাদিগকে ভাল বাসি না তাহাদিগের সুখেই আমাদের ঈর্ষার উদয় হয়। সুতরাং প্রেমই সংসারে সুখ সন্তোষের মূল। যাঁহারা যত অন্যের সুখে সুখী, যত পরোপকারী তাঁহারা তত মহৎ লোক। অনেক সময় আমরা আলস্য-স্পৃহাকে সন্তোষ জ্ঞানে হৃদয়ে পোষণ করিয়া নিজের অবনত অবস্থার উন্নতিতে নিশ্চেষ্ট হই। কিন্তু এই ভ্রান্ত বিশ্বাস নিতান্তই অনর্থের মূল। বস্তুতঃ আলস্য আমাদিগকে যথার্থ সন্তোষ দিতে পারে না, কেবল আমাদিগের জড়ভাব বৃদ্ধি করে মাত্র। প্রকৃত পক্ষে অন্যের সুখের অবস্থাকে ঈর্ষা করাই যথার্থ অসন্তোষ, কিন্তু উন্নতির জন্য মানুষের যে উদ্যম—সে উদ্যমের মধ্যেও যথার্থ সন্তোষ নিহিত।
যদি সুখী হইতে চাহ ত আলস্য পরিত্যাগ কর, কিন্তু সংসারের সাররত্ন প্রেম ও সন্তোষে হৃদয় উজ্জ্বল করিয়া রাখ।
একদিন ভাগ্য দেবী মনুষ্যের ভাগ্য মাপিতেছেন—এবং আপনার ক্ষমতায় মনে মনে গর্ব্ব অনুভব করিতেছেন এমন সময় গোলাপদলের পরিচ্ছদ পরিয়া প্রজাপতিতে চড়িয়া একটি ক্ষুদ্র পরী সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া ভাগ্যদেবী সহাস্য-মুখে জিজ্ঞাসা করিলেন—“কোথা হইতে আসিতেছ? দেখিয়া ত বোধ হইতেছে পৃথিবী হইতে। সেখানকার খবর কি?”
পরী বলিল—“খবর বড় ভাল নহে। লোকে কেবল সেখানে নিজের ভাগ্যের আর তোমার নিন্দা করিতেছে। বাস্তবিক তোমার ভাণ্ডারে ধন মান যশ প্রভৃতি মানবের প্রার্থনীয় বস্তুর কিছুরই অভাব নাই—তুমি ইচ্ছা করিলেই লোককে সুখী করিতে পার, তবে কেন কর না? আমি যদি তোমার কাজে থাকিতাম— তাহা হইলে কেহ দুঃখ পাইত না।”
ভাগ্য দেবী ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন—“বেশ ত তুমি কিছু দিন আমার কাজ করিয়া দেখ না মানুষকে সুখী করা কেমন সহজ।” এই বলিয়া ভাগ্য দেবী তাঁহার ধন ভাণ্ডারের চাবি পরীর হাতে দিলেন। পরী ভাগ্যদেবীর ভাণ্ডার খুলিয়া তাহার শোভায় মোহিত হইয়া গেল।
ভণ্ডারটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম কক্ষটি ধন ভাণ্ডার— অগণ্য হীরা মুক্তা, মণি কাঞ্চনের জ্যোতিতে কক্ষ আলোকিত, এই আলোকসাগরে পড়িয়া পরীর চক্ষু যেন ঝলসিয়া যাইতে লাগিল।
দ্বিতীয় কক্ষটি মান যশ বিদ্যা বুদ্ধির ভাণ্ডার, ইহার দিগন্ত ব্যাপী সৌরভে পরীর হৃদয় মুগ্ধ হইয়া পড়িল।
তৃতীয় কক্ষে বাহ্যমোহকর বস্তুকিছু ছিলনা, এই কক্ষে প্রবেশ করিবা মাত্র একটি অপূর্ব্ব শান্তিতে তাহার মনপ্রাণ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। এই কক্ষটি ভাগ্য দেবীর সাররত্নের ভাণ্ডার,—সন্তোষ ও প্রেম এই দুইটি মাত্র রত্ন এখানে রক্ষিত।
এই সকল ধনরত্ন দেখিয়া পরীর হৃদস্য আহ্লাদে স্ফীত হইয়া উঠিল। এত দুর্লভ, অপূর্ব্ব দ্রব্য থাকিতে ভাগ্য দেবী যে কাহাকেও সুখী করিতে পারেন না, ইহা তাহার অত্যন্ত আশ্চর্য্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল। এই সকল ধন রত্ন দ্বারা পরী যে পৃথিবীর দুঃখ দূর করিতে সমর্থ হইবে তাহাতে আর তাহার সন্দেহ মাত্র রহিল না।
আশাপূর্ণ হৃদয়ে সে পৃথিবীতে নামিয়া প্রথমেই একটি মাঠের ধারে একখানি ভগ্ন কুটীরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল। দেখিল, কুটীরে একজন কৃষকপত্নী ক্ষুধিত সন্তানের দিকে চাহিয়া কাঁদিতেছে, আর চাষা নিকটেই ক্ষেত্রে কোদাল পাড়িতেছে। তাহার এমন সঙ্গতি নাই যে একখানি লাঙ্গলও কিনিয়া কার্য্যের একটু সুসার করে। তাদের দুঃখ দেখিয়া দয়ার্দ্র হৃদয়ে চাষার নিকটে আসিয়া পরী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল—“তুমি কি চাও?”
কৃষক তাহার নিকট কিঞ্চিৎ অর্থ প্রার্থনা করিল, প্রার্থনা পূর্ণ হইলে মহা সুখী হইয়া কুটীরে গমন করিল।
পরী মনে মনে ভাবিল, “এইত ভাগ্য দেবী যাহা পারেন নাই, আমি তাহা পারিলাম, আমার দানে কৃষক কতদুর সুখী হইয়াছে। আচ্ছা ইহার যেন ধনের অভাব ছিল, কিন্তু যাহার ধনের অভাব নাই সে না জানি কিসের কাঙ্গাল!” পরী কৌতুহল পরবশ হইয়া একজন ধনীর গৃহে গিয়া দেখিল, ধনী মনে মনে মহা অসুখী। তাহার ধন আছে বটে কিন্তু মান নাই। পরী দয়ার্দ্র হইয়া তাহাকে মান দান করিল। মান পাইয়া তাহাকে সুখী হইতে দেখিয়া পরী তখন ভাবিতে লাগিল—“আচ্ছা একজন ধনের কাঙ্গাল একজন মানের কাঙ্গাল, এ দুইই যাহার আছে—তাহার কি দুঃখ?”
এই ভাবিয়া পরী এক রাজগৃহে আসিয়া দেখিল, রাজার ধন মান কিছুরই অভাব নাই কিন্তু তথাপি তিনি সুখী নহেন। নিষ্ঠুর রাজা প্রজাদিগের উপর সর্ব্বদাই পীড়ন করেন, অথচ তিনি চাহেন সকলেই তাঁহার বশীভূত হয়। পরীর কৃপায় তাঁহার বাসনা পূর্ণ হইল, বিদ্রোহী প্রজারাও তাঁহার অনুগত হইয়া পড়িল। রাজাকে সুখী করিয়া পরী গর্ব্বিতহৃদয়ে ভাগ্য-দেবীকে এই শুভ সংবাদ দিতে তাঁহার নিকট গমন করিল। পথের মধ্যে তাহার মনে হইল, “আচ্ছা সেই কৃষক যাহাকে ধন দিয়া আমি সুখী করিয়াছি, সে কেমন সুখে আছে একবার দেখিয়া যাই”।
চাষার নিকট আসিয়া পরী দেখিল, চাষ ধনী হইয়াছে বটে—কিন্তু তথাপি সে সুখী হইতে পারে নাই, তাহার ধন-তৃষ্ণা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে মাত্র। পরী তখন তাহাকে আরও ধন প্রদান করিল, কিন্তু তাহাতেও তাহার ধনতৃষ্ণা মিটিল না। তখন পরী হতাশ হইয়া ভাবিল—“একজনকে সুখী করিতে নাই পারিলাম, অপর দুই জনকে ত করিয়াছি”।
কিন্তু তাহাদের নিকট আসিয়া দেখিল, হায়! তাহার সমস্ত দানই ব্যর্থ হইয়াছে—কেহই সুখী হয় নাই। আশা কাহাকেও সহজে ছাড়ে না, অন্তঃপর পরী ভাবিল—“আমি আর একবার ইহাদিগকে সুখী করিতে চেষ্টা করিব। তৃতীয় কক্ষের ধন এপর্য্যন্ত কাহাকেও দিই নাই, সেই সার ধন দিয়া ইহাদের দুঃখ দূর করিব।” এই ভাবিয়া পরী তৃতীয় কক্ষের দুইটি রত্ন লইয়া প্রথমে চাষার নিকট, পরে ধনীর নিকট আসিয়া তাহাদের প্রার্থিত ধনের পরিবর্ত্তে সন্তোষ-ধন দিতে চাহিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কেহই তাহা লইতে সম্মত হইল না। তখন পরী রাজগৃহে গিয়া উপস্থিত হইল। যদিও পরীর করুণায় এখন প্রজারা রাজার বশীভূত, কিন্তু নিষ্ঠুর অত্যাচারী রাজা মনে মনে সদাই শঙ্কিত। পরী তাহাকে প্রেমরত্ন দেখাইয়া বলিল, “মহারাজ, তুমি এই রত্ন গ্রহণ কর—ইহা গ্রহণ করিলে তোমার অসুখের কারণ বিন্দুমাত্র থাকিবে না।” কিন্তু রাজা সে সাররত্নের প্রকৃত মূল্য কিছুই বুঝিতে পারিলেন না, সুতরাং পরীর দান অগ্রাহ্য করিলেন। পরী তখন হতাশ হইয়া ক্ষুণ্ণচিত্তে-ভাগ্য-দেবীর নিকট যাত্রা করিল। যাইতে যাইতে পথে দেখিল, একজন গৃহস্থ সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর স্ত্রী পুত্র কন্যাকে লইয়া আনন্দ উপভোগ করিতেছে এবং তাহার এই সুখের জন্য মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেছে। পরী তাহার নিকট গিয়া আপনার অমূল্য রত্নের এক ক্ষুদ্র ভাগ তাহাকে দিতে চাহিল। গৃহস্থ অন্যের ন্যায় তাহা লইতে অস্বীকৃত না হইয়া কৃতজ্ঞচিত্তে তাহা গ্রহণ করিল। পরী তখন আবার তাহার গন্তব্য পথে যাত্রা করিল— তাহার দানে গৃহস্থ প্রকৃত সুখী হয় কিনা তাহা দেখিবার জন্য সে আর অপেক্ষা করিল না। কিছুতেই যে কাহাকেও সুখী করা যায় এ আশা আর তখন তাহার ছিল না। পরী ভাগ্য-দেবীর নিকট পৌঁছিয়া বলিল, “মানুষকে সুখী করা যে কত কঠিন, তাহা আমি এখন বেশ বুঝিয়াছি—ইহা না বুঝিয়াই আগে আমি তোমাকে দোষী করিতেছিলাম, সে জন্য আমাকে ক্ষমা কর। রাজা, ধনী, কৃষক, ও গৃহস্থ—এই চারি জনের একজনকেও যখন সুখী করিতেপারিলাম না, তখন সমস্ত পৃথিবীকে সুখী করিব কেমন করিয়া?” পরীর এই কথায় ভাগ্য-দেবী তাহার দুঃখে দুঃখিত হইয়া বলিলেন,সকলকে তুমি সুখী করিতে পারি নাই সত্য, কিন্তু কেহই যে তোমার দানে সুখী হয় নাই তাহা নহে। রাজা, ধনী, চাষা, প্রথমে তোমার দানে সুখী হইয়াছিল; কিন্তু সে সুখ প্রকৃত সুখ নহে, তাই তাহা স্থায়ী হইলনা। কিন্তু ঐ দেখ, একজনকে তুমি প্রকৃত সুখ দিয়াছ। তোমার অনুগ্রহে ঐ গৃহস্থের এত সুখ হইয়াছে যে জগতে তাহার ন্যায় সুখী ব্যক্তি অতি বিরল।