খনির রাজা।

 এক গ্রামে এক বুড়ী থাক্‌ত। তার একটি মেয়ে ছিল, তার নাম ছিল মুরলা। মুরলা দেখ্‌তে খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু সে তার মার কথা একটুও শুন্‌ত না। সে কেবল দামী দামী শাড়ী পরতে আর মিঠাই মণ্ডা খেতে বড় ভালবাসে। তার মা গরীব মানুষ, এসব কোত্থেকে পাবে? সে এত দামী জিনিষ কিনে দিতে পার্‌তই না, আর তাতে মুরলা ভারি খুঁৎ খুঁৎ কর্‌ত। তাই বুড়ীর মনে বড় দুঃখ ছিল।

 একদিন সে ব’সে ব’সে তার মেয়ের কথা ভাব্‌ছে আর, কাঁদ্‌ছে, এমন সময় যারপরনাই সুন্দর একটি মেয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “হ্যাঁ গা, তুমি কাঁদ্‌ছ কেন?” সেই মেয়ের পরনে রূপলী পােষাক, মাথায় তারার মালা। বুড়ী দেখেই বুঝ্‌তে পার্‌ল যে নিশ্চই কোন পরী হবে। সে বল্‌ল, আমার মেয়েটা বড়ই দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে। সে কারাের কথা শােনে না। কেবল টাকাকড়ি আর সাজ পােষাক ভালবাসে। তাই আমি কাঁদ্‌ছি।” পরী বল্ল, “আচ্ছা, দেখি আমি তা’কে ভাল কর্‌তে পারি কি না।” এই বলে পরী চ’লে গেল। তারপর একদিন রাত্রে মুরলা ঘুমুচ্ছিল, বুড়ী তার পাশে জেগে শুয়েছিল। ঘুমের মধ্যে মুরলা খিল্ খিল্ ক’রে হেসে উঠল। সকালে উঠে বুড়ী তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কাল রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাস্‌ছিলে কেন?

 মুরলা বল্‌ল, “মা কাল রাত্রে আমি একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। একটা লাল রংএর তামার গাড়ীতে চ’ড়ে একজন লােক যেন আমাদের বাড়ীতে এসেছে; আর সে যেন আমাকে একটা আংটি দিয়েছে। অংটীটা যে কি সুন্দর কি বলব! তার পাথরগুলাে সব তারার মত জ্বলছে। সে আংটি পরে আমাকে এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে সবাই বল্‌ছে, ‘এমন সুন্দর মেয়ে আমাদের গ্রামে নেই।’

 বুড়ী বল্‌ল, “চুপ, চুপ, অমন ক’রে বলতে নেই। তোমার মত সুন্দর মেয়ে কত আছে।” মুরলা সে কথায় কানও দিল না, সে সেই আংটির কথা ভাব্‌তে ভাব্‌তে সেখান থেকে চ’লে গেল।

 এর কিছুদিন পর এক চাষার ছেলে মুরলাকে বিয়ে করতে এল। চাষা হলেও তাদের বেশ টাকাকড়ি আছে। কিন্তু মুরলা নাক্‌ সিঁটকিয়ে বলল, “এ্যাঃ! চাষাকে কে বিয়ে করে! সে যদি লাল রংএর গাড়ীতে চড়ে আস্‌ত, আর আমাকে তারার মত চক্‌চকে আংটি দিত, তবু আমি তাকে বিয়ে কর্‌তাম না। বেচারী বুড়ী আর কি বল্‌বে! সে চুপ ক’রে গেল। সেদিন রাত্রে আবার মুরলা ঘুমের মধ্যে খুব হেসে উঠ্‌ল! সকালে উঠে বুড়ী তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কালকেও যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাস্‌ছিলে? আবার কি স্বপ্ন দেখ্‌লে?” মুরলা বল্‌ল, “সে ভারি মজার স্বপ্ন। শুন্‌লে তুমি আমাকে বক্‌বে। দেখছিলাম যে রূপর গাড়ী চ’ড়ে একজন লােক এসেছে, আর সে আমাকে একটা সােণার মুকুট দিয়েছে। সে মুকুট মাথায় পরে আমাকে এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে সবাই বল্‌ছে, ‘এমন সুন্দর মেয়ে আমাদের দেশে আর নেই।”

 বুড়ী কানে হাত দিয়ে বল্‌ল, “ছি ছি! অমন ক’রে অহঙ্কার কর্‌তে নেই, তা’হলে কেউ ভাল বল্‌বে না।” মুরলা মুখ বাঁকিয়ে বল্ল, “না বলে ত ব’য়ে গেল।” এই ব’লে সে খেলা করতে চল গেল।

 সেদিন সেই গ্রামের জমিদার মুরলাকে বিয়ে কর্‌বার জন্য বুড়ীর বাড়ীতে এলেন। বুড়ীর মনে ত আনন্দ আর ধরেই না। সে ভাব্‌ল, “আমার মেয়ে তবে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর; না হ’লে জমিদার মশাই তা’কে বিয়ে করতে আসেন?” মুরলা কিন্তু ঘাড় বাঁকিয়ে বল্‌ল, “কোথাকার কোন এক গ্রামের জমিদার, তাকে আমি বিয়ে কর্‌তে গেলাম আর কি! সে যদি রূপর গাড়ী হাঁকিয়ে আস্‌ত, আর আমাকে সােণার মুকুট দিত, তবু আমি তা’কে বিয়ে কর্‌তাম না।” বুড়ী তার কথা শুনে মাথা চাপ্‌ড়িয়ে কাঁদ্‌তে লাগ্‌ল।

 সেদিন রাত্রে মুরলা ঘুমের মধ্যে এমনি চেঁচিয়ে ‘হাে’ ‘হো’ করে হেসে উঠ্‌ল যে, ঘরে একটা বেড়াল শুয়ে ছিল, সেটা ভয় পেয়ে ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।

 সকালে উঠে বুড়ী বল্ল, “মুরলা, কাল রাত্রে বুঝি আরও জমকালো স্বপ্ন দেখেছিলে? তাই অত ‘হাে’ ‘হো’ করে হাস্‌ছিলে? মুরলা বল্‌ল, “হাঁ মা! কাল যে স্বপ্ন দেখেছি, সে স্বপ্ন যদি সত্যি হ’ত তবে কি মজাটাই হত! সব কথা শুন্‌লে তুমি আমাকে মার্‌তেই আসবে।” বুড়ী বল্‌ল, “এমন মজার স্বপ্নটা কি, শুনিই না কেন।” তখন মুরলা হাস্‌তে হাস্‌তে বল্‌ল, “কাল দেখেছি, একজন লোক যেন এক প্রকাণ্ড ঝক্‌ ঝকে সোণার গাড়ীতে চ’ড়ে আমাদের বাড়ী এসেছে, আর আমাকে একটা শাড়ী দিয়েছে সেটা আগাগোড়া সোণার। শাড়ীখানা প’রে আমাকে এমনি চমৎকার দেখাচ্ছে যে সকলে বল্‌ছে ‘এমন চমৎকার মেয়ে পৃথিবীতে নেই।” এই কথা ব’লেই মুরলা দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল, পাছে বুড়ী তা’কে বকে।

 তার পরদিন সকালে উঠে তা’রা দেখল সত্যি সত্যিই তিনখানা গাড়ী তাদের দরজার সাম্‌নে দাঁড়িয়ে আছে। একখানা লাল রংএর তামার তৈরী, তা’তে দুইটা ঘোড়া। আর একখানা সাদা ধব্‌ধবে, রূপর তৈরী, তাতে চারটা ঘোড়া। আর একখানা হল্‌দে রংএর, ঝক্‌ঝকে সোণার তৈরী, তা’তে এই বড় বড় আটটা ঘোড়া জোতা। সে সব গাড়ীর সইস কোচওয়ান সকলেরই ঝক্‌ঝকে জরির পোষাক। দেখ্‌লে বড়লোক বলে মনে হয়। বুড়ী আর মুরলা ঘরের দরজা খুল্‌তেই, সেই সোণার গাড়ী থেকে একজন লোক নেমে এল; তার পরণে সোণার পোষাক, মাথায় সোণার পাগড়ী। সে এসে বুড়ীকে বল্‌ল, “আমি খনির রাজা, আমি মুরলাকে বিয়ে কর্‌তে চাই।” এবারে আর মুরলা “না” বল্ল না। তখন খনির রাজা তার হাতে একটা আংটি পরিয়ে দিল, তা’র পাথরগুলো সব তারার মতন জ্বল্‌ছে; একটা সোণার মুকুট তা’র মাথায় পরিয়ে দিল সেটা চাঁদের মত চক্‌চক্‌ কর্‌ছে, আর একখানা শাড়ী তা’কে দিল, সেই শাড়ীর পাড়ে হীরে মাণিক ঝক্ঝক্‌ কর্‌ছে। মুরলা তাড়াতাড়ি সেই শাড়ীখানা প’রেই অমনি খনির রাজার সঙ্গে গিয়ে সােণার গাড়ীতে উঠল, তার মা’র দিকে একবার ফিরেও চাইল না।বুড়ী কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে রাজাকে বল্‌ল, “আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তাকে কি পর্‌তে দেবে, কি খেতে দেবে?”

 খনির রাজা বল্‌লেন, ‘আমার দেশের পােষাক সব সােণারূপাের, তাই সে পর্‌বে; আর ভাতও সব সােণারূপাের, তাই সে খাবে।” এই কথা বল্‌তে বল্‌তে সেই আট ঘােড়ার সােণার গাড়ী ছুটে চলে গেল, তার পিছন পিছন রূপর গাড়ী তামার গাড়ীও চলে গেল; বুড়ী একলা তার বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেল্‌তে লাগ্‌ল।

 কত পাহাড়, কত নদী, কত বন, কত দেশ পার হয়ে গাড়ী চলেছে। পথ আর ফুরায়ই না। মুরলা ভয় পেয়ে রাজাকে জিজ্ঞাসা করল, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

 খনির রাজা বল্লেন, “এই এখনি দেখ্‌তে পাবে।” সমস্ত দিন ছুটে ছুটে সন্ধ্যার সময় গাড়ী এক জায়গায় থাম্‌ল। মুরলা দেখল, সামনে প্রকাণ্ড কাল পাথরের পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে এক প্রকাণ্ড দরজা কাটা; সেই দরজার ভিতর গাড়ী গুলাে ঢুক্‌ল। চারিদিকে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। ভয়ে মুরলার গা দিয়ে ঘাম বেরচ্ছে।

 খনির রাজা বল্লেন, “ভয় কি? এখনি আলাে হবে। এই ত আমার দেশ, যেখানে সােণা, রূপা, তামা, শীশা, এই সব পাওয়া যায়।”

 খানিক পরে অনেক গুলাে ভূতের মত লােক মশাল হাতে নিয়ে গাড়ীর কাছে এল; তখন মশালের আলােতে মুরলা দেখ্‌ল কি আশ্চর্য দেশ। লাল রংএর তামার রাস্তা, দুইধারে বন, সে বনের গাছপালা সব শাদা শীশার। বনের পরে প্রকাণ্ড মাঠ, তাতে রূপার ঘাস ঝক্‌ঝক্ কর্‌ছে; সেই মাঠের মাঝখানে সােণার রাজবাড়ী। সেই বাড়ীর দরজার কাছে এসে রাজা বল্লেন, “আমি এই দেশের রাজা; এই আমার বাড়ী। তুমি এখানকার রাণী হলে।”

 মুরলা ভাবল, “আহা! কি চমৎকার! হ’লই বা অন্ধকার? এত সােণারূপা আর কোথায় আছে?”

 সমস্তদিন গাড়ীতে ঘুরে ঘুরে সকলেরি খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, তাই রাজা মুরলাকে বল্‌লেন, “চল এবার খেতে যাই।” মুরলারও খুবই ক্ষিদে পেয়েছিল, আর সে ভাবছিল যে এ দেশের খাবার জিনিষ না জানি কি চমৎকার! খাবার ঘরে গিয়ে দেখ্‌ল, সেখানে থালা ভ’রে ভ’রে কেবল লাল, নীল, হলদে, সবুজ, বেগুনী, নানা রঙ্গের দামী দামী পাথর সাজান রয়েছে। সে গুলাে দেখ্‌তে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে, কিন্তু খাবার কোথায়? রাজা খেতে ব’সেছেন, মুরলা বসেছে, চারদিকে সেই ভূতগুলো ব’সেছে। তারা সকলেই সেই সব পাথর মুঠো মুঠো তুলে মুখে দিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে, মুরলা হাঁ করে বসে দেখ্‌ছে। খানিক পরে রাজা বললেন, “রাণী তুমি কিছু খাচ্ছ না যে? তােমার ক্ষিদে পায়নি?” মুরলা বলল, “আমরা ত ভাত খাই; এ সব কেমন ক’রে খাব?” রাজা একটা ভূতকে ডেকে বল্লেন, “ওরে ভাত নিয়ে আয়।” মুরলা ভাব্‌ল, “বাঁচা গেল, এইবারে ভাত খেতে পাব।

 কিন্তু ভাত যা’ নিয়ে এল, সে খালি তামার তৈরী লাল লাল দানা, মুরলা তা’ কেমন করে খাবে? সে বল্ল, “এ ভাত ত আমি খেতে পার্‌ব না, আমরা সাদা ভাত খাই।” তা শুনে সেই ভূতটা বল্‌ল, “হঁ! সে ভী আছে।” বলেই অমনি ছুটে গিয়ে সে একথালা রূপার ভাত নিয়ে এল। সে ভাতও মুরলা খেতে পার্‌ল না দেখে একথালা সােণার ভাত আন্‌ল। তাও যখন মুরলা খেতে পার্‌ল না, তখন রাজা বল্লেন, “আমাদের দেশে এ রকম ছাড়া অন্য রকম ভাত নেই। তুমি খেতে পার খাও, না খেতে পার চুপ ক’রে থাক।” তখন মুরলা ভয়ানক কাঁদ্‌তে লাগল। সে রাত সে না খেয়েই রইল, পরদিনও কিছু খেল না! কিন্তু না খেয়ে আর কতদিন থাক্‌বে? দুই তিন দিনের মধ্যেই সে ভয়ানক রােগা আর দেখ্‌তে বিশ্রী হয়ে গেল। তখন মনের দুঃখে মুরলা বিছানায় পড়ে কাঁদ্‌তে লাগল।

 এমন সময় সেই রূপর পােষাক পরা আর তারার মালা পরা পরী এসে তার সাম্‌নে দাঁড়িয়ে বল্ল, “কি মুরলা, এত টাকা পেয়েও তুমি খুসী হও নি?”

 মুরলা কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে বল্‌ল, “ওগাে আমি টাকা চাই না। এখন আমি বুঝেছি যে শুধু টাকাতে কিছু হয় না। আমি মা’র কাছে সেই কুঁড়ে ঘরখানিতে ফিরে যেতে চাই।”

 যেই মুরলা এইকথা বলেছে, অমনি সেই খনির রাজা, সােণার
খনির রাজা মুরলাকে ভাত খেতে দিয়েছে।
বাড়ী, রূপর মাঠ সব কোথায় মিলিয়ে গেল, আর মুরলাকে নিয়ে পরী তার মার কাছে এসে উপস্থিত হ’ল।

 মুরলাকে বুড়ীর হাতে দিয়ে পরী বল্ল, “এই নাও তোমার মেয়ে। বোধ হয় এখন সে ভাল হয়ে গিয়েছে।”