গল্পের বই/বিড়াল রাণী
বিড়াল রাণী।
রাজা মশাই বুড়ো হয়েছেন, ভাল করে রাজ্যের কাজ আর দেখ্তে পারেন না। সকলে বল্ল, “রাজামশাই, আপনার ত বড় বড় তিন ছেলে রয়েছে, তাদের একজনকে কেন রাজা করে দিন্ না? আপনি বুড়ো মানুষ আর কতদিন খাট্বেন।”
রাজার সেকথা তত ভাল লাগ্ল না। তাঁর মনে ভয় আছে পাছে ছেলেরা রাজা হয়ে তাঁকে কষ্ট দেয়, আর না মানে। তাই তিনি বল্লেন, “তিন ছেলের মধ্যে কা’কে রাজা কর্ব তাই আগে ঠিক করি।”
একদিন তিনি তাঁর ছেলেদের ডেকে বল্লেন, “দেখ বাবা, আমি বুড়ো হয়েছি, ভাল ক’রে কাজ কর্তে পারি না, এখন তোমাদের একজনকে রাজা কর্তে চাই। তোমাদের তিন জনের মধ্যে যে সকলের চেয়ে কাজের লোক, তাকে রাজা কর্ব। দেখিত, আজ থেকে এক বছরের মধ্যে তোমরা কে আমাকে একটি সকলের চেয়ে সুন্দর, আর সকলের চেয়ে ছোট্ট কুকুর এনে দিতে পার।”
তিন রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে তিনদিকে বা’র হলেন। এক বছরের মধ্যে তাঁদের সকলকে কুকুর নিয়ে বাড়ী ফিরতে হবে। বড় দুইজন দুইদিকে চলে গিয়েছে, ছোট ছেলে মাণিক ও কুকুর খুঁজ্তে একপথ দিয়ে চলেছে। যত লোকের কাছে যত সুন্দর কুকুর দেখছে সব সে কিন্ছে। কিন্তু কোনটাই তার মনের মত হচ্ছেনা। এমনি করে অনেক দেশ ঘুরে ঘুরে শেষে সে এক প্রকাণ্ড বনের ভিতর এসে পড়্লেন। একেত বনের ভিতরে ভাল ক’রে পথ দেখা যায় না, তার উপর আবার তখনি ভয়ানক ঝড় বৃষ্টি এল। মানিকের কষ্টের আর সীমা নাই!
এমনি করে অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে যেতে যেতে সে হটাৎ সামনে একটা প্রকাণ্ড দরজা দেখ্তে পেল। দরজাটা আগাগােড়া সােণার, তাতে দামী দামী পাথর বসান, অন্ধকারে সে গুলাে ঝক্ ঝক্ করছে। মাণিক আস্তে আস্তে যেই সেই দরজায় যা দিয়েছে অমনি সেটা খুলে গেল। দরজা খুল্তেই যা দেখা গেল, সে ভারি মজার তামাসা। মাণিকের বড়ই পরিশ্রম আর ক্ষিদে হয়েছিল; নইলে সে তা দেখে নিশ্চয়ই খুব হাস্ত। সে দেখল কি, একদল বেড়াল দুই পায় দাঁড়িয়ে সামনের দুই পা দিয়ে তাকে নমস্কার কর্ছে। তারা আবার কথাও বল্তে পারে! আর সকলে মিলে তাকে ভিতরে যাবার জন্য ডাক্ছে।
মাণিক এ সব দেখে এতই আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছে যে ভিতরে যাবার কথা তার আর মনেই আস্ছে না। সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার কথাটি নেই।
তাই দেখে বেড়ালেরা এসে তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। মাণিক তাতে কোন ভয় পেল না;—তার সঙ্গে তলােয়ার ছিল।
সেই বাড়ীর দরজা যেমন সুন্দর ভিতরটাও তেমনি চমৎকার। বেড়ালেরা তার ভিজে কাপড় ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে একটা ঘরে বসাল। সে ঘরটি ফুলের মালা দিয়ে সাজান। তার মেজে ফিরােজা পাথরের তৈরী, দরজা জানালা ঝিনুকের। মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড ঝাড়, তার নীচে দুজনের খাবার জায়গা হয়েছ, আর সোণার বাসনে ক’রে খাবার সাজান রয়েছে।
মাণিক খেতে বসতে যাবে এমন সময় কোত্থেকে বাজনার শব্দ এল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে, “মি···উ,···মি···উ, ম্যা···ও,” করে অনেক বেড়ালের গানও শোনা গেল। এমন গান সে কখনও শোনে নি। গান ক্রমে কাছে আস্তে লাগ্ল; শেষে হটাৎ ঘরের একটা দরজা খুলে গেল। মাণিক চেয়ে দেখ্ল এতটুকু ছোট্ট একজন কে মাথা থেকে পা অবধি কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে এসে ঘরে ঢুকেছে, আর তার পিছু পিছু ঢের বিড়াল এসে মিউ মিউ কর্ছে। সে তার কালো কাপড় খুলে ফেল্লে দেখা গেল, সাদা ধব্ধবে সুন্দর একটি বেড়াল। তার চোখ দুটি নীল রংএর। আর মুখখানা ভারি কাঁদ কাঁদ। সে মাণিককে নমস্কার করে বল্ল, “আমি বেড়ালদের রাণী। তুমি এখানে থাক, তোমার কোন ভয় নেই।” মাণিক বল্ল, “বিড়াল রাণী, নমস্কার। তোমার কথা শুনে আমি খুব খুশী হলাম।”
তারপর মাণিককে নিয়ে বেড়ালদের রাণী খেতে বস্ল। কত রকমের তরকারীই তারা রেঁধেছে, আর সে সব খেতেও তেমনি চমৎকার হয়েছে। মাণিকও মনের সুখে সে সব খেতে লাগ্ল। ক্ষীর, সর, পায়েস, রাবড়ী, কিছুই সে খেতে বাকি রাখ্ল না; খায়নি শুধু ইঁদুর ভাজা, ইঁদুরের কালিয়া, আর তার চাট্নি।
খেতে খেতে মাণিক দেখ্ল যে, বিড়াল রাণীর হাতের বালার সঙ্গে ছোট্ট একটা কিসের ছবি ঝুল্ছে। সে সেটা
বেড়ালের বাড়ীতে মাণিক। দেখ্তে চাইলে, রাণী বালা খুলে তার হাতে দিল। সেটা একজন লোকের ছবি, কিন্তু কি আশ্চর্য্য, সে লোক দেখ্তে অনেকটা মাণিকের মত!
তারপর সোণার গেলাসে ক’রে সরবৎ এল। সে সরবতে না জানি কি ওষুধ মেশান ছিল; সরবৎ খেতে খেতেই মাণিক তার দেশের কথা, বাবার কথা, কুকুরের কথা, সব ভুলে গেল। তখন থেকে সে সেই বেড়ালদের সঙ্গে বেড়ালদের দেশেই থাকে। সেখানে ত তার আদর যত্ন ও খুব হয়। কোন কষ্ট নেই, খুব সুখেই আছে!
বিড়ালরাণী দেখ্তেই শুধু বেড়ালের মত, কিন্তু আর সবটাতে ঠিক মানুষের মত। মানুষের মত কথা ত বলেই, লেখাপড়াও বেশ জানে, আর গায় বাজায়ও অতি চমৎকারই। একদিন মাণিক তাকে জিজ্ঞাসা কর্ল, “তোমার সবই ত মানুষের মত দেখ্ছি, তবে চেহারাটি বেড়ালের মত কেন?” সে বল্ল, “আজ না, আর একদিন বল্ব।”
এদিকে এক বছর প্রায় হ’য়ে গেছে; কুকুর নিয়ে দেশে ফির্বার আর তিনটি দিন মোটে বাকী। মানিকের কিন্তু সে খেয়ালই নেই। তখন বিড়াল তাকে বল্ল, “তুমি যে নিশ্চিন্ত হয়ে ব’সে আছ, তোমার কি কর্তে হবে মনে নেই? তোমার বাবার জন্য কুকুর নিয়ে যাবে না?” অমনি মাণিকের সব কথা মনে পড়ে গেল। সে বল্ল, “তাইত, কি করি? আর যে মোটে তিনটি দিন আছে, এখন কুকুরই বা পাই কোথায়, আর তিনদিনের মধ্যে দেশে ফিরেই বা যাই কি ক’রে?” বিড়ালরাণী বল্ল, “সে জন্য তোমার কিছু ভাবনা নেই। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।” ব’লেই তখনি সে মাণিকের জন্য ঘোড়া আন্তে হুকুম দিল; আর ঘোড়াও তখনি খট্ খট্ ক’রে এসে হাজির হ’ল। মাণিক ত একেবারে অবাক! লাল রংএর কাঠের ঘোড়া, তার সনের চুল সনের লেজ! মাণিক বল্ল, “তোমরা কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ? কাঠের ঘোড়ায় চড়ে কেমন করে যাব? সে কি আবার চল্তে পারে?” রাণী বল্ল, ‘চ’ড়েই দেখ না কেন; ও বাতাসের আগে যাবে।
যেমন করেই হোক, ঘোড়া ত হ’ল; এখন কুকুর চাই। বিড়ালনী একটা আমের আঠি এনে মাণিককে দিয়ে বল্ল, “এর ভিতর কুকুর আছে। এখন এটা খুলো না তা’হলে কুকুরটার ঠাণ্ডা লাগ্তে পারে। একেবারে তোমার বাবার কাছে নিয়ে খুল্বে।” কাণের কাছে আঠিটা নিয়ে মাণিক শুন্ল সত্যি সত্যিই তার ভিতর ‘ভোউ’ ‘ভোউ’ ক’রে কুকুর ডাক্ছে। সেই আঠি কোঁচড়ে বেঁধে নিয়ে মাণিক যেই সেই কাঠের ঘোড়ায় চড়েছে, অমনি সেই ঘোড়া ঠক্ ঠক্ করে কাঠের পা ফেলে কি ছুটই দিল! তিন দিনের মধ্যে সে একেবারে রাজার বাড়ীতে এসে উপস্থিত!
রাজার আর দুই ছেলে এর আগেই ফিরে এসেছিল। তারা ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনে এসে দেখল উঠানে একটা লাল রংএর কাঠের ঘোড়া নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস্ কর্ছে, আর কাঠের কাণ খাড়া করে সনের লেজ নেড়ে নেড়ে মাছি তাড়াচ্ছে। দেখে ত তারা হেসেই কুটপাট! তারা বল্ল, “কি মাণিক, কুকুর বুঝি পাওনি, তাই এই কাঠের ঘোড়াটা নিয়ে এসেছ?” মাণিক কিছু বল্ল না, চুপ করে রইল।
পরদিন রাজামশাই সভায় বসেছেন, চারদিকে সব লোকজনেরা ব’সেছে। কুকুর দেখাবার জন্য, রাজা তাঁর ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। বড় দুই ছেলে যে দুই কুকুর এনেছে, সে দুটোই খুব ছোট আর খুব সুন্দর। তা দেখে সকলেই বল্ল যে “এমন কুকুর আর পৃথিবীতে নেই।” কিন্তু তার কোনটা যে বেশী ভাল তা কেউ ঠিক করতে পার্ল না; তাই তারা বল্ল, “রাজ্য দুই ভাগ ক’রে, দুজনকে সমান ভাগ দিন।”
এমন সময় মাণিক সেই আমের আঠিটি এনে রাজার হাতে দিল। রাজামশাই যেই সেটি খুলেছেন, অমনি আরশুলার মতন ছোট্ট একটি কুকুর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে লেজ নাড়্তে লাগল। তখন আর কারোর মুখে কথাটি নেই, সকলে হাঁ করে খালি সেই কুকুরের দিকে চেয়ে আছে।
রাজামশাই কুকুর দেখে খুবই খুসী হলেন, তা’তে আর ভুল কি, কিন্তু তাঁর রাজ্য ছেড়ে দেবার ইচ্ছা একেবারেই নেই। তাই তিনি ছেলেদের বল্লেন যে, “বাপু সকল, তোমরা আমার জন্য এত পরিশ্রম করে কুকুর এনেছ দেখে আমি অত্যন্ত খুসী হ’লাম। এখন তোমাদের আর একটি কাজ দিচ্ছি, এটি করলেই রাজ্য দিব। এক বছরের মধ্যে আমাকে এমন একখানা পাতলা কাপড় এনে দিতে হবে, যে সে কাপড়খানা একটা ছুঁচের ফুটোর ভিতর দিয়ে গলে যেতে পারে।”
তখন আবার তারা তিন জনে বার হ’ল। বড় দুভাই ঘোড়ায় চড়ে দু’দিকে চলে গেল। আর মাণিক তার কাঠের ঘোড় চড়ে একেবারে বেড়ালদের দেশে উপস্থিত হ’ল।
বিড়ালরাণী তাকে দেখে খুব খুসী হয়ে বল্ল, “এর মধ্যে ফিরে এসেছ? কিন্তু রাজা হ’তে পারনি নাকি? তোমার মুকুট কোথায়?” সে বল্ল, “না, হতে পারিনি। বাবা আরেকটা কাজ দিয়েছেন। এক বছরের মধ্যে এমন একখানা পাতলা কাপড় নিয়ে যেতে হবে, যে তাকে একটা ছুঁচের ফুটোর ভিতর দিয়ে গলান যেতে পারে।” রাণী বল্ল, “তার জন্য কোন ভাবনা নেই। তুমি মনের সুখে এখানে বসে থাক। আমি সব ঠিক করে দেব।” কাজেই মাণিকের আর কোন ভাবনা নেই, সে সেখানে থেকে মনের সুখে খায় দায়, আর বেড়িয়ে বেড়ায়। প্রায় এক বছর এইভাবে গেল। তখন একদিন বিড়ালরাণী তাঁকে বল্ল যে, “এখন কাপড় নিয়ে বাড়ী ফিরবার সময় হয়েছে।”
এবারে আর মাণিককে কাঠের ঘোড়ায় চ’ড়ে যেতে হ’ল না। এবার তার জন্য রূপর গাড়ী এল, তাতে বারটি সাদা ধব্ধবে ঘোড়া জোতা। মাণিক ঝকঝকে সোণালী পোষাক পরে সেই গাড়ীতে উঠ্ল। তখন বিড়ালরাণী তার হাতে একটা বাদাম দিয়ে বল্ল, “এই নাও। কিন্তু রাস্তায় এটা খুলো না, তা হ’লে কাপড়খানা কাদা লেগে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তারপর সেই বার ঘোড়ার গাড়ী ছুটিয়ে মাণিক তার দেশে ফিরে এল। তখন দেশের লোক তার সাজ পোষাক, জাঁকজমক দেখে আর চোখ ফিরাতে পারে না।
পরদিন রাজামশাই আবার তাঁর তিন ছেলেকে ডেকে বল্লেন, “এসত দেখি, তোমরা কে কি কাপড় এনেছ।” ছেলেরা একে একে তাদের কাপড় এনে দেখাতে লাগ্ল। বড় ছেলে যে কাপড় এনেছে সেখানা একটা আংটির ভিতর দিয়ে ঢুকে গেল, কিন্তু ছুঁচের ভিতর ঢুক্ল না। মেঝ ছেলের কাপড় খানা একটা মোটা চট সেলাই কর্বার ছুঁচের ভিতর দিয়ে গেল। সকলে ভাব্ল মেঝ ছেলেই রাজা হবে। কিন্তু রাজামশাই কর্লেন কি, তাঁর বাড়ীতে সকলের চেয়ে যে সরু ছুঁচ, সেই ছুঁচ খুঁজে আন্তে বল্লেন। সে ছুঁচের ভিতর দিয়ে আর সে-কাপড় গল্ল না। তখন ছোট ছেলে এসে তার বাদামটি তাঁর হাতে দিল। তিনি সেটা খুল্লেন। কিন্তু কই, তার ভিতর ত কাপড় নেই, শুধু একটা কুলের বিচি। রাজা কুলের বিচি খুল্লেন, তার মধ্যে থেকে একটা মটর বার হ’ল; মটরের ভিতর ধান, ধানের ভিতর চাল! মাণিক মনে মনে বল্তে লাগল, “বিড়ালরাণী, তুমি আমার বন্ধু হয়ে আমাকে ফাঁকি দিলে নাকি?” অমনি তার মনে হ’ল যেন তার হাতে আস্তে আস্তে বেড়ালে আঁচড়াচ্ছে। সে বুঝতে পার্ল বিড়ালরাণী বল্ছে, “কোন ভয় নেই।” তারপর রাজা সে ধানটি ভাঙ্গলেন। তখন তার ভিতর থেকে এমন পাতলা এক খানা কাপড় বার হল যে তাকে ভাল করে চোখে দেখাই যায় না। আর তাতে কি চমৎকার কাজ! সকলের চেয়ে সরু ছুঁচের ভিতর দিয়েও সেটা ফস্ ক’র ঢুকে গেল। সভার লোকে বল্ল, “দুবার দুবার ছোট ছেলে জিতেছে। তাকেই রাজা করা হোক।” তা শুনে বড় দু’ভাইয়ের ভারি হিংসা হল।
তখন রাজামশাই মুখ ভার ক’রে মাথা নেড়ে বল্লেন, “না এতেও হবে না। আরও এক কাজ বাকী আছে। এক বছর পরে তোমাদের তিন জনের মধ্যে যে সকলের চেয়ে সুন্দর রাজার মেয়ে বৌ আন্তে পার্বে তাকে আমি সেই দিনই রাজা করে দেব।”
কাজেই আবার তিন ভাইকে বেরুতে হ’ল। বড় দু’ভাই দু’দিকে যাচ্ছে আর ভাব্ছে, “তাইত, কোথায় যাই?” মাণিক ত জানেই কোথায় যেতে হবে। সে গাড়ীতে উঠেই একেবারে বেড়ালদের দেশে চ’লে এসেছে। তাকে আবার ফিরে আসতে দেখে বেড়ালেরা ভারি খুসী হ’ল, আর গান গেয়ে, নেচে নেচে, বাজনা বাজিয়ে, তাকে আদর করে ঘরে নিয়ে গেল।
বিড়ালরাণী তাকে দেখে বল্ল, “কই, এবারেও ত রাজা হ’তে পারনি?” মাণিক বল্ল, “না, বাবা তবুও আমাকে রাজা কর্লেন না। তিনি ব’লেছেন, এবারে যে সব চেয়ে সুন্দর রাজার মেয়ে বিয়ে ক’রে নিয়ে যেতে পারবে, তাকে নিশ্চয় রাজা কর্বেন। আমার রাজা হ’তে তত ইচ্ছাও নেই।” বিড়ালনী বলল, “না, সে কি হয়? চেষ্টা করে দেখা ভাল। তবে, তার জন্য তুমি ভেবো না। আমি সব ক’রে দেব। এখন চল তামাসা দেখ্তে যাই।”
বেড়ালদের দেশে মাণিক বড়ই সুখে আছে। এমন বাড়ী, এমন চমৎকার খাবার, এমন গান বাজনা ত তার দেশে নেই। সে মাঝে মাঝে বিড়ালনীকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কে? এত সব জিনিষ কোত্থেকে পেলে?” বিড়ালনী বলে, “পরে বল্ব, এখন না।”
এম্নি করে বছর যখন শেষ হয়ে এসেছে, শুধু একদিন বাকি আছে, তখন বিড়ালরাণী মাণিককে দেশে ফিরে যাবার কথা মনে করিয়ে দিল। কিন্তু রাজার মেয়ে ত চাই। বিড়ালনী বল্ল, “আমি তোমাকে খুবই সুন্দর একটি রাজার মেয়ে এনে দেব, কিন্তু তোমাকে একটা কাজ কর্তে হ’বে। আমার মাথাটা আর লেজটা কেটে আগুনে ফেলে দিতে হবে।”
মাণিক ত তা’তে কিছুতেই রাজি হল না। সে বল্ল, “আমি কি এমনি দুষ্টু লোক? তুমি আমার এত ভাল করেছ, আর আমি তোমাকে মেরে ফেল্ব? সে হতেই পারে না। আমি রাজার মেয়েও চাই না, রাজা হ’তেও চাই না।”
বিড়ালনীও কিছুতে ছাড়্বেনা; সে বল্ল, “এ কাজ তোমাকে কর্তেই হ’বে। এতে তোমার ভাল হবে, আমারও ভাল হবে।” তখন মাণিক আর রাজি না হয়ে কি করে! সে তলোয়ার দিয়ে বিড়ালনীর মাথা আর লেজ কেটে আগুনে ফেলে দিল। অমনি দপ্ ক’রে ঘর আলো হ’য়ে গেল, চারদিকে বাজনা বেজে উঠ্ল। আর সেই আলোর মাঝখান থেকে একটী দেবতার মতন সুন্দর মেয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে মাণিককে বল্ল, “এইবারে আমি, আর আমার লোকজনেরা মানুষ হ’লাম।” বল্তে বল্তে চারদিক থেকে মানুষ এসে সেই ঘরে ঢুক্তে লাগ্ল। এত দিন তারা বিড়াল হয়ে ছিল, আর সেই সুন্দর মেয়েটি ছিল সেই বিড়ালদের রাণী, সেই বিড়ালনী। আজ তারা আবার মানুষ হয়েছে, আর অমনি তাদের রাণীকে আদর কর্তে ছুটে এসেছে। যে যার বিড়ালের চামড়াখানি আবার হাতে ক’রে মাণিককে দেখাতে এনেছে। তখন সকলে মিলে, তাদের রাণী, সেই মেয়েটিকে নিয়ে খুব আনন্দ কর্ল।
তার পর সেই মেয়েটি মাণিককে বল্ল, “এখন আমার কথা শােন। এতদিন বলিনি, এইবার বলি। আমি এক রাজার মেয়ে। আমি যখন খুব ছােট্ট ছিলাম, তখন একদিন আমার মা শুন্তে পেলেন যে, আমাদের বাড়ীর কাছে এক বনের ভিতরে একটা খুব আশ্চর্য্য বাড়ী আছে। শুনে মা অনেক লােক নিয়ে সেই বাড়ী দেখ্তে গেলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন না। বাড়ীটার চারদিকে খুব উঁচু দেয়াল, আর সব দরজা বন্ধ। তাঁরা গিয়ে সেই দরজায় কত ধাক্কা দিলেন, কিন্তু কেউ দরজা খুলে দিল না। তখন মা দরজার ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখলেন যে সেই বাড়ীর ভিতরে একটা প্রকাণ্ড বাগান, আর তা’তে নানারকম আশ্চর্য্য ফল হ’য়ে রয়েছে, সে রকম ফল আমাদের দেশে কোথাও নেই। এ সব দেখে তাঁর ভারি লােভ হ’ল। তাই তিনি ভাব্লেন দেওয়াল টপ্কিয়ে ভিতরে যাবেন। তাঁর কথায় সকলে মই নিয়ে এল, কিন্তু তাঁরা যতই বড় বড় মই লাগান, দেয়াল ততই আরও উঁচু হয়ে হ’য়ে যায়। এমনি করে সন্ধ্যা হ’য়ে গেল। তখন তাঁরা বল্লেন, “আজ থাক, কাল দেখ্ব।” এই ব’লে তাঁরা সে রাত্রে সেই বনেই রইলেন।
রাত দুপুর হয়েছে। সকলে ঘুমিয়েছে। মাও ঘুমিয়েছেন। এমন সময় হটাৎ তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চেয়ে দেখেন এক বুড়ী ব’সে ব’সে তাঁর কাণে চিম্টি কাট্ছে। মার ঘুম ভাঙ্গতেই বুড়ী বল্ল, ‘বটে! আমার বাগানে ঢুকবার চেষ্টা হচ্ছে! সে অমনি হবে না। যদি তোমার মেয়েটিকে আমাকে দাও, তবে ঢুক্তে পাচ্ছ, না হ’লে নয়।” মা কত খাবার, কত টাকা, কত জিনিষ দিতে চাইলেন, বুড়ী কিছুই নিল না। মা’রও বড্ড লোভ হয়েছিল, সে লোভ তিনি সাম্লাতে পার্লেন না। কাজেই শেষে বল্লেন, “আচ্ছা, আমার মেয়েকেই দিব।”
বুড়ী তখন তাঁকে তা’র বাগানে নিয়ে গিয়ে খুব পেট ভ’রে ফল খাওয়াল, আর বাড়ী ফির্বার সময় গাড়ী বোঝাই ক’রে তাঁর সঙ্গে ফল দিল। বাড়ীতে আমাকে দেখে মা’র মনে ভারি দুঃখ হল। তিনি খুব কাঁদ্তে লাগ্লেন। কিন্তু এখন আর কাঁদ্লে কি হবে?।
কিছুদিন পরে পাঁচটা বেঁটে বেঁটে ভূতের মতন লোক আমাকে বুড়ীর বাড়ীতে নিয়ে যেতে এল। তখন বাড়ীর সকলে চীৎকার ক’রে কাঁদ্তে লাগ্ল আর সেই লোক গুলোকে মার্তে গেল। কিন্তু তাদের মারে কা’র সাধ্যি! তলোয়ার দিয়ে কেটে দু’খানা কর্লেও তা’রা আবার জোড়া লেগে বেঁচে ওঠে। তা’রা আমাকে জোর ক’রে নিয়ে বুড়ীর বাড়ীতে পালিয়ে গেল। বুড়ীরা তিন বােন ছিল। তা’রা আমাকে বল্ল, “দেখ, যতদিন আমাদের কথা শুন্বে আর পালাতে চাইবে না, ততদিন তােমাকে খুব যত্ন করব কিন্তু পালাতে গেলেই ভয়ানক সাজা পাবে!”
আগে তারা আমাকে যত্ন কর্ত; আমি কোন জিনিষ চাইলেই আমাকে এনে দিত। তারপর একদিন একটা বাক্স ঘাঁট্তে ঘাঁট্তে আমি আমার হাতের এই বালাটা পেলাম, যাতে এই ছবিটি ঝুল্ছে। বালা নিয়ে আমি বুড়ীকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর্লাম, “এটা কিসের ছবি?” বুড়ী আমার কথায় রেগে বল্ল, “ওটা একদেশের বাঁদরের ছবি।” আমি বল্লাম, “বাঃ, কি সুন্দর! এরকম বাঁদর কোথায় থাকে? আমি দেখ্ব।’ বুড়ী বল্ল “খবরদার! তা’ হ’লে ভারি মুস্কিল হবে কিন্তু।”
তার পর থেকে আমার আর কিছু ভাল লাগ্ত না। কেবল ভাবতাম কি করে পালিয়ে যা’ব; কি ক’রে সেই বাঁদরদের দেশে যাব। একদিন সত্যি সত্যিই পালাতে গেলাম। দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছি, প্রায় বাড়ীর দরজার কাছে এসে প’ড়েছি, এমন সময় দেখ্লাম, সর্ব্বনাশ! সানেই বুড়ীরা তিন বােন! তারা আমাকে দেখে চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, “বটে। তবে রাে’স দেখাচ্ছি!” এই বলে তারা আমাকে একটা শাদা বেড়াল বানিয়ে দিল। আর আমার দেশ থেকে অনেক লােক ধ’রে এনে তাদেরও বেড়াল বানিয়ে আমার সঙ্গে রেখে দিল। দিয়ে আমাকে বল্ল যে, “তুমি এই সব লােক নিয়ে এই বাড়ীতে থাক্বে। আর ঐ যে বাঁদরের ছবি দেখেছ, যদি কখন ঠিক সেই রকম দেখ্তে একটা বাঁদর এসে। তোমাকে বিয়ে করে তবেই আবার তোমরা মানুষ হবে।”
সেই বালার সঙ্গে ঝোলান সেই ছবিটি সত্যি সত্যিই ঠিক মাণিকের মতন দেখ্তে।
তারপর রাজার মেয়ে বল্ল, “চল, এইবার আমরা তোমার দেশে যাই।”
তখন বারো ঘোড়ায় টানা সেই রূপর গাড়ী, আর শাদা রেশনের পর্দ্দায় ঘেরা কাঁচের পাল্কী সেজে এল। সেই কাঁচের পাল্কীতে ক’রে রাজার মেয়েকে নিয়ে মাণিক সেই রূপার গাড়ী চ’ড়ে দেশে ফিরে এল।
এর আগেই তার আর দু’ভাই দুইটি সুন্দর সুন্দর রাজার মেয়ে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিল। কিন্তু তা’রা বিড়াল রাণীর মত সুন্দর নয়। বড় ভাইরা এসে মাণিককে জিজ্ঞাসা কর্ল, “কি মাণিক রাজার মেয়ে এনেছ?” মাণিক বল্ল, “একটি শাদা বিড়ালনীকে আমার সব চেয়ে সুন্দর ব’লে মনে হ’ল, তাই তা’কেই নিয়ে এসেছি।” তারা ‘হো’ ‘হো’ ক’রে হাততালি দিয়ে হাস্তে লাগ্ল।
তারপর রাজা তাদের ডেকে পাঠালেন; বড় দুই ভাই দুই বৌ নিয়ে তাঁর কাছে এল; তাদের দেখে রাজা মশাই বল্লেন, “তাইত, এরা দুজনেই দেখ্ছি খুব সুন্দর; কিন্তু কে বেশী সুন্দর তা’ত বুঝ্তে পারছিনা। এখন কা’কে রাজা করি!” মাণিককে তিনি বললেন, “কি মাণিক? এবারে বুঝি আর তুমি পার্লে না।”
মাণিক বল্ল, “বাবা, আমি একটি শাদা ধব্ধবে বেড়াল পেয়েছি। ঐ পাল্কীর ভিতরে আছে। একবার এসে দেখুন! খুব খুসী হবেন।”
রাজা হাস্তে হাস্তে গিয়ে সেই কাঁচের পাল্কীর দরজা খুল্লেন। তারপর তা’র ভিতর থেকে সেই দেবতার মত সুন্দর রাজার মেয়েটি বেরিয়ে এল। সভাশুদ্ধ লোক তা’কে দেখে আর চোখের পলক ফেল্তে পারে না। তা’রা হাঁ করে চেয়ে আছে, আর খালি বল্ছে, “আহা! আহা!”
রাজামশাই তাকে দেখে এত খুসী হ’লেন যে তিনি হাততালি দিয়ে নাচ্তেই লাগলেন।
তখন সে রাজার মেয়ে তাঁকে বল্ল, “আমরা আপনার রাজ্য চাই না। আমার ছয়টা রাজ্য আছে। তার মধ্যে দুইটা আমি আপনার বড় দুই ছেলেকে দিতে চাই। বাকি চারটাতেই আমাদের ঢের হবে।”
তারপর রাজার তিন ছেলের সঙ্গে সেই তিনটি রাজার মেয়ের বিয়ে হল।