গল্পের বই/দরজী আর তার ছাগল

দরজী আর তার ছাগল।

 এক দরজীর তিন ছেলে। তার একটা ছাগল ও আছে, আর সেই ছাগলটাকে সে তার ছেলেদের চেয়েও বেশী ভালবাসে।

 একদিন সে তার বড় ছেলেকে ডেকে বল্‌ল, “যাও ত, ছাগলটাকে ঘাস খাইয়ে নিয়ে এস। দেখ, যেন খুব পেট ভ’রে খেতে পায়।

 ছেলেটি ছাগলটাকে নিয়ে মাঠে গেল, আর যেখানে খুব ভাল ঘাস আছে এমন জায়গায় তা’কে ছেড়ে দিল। ছাগল সমস্তদিন খেলা ক’রে বেড়াচ্ছে আর ঘাস খাচ্ছে। সন্ধ্যার সময় দরজীর ছেলে এসে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কি ছাগল, পেট ভরেছে? বাড়ী যাবে?” ছাগলটা বল্‌ল, “উঃ! বড্ড পেট ভরেছে! ব্যা—ব্যা!”

 তখন দরজীর ছেলে বাড়ী ফিরে এসে ছাগলটাকে গােয়ালে বেঁধে রেখে দিল।

 দরজী তাকে জিজ্ঞাসা কর ল, “ছাগলকে পেট ভ’রে ঘাস খাইয়েছ ত?”

 সে বল্‌ল, “হাঁ, খুব পেট ভরে খাইয়েছি।”

 এরপর দরজী গােয়ালে গিয়ে ছাগলকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “ছাগল তোমার পেট ভরেছে?”

 তখন ছাগলটা বল্‌ল, “কেত্থেকে পেট ভর্‌বে? কিছুই খেতে পাইনি।”

 দরজী একথা শুনে ভয়ানক রেগে তা’র ছেলেকে মেরে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিল।

 পরদিন সে তার মেঝছেলেকে ডেকে বল্‌ল, “আজ তুমি গিয়ে ছাগলটাকে ঘাস খাইয়ে আন। দেখ, যেন সে পেট ভ’রে খেতে পায়।”

 মেঝছেলে ছাগল নিয়ে নদীর ধারে গেল। নদীর ধারে লম্বা ঘাস ছিল, ছাগলটা সমস্তদিন মজা ক’রে তাই খেল। সন্ধ্যার সময় দরজীর ছেলে যখন এসে তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “ছাগল বাড়ী যাবে? খুব ভাল করে পেট ভরেছে ত?” তখন সেটা বল্‌ল, “বাপ্‌রে ভয়ানক পেট ভরে গিয়েছে, ব্যা—ব্যা!” তা শুনে সে তা’কে বাড়ী নিয়ে গােয়ালে বেঁধে রাখ্‌ল।

 সে দিনও দরজী জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “ছাগলটা ঘাস খেয়েছে? তাকে পেট ভ’রে খাইয়েছ ত?” সে বল্‌ল, “হাঁ বাবা খুব ভাল ক’রে খাইয়েছি। কিন্তু, দরজীর সে কথায় বিশ্বাস হ’ল না। সে আস্তাবলে গিয়ে আবার ছাগলকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “ছাগল, আজ তােমার পেট ভ’রেছে?”

 তখন সে হতভাগা ছাগল বল্‌ল, “না, কেমন করে ভর্‌বে? শুধু শুক্‌নো মাঠ সেখানে ত ঘাস নেই।”

 তাতে দরজী খুব রেগে তখনি তার মেঝ ছেলেকেও মেরে দূর ক’রে দিল।

 পরদিন দরজী তার ছোট ছেলেকে ছাগলটি দিয়ে পাঠাল, আর বেশ করে বলে দিল যে ছাগল যেন খুব পেট ভরে খেতে পায়। সে নিয়ে খুঁজে খুঁজে যেখানে সব চেয়ে চমৎকার ঘাস, সেইখানে ছাগলটাকে ছেড়ে দিয়ে বল্‌ল, “খুব পেট ভ’রে খাও।” সত্যি সত্যিই সে ঘাস ভারি চমংকার ছিল, আর ছাগলটাও যত পেটে ধরে খেল।

 সন্ধ্যার সময় দরজীর ছেলে তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “পেট ভরেছে?” তাতে সে বল্‌ল, “উঃ, বড় পেট ভরেছে, নড়্‌তে পার্‌ছি না! ব্যা—ব্যা!” তখন দরজীর ছেলে তাকে বাড়ী নিয়ে গোয়ালে বেঁধে রাখ্‌ল।

 ছেলেকে ফিরে আসতে দেখে দরজী জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কেমন, ফাঁকি দাওনি ত? ছাগলকে ভাল ক’রে খাইয়েছ?” সে বল্‌ল “হাঁ বাবা খুব পেট ভরে খাইয়েছি। ছাগল বলেছে যে সে নড়তেই পার্‌ছে না।”

 কিন্তু দরজী গোয়ালে গিয়ে ছাগলকে জিজ্ঞাসা কর্‌লে পর ছাগল বল্‌ল, “না কিছুই পেট ভরেনি। একটা ঘাস ও খেতে পাইনি।”

 সে কথা শুনে দরজীর যে রাগ হ’ল! সে তখনি ছুটে গিয়ে তার ছোট ছেলেকেও মার্‌তে মার্‌তে বাড়ীথেকে বার করে দিল।

 ছেলেরা ত গেল, এখন ছাগলকে কে খাওয়াবে? তাই পরদিন দরজী ভাব্‌ ল, আজ সে নিজেই ছাগল নিয়ে যাবে। সে গোয়ালে গিয়ে ছাগলের গায় হাত বুলাচ্ছে আর বল্‌ছে, ছাগল আজ তুমি খুব ভাল করে খেতে পাবে। আজ আমি নিজে নিয়ে তোমাকে খাওয়াব।” তারপর ছাগলটাকে নিয়ে মাঠে ছেড়ে দিল, আর সমস্ত দিন ধ’রে সেটা ঘাস খেল! সন্ধ্যর সময় দরজী তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “ছাগল আজ ত তোমার পেট ভরেছে? আজত তোমাকে কেউ ফাকি দেয় নি?”

 তাতে সেটা বল্‌ল, “খুব পেট ভরেছে; পেটে আর জায়গা নাই! ব্যা—ব্যা! “একথা শুনে দরজী যেই সেটাকে নিয়ে বাড়ী চলেছে’ অমনি সেটা বল্‌ছে কি, “আমার একটুও পেট ভরেনি। একটুও ভরেনি, ব্যা—ব্যা!”

 তখন আর দরজীর কিছু বুঝ্‌তে বাকী রইল না; আর তার রাগটা যে হল! সে দুই চোখ লাল করে দাঁত কড়মড়িয়ে বল্ল, “বটে তোর এই কাজ! এমনি ক’রে রোজ রোজ তুই ফাঁকি দিয়েছিস! দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি!” বলে সে সেই দুষ্ট ছাগলটার মাথা চেঁচে একেবারে নেড়া করে সেটাকে বাড়ী থেকে দূর ক’রে দিল। এখন দরজী একলা। তার ছেলেরাও নেই। ছেলেদের মিছিমিছি তাড়িয়ে দিয়ে তার মনে ভারি দুঃখ হল। কিন্তু এখন আর দুঃখ কর্‌লে কি হবে? ছেলেরা কোথায় চলে গিয়েছে, কে তাদের খুঁজে আন্‌বে! বুড়ো ভাবে, “না জানি তারা কত কষ্ট পাচ্ছে।”

 এদিকে ছেলেদের কিন্তু তেমন কিছু কষ্ট হয়নি। বড় ছেলেটি এক তাঁতির কাছে গিয়ে রয়েছে; সেখানে সে কাপড় বুনতে শিখ্‌ছে। সে খুব মন দিয়ে কাজ শেখে তাই তাঁতি তাকে খুব ভালবাসে। এক বছরে সে খুব কাপড় বুনতে শিখ্‌ল। তখন একদিন তাঁতি তাকে বল্‌ল, “তোমার ত সব কাজ শেখা হয়ে গিয়েছে, তুমি আর এখানে থেকে কি করবে? এখন তুমি নিজেই করে খেতে পার্‌বে।” ব’লে তাঁতি তাকে একখানা চাদর দিল। সে বল্‌ল, “আমি চাদর নিয়ে কি করব?”

 তাতি বল্‌ল, “এখানা তুমি নাও, এতে তোমার অনেক উপকার হবে। এই চাদর বিছিয়ে যখনি বল্‌বে ‘চাদর আন ত’ অমনি দেখ্‌বে চাদরের উপর সব ভাল ভাল খাবার জিনিষ এসে হাজির হয়েছে। তা শুনে দরজীর ছেলে খুব খুসী হয়ে চাদর নিয়ে তাঁতির বাড়ী থেকে চলে এল। এখন আর তার কোনও খাবার ভাবনা নাই। সে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়; ক্ষিদে পেলেই চাদর বিছিয়ে বলে “চাদর আনত,” আর অমনি লুচি মণ্ডায় চাদর ভরে যায়। তারপর একদিন তার বাবার কথা মনে পড়্‌ল। সে ভাব্‌ল, “বাবাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে কর্‌ছে; এত দিন তাঁর রাগ চলে গিয়েছে।” এই ভেবে সে বাড়ীর পথে রওনা হল। বাড়ী যেতে পথে এক জায়গায় এক সরাইখানায় রাত্রে থাক্‌তে হল। সে দিন সে সরাইএ এত লোক হয়েছে যে খাবারে কম পড়ে গিয়েছে।

 সরাইওয়ালা ত মহা মুস্কিলে পড়েছে, এত লোককে কি দিয়ে খাওয়ায়। দরজীর ছেলে তখন বল্‌ল, “তোমাদের কিছু ভাবনা নাই। আমি তোমাদের সকলকে খাওয়াব।” তার কথা শুনে সকলে ভাব্‌ল বুঝি সে ঠাট্টা কর্‌ছে। কিন্তু তাদের সামনে যখন সে চাদর বিছিয়ে বল্‌ল, ‘চাদর আনত!’ আর চাদর খাবারে ভরে গেল, তখন তারা একেবারে হাঁ করে রইল। সে খাবার খেয়ে তাদের আর খুসীর সীমাই নাই। তেমন খাবার আর তারা কেউ কখনাে খায়নি। তারপর সকলে পেট ভরে খেয়ে ঘুমিয়েছে, দরজীর ছেলেও ঘুমিয়েছে; এমন সময় সেই যে সরাই ওয়ালা সে ঘুমােয়নি—সে অন্ধকারের ভিতর চুপি চুপি উঠে কি যেন কর্‌ছে। সেই চাদর খানা দেখে অবধিই সে বেটা খালি ভাবছিল ওখানা চুরি করতে পার্‌লে ওর ভারি সুবিধা হবে। ওর ঠিক ঐ রকমের দেখ্‌তে একখানা চাদর আছে। অন্ধকারের ভিতরে সেইখানা হাতড়ে বার করে নিয়ে বেটা দরজীর ছেলের কাছে এল। সে তার চাদর খানা গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে, সরাই ওয়ালা হতভাগা সেখানা আস্তে আস্তে খুলে নিয়ে নিজের চাদরটা তার গায়ে ঢাকা দিয়ে দিল।

 দরজীর ছেলেত এর কিছুই জানে না। সকালে উঠে সেই সরাইওয়ালার চাদরটাকে সে মনে কর্‌ল তার নিজেরি চাদর। সেইটাকে বেশ করে পুঁটুলীতে বেঁধে নিয়ে সে বাড়ী চলে এল।

 তাকে ফিরে পেয়ে বুড় দরজী খুব খুশী হল, আর জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “এতদিন কোথায় ছিলে? কি কর্‌ছিলে?” সে বল্‌ল, “আমি তাঁতির কাজ শিখ্‌ছিলাম।” দরজী বল্‌ল, “বেশ করেছ। বাবা, বেশ করেছ। আমি এখন বুড়ো হয়েছি, চোখে দেখ্‌তে পাইনা, ভাল করে সেলাইও কর্‌তে পারি না। তুমি যদি নিজে করে খেতে পার তবে আর কষ্ট থাকে না। আচ্ছা দেখি তুমি কি রকম কাপড় বুন্‌তে শিখেছ?”

 ছেলেটি পুঁটুলীর ভিতর থেকে তার হাতের বোনা কাপড় বার করে তার বাপকে দেখাল। তারপর সেই চাদরটা দেখিয়ে বল্‌ল, “বাবা এ চাদরটা দেখতে মোটা, কিন্তু এর ভারি গুণ। চাদর খানা বিছিয়ে যদি বলি ‘চাদর আনত!’ অমনি দেখ্‌বে কত রকম খাবার এসে হাজির হবে। তুমি আজ রাত্রে তোমার সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ কর।”

 দরজী ত সে কথা শুনে ভারি খুসী হয়ে তখনি গিয়ে তার বন্ধুদের বল্ল “তোমরা সবাই আজ রাত্রে আমাদের বাড়ী খাবে।” তারাও সকলে মিলে সন্ধ্যা হতে না হতেই দরজীর বাড়ী এসে হাজির হল।

 খাবার সময় হয়েছে পাত পীড়ি সব ঠিক। দরজীর ছেলেও তার চাদর এনে মাটিতে বিছিয়েছে। সকলে চেয়ে দেখ্‌ছে, এর পর কি তামাসা হয়। কিন্তু সেত আর সে চাদর নয়, তাতে আর কি করে তামাসা হবে। দরজীর ছেলে কত রকম করে বল্‌ছে “চাদর আনত!” “চাদর আনত।” “চাদর আনত!” সে কথায় এক মুঠো মুড়িও আস্‌ছে না। চাদর যেমন খালি তেমনি খালি পড়ে আছে! কাজেই সে রাত্রে দরজীর বন্ধুদের না খেয়েই বাড়ী ফিরে যেতে হ’ল।

 দরজীর ছেলের ভারি দুঃখ হল তাতে আর ভুল কি। সে বেশ বুঝ্‌তে পারল যে সরাইওয়ালারই এই কাজ। সেই বেটা চাদর বদলিয়ে দিয়েছে।

 এদিকে মেঝ ছেলে গিয়েছে এক ধােপার কাছে, কাপড় কাচা শিখ্‌তে।

 কাপড় কাচা শেখা হয়ে গেলে পর সে যখন চলে আস্‌বে তখন ধােপা তাকে একটা গাধা দিয়ে বল্‌ল, “এই গাধাটা নাও, তােমার অনেক কাজে আস্‌বে। তােমার যখনি টাকার দরকার হবে, গাধাকে বল্‌বে ‘থু-থু!’ অমনি দেখ্‌বে গাধার মুখ দিয়ে মােহর পড়্‌বে।

 গাধা পেয়ে দরজীর ছেলের খুবই সুবিধা হল। টাকার দরকার হলেই সে বলে “গাধা! থু-থু!” আর অমনি গাধা মেলাই মােহর বার করে দেয়। তখন সে ভাব্‌ল, “এইবার বাবার কাছে ফিরে যাই।”

 বাড়ী ফিরবার পথে সেই সরাই, যেখানে তার ভাই উঠে ছিল।

 সন্ধ্যাবেলা সেও গিয়ে সেই সরাইএ উঠ্‌ল। খাবার সময়। সরাইওয়ালাকে দুটা মােহর দিয়ে সে বলল, “তােমার কাছে যত ভাল খাবার আছে তাই আমাকে এনে দাও।” সরাই ওয়ালা ভাবল, “এ নিশ্চয় কোন বড় লােক হবে, না হলে কি আর এক বেলা সরাইএ খাবার জন্য দুটা মােহর দেয়? এর কাছ থেকে আরও কিছু আদায় করতে হবে। এই ভেবে সে বল্‌ল “দুটো মােহরে হবে না, আরও দুটো চাই।” দরজীর ছেলে তখন জামার ভিতর হাত দিয়ে দেখে আর মােহর নাই; গাধাটাকে সে আস্তাবলে বেঁধে রেখে এসেছে সেই খানে গিয়ে তা’র কাছ থেকে মােহর আন্‌তে হবে, তাই সে সরাইওয়ালাকে বল্‌ল, “একটু দাঁড়াও আমি এখনি আস্‌ছি।” বলে সে তাড়াতাড়ি আস্তাবলে গেল, দুষ্ট সরাইওয়ালাও যে চুপি চুপি চুপি তার পিছু পিছু গিয়েছে তা সে বুঝতে পার্‌ল না।

 আস্তাবলে গিয়ে সে দরজা বন্ধ করে গাধার কাছ থেকে মােহর বার করে নিল। সে দরজায় যে একটা ফুটো ছিল তা সে দেখ্‌তে পায়নি। সরাইওয়ালা কিন্তু সেই ফুটোর ভিতর দিয়ে সবই দেখে নিল। আর ভাব্‌ল যে “একটা চাদর ত পেয়েছি, এই গাধাটাও নিতে হবে।”

 এই ভেবে সে চুপি চুপি ঘরে ফিরে এল; দরজীর ছেলে টের পেল না।

 ঘরে এসে সরাই ওয়ালা সকলকে বেশ করে খাইয়ে সকাল সকাল ঘুম পাড়িয়ে দিল।

 তারপর দুপুর রাত্রে উঠে সে দরজীর ছেলের গাধাটি চুরী করে তার জায়গায় আরেকটা গাধা বেঁধে রেখে দিল। সকালে উঠে দরজীর ছেলে সেই গাধাটাকে নিয়েই বাড়ী চল্‌ল; সেটা যে তার নিজেরটি নয়, তা সে বুঝ্‌তে পার্‌ল না। সে বাড়ী এলে দরজী তাকে দেখে খুব খুসী হয়ে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “এতদিন কি কর্‌ছিলে?” সে বল্‌ল, “ধােপার কাজ শিখ্‌ছিলাম। এই দেখ সেই ধােপা আমাকে একটা গাধা দিয়েছে।”

 গাধাটা দেখে দরজীর তত পছন্দ হ’ল না; সে বল্ল, “ওরকম গাধাত বাড়ীতে আরও দু একটা আছে; বরং একটা ছাগল টাগ হলে ভাল হত।” তার ছেলে বল্‌ল, “বাবা এ গাধাটা ভারি আশ্চর্য্য। যদি বলি ‘গাধা, থু-থু!’ অমনি সে মুখ দিয়ে মােহর বার করে দিবে। তােমার বন্ধুদের ডেকে পাঠাও, তাদের তামাসা দেখাব।”

 তখন দরজী খুব খুসী হয়ে তার বন্ধুদের ডেকে পাঠাল।

 বন্ধুরা তখনি তামাসা দেখতে ছুটে এল। এসে তামাসা ত দেখ্‌ল খুবই। বড় ছেলের কথায় এসে তারা যেমন নিমন্ত্রণ খেয়েছিল, এবারে মেঝ ছেলের কথায় এসে তারা তেমনি তামাস দেখ্‌ল। গাধাকে যতই বলা যায় “গাধা! থু—থু!” ততই সে বেটা ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, একবার ফিরেও তাকায় না। তখন সে বুঝ্‌তে পার্‌ল যে এও সেই সরাইওয়ালার কাজ। হতভাগা গাধা বদ্‌লে দিয়েছে।

 দরজীর ছােট ছেলে এক ছুতােরের কাছে গিয়ে এতদিন কাজ শিখ্‌ছিল।

 সেই খানে তার বড় ভাইরা তাকে বলে পাঠাল যে বাড়ী ফিরবার সময় সে যেন খুব সাবধান হয়ে আসে। পথে ভারি দুষ্ট সরাইওয়ালা আছে, তাদের সে ভয়ানক ঠকিয়েছে। ছােটছেলেটি তার বড় ভাইদের চেয়ে চালাক ছিল, সে ভাব্‌ল যে “এই সরাই ওয়ালাকে জব্দ কর্‌তে হবে।

 এদিকে তার কাজ শেখাও শেষ হয়েছে। তাই সে ছুতােরকে গিয়ে বল্‌ল, “এখন আমি বাড়ী যেতে চাই।” তখন ছুতোর তাকে একটা থলে দিল, সেই থলের ভিতর একটি হাতুড়ি। হাতুড়িটি দেখ্‌তে ছোট্ট খাট্টো, কিন্তু তার গুণ বড় চমৎকার! যদি কারোর সঙ্গে ঝগড়া হয়, আর যদি তখন তাকে বলা যায় যে ‘হাতুড়ি, লাগত!’ তা হলে অমনি সে, সে লোকটাকে ঠুকে নাকাল করে দিবে।

 সেই হাতুড়িটি থলে শুদ্ধ বগলে করে নিয়ে দরজীর ছেলে বাড়ী চল্‌ল।

 সে যাচ্ছে আর সেই সরাইওয়ালার কথা ভাবছে। সে সরাইয়ে তার না গেলেও চল্‌ত, তবু সে খুঁজে খুঁজে সন্ধ্যার। সময় সেইখানে গিয়ে উপস্থিত হল।

 তারপর যখন সকলে খেতে বসেছে আর গল্পসল্প চলছে, তখন সে বল্‌ল, “আমি অনেক দেশ বেড়িয়েছি, আর অনেক আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য জিনিষ দেখেছি। একটা চাদর আছে সেটাকে ‘চাদর! আনত!’ বল্‌লেই সেটা খাবারে ভরে যায়। একটা গাধা আছে তাকে “গাধা থু-থু” বল্‌লেই অমনি মুখ দিয়ে মোহর বার করে। কিন্তু আমার কাছে এই যে থলেটি দেখ্‌ছ, এর মত আশ্চর্য্য জিনিষ আর কিছুই নাই।”

 এই কথা শুনেত সরাইওয়ালার জিভ দিয়ে জল পড়্‌তে লেগেছে! সে ভাব্‌ল, “ঐ থলি ভরা নিশ্চয় হীরে মুক্ত আছে; ওটাকে না চুরী কর্‌লে চল্‌ছে না।”

 তারপর সকলে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছে, দুপুর রাত হয়েছে। তখন সরাইওয়ালা চুপি চুপি উঠে দরজীর ছেলের কাছে এল। দরজীর ছেলে তখন তার থলেটি মাথায় দিয়ে শুয়ে ভারি নাক ডাকাচ্ছে। তা শুনে সরাইওয়ালা ভাব্‌ল, “খুব ঘুমুচ্ছে, এই বেলা থলেটা নিয়ে পালাই!” এই বলে সে থলেটা ধর্‌তে গেল। সে জান্‌ত না যে দরজীর ছেলে একটুও ঘুমােয়নি; মিছিমিছি নাক ডাকাচ্ছে, আর মিটির মিটির চেয়ে দেখ্‌ছে। সরাইওয়ালা থলেতে হাত দিতেই সে বল্‌ল, “হাতুড়ি লাগত!” অমনি আর বেটা যাবে কোথায়! হাতুড়ি থলে থেকে বার হয়ে তাকে ঠকাঠক্ ঠকাঠক্ এমনি ঠুকতে লাগ্‌ল যে ঠুকুনি যাকে বলে! ঠুকুনির চোটে সে ভ্যাড়ার মতন চ্যাঁচাতে লাগ্‌ল, আর বল্‌ল, “মাগাে, গেলুম্; ছেড়ে দাও, আর কর্‌বনা!”

 দরজীর ছেলে তা শুনে হাততালি দিয়ে হাস্‌ছে আর বল্‌ছে “দাঁড়া, আগে চাদরটা আর গাধাটা বার করে নি।”

 তখন সরাইওয়ালা হাত যোড় করে বল্‌ল, “বাবা দোহাই। তােমার। সে চাদর আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি; সে গাধা ফিরিয়ে দিচ্ছি, তুমি তােমার ভূতটাকে আমার পিঠ থেকে নাম্‌তে বল।” তখন দরজীর ছেলে “হাতুড়ি থাম,” বল্‌তেই হাতুড়ি গিয়ে থলির ভিতর ঢুক্‌ল। আর সরাইওয়ালাও অমনি চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটে গিয়ে চাদর আর গাধা এনে দিল। তারপর দরজীর ছেলে সেই চাদর, গাধা, আর থলে নিয়ে বাড়ী এল। তখন তিন ছেলেকে ফিরে পেয়ে দরজীর ত খুবই আনন্দ। চাদর আর গাধা ফিরে পেয়ে দরজীর বড় দুই ছেলেরও আনন্দ কম
হাতুড়ি সরাইওয়ালাকে দমাদ্দম লাগাচ্ছে।
হলনা। কিন্তু সকলের চেয়ে আদর হ’ল ছোট ছেলে আর তার হাতুড়িটির। দরজীর বন্ধুরাও বাদ গেল না। তারা পেট ভরেত খেলই, তামাসা ত দেখ্‌লই, তাছাড়া থলি ভরে ভরে টাকাও পেয়ে গেল।

 আর সেই ছাগলটা? সেটার বোধ হয় নেড়া হয়ে বড়ই লজ্জা হয়েছিল; তাই সে কোথায় যে পালিয়ে গেল, তা কেউ বল্‌তে পারে না।