গরীব মুচি।

 এক মুচি ছিল। সে বেচারী গরীব হ’তে হ’তে শেষটায় এমন গরীব হয়ে গেল, যে, তার শুধু এক টুকরা চামড়া ছাড়া আর কিছুই রইল না! সন্ধ্যার সময় সে চামড়া খানাকে কেটে রেখে দিয়েছে, পরদিন সকালে উঠে তাই দিয়ে এক জোড়া জুতা সেলাই করবে। সকালে উঠে দেখে এ কি আশ্চর্য্য! সেই চামড়া টুকু দিয়ে কে এমন সুন্দর জুতা তৈরী ক’রে রেখেছে। এমন জুতা মুচি নিজে কখনই সেলাই করতে পারে না। একটি ফোঁড় ছােট বড় হয়নি; কোথাও এক চুল কম বেশী কাটা হয়নি। তারপর, সেই জুতা জোড়া বিক্রী করে তার এত পয়সা হ’ল যে তাই দিয়ে সে আরও চার জোড়া জুতার চামড়া কিন্‌ল।

 সেদিনও সন্ধ্যার সময় মুচি চার জোড়া জুতার চামড়া কেটে রেখে দিল, মনে কর্‌ল পরদিন তাই দিয়ে জুতা তৈরী কর্‌বে। কিন্তু পরদিন উঠে দেখে চার জোড়া জুতাই কে সেলাই ক’রে রেখেছে, আর সেলাইও খুব চমৎকারই ক’রেছে।

 মুচির ত মজাই হ’ল; রােজ সন্ধ্যার সময় সে চামড়া কেটে রাখে, আর রােজ রাত্রে কে এসে তার সব জুতা সেলাই ক’রে দেয়। মুচি দেখ্‌তে দেখ্‌তে বড়লােক হ’য়ে গেল। তার দোকানে যেমন জুতা পাওয়া যায়, সে দেশে আর কোন দোকানে তেমন সুন্দর জুতা পাওয়া যায় না। লােকে ঢের বেশী দাম দিয়েও খুসী হ’য়ে তার জুতা কেনে।

 একদিন মুচি তা’র স্ত্রীকে বল, “রােজ রাত্রে এসে কে আমার সব জুতা এমন ক’রে সেলাই করে রাখে? চলত আজ আমরা লুকিয়ে থেকে দেখি।”

 সেদিন রাত্রে মুচি আর মুচির স্ত্রী ঘরের এক কোণে পর্দ্দার আড়ালে লুকিয়ে বসে রইল। অনেকক্ষণ তারা কিচ্ছু দেখ্‌তে পেলনা। তারপর যখন রাত দুপুর হয়েছে, আর তাদের বড্ড ঘু পেয়েছে,তখন সুড়ুৎ করে কোত্থেকে দুটি ভূতের খােকা এসে সেই ঘরে ঢুকেছে। তিন পো’ হাত উঁচু এত টুকু খোকা দুটি; পরনে কিছু নাই। তাদের চোখ দুটি খালি মিট মিট কর্‌ছে আর তারা হাস্‌ছে আর তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে।

 মুচি সেদিন অনেক গুলাে জুতার চামড়া কেটে রেখে দিয়েছিল। খােকা দুটি হাস্‌তে হাস্‌তে সেই চামড়ার কাছে গিয়ে বস্‌ল। তার পর দুজনে মিলে ঠুক্‌ ঠাক্‌, খুট্‌ খাট্‌, এমনি সেলাই কর্‌তে লাগ্‌ল যে কি বলব। মুচি আর তার স্ত্রী এসব দেখে এতই আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছে যে তারা বুঝ্‌তেই পার্‌ছেনা কেমন করে কি হচ্ছে। দেখ্‌তে দেখ্‌তে সব জুতা সেলাই করে দিয়ে খোকা দুটি কোনখান দিয়ে যে পালাল, তাও তারা বুঝ্‌তে পার্‌লনা।

 যা হােক, খোকা দুটির উপরে তাদের বড় মায়া হয়েছে তাই মুচির স্ত্রী মুচিকে বল্‌ল, “ছােট্ট ছােট্ট খোকা দুটি আমাদের এত কাজ করে দেয়, আর আমরা কি ওদের জন্য কিছু কর্‌তে পারিনা?” মুচি বল্‌ল “হাঁ! তাইত, আমরা কি কর্‌তে পারিনা? আচ্ছা বলত কি করা যায়।” মুচির স্ত্রী বল্‌ল, “আচ্ছা, আমি যদি ওদের দুজনের জন্য দুটি পােষাক সেলাই করে দি, আর তুমি দুটি ছােট্ট ছােট্ট জুত বানিয়ে দাও তবে কেমন হয়? এই শীতের মধ্যে বেচারীরা রােজ রাত্রে শুধু গায় আসে, ওদের বােধ হয় বড় কষ্ট হয়।”

 পরদিন মুচির স্ত্রী দুজনের জন্য ছােট্ট ছােট্ট দুখানি লাল রংএর পােষাক তৈরী কর্‌ল, আর মুচি দুজোড়া লাল জুতা বানাল। রােজ সন্ধ্যার সময়, যেখানে জুতার জন্য চামড়া কেটে রাখ্‌ত, সেদিন সেখানে আর চামড়া না রেখে, সেই পােষাক, আর জুত রেখেছিল। তারপর মুচি আর মুচির স্ত্রী চুপ্‌ করে ঘরের কোণে লুকিয়ে রইল।

 তারপর দুপুর রাত্রে আবার সেই খোকা দুটি এসেছে। এসেই ত তারা এখানে খুঁজছে, ওখানে খুঁজছে, কোথাও জুতাের চামড়া দেখ্‌তে পাচ্ছে না। কোথায় পাবে? সে দিন ত আর চামড়া রাখেনি। সে দিন তার বদলে সেই পােষাক জুতা রাখা হয়েছে। খােকা দুটি চামড়া খুঁজ্‌তে গিয়ে তাই দেখ্‌তে পেয়ে খুসী যা হল! সেই কাপড় আর জুতা উল্টে পাল্টে দেখে আর হাসে। তারপর আস্তে আস্তে পােষাক দুটি পরে দেখ্‌ল ঠিক হয়েছে। জুতায় পা ঢুকিয়ে দেখ্‌ল ঠিক হয়েছে। তখন দুজনে মিলে খানিকক্ষণ খুব নাচ্‌ল। তারপর হাস্‌তে হাস্‌তে সেখান থেকে ছুটে পালাল আর এল না।