মেনকা।

 মেনকা এক রাজার মেয়ে। তার বাপ মরে গিয়েছেন, মা বেঁচে আছেন। মেনকার একটা ঘােড়া আছে তার নাম ‘মাদারি।’ মাদারি বড় আশ্চর্য্য ঘােড়া। সে মানুষের মত কথা বল্‌তে পারে, আর সব বুঝ্‌তে পারে।

 মেনকার মতন সুন্দর মেয়ে পৃথিবীতে কোথাও নাই। আর সে যত বড় হচ্ছে ততই আরাে সুন্দর হচ্ছে। এই কথা শুনে খুব বড় এক রাজার ছেলে তাকে বিয়ে কর্‌তে এল। সেই রাজার ছেলের দেশ অনেক দূরে, তাই বিয়ের পর দিনই সে মেনকাকে, নিয়ে দেশে চল্ল। যাবার সময় মেনকার মা, তার সঙ্গে অনেক টাকা কড়ি, হাতী ঘােড়া দিলেন আর দিলেন একটি ঝি।

 তারপর মেনকা তার ঘােড়া ‘মাদারির’ পিঠে গিয়ে উঠ্‌ল আর সেই ঝিও আরেক ঘােড়ায় চড়ে তার সঙ্গে চল্ল।

 এমনি করে তারা অনেক দূর এসেছে, এখন একটা মস্ত বন পার হতে হবে। রাজার ছেলে লোক জন নিয়ে আগে গিয়েছে; মেনকা তার ঝি, আর কয়েকজন লােক একটু পিছনে পড়েছে। বনের মধ্যে একজন আর একজনকে ভাল ক’রে দেখ্‌তে পাচ্ছে না।

 এমন সময় হয়েছে কি, মেনকার যে ঝি, সেটা ভয়ানক দুষ্ট। সে মনে মনে ভাব্‌ল ‘রাজার ছেলে ত মেনকাকে মােটে একদিন দেখেছেন, আর গােলমালে ভাল ক’রে দেখ্‌তেও পান নি। আর আমিও ত দেখ্‌তে কম সুন্দর নই। এখন আমি যদি বলি যে আমিই মেনকা, আর মেনকা আমার ঝি, তবে কে ধর্‌বে?”

 এর একটু পরেই মেনকার ভারি জল তেষ্টা পেয়েছে। তাই সে ঝিকে বল্‌ল, “ঝি একটু জল এনে দাও।” ঝি তাতে ভারি বিরক্ত হয়ে, মুখ নেড়ে বল্‌ল, “কেন নিজে নিয়ে খেতে পার না? আমি কি তােমার ঝি? আমি জল টল দিতে পার্‌ব না।” মেনকা বেচারী বড় ভালমানুষ, কাউকে কিছু বলে না। সে নিজেই ঘােড়া থেকে নেমে জল খেতে গেল। অমনি সেই হতভাগী ঝি কর্‌ল কি তাড়া তাড়ি তা’র ঘােড়াথেকে নেমে মাদারির পিঠে চড়ে বস্‌ল। মেনকাকে দেখে সে বল্‌ল, “এ আমার ঘােড়া। তুমি ঐ ঘােড়ায় চড়ে যাবে। তােমার পােশাক খুলে আমাকে দাও, তুমি আমার পােষাক পর। আমি বল্‌ব যে আমিই রাজার মেয়ে, আর তুমি আমার ঝি। তুমি তা’তে ‘না’ বল্‌তে পার্‌বে না। বল, ‘না’ বল্‌বে না, নইলে তােমাকে মেরে ফেল্‌ব।”

 মেনকা আর কি করে, সে ঝির কথায়ই রাজি হ’ল। তারপর ঝির পােষাক প’রে সে ঝির ঘােড়ায় গিয়ে উঠ্‌ল। তার মনে মনে ভারি দুঃখ হ’ল কিন্তু কি কর্‌বে? মাদারি সব শুনেছে সব বুঝ্‌তে পেরেছে, কিন্তু কিছু বল্‌ছে না।

 রাজার ছেলে বৌ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। বুড়াে রাজা দেখ্‌বার জন্য ছুটে এলেন। তাঁরা ত আর কিছু জানেন না। তাঁরা ঝিকেই বৌ মনে করে আদর ক’রে ঘরে নিয়ে গেলেন। মেনকা বাইরে দাড়িয়ে রইল।

 কিন্তু ঝিএর কাপড় প’রেও মেনকাকে এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে সকলে তাকে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেছে আর বল্‌ছে, “এ মেয়েটি কে?” “এ মেয়েটি কে?” ঝি এ কথা শুন্‌তে পেয়ে রাজাকে বল্ল যে, “আমার একজন ঝি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখনি কোন কাজে পাঠিয়ে দিন্‌। না হ’লে বসে থেকে কুঁড়ে হয়ে যাবে।”

 রাজা গিয়ে দেখলেন, দেবতার মত সুন্দর একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকে বল্‌লেন, “মা আমার বাড়ীতে ত ঢের ঝি চাকর আছে। তোমাকে আর কি কাজ দেব। যে ছেলেটা আমার হাঁস চরায় তার নাম কানাই, সে বড্ড ছেলে মানুষ, কেবল খেলা করে বেড়ায়; তুমি তার সঙ্গে যেও আর দেখো যেন হাঁস গুলো না হারিয়ে যায়।

 এদিকে সে দুষ্টু ঝি ত এখন রাজার বৌ হয়েছে। সে রাজার ছেলেকে বল্‌ল, “আমি যে ঘোড়ায় চড়ে এসেছি সেটা ভারি দুষ্টু ঘোড়া। তাকে মেরে ফেল্‌তে হবে।” তার মনে ভয় হয়েছে, পাছে মাদারি সব কথা বলে দেয়।

 তখনি কসাই ডেকে মাদারিকে মেরে ফেলার হুকুম দেওয়া হল।” কসাই মাদারিকে নিয়ে মাঠে গিয়েছে, এমন সময় মেনকা ভয়ানক কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে এসে বল্‌ল, “তোমার দুটি পাড়ে পড়ি, ঘোড়াটাকে মেরো না।” কসাই বল্‌ল, “রাজার ছেলের হুকুম, মার্‌তেই হবে।” মেনকা বল্‌ল “তবে ওর মাথাটা ফেলে দিওনা, ঐ বট গাছে ঝুলিয়ে রেখে দিও। কসাই সে কথায় রাজি হয়ে ঘোড়াটাকে কেটে তার মাথাটা বট গাছে ঝুলিয়ে রাখ্ল।

 তারপর হাঁসের পাল নিয়ে কানাইএর সঙ্গে মেনকা মাঠে যাচ্ছে। যেতে যেতে সেই বটগাছের নীচে সে থাম্‌ল। থেমে বল্ল, ‘মাদারি, মাদারি, কি কর্‌ছ?”

 মাদারির মাথাটা অমনি বল্ল “রাজার মেয়ে, আমি তোমার জন্য কাঁদ্‌ছি।”

 মাঠে গিয়ে হাঁসগুলো ছেড়ে দিয়ে মেনকা চুল বাঁধ্‌তে বস্‌ল। তার চুল ছিল কাল কুচ কুচে, আর চমৎকার ঢেউখেলান। সে চুল মেনকা খুল্‌তেই তার পায়ে এসে ঝুলে পড়্‌ল। কাণাই তা দেখে ছুটে এসে বল্‌ল, “বাঃ কি চমৎকার চুল! দেখি না কত লম্বা।” এই ব’লে সে মেনকার কোঁকড়া চুলগুলি ধ’রে, টেনে লম্বা করূতে লাগ্‌ল। তখন মেনকা বাতাসকে ডেকে বল্‌ল, “বাতাস বাতাস, কানাইএর পাগড়ী উড়িয়ে নাও ত। কানাই বড় দুষ্টুমি কর্‌ছে।” অমনি হু হু করে কোথা থেকে বাতাস এসে কানাইএর মাথার পাগড়ী উড়িয়ে নিয়ে গেল। আর কানাই তাতে ভারি ব্যস্ত হয়ে পাগড়ী আন্‌তে ছুটল। তার পর পাগড়ী নিয়ে যখন সে ফিরে এসেছে, ততক্ষণে মেনকার চুলও বাঁধা হয়ে গিয়েছে।

 এমনি ক’রে, রোজ মাঠে যাবার সময় মেনকা বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলে, “মাদারি, মাদারি কি কর্‌ছ?”

 মাদারির গলা বলে, “রাজার মেয়ে, আমি তোমার জন্য কাঁদ্‌ছি।”


বাতাসে কানাইএর পাগড়ি উড়ে গেছে।
 রোজ মাঠে হাঁস ছেড়ে দিয়ে মেনকা চুল বাঁধ্‌তে বসে। আর কানাই এসে তা’র চুল নিয়ে টানাটানি করে। তখন মেনকা বলে, “বাতাস বাতাস কানাইএর পাগড়ী উড়িয়ে নাও ত।” আর কোথেকে বাতাস এসে কানাইএর পাগড়ী উড়িয়ে নিয়ে যায়।

 তারপর একদিন কানাই এসে রাজাকে বল্‌ল, “রাজামশাই, আমি আর হাঁস চরাতে যাব না।”

 রাজা বল্‌লেন, “কেন রে?”

 কানাই বল্‌ল, “সেই ঝি আমাকে রোজ ভারি নাকাল করে।” রাজা হাস্‌তে হাস্‌তে বল্‌লেন, “কেন, সে তোকে এত কি নাকাল করে?”

 তখন কানাই বল্‌ল, “রোজ মাঠে যাবার সময় সে একটা বটগাছের নীচে দাঁড়ায়। সেই গাছে একটা ঘোড়ার মাথা ঝোলান আছে, সেটাকে সে বলে, মাদারি, মাদারি, কি কর্‌ছ?” তখন মাথাটা বলে, ‘রাজার মেয়ে, আমি তোমার জন্য কাঁদ্‌ছি।’

 “তারপর মাঠে গিয়ে সে রোজ তার লম্বা লম্বা চুল বাঁধ্‌তে বসে, আর বলে, ‘বাতাস, বাতাস, কানাইএর পাগড়ী উড়িয়ে নাও ত!’ আর অমনি কোত্থেকে হু হু করে বাতাস এসে আনার পাগড়ী উড়িয়ে নিয়ে যায়। রোজ আমাকে পাগড়ীর পিছনে দৌড়ে দৌড়ে নাকাল হ’তে হয়।”

 রাজা বলেন, “তাইত, এত ভারি আশ্চর্য্য! আচ্ছা, কাল তুমি যাও, তারপর দেখা যাবে।”

 পরদিন সকালে রাজামশাই নিজে গিয়ে সেই বটগাছের পিছনে লুকিয়ে রইলেন। সে দিনও কানাই আর মেনকা হাঁস চরাতে এসেছে। গাছতলা দিয়ে যাবার সময় মেনকা মাদারির সঙ্গে কথা বল্‌ল, তারপর সে চুল বাঁধ্‌তে ব’সে বাতাসকে কানাইএর পাগড়ী উড়িয়ে নিতে বল্‌ল, আর কানাইকে সেই পাগড়ীর পিছু পিছু খুব ছুটোছুটী কর্‌তে হ’ল। রাজামশাই বটগাছের আড়াল থেকে সব দেখ্‌লেন।

 তারপর বাড়ী এসেই তিনি মেনকাকে ডেকে পাঠালেন। মেনকা আস্‌তেই তিনি তাকে জিজ্ঞাসা কর্‌লেন, “মা, তুমি কে, আর কেনই বা বোজ এমনি ক’রে ঘোড়ার মাথার সঙ্গে কথা বল?” মেনকা হাত জোড় করে বল্‌ল, “রাজামশাই, আমি একজনকে ব’লেছি যে এ সব কথা কোন লোককে বল্‌ব না।”

 রাজা বল্‌লেন, “আচ্ছা মা, কোন লোককে নাই বল্‌লে। উঠানে যে পেয়ারা গাছ আছে, ঐ গাছটার কাছে গিয়ে বল।” তখন মেনকা গাছের কাছে গিয়ে বল্‌তে লাগ্‌ল, “আমি রাজার মেয়ে, আমার এই কষ্ট। ঝি দুষ্টুমি ক’রে আমার সব কেড়ে নিয়েছে, আর আমাকে দিয়ে এখন ঝির কাজ করাচ্ছে। মা যদি এ সব কথা জান্‌তে পারেন তবে তিনি কেঁদেই মরে যাবেন। রাজামশাই কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে এসে সবই শুনেছেন। শুনেই তখনি তিনি তাঁর ছেলেকে ডেকে সব কথা বল্লেন। রাজার ছেলে দেখ্‌লেন সত্যি সত্যিই সেই ঝিটার চেয়ে মেনকা দেখ্‌তে অনেক সুন্দর।

 তখন সকলে ছুটাছুটি ক’রে চমৎকার সোণালী শাড়ী আর হীরার গহনা এনে মেনকাকে সাজাল। সেই শাড়ী আর গহনা পরে তা’কে এমন সুন্দর দেখাতে লাগ্‌ল যে তেমন আর কেউ কখনো দেখেনি। তারপর সেই ঝি হতভাগীকে, নেড়া ক’রে ঘোল ঢেলে, ঝাঁটা মেরে, দেশের বার করে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হল।