গল্পের বই/ঘুমের দেশ
ঘুমের দেশ।
এক রাজা, তাঁর ছেলেপিলে কিছু ছিল না, তাই তাঁর মনে বড় দুঃখ ছিল। তারপর, অনেক দিন পরে রাণীর একটি মেয়ে, হয়েছে; তাতে রাজামশাই ভারি খুসী হয়েছেন। মেয়েটির ভাত হবে, তাতে ভারি ধুমধাম হবে। সে দেশের যত বড় লােক, যত গরীব লােক সকলের নেমন্তন্ন হয়েছে। সেই দেশের তেরজন পরী ছিল। রাজা ভাব্লেন “পরীদের যদি নেমন্তন্ন করি, তা হ’লে নিশ্চয় তারা আমার মেয়েকে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিষ দেবে।” পরীরা তেরজন। কিন্তু রাজার বাড়ীতে মােটে বারখানা সােণার থালা। তেরজনকে খেতে দেবেন কি করে? তাই রাজামশাই কর,লেন কি, তাদের মধ্যে যে সকলের চেয়ে বুড়ী পরী, তাকে বাদ দিয়ে আর বারজনকে নেমন্তন্ন কর্লেন।
ভাতের দিন সব লােক জন এসেছে। বারােজন পরীও এসেছে। বারজনকে বারখানা সােণার থালায় ক’রে খেতে দেওয়া হয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হ’লে পরীরা মেয়ে দেখ্তে চাইল। এক একজন পরী তাকে এক একটা বর দিল। একজন বল,ল, “এই মেয়ে পৃথিবীর মধ্যে সকলের চেয়ে সুন্দরী হবে।” আর একজন বল্ল, “এ খুব লক্ষ্মী হবে।” কেউ বল্ল, “এর অনেক টাকা হবে।” এমনি ক’রে যত ভাল জিনিষ একে একে সব তারা সেই মেয়েটিকে দিল। এগারজন পরী মেয়ে দেখেছে, একজন শুধু বাকী আছে, এমন সময় সেই যে বুড়ী পরী, যার নেমন্তন্ন হয় নি, সে এসে হাজির। সকলে ত তাকে দেখে ভারি ব্যস্ত হয়ে গেল, কোথায় বস্তে দেবে, কি খেতে দেবে! বুড়ী কিন্তু কারাের দিকে চেয়েও দেখল না। নেমন্তন্ন হয়নি ব’লে তার এমনি রাগ হয়েছে যে সে ঠক্ঠক্ ক’রে কাঁপছে। সে এসেই একেবারে সােজা মেয়ের কাছে গেল। গিয়ে চোখ পাকিয়ে, মাথা নেড়ে বল্ল, “এই মেয়ে যখন পনের বছরের হবে তখন চরকায় হাত কেটে সে মারা যাবে।” এই বলে বুড়ী রাগে গর্গর কর্তে কর্তে সেখান থেকে চলে গেল। বুড়ীর কথা শুনে সকলেরই ভারি দুঃখ হ’ল; রাজা রাণী ভয়ানক কাঁদ্তে লাগ্লেন।
এমনি করে তাঁরা কাঁদছেন এমন সময় আরেকটি পরী এগিয়ে এল। এটি সেই বাবােজন পরীর একটি; তার এখনাে মেয়ে দেখা হয় নি। সে এসে বল্ল, “পনের বছরের সময় চরকাতে মেয়ের হাত কেটে যাবে বটে, কিন্তু সে একেবারে মর্বে না, শুধু ঘুমিয়ে পড়্বে। একশ বছর পরে তার ঘুম ভাঙ্গ্বে। এই কথা শুনে রাজারাণী একটু স্থির হ’লেন।
তারপর রাজা হুকুম দিলেন যে দেশে যত চরকা আছে সব পুড়িয়ে ফেল্তে হবে। কেউ আর চরকা দিয়ে সুতো কাট্তে পার্বে না!
গরপর অনেক বছর কেটে গিয়েছে; মেয়েটি এখন পনের বছরের হয়েছে। রাজা রাণী তাকে সব সময়ে সাবধানে রাখেন, একলা কোথাও যেতে দেন না।
এর মধ্যে একদিন তাঁরা বেড়াতে বেরিয়েছেন,বাড়ীতে ঝির কাছে মেয়েটি রয়েছে। ঝি আবার কেমন বোকা, সে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটি তখন ঘর থেকে বেরিয়ে সব দেখতে লাগল। রাজার বাড়ী, সে কি যেমন তেমন বড় বাড়ী! তার যে কত মহল, কত ঘর, রাজা নিজেও ভাল ক’রে দেখেন নি। রাজার মেয়ে এতদিন পরে খোলা পেয়ে, যেমন ইচ্ছা ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে দেখ্ল একটা ঘরের দরজা বন্ধ, তার উপরে মাকড়সায় জাল করেছে। অনেকদিন যেন সে ঘর খোলা হয়নি। রাজার মেয়ে আস্তে আস্তে দরজা ঠেল্তেই অমনি দরজা খুলে গেল। সেই ঘরের ভিতর এক বুড়ী ব’সে চরকায় সুত কাট্ছিল। রাজার মেয়ে কখন চরকা দেখেনি, সে আশ্চর্য্য হয়ে বুড়ীকে জিজ্ঞাসা কর্ল, “তুমি কি কর্ছ? ওটা কি অম্নি বন্ বন করে ঘুর্ছে?” বুড়ী বলল, “ওটা চরকা। আমি সুত কাটছি।” মেয়েটি বল্ল, “আমি দেখ্ব চরকা কি রকম?” বুড়ী তার হতে চরকা দিল। কিন্তু যেই সে চরকা ঘুরাতে গিয়েছে, অমনি কেমন করে সেই চরকার টেকো তার হাতে বিঁধে গেল, আর তখনি সে সেইখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়্ল।
ঠিক সেই সময় রাজার বাড়ীর সকলে যে যেখানে ছিল সেইখানেই ঘুমল। রাজা রাণী তখন সব বেড়িয়ে ফিরে এসেছেন, তাঁরাও তাঁদের কাপড় চোপড় শুদ্ধ দরজার কাছেই ঘুমিয়ে পড়্লেন। চাকর বাকর যে যেখানে ছিল সব ঘুমল। রান্নাঘরে রাঁধুনি আর এক ঝির সঙ্গে ঝগড়া কর্ছিল, তার চুলের মুঠি ধরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। বাড়ীর পোকা মাকড়সাগুলো অবধি ঘুমুতে বাকী রইল না।
তারপর দেখ্তে দেখ্তে সেই ঘুমন্ত বাড়ীর চারদিকে সব কাঁটা গাছ গজিয়ে উঠ্ল। সেই গাছ বড় হয়ে হয়ে শেষে ভয়ানক বন হল; রাজার বাড়ীর চুড়ার নিশান অবধি তাতে ঢেকে গেল। সে বনের ভিতর কেউ ঢুক্তে পারেনা আর বাইরে থেকে রাজার বাড়ীর কিছুই দেখা যায় না; সে রাজার বাড়ীর কথা লোকে ভুলে গেল।
সকলে সেই কাঁটা গাছের বন দেখে ভয় পেত, খুব বড়রা কেউ কেউ খালি বল্ত যে “শুনেছি ঐ কাঁটা বনের ভিতরে এক রাজার বাড়ী আছে, আর তাতে এক চমৎকার সুন্দরী মেয়ে আছে।”
এমনি করে একশ বছর যায়। তখন একদিন এক রাজার ছেলে সেইখান দিয়ে যাচ্ছিলেন! রাস্তায় এক বুড়োকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এগুলো কি গাছ?” বুড়ো বল্ল, “এ গুলো ভূতের গাছ। কত বছর থেকে যে এগুলো এখানে আছে—কেউ বল্তে পারেনা। শুনেছি ওর পিছনে নাকি এক রাজার বাড়ী আর তাতে খুব সুন্দর এক রাজার মেয়ে আছে। ঐ গাছগুলো পার হয়ে কেউ সেখানে যেতে পারে না। কেউ কাছে গেলেই গাছেরা তাকে খেয়ে ফেলে।” রাজার ছেলে তা শুনে বল্লেন “আমি যাব।” বুড়ো কত মানা কর্ল, তিনি কিছুতেই শুন্লেন না। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! রাজার ছেলে কাছে যেতেই কাঁটা গাছের যত কাঁটা সব ফুল হয়ে গেল আর গাছগুলো আপনা হতেই ফাঁক হয়ে তাঁর জন্য পথ করে দিল। তারপর তিনি ভিতরে গিয়ে দেখ্লেন সত্যি সত্যিই প্রকাণ্ড রাজ বাড়ী তাতে লােক জন হাতী ঘােড়া কতই আছে কিন্তু তারা সকলেই ঘুমচ্ছে। রাজা রাণী পর্য্যন্ত ঘুমচ্ছেন। সকল ঘরে ঘূরে ঘূরে রাজার ছেলে শেষটায় একটা ঘরে এলেন, সেই ঘরে সেই রাজার মেয়ে ঘুমচ্ছিল। ঘরে ঢুকেই তিনি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখ্ছেন, আর ভাবছেন “এমন সুন্দর মেয়ে বুঝি আর পৃথিবীতে নেই।” ঠিক সেই সময়ে রাজার মেয়ের সেই একশ বছরের ঘুম শেষ হ’ল আর সে চোখ মেলে চাইল। অমনি আর সকলেরই ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখন ঝি তাড়াতাড়ি উঠে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে চাকরেরা ডাকাডাকি হাঁকাহাকি কর্ছে, রান্নাঘরে রাঁধুনি ঝির চুল ধরে মারামারি লাগিয়েছে, ভারি হৈ চৈ পড়ে গেল আর কি! রাজারাণীও তখন উঠে নিজেদের ঘরে গেলেন। আবার সব যেমন ছিল তেমনি হল।
তারপর কি হল? তারপর সেই রাজার ছেলের সঙ্গে রাজারাণী তাঁদের মেয়ের বিয়ে দিলেন। আর খুব খাওয়া দাওয়া ধূমধাম হ’ল আর কি!