বারো ভাই।

 এক রাজার বারোটি ছেলে, কিন্তু একটিও মেয়ে নাই; তাই তাঁর মনে বড় দুঃখ। একদিন তিনি রাণীকে বল্‌লেন, এবার যদি আমার মেয়ে হয় তবে আমি ছেলে বারোটাকে বনে তাড়িয়ে দিয়ে মেয়েকেই আমার সব দিয়ে দেব।” এই কথা শুনে রাণী খুব কাঁদতে লাগলেন।

 কিছুদিন পরে রাজার একটি মেয়ে হ’লো। মেয়েটি যারপরনাই সুন্দর, তার কপালে সোনার তারা ঝক্‌ঝক্ করছে। রাজা সেই মেয়েটিকে পেয়ে তাঁর বারোটি ছেলেকে বনে তাড়িয়ে দিলেন। সেই ভয়ানক বনের ভিতরে বারোটি ভাই ঘুরে বেড়াতে লাগ্‌ল। ঘুরতে ঘুরতে তারা দেখ্‌তে পেল। এক জায়গায় একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘর রয়েছে। ঘরখানি বেশ সুন্দর, তার চারধারে বাগান, কিন্তু তাতে লোকজন কেউ নেই। তা দেখে তারা বল্‌ল, “চল আমরা এই ঘরে থাকি।”

 সেই ঘরটিতে তারা বারো ভাই মিলে থাক্‌তে লাগ্‌ল। সকলের ছোট ভাইটি বেশী পরিশ্রম কর্‌তে পারে না; সে বাড়ীতে থেকে পাহারা দেয় আর ঘরের কাজ করে। অন্য এগার ভাই রোজ সকালে উঠে শীকার কর্‌তে যায়, সন্ধ্যার সময় ফিরে আসে। এমনি করে দশ বছর কেটে গেল।

 এদিকে রাজার বাড়ীতে কি হ’ল শোন। এতদিনে মেয়েটি বেশ বড় হয়েছে। সে দেখ্‌তে যেমন সুন্দর, তেম্‌নি লক্ষ্মী মেয়ে। তাকে যে দেখে সেই খুব ভালবাসে।

 একদিন হয়েছে কি, রাজার বাড়ীর অনেক কাপড় রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। সেই সব কাপড়ের সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট বারোটি জামাও শুকাচ্ছে। রাজার মেয়ে সেই বারোটি ছোট্ট ছোট্ট জামা দেখতে পেয়ে তার মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “মা, ছোট্ট ছোট্ট জামাগুলি কার? বাবার ত এতটুকু জামা নয়?”

 তার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ও জামা তোমার দাদাদের।” মেয়েটি বল্‌ল, “আমার দাদাদের! কই মা, তাদের ত আমি কখনো দেখিনি? তারা কোথায়?”

 রাণী বল্‌লেন “তোমার বারজন বড় ভাই ছিল। তাদের তোমার বাবা বনে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা কোথায় আছে জানি না, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না।”

 একথা শুনে সেই মেয়েটি বল্‌ল, “মা তুমি কেঁদোনা। আমি আমার দাদাদের খুঁজে নিয়ে আস্‌ব।”

 তার পরদিন সকালে উঠেই সে বাড়ীথেকে বেরিয়ে তার ভাইদের খুঁজতে সেই বনের ভিতরে চলে গেল। ভাইদের সে কখনো চক্ষে দেখেনি কোথায় তাদের খুঁজতে হবে তাও জানে না; আর বনের ভিতরে পথঘাট ও কিছু নাই। সে অনেকক্ষণ ধরে এলো মেলো এদিক সেদিক খুঁজল। খুঁজে খুঁজে তার এমনি পরিশ্রম হল আর জলতেষ্টা পেল যে কি বলব! এমন সময় সে দেখ্‌তে পেল যে একটা কুঁড়ে ঘরের সামনে একটি ছোট্ট ছেলে ব’সে আছে। সেই ছেলেটির কাছে গিয়ে সে বল্ল, “আমাকে একটু জল খেতে দিবে?” ছেলেটি তাকে দেখে ভাব্‌ল, কি চমৎকার মেয়ে! কপালে কি সুন্দর সােনার তারা! সে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞসা কর্‌ল, “তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?” মেয়েটা বল্‌ল,” আমি রাজার মেয়ে। আমার বার জন ভাইকে বাবা বনে তাড়িয়ে দিয়েছেন, আমি তাদের খুঁজতে এসেছি।”

 তখন ছেলেটি বুঝ্‌তে পার্‌ল যে এই সুন্দর মেয়ে আর কেউ না, তাদেরি ছােট বােন। তার যে কি আনন্দ হল! আর সে তার বােনকে কত আদর করল!

 তার পর দুজনে বসে গল্প কর্‌তে লাগল। খানিক পরে ছেলেটি বল্‌ল “দেখ বােন, একটা ভারি মুস্কিলের কথা। আমাদের বােন হয়েছিল বলে বাবা আমাদের তাড়িয়ে দিলেন কিনা, তাই আমরা ঠিক করেছি যে যত মেয়ে দেখ্‌ব সকলকে মেরে ফেল্‌ব। কিন্তু আমি তােমাকে কখনই মার্‌তে দেব না। তার পর সে একটু ভেবে বল্ল, “তুমি এক কাজ কর। ঘরের মধ্যে একটা পীঁপে আছে, তুমি তার নীচে লুকিয়ে থাক। এখনি দাদারা ফিরে আস্‌বে।”

 এই বলে সে তার বােনটিকে সেই পীঁপের নীচে লুকিয়ে রাখ্‌ল। তারপর সে সবে আবার এসে ঘরের দরজায় বসেছে, অমনি সে দেখতে গেল যে তার এগারো ভাই শীকার করে তীর ধনুক হাতে ঘরে ফিরে আস্‌ছে। সারাদিন খেটে ওদের বড্ড খিদে পেয়েছে; এসেই ওরা খেতে চাইবে। ছােট ভাই তাড়াতাড়ি তাদের জন্য খাবার জায়গা করে, ভাত বেড়ে খেতে দিল। যখন সকলে খেতে বসেছে তখন সে তাদের বল্‌ল, “আজ একটা খুব ভাল খবর আছে।”

 সকলে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কি খবর? খবর?”

 ছােট ভাইটি বল্ল,“আগে বল যে আমরা প্রথম যে মেয়েটি দেখব তাকে মারব না।” তা’ শুনে এগার’ ভাই এক সঙ্গে বল্ল, “না তাকে মারব না। কি খবর বল।”

 তখন সে পীঁপের নীচ থেকে তাদের বােনকে বার করে নিয়ে এলাে। তাকে দেখে সকলে ভারি আশ্চর্য্য আর খুসী হয়ে বল্ল, “বাঃ কি সুন্দর মেয়েটি! কপালে কি সুন্দর তারা! একে কোথায় পেলে?”


 তারপর যখন তারা জান্‌ল যে সেটি তাদের বােন, তখন তারা তাকে কোলে নিয়ে নাচ্‌তে লাগ্‌ল, আর আনন্দে চেঁচিয়ে ঘর ফাটিয়ে দিল।

 এখন থেকে বােনটি ঘরের কাজ করে, বাটনা বাটে, রান্না করে, ঘর ঝাঁট দেয়, বিছানা করে। আর ছােট ভাই কাঠ কাটে। জল তােলে আর বাড়ী পাহারা দেয়। এমনি করে সেই বনে তারা খুব সুখে আছে।

 এমন সময় একদিন হ’ল কি, রাজার মেয়ে কুঁড়ে ঘরের সাম্‌নে বাগানে বেড়াচ্ছে, বেড়াতে বেড়াতে দেখ্‌তে পেল একটা গাছে বারটা মস্ত মস্ত সুন্দর গোলাপ ফুল ফুটে রয়েছে। সে মনে কর্‌ল, “বাঃ, কেমন সুন্দর ফুল! বারটা ফুল আছে, দাদারা বাড়ী এলে সকলকে একটা একটা দেব, তারা কত খুসী হবে।” এই মনে করে সে ফুলগুলি গাছথেকে তুলে ফেল্ল। এখন হয়েছে কি, তারা যে ঘরে থাক্‌ত, সে ঘর ছিল এক বুড়ী ডাইনীর। ঘরটাকে আর চারিদিকের বাগানকে ডাইনী যাদু করে রেখেছিল। রাজার মেয়ে ফুল ছিঁড়তেই এক বুড়ী ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে বল্‌ল, “কি কর্‌লে! কি কর্‌লে! ও ফুল কেন ছিঁড়লে? ওই বারটা ফুলে তােমার বারজন ভাইকে যাদু করা হয়েছে। তুমি ফুল ছিঁড়ে ফেলেছ, এখন তােমার ভাইরা সকলে কাক হয়ে গিয়েছে।

 সত্যি সত্যি তখনি বারটি ভাই বারটা দাঁড়কাক হয়ে ‘কা—কা’ করতে করতে উড়ে চলে গেল।

 রাজার মেয়ে “হায়, হায়! কি কর্‌লাম!” বলে চীৎকার করে কাঁদতে লাগল। তাকে কাঁদতে দেখে ডাইনী বুড়ী বল্‌ল, “যদি তুমি এক কাজ কর্‌তে পার তবে তোমার ভাইরা আবার মানুষ হতে পারে। কিন্তু সে বড় শক্ত কাজ, তুমি কি পারবে?”।

 রাজার মেয়ে বল্ল, “হাঁ আমি পারব; বল সে কি কাজ।” ডাইনী বল্ল, “যদি সাত বছর না হেসে আর কা’রাে সঙ্গে একটাও কথা না বলে থাক্‌তে পার, তবে সাত বছর পরে তােমার দাদারা আবার মানুষ হবে।” রাজার মেয়ে বল্‌ল “আমি তাই কর্‌ব। যদি দাদারা ভাল হয় তবে আমি এখন থেকে সাত বছর কারাের সঙ্গে কথা বল্‌ব না। সেইদিন থেকে সে হাস্‌তও না কথাও বল্‌ত না, কেবল কুঁড়ে ঘর খানির সামনে একলা একলা বসে সেলাই কর্‌ত।

 একদিন একজন রাজা সেই বনে শীকার করতে এলেন। শীকার কর্‌তে কর্‌তে তিনি সেই কুঁড়ে ঘরের কাছে এসে দেখ্‌লেন যে কি সুন্দর একটি মেয়ে বসে সেলাই কর্‌ছে। তাঁর মনে হল যে এমন চমৎকার মেয়ে তিনি আর কখনও দেখেন নি। তিনি তার কাছে গিয়ে বল্‌লেন “তুমি আমার রাণী হবে? সে ত কথা কয় না, শুধু ঘাড় নেড়ে বলল “হাঁ”। তখন রাজা তাকে ঘােড়ায় করে বাড়ী নিয়ে গেলেন আর খুব ধূমধাম করে তাঁদের বিয়ে হল।

 কিন্তু রাজার বাড়ী গিয়ে মেয়েটি কোন কথা বলে না। সকলে মনে কর্‌ল তাকে বােবা। রাজার এক সৎমা ছিল সে ভারি দুষ্টু। সে মেয়েটিকে দেখ্‌তে পারত না। ক্রমাগত রাজাকে বল্‌ত, “কি মেয়ে বিয়ে করে এনেছ। হাস্‌তেও জানে না, কথা বল্‌তেও জানে না। ওটা নিশ্চয় ডাইনী, বাড়ী থেকে দূর করে দাও।”

 অনেকদিন রাজা তার কথায় কান দেন নি। কিন্তু যখন সাত বছর হতে চল্ল, তবুও রাণী কথা কয় না, হাসে না, তখন সকলে রাজাকে বল্‌তে লাগল, “রাজামশাই, নূতন রাণী নিশ্চয় ডাইনী হবে। ডাইনীদের পুড়িয়ে মারতে হয়। ওকে পুড়িয়ে মেরে ফেলুন।” তখন রাজাও ভাবলেন, হয়ত তাই হবে। কাজেই তিনি তাদের কথায় রাজি হলেন।


মেয়ে ব’সে সেলাই করছে।
 তখন সবাই মিলে বােঝায় বােঝায় কাঠ এনে মস্ত আগুন জ্বেলে রাণীকে সেই আগুনে পােড়াতে চল্‌ল; রাজামশাই সভাশুদ্ধ সেইখানে তামাসা দেখ্‌তে এলেন। ঠিক সেই সময় সাত বছর শেষ হল।

 এমন সময়ে হয়েছে কি,—কোথা থেকে বারােটা দাঁড়কাক ‘কা-কা’ করে সেখানে উড়ে এসেছে, আর সেই বারােটা কাক মাটিতে নামতেই বারােটি রাজার ছেলে হয়ে গেছে।

 তারা সকলে মিলে তাড়াতাড়ি আগুণ নিবিয়ে দিয়ে রাজা মশাইকে সকল কথা বলে দিল। তা শুনে তিনি কি যে সুখী হলেন, কি বলব! তখন যারপরনাই আদর করে রাণীকে বাড়ী নিয়ে গেলেন। আর বার ভাই তাদের বাপ মায়ের কাছে ফিরে গেল।