ভাই বােন।

 ছােট ভাইটি তার ছােট্ট বােনটিকে বল্‌ল “দেখ বােন, আমাদের ত মা নাই বাবা নাই; সৎ মা আমাদের কত কষ্ট দেন, খেতে দেন না, কেবল মারেন, চল আমরা এখান থেকে চলে যাই।” এই বলে ভাই বােনের হাত ধরে,বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল। তখন বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তারা কত পথ কত মাঠ পার হয়ে, শেষে সন্ধ্যার সময় এক বনের ভিতর এসে পড়ল। সমস্ত দিন না খেয়ে আর হেঁটে হেঁটে তাদের বড় ঘুম পেয়েছিল, তাই তারা একটা গাছের কোটরের ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে রইল।

 যখন তাদের ঘুম ভাঙ্গল তখন সকাল হয়ে গিয়েছে, রােদ উঠেছে। ভাইটি বল্‌ল “বােন, আমার বড্ড ক্ষিদে আর জল তেষ্টা পেয়েছে। চলত দেখি কোথাও ঝরণা আছে কি না।”

 এদিকে হয়েছে কি, তাদের যে সৎ মা, সেটা ছিল ডাইনী। সে জান্‌তে পেরেছে যে তার সৎ ছেলে মেয়েরা মরেনি। সে লুকিয়ে লুকিয়ে বনে এসে, বনের সকল ঝরণার জলকে যাদু করে দিয়েছে। জল খুঁজতে খুঁজতে দুই ভাই বােন এক ঝরণার ধারে এলাে। কিন্তু ভাইটি যেই জল খেতে যাবে অমনি বােনটি শুন্‌তে পেল, ঝরণা যেন কুল কুল করে বল্‌ছে “খেওনা, খেওনা! আমার জল যে খাবে সে বাঘ হয়ে যাবে।” তা শুনে বোনটি তাড়াতাড়ি বল্ল, “দাদা ও জল খেয়োনা!” সে বল্‌ল, “আচ্ছা চল দেখি আর ঝরণা পাই কি না।” কিছু দূরে গিয়ে তারা আর একটি ঝরণা দেখতে পেল। কিন্তু ভাই যেই জল খেতে যাবে, অমনি ঝরণা বল্ল, কুল্, কুল্, কুল্, কুল্। জল খেওনা! খেলেই ছাগল হয়ে যাবে।” বোনটি সে কথা শুনতে পেয়ে তার ভাইকে জল খেতে বারণ করল। কিন্তু ভাইটি কিছু শুন্‌তে পায় নি, আর তার বড্ড জল তেষ্টা পেয়েছিল, তাই সে রাগ করে বল্‌ল, “তুমি বুঝি আমাকে জল খেতে দেবেনা। আমি জল তেষ্টায় মরে যাচ্ছি। এরপরে যে ঝরণা পাব তার জল আমি খাবই খাব।”

  খানিক দূর গিয়ে তারা আরেকটা ঝরণা দেখ্‌তে পেল, তাতে সুন্দর পরিষ্কার জল তক্‌ তক্‌ করছে। কিন্তু বোন শুনতে পেল ঢেউ গুলি বল্‌ছে, “জল খেওনা, খেওনা। খেলেই হরিণ হয়ে যাবে।” এবারেও সে তার ভাইকে জল খেতে বারণ করল, কিন্তু ভাই তার কোন কথাই শুন্‌ল না। সে দুহাতে করে জল নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে ফেল্ল—আর অমনি সে একটি হরিণ ছানা হয়ে গেল। তার বোন তখন কত কাঁদল। কিন্তু কেঁদে আর কি হবে, যা হবার তা’তো হয়েছে। তাই সে তার পায়ে থেকে রূপোর মল খুলে হরিণের গলায় পরিয়ে দিল, তারপর কচি ঘাসের দড়ি পাকিয়ে, সেই দড়ি দিয়ে হরিণছানাটিকে বেঁধে নিয়ে চল্‌ল।

 এমনি করে অনেক দূরে গিয়ে এক জায়গায় সে দেখ্‌ল যে বনের ভিতরে সুন্দর একটি লতাপাতার ঘর রয়েছে। সেই ঘরটিতে সে তার হরিণ ভাইকে নিয়ে থাক্‌তে লাগল। রােজ সে হরিণছানার জন্য কচি কচি লতা পাতা দিয়ে নরম বিছানা পেতে দেয়, নিজের হাতে ভাল ভাল ঘাস তুলে এনে তাকে খাওয়ায়, আর রাত্রে তার গায়ে মাথা রেখে ঘুমােয়।

 এমনি করে অনেকদিন কেটে গেল। একদিন খুব বাজনা বাজিয়ে ঘােড়ায় চড়ে এক রাজা সেই বনে শীকার কর্‌তে এলেন। বাজনা শুনে হরিণ বল্‌ল, “বােন, আমি শীকার দেখতে যাব। বােন বল্‌ল, “যাও, কিন্তু খুব সাবধান হয়ে থেকো। যখন ফিরে আসবে, তখন দরজা ঠেল্‌বে আর বল্‌বে ‘ছােট বােন, দরজা। খােল’, তবেই আমি দরজা খুল্‌ব, না হলে খুলব না।

 এ কথা শুনেই হরিণটি ছুটে শীকার দেখ্‌তে গেল। রাজামশাই দেখ্‌লেন, একটি সুন্দর হরিণছানা ছুটে চলে যাচ্ছে, তার গলায় রূপাের হাঁসুলি চক্‌ চক্‌ করছে। তাঁর লােকেরাও তাকে দেখ্‌তে পেল। কিন্তু দেখ্‌তে না দেখতেই হরিণ যে কোথায় লুকিয়ে পড়্‌ল, আর কিছুতেই তারা তাকে খুঁজে পেল না।

 তার পরদিনও বাজনা শুনে হরিণ শীকার দেখ্‌তে এলো। সেদিন রাজামশাই তাকে দেখ্‌তে পেয়েই তাকে ধরবার জন্য ছুটিয়ে লোক পাঠিয়ে দিলেন। | কিন্তু তাকে কি সহজে কেউ ধরতে পারে? রাজার লােক যত ছোটে হরিণও তত ছােটে। রাজার লােক তীর মেরে তার পা থেকে রক্ত বার ক’রে দিল, তবুও তাকে ধরতে পারল না।


হরিণ ভাই।
 সমস্ত দিন এমনি ছুটোছুটি করে, সন্ধ্যার সময় হরিণ ছানা সেই লতার ঘরের কাছে এসে দরজা ঠেলে যেই বল্‌ল “ছোট বোন দরজা খোল,” অমনি ভিতর থেকে দরজা খুলে গেল; হরিণ ঘরে ঢুকতেই আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কে খুল্‌ল কে বন্ধ করল রাজার লোক তার কিছুই বুঝতে পারল না।

 তখন সে রাজার কাছে ফিরে গিয়ে সব কথা তাঁকে বল্‌ল। তা শুনে রাজা আশ্চর্য্য হয়ে বল্‌লেন, “কাল আমি দেখব হরিণ কোথায় যায়। কিন্তু কাল তোমরা কেউ ওকে তীর ছুঁড়োনা।” হরিণছানা ঘরে ফিরে গেলে, বোন তার পায়ের রক্ত ধুয়ে ফেলে তাকে বিছানায় শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

 পরদিন সকাল হতে না হতেই আবার শীকারের বাজনা বেজে উঠল। অমনি হরিণছানাও আবার শীকার দেখতে যাবার জন্য ব্যস্ত হল। তার বোন কিন্তু সেদিন তাকে যেতে দিতে চাইল না; সে বল্‌ল, “কাল তোমার পায়ে তীর মেরেছে, আজ হয়ত তোমাকে মেরেই ফেল্‌বে।” হরিণ বলল, “না, আমি খুব সাবধান হয়ে থাক্‌ব। ওরা আমার কিছু করতে পারবে না। ওই শোননা কেমন বাজনা বাজ্‌ছে, আমার বড্ড যেতে ইচ্ছা করছে। সন্ধ্যা হলেই আমি ঠিক্ বাড়ী ফিরে আস্‌ব।” কাজেই তার বোন তাকে ছুটী না দিয়ে পারল না।

 সেদিন তাকে দেখতে পেয়ে রাজা নিজেই তাকে ধরতে এলেন। সমস্ত দিন সে ছুটে বেড়াল, রাজাকেও তার সঙ্গে ছুটতে হ’ল। কিন্তু সন্ধ্যা হবার একটু আগে তিনি হরিণকে ছেড়ে সেই লতার ঘরটি খুঁজে বা’র করলেন। তারপর সেই ঘরের দরজার কাছে গিয়ে তিনি বল্‌লেন, “ছোট বোন, দরজা খোল।” অমনি দরজা খুলে গেল। ঘরের ভিতর ঢুকেই রাজামশাই সেই মেয়েটিকে দেখ্‌তে পেলেন। এমন চমৎকার সুন্দর মেয়ে তিনি আর কখনও দেখেন নি। মেয়েটী প্রথমে রাজাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু তিনি তার সঙ্গে খুব মিষ্টি করে কথা বল্‌তে লাগ্‌লেন। রাজা বললেন, “আমি তোমাকে দেশে নিয়ে যাব, সেখানে গিয়ে তোমাকে আমার রাণী করব। তুমি যাবে?” মেয়েটি তার হরিণ ছানা ফেলে যেতে চাইল না। তখন রাজা বল্‌লেন, “হরিণও আমাদের সঙ্গে যাবে। সেখানে সে খুব যত্নে থাক্‌বে।” সন্ধ্যার সময় হরিণ বাড়ী ফিরে এল। তারপর রাজা দুজনকে নিয়ে তাঁর দেশে গেলেন। সেখানে খুব ধুমধাম করে মেয়েটীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হ’ল।

 তারপর রাজার বাড়ীতে দুজনে খুব সুখেই আছে। বোনটি রাণী হয়েছে, আর হরিণটি খুব যত্নে থাকে। কিছুদিন পরে সেই রাণীর একটি সুন্দর ছেলে হ’ল। রাজা তখন দেশে ছিলেন না, শীকার করতে গিয়েছিলেন।

 এর মধ্যে হয়েছে কি, সেই যে তাদের ডাইনী সৎ মা, সে কি করে সব খবর পেয়েছে। খবর পেয়েই ত তার মনে হিংসা আর ধর্‌ছে না। তার একটা মেয়ে ছিল, সে সেই রাণীর বয়সী। ডাইনী ভাবল, সৎ মেয়েটাকে মেরে আমার মেয়েকে রাণী করতে হবে।” যেমন এই কথা ভাবা, অমনি হতভাগী তার মেয়ে শুদ্ধ সেই রাজার দেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। তারপর নিজেদের চেহারা বদলিয়ে দুজনে রাজার বাড়ীতে গিয়ে ঝি হ’ল। শেষে একদিন রাত্রে, যখন সকলে ঘুমিয়েছিল, সেই সময় দুষ্ট ডাইনী রাণীকে মন্ত্র পড়ে রাজহাঁস বানিয়ে বাগানের পুকুরে ছেড়ে দিল; আর নিজের মেয়েকে এনে রাণীর পোষাক পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে রাখ্‌ল।

 রাজামশাই শীকার থেকে ফিরে এসে শুন্‌লেন যে তাঁর ছেলে হয়েছে। তাতে তিনি খুব খুসী হয়ে তাড়াতাড়ি ছেলে দেখ্‌তে বাড়ীর ভিতর যাচ্ছেন, এমন সময় ডাইনী ঝিটা ছুটে এসে বল্‌ল, “এখন রাণীর ঘরে যাবেন না, তাঁর বড্ড অসুখ করেছে। ডাক্তারেরা কাউকে সে ঘরে যেতে মানা করেছেন।” রাজা ত জানেন না দুষ্টু ডাইনী কি করেছে, তিনি মনে করলেন বুঝি সত্যি।

 সেদিন দুপুর রাত্রে, রাজার বাগানের পাহাড়াওয়ালা দেখ্‌তে পেল, বাগানের পুকুরে একটী শাদা ধব্‌ধবে রাজহাঁস এসেছে। পাহাড়ওয়ালাকে দেখে হাঁসটি তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “রাজা কি করছেন?”

 পাহাড়াওয়ালা বল্‌ল, “ঘুমচ্ছেন।”

 হাঁস বল্‌ল, “আমার খোকা কি করছে?”

 পাহাড়াওয়ালা বল্‌ল, “ঘুমচ্ছে।”

 হাস বল্‌ল, “আমার হরিণ কি কর্‌ছে?”

 পাহাড়াওয়ালা বল্‌ল, “ঘুমচ্ছে।”

 তখন হাঁস “আমি, কাল আবার আস্‌ব” বলে চলে গেল।

 সকালে উঠেই পাহাড়াওয়ালা, রাত্রে যা দেখেছিল সবগিয়ে রাজাকে বল্‌ল। রাজা খুব আশ্চর্য্য হয়ে ভাবলেন “তাইত এর মানে কি?” সেদিন রাত্রে পাহাড়াওয়ালার সঙ্গে রাজামশাই ও বাগানে গিয়ে লুকিয়ে রইলেন। দুপুর রাত হতেই রাজহাঁস, আগের দিনের মত আবার এসে পাহাড়াওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল “রাজা কি করছেন?”

 “আমার খোকা কি কর্‌ছে?”

 “আমার হরিণ কি করছে?

 পাহাড়াওয়ালা যখন বল্‌ল সকলে ঘুমচ্ছে, তখন হাঁস ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় রাজা এসে দেখা দিলেন। রাজাকে দেখে হাঁস বল্ল “রাজামশাই, রাজামশাই, আপনার তলোয়ারটি আমার মাথার চারিদিকে তিনবার ঘোরান।” রাজা যেই তার মাথার চারদিকে তিনবার তলোয়ার ঘুরিয়েছেন অমনি সেই রাজহাঁসের জায়গায় তাঁর সত্যি রাণী এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। রাজা আশ্চর্য্য হয়ে বল্লেন, “এ কি?” তখন দুষ্ট ডাইনির সব দুষ্টমি ধরা পড়্‌ল। রাজা ত রেগে তলোয়ায় নিয়ে তখনি ডাইনী আর তার মেয়েকে কাটেন আর কি! রাণী তাঁর পায়ে ধরে বল্‌লেন, “মারবেন না। হাজার হোক আমার সৎ মা সৎ বোন ত! তবে, ওঁকে বলুন যে আমার ভাইকে আবার মানুষ করে দিতে হবে।

 তখন রাজা ডাইনীকে বল্‌লেন, “এখনি হরিণ ছানাকে ফিরে মানুষ করে দে, তা না হলে এই তোদের কেটে ফেল্‌ছি।”

 ডাইনি ভয়ে কাঁপ্‌তে কাঁপ্‌তে কি যেন মন্ত্র পড়্‌ল, আর অমনি হরিণের জায়গায় রাণীর ছোট ভাই এসে দাঁড়াল।

 তারপর দুষ্টু ডাইনী আর তার মেয়েকে মাথায় ঘোল ঢেলে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হ’ল।