সুন্দরী।

 এক সওদাগরের তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ে দেখতে সুন্দর, কিন্তু তারা ভারি রাগী আর হিংসুটে। সমস্ত দিন তারা সাজ পােষাক নিয়েই থাকে। ছােট মেয়েটি যেমন লক্ষ্মী, সুন্দরও তেমনি; আর তার মুখে সকল সময়ই হাসি। তাকে সকলেই ভালবাসে, আর ‘সুন্দরী’ বলে ডাকে।

 সওদাগরের অনেক টাকা। দামী দামী জিনিষ বােঝাই হয়ে তাঁর জাহাজ দেশবিদেশে যায়।

 একদিন সওদাগরের কাছে খবর এল, ঝড়ে তাঁর সব জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে। শুনেই ত তিনি মাথায় হাত দিয়ে ব’সে পড়্‌লেন। হায়, হায়, সর্ব্বনাশ হল! কত জিনিষ কত টাকাকড়ি নিয়ে তাঁর জাহাজ আস্‌ছিল, সব গেল। এখন ত তিনি বড় গরীব হয়ে পড়েছেন, তাই তাঁর সেই প্রকাণ্ড বাড়ী আর লােকজন সব ছেড়ে দিয়ে তাঁকে এখন একটি ছােট্ট বাড়ীতে গিয়ে নিতান্ত গরীবের মত থাক্‌তে হল।

 ছােট্ট বাড়ী দেখেই ত বড় দুই মেয়ের ভারী রাগ হল। তাদের আর কিছুই ভাল লাগে না, কেবল কথায় কথায় খুঁৎ খুঁৎ করে। কিন্তু ছোট মেয়ে সুন্দরীর মুখে হাসিটি লেগেই আছে। সে সমস্ত দিন বাড়ীর কাজ করে, রান্না করে, ঘর পরিষ্কার করে, বাবাকে দেখে, আর রাত্রিতে তার ছােট্ট বিছানাটিতে মনের সুখে ঘুমিয়ে থাকে। ভাের হ’তে না হ’তেই উঠে আবার ঘরের কাজ করে। তাই তিনটি মেয়ের মধ্যে সওদাগর ছােটটিকেই সব চেয়ে বেশী ভালবাসেন। বড় দুই বােন তার হিংসায় আর বাঁচেনা।

 অনেকদিন পর একদিন আবার খবর এল যে সওদাগরের একখানা জাহাজ পাওয়া গিয়েছে। সে জাহাজখানাও ঝড়ে পড়েছিল, অনেক কষ্টে বেঁচেছে। কিন্তু অনেক দূরে কোন এক দেশে সেখানা বালিতে আট্‌কিয়ে গিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আন্‌তে একবছর লাগ্‌বে।

 সওদাগর তাঁর তিন মেয়েকে ডেকে বল্‌লেন, “আমি অনেক দূরে জাহাজ আনতে যাচ্ছি, এক বছর পরে ফির্‌ব। বল ত মা তােমাদের কা’র জন্য কি জিনিষ আন্‌ব?”

 বাবা চ’লে যাবেন শুনে ছােট মেয়েটি কাঁদ্‌তে লাগ্‌ল। বড় মেয়ে বল্‌ল, “আমার জন্য একখানা খুব চমৎকার শাড়ী এনো।” মেঝ মেয়ে বল্‌ল, “আমার জন্য একছড়া মুক্তার মালা এনাে।” ছোট মেয়ে সুন্দরী কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে বল্‌ল, “আমি কিছু চাই না বাবা। তুমি ফিরে এলেই আমি খুসী হব।” সওদাগর বল্‌লেন, “তা কি হয় মা? সকলের জন্য জিনিষ আস্‌বে, তােমার জন্য আস্‌বে না? বল, তােমার কি ভাল লাগে।” তখন সুন্দরী বল্‌ল, তা’হ’লে আমার জন্য একটি শাদা ধব্‌ধবে গােলাপ ফুল এনাে।”

 এক বছর প্রায় হয়ে এসেছে। জাহাজ নিয়ে সওদাগর দেশে ফিরছেন। তিনি বড় মেয়ের জন্য শাড়ী, মেঝ মেয়ের জন্য মালা এনেছেন। কিন্তু সাদা গােলাপ ফুল আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন। না। সে দেশে গােলাপ ফুলই হয় না; শাদা গােলাপ ত দূরের কথা। যা’কে জিজ্ঞাসা করেন সেই বলে, “কই, সাদা গোলাপ ত কখনো দেখিনি।”

 এর মধ্যে একদিন সওদাগর এক সহর থেকে আর এক সহরে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক জঙ্গলে এসে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর খুবই পরিশ্রম হয়েছে, ঘুমও পেয়েছে। কিন্তু বনের মধ্যে কোথায় বিশ্রাম কর্‌বেন? তিনি খালি এই কথা ভাবছেন আর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘুর্‌তে ঘুর্‌তে শেষে দেখ্‌লেন একটা প্রকাণ্ড বাড়ী। তা’তে তিনি ভারি আশ্চর্য্য হয়ে বল্লেন, “তাইত, এই বনের ভিতরে এত বড় বাড়ী কোত্থেকে এল!” এই বলে যেই তিনি সেই বাড়ীর দরজায় ঘা দিয়েছেন, অমনি দরজা খুলে গিয়েছে। সেখানে লোকজন কেউ নাই, কে যে দরজা খুল্‌ল, কিছুই বোঝা গেল না। সওদাগর কেবল দেখলেন শূন্যে থেকে দুখানা হাত তাঁকে নমস্কার কর্‌ছে আর ভিতরে যাবার জন্য ডাক্‌ছে। তিনি বল্‌লেন, “ঘোড়াটাকে বাইরে রেখে কি ক’রে যাই?” অমনি কোত্থেকে আর দুখানা হাত এসে ঘোড়ার গায়ে হাত বুলাতে লাগ্‌ল, আর তাকে আস্তাবলের দিকে নিয়ে চল্‌ল। তখন তিনি মনে কর্‌লেন, “এটা তবে বুঝি ভূতের বাড়ী।” তাঁর ভারি ভয় হল, কিন্তু তাঁর এতই পরিশ্রম হয়েছিল যে তবু তিনি ভিতরে না ঢুকে পার্‌লেন না। ঢুকতেই সেই হাত দু’খানা তাঁকে ডেকে নিয়ে একটা ঘরে বসাল। সেখানে, লুচি সন্দেশ মিঠাই মোণ্ডা সব থালা ভ’রে সাজান ছিল। সওদাগর তা’ দেখেই অমনি খেতে আরম্ভ কর্‌লেন।
সিংহ এসে সওদাগরের সাম্‌নে দাঁড়িয়েছে।
তখন চারদিক থেকে আরও অনেক গুলি হাত এসে, কেউ তাঁকে বাতাস কর্‌ছে, কেউ জল এনে দিচ্ছে, কেউ সরবৎ এনে দিচ্ছে। এম্‌নি করে খাওয়া হ’লে তারা তাঁকে শােবার ঘরে নিয়ে গেল। সেটা অতি চমৎকার ঘর, আর তাতে আরো চমৎকার নরম বিছানা! সওদাগর সমস্ত রাত খুব সুখেই ঘুমলেন।

 সকালে উঠে, আস্তাবল থেকে ঘােড়া নিয়ে, তিনি বার হলেন। সে বাড়ীর চারদিকে প্রকাণ্ড বাগান। ফল ফুলের গাছ কতই আছে তেমন তিনি কখনও দেখেননি। একটি গােলাপের গাছে এই বড় বড় শাদা ফুল ফুটে রয়েছে! তার কি চমৎকার গন্ধ! তা’ দেখে সওদাগর মনে কর্‌লেন, “এই ত আমার ছােটমেয়ের জিনিষ পেয়েছি। এখানকার হাতগুলি আমাকে এত যত্ন করল, আর একটা ফুল নিলে কি তা’রা বিরক্ত হবে? কখনই না!” এই ভেবে তিনি বেছে সবচেয়ে বড় গােলাপটি তুলে নিলেন।

 যেই ফুল তােলা অমনি এমন ভয়ানক শব্দ হল যে কি বল্‌ব! সেই শব্দ শুনেই সওদাগরের হাত থেকে ফুলটি প’ড়ে গেল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ে দেখলেন, এই বড় এক সিংহ এসে তাঁর সাম্‌নে দাঁড়িয়েছে। সে চোখ ঘুরিয়ে লক্‌লকে জিভ বার করে দাঁত খিঁচিয়ে বল্‌ল, “কেন আমার ফুল ছিঁড়্‌লে? আমি এখনি তােমাকে খাব।”

 সওদাগর হত যােড় ক’রে বল্লেন, “আমার অন্যায় হয়েছে, মাপ কর। আমি ত জান্‌তাম না এ তােমার বাগান। আমার ছােট মেয়ে একটি সাদা গােলাপ ফুল চেয়েছিল, তােমার বাগানে সে ফুল দেখে, আমি একটি নিয়েছিলাম।”

 সিংহ বলল, “আচ্ছা, তােমাকে আমি খাব না, কিন্তু তােমাকে এক কাজ কর্‌তে হবে। দেশে গিয়ে বাড়ীতে ঢুক্‌তেই প্রথম যা’কে দেখ্‌তে পাবে তাকে এক মাসের মধ্যে আমার কাছে নিয়ে আস্‌বে!”

 সওদাগর ভাব্‌লেন, “বাড়ীতে ঢুতেই প্রথমে আর কা’কে দেখ্‌ব, দেখ্‌ব ত আমার কুকুরটা দরজার কাছে ব’সে আছে।” এই ভেবে তিনি বললেন, “তাই হবে। বাড়ী যেতেই প্রথম যাকে দেখ্‌ব তা’কে একমাসের মধ্যে তােমার কাছে নিয়ে আস্‌ব।”

 সিংহ বল্‌ল, “ফুলটা তােমার মেয়ের জন্য নিয়ে যাও। এক মাস পর যখন আস্‌বার সময় হবে, এই ফুল হাতে নিয়ে, আমার বাড়ী আস্‌তে চেয়ো তা’হলেই এখানে এসে পড়্‌বে।”

 পথে যেতে যেতে কিন্তু সওদাগরের মনে ভয় হ’তে লাগ্‌ল, কেন এমন প্রতিজ্ঞা কর্‌লাম। কুকুরটা যদি দরজার কাছে না থাকে, ঢুকেই যদি সুন্দরীকে দেখ্‌তে পাই?”

 যা ভেবে ছিলেন, তাই হ’ল। সওদাগর বাড়ীর দরজা খুল্‌তে না খুল্‌তেই সুন্দরী “বাবা, বাবা,” করে ছুটে এল। হায় হায়, কেন এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন! তার চেয়ে সিংহ তাঁকে খেয়ে ফেল্‌লেও ত ভাল ছিল! এখন যে সুন্দরীকে সিংহের কাছে নিয়ে দিতে হবে! সওদাগরের চোখ দিয়ে জল পড়্‌তে লাগ্‌ল। তা’দেখে সুন্দরী ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “বাবা তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কি অসুখ করেছে?” তখন তিনি কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে তাকে সব কথা বল্‌লেন। সুন্দরী বল্‌ল, “তুমি যখন প্রতিজ্ঞা ক’রেছ তখন তা কর্‌তেই হবে। আমাকে সেইখানে নিয়ে চল, তার জন্য তুমি কিছু ভেবোনা।”

 একমাস প্রায় হয়ে এল। সুন্দরীকে সিংহের কাছে নিয়ে যেতে সওদাগরের মোটেই ইচ্ছা হচ্ছে না। তিনি বললেন, “না, সে কখনো হ’তে পারে না। গিয়ে কাজ নেই। না গেলে সিংহ আর বেশী কি কর্‌বে, না হয় আমাকে খেয়ে ফেল্‌বে।”

 কিন্তু সুন্দরী কিছুতে শুন্‌ল না। সে বল্ল, “তুমি যখন প্রতিজ্ঞ করেছ তখন আমাকে যেতেই হবে।”

 কাজেই সওদাগর আর কি করেন? একমাস হয়ে এল, তাঁরা যাবার জন্য ঠিক হলেন। সেই গোলাপটি তখনও একেবারে টাটকাই ছিল। সওদাগর সেটি হাতে নিয়ে বল্‌লেন যে, “আমি আর সুন্দরী সিংহের বাড়ী যাব।” অমনি দেখেন তাঁরা দুজনে সেই বনের ভিতর সিংহের বাড়ীর দরজার সাম্‌নে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ীর ভিতরে ঢুকে তাঁরা কাউকে দেখতে পেলেন না, কেবল, আগের মত দু’খানা হাত এসে তাঁদের নমষ্কার ক’রে ডেকে নিয়ে গেল।

 তাঁদের দুজনের জন্য খাবার তৈরি ছিল। খাবার সময় অনেকগুলি হাত এসে তাঁদের সেবা কর্‌তে লাগল। খাওয়া শেষ হলে শুন্‌তে পেলেন কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। তা শুনে সওদাগর যেই বল্লেন, “ভিতরে এস”, অমনি দরজা খুলে সেই সিংহটা ঘরে এসে ঢুক্‌ল। সিংহকে দেখে সুন্দরী ত একেবারে ভয়ে জড় সড়। সওদাগর তাঁকে নমস্কার ক’রে বল্লেন, “এই আমার ছোটমেয়ে সুন্দরী। আমি বাড়ী গিয়ে ওকেই সকলের আগে দেখ্‌তে পেলাম, তাই তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।”

 সিংহ বল্‌ল, ‘আমি মনে করিনি তোমরা আস্‌বে। এসেছ দেখে খুব খুসী হলাম। তোমাকে কিন্তু কাল সকালেই বাড়ী ফিরে যেতে হবে। আর তোমার মেয়ে আমার কাছে থাক্‌বে। তুমি তার জন্য কিছু ভেবোনা। এখানে তার কোন কষ্ট হবে না।”

 পরদিন সকালে সওদাগর দেশে ফিরে গেলেন। সুন্দরী সেই প্রকাণ্ড ভূতের বাড়ীতে একলা প’ড়ে রইল। তার কোন কষ্ট নেই। সেই হাতেরা সব সময়ে তার কাছে কাছে রয়েছে, যখন যা দরকার তখনি এনে দিচ্ছে। স্নানের সময় স্নানের ঘরে গিয়ে সুন্দরী দেখ্‌ল তার জন্য শাদা পাথরের চৌবাচ্চা ভরা গোলাপ জল রয়েছে, কত ভাল ভাল তেল, আর আলনা ভরা সুন্দর সুন্দর শাড়ী সাজান রয়েছে। খাবার সময় খাবার সব তৈরী। সুন্দরী খেতে বস্‌তেই চারদিক থেকে বাজনা বেজে উঠ্‌ল। সে বাড়ীর সবই চমৎকার, সবই আশ্চর্য্য। একঘরে নানান রকম খেলনা সাজান আছে, আরেক ঘরে সুন্দর সুন্দর বই; আর এক ঘরে লাল নীল হলদে পাখী সোণার খাঁচায় ব’সে গান কর্‌ছে। সমস্তদিন সুন্দরী সব ঘুরে ঘুরে দেখ্‌ল। অত বড় বাড়ীতে একলা তার বড় ভয় কর্‌ছিল, তা’ নইলে এগুলি তার ভালই লাগ্‌ত।

 সন্ধ্যার সময় আবার সিংহ এসে হাজির। সে সুন্দরীকে বল্‌ল, “আমি কি তোমার সঙ্গে বসে একটু গল্প কর্‌ব?” সুন্দরী ভাব্‌ল, “যদি ‘না’ বলি, তা’ হ’লে হয় তো আমাকে খেয়েই ফেলবে; তাই সে বল্‌ল “আচ্ছা।” সিংহ এখন ভারি খুসী হয়ে বসে তা’র সঙ্গে গল্প করতে লাগল। সিংহ তা’কে বল্‌ল, “তুমি এখানে কিছু ভয় পেওনা। এ বাড়ীর সব তোমার, তোমার যখন যা’ দরকার, চাইলেই তা’ পাবে।” সিংহটার কথাগুলি খুব মিষ্টি, কিন্তু সুন্দরী যতবার তার মুখের দিকে চায়, ততবার ভয়ে তার বুকের ভিতর ধড়াস্‌ করে ওঠে, আর ছুটে পালাতে ইচ্ছা করে। এম্‌নি ভাবে খানিকক্ষণ গল্প ক’রে সিংহ চ’লে গেল, সুন্দরী ও ঘুমতে গেল।

 এম্‌নি করে, রোজ সন্ধ্যার সময় সিংহ এসে বলে, “গল্প কর্‌ব?” আর সুন্দরী বলে, “হাঁ”। ক্রমে একটু একটু করে সুন্দরীর ভয় কম্‌তে লাগল। তখন সে দেখ্‌ল যে সিংহের চেহারাটা ভয়ানক হ’লেও তার মনটি বড়ই ভাল। ক্রমে ক্রমে সিংহের সঙ্গে তার বেশ ভাব হ’য়ে গেল। শেষটায় একদিন সিংহ সুন্দরীকে বল্ল, “আমাকে বিয়ে কর্‌বে?” এ কথায় সুন্দরীর বড়ই ভয় হ’ল, সে কিছুতেই রাজি হলনা। তা’তে সিংহ ভারি দুঃখিত হয়ে চলে গেল।

 সেদিন রাত্রে সুন্দরী স্বপ্ন দেখ্‌ল যে তার বাবার যেন খুব অসুখ করেছে, তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন, কিন্তু তাঁ’র কাছে তাঁকে দেখ্‌বার কেউ নেই। তার বোনেরা যেন আর এক ঘরে ব’সে ব’সে সাজ পোষাক কর্‌ছে। দেখে তার মন ভারি খারাপ হয়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যার সময় সিংহ আস্‌তেই সে দৌড়ে গিয়ে তাকে বল্‌ল, “আমি অনেকদিন বাড়ী যাইনি। একবার বাবাকে দেখ্‌তে বড় ইচ্ছা কর্‌ছে। কাল রাত্রে আমি স্বপ্ন দেখেছি যেন তাঁর খুব অসুখ।”

 সিংহ বল্‌ল, “আচ্ছা যাও, কিন্তু ঠিক সাতদিনের দিন ফিরে এস।” সুন্দরী বল্‌ল, “কি ক’রে যাব, আর ফিরে আস্‌ব কি করে?” সিংহ তাকে একটা শাদা গােলাপফুল দিয়ে বল্‌ল, “এই ফুলটা হাতে করে তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পার্‌বে। সাতদিন পর এই ফুল হাতে নিয়ে এখানে ফিরে আস্‌তে চেয়ো, তা’ হলেই ফুল তােমাকে নিয়ে আস্‌বে।”

 পরদিন সকালে সুন্দরী গােলাপফুল হাতে নিয়ে বাড়ী যেতে চাইল, আর অমনি সে তাদের বাড়ীতে, তার বাবার ঘরে এসে পড়্‌ল। সত্যি সত্যিই সওদাগরের অসুখ করেছিল। কিন্ত সুন্দরীকে দেখে তিনি এত খুসী হলেন যে তখনি তাঁর অর্দ্ধেক অসুখ সেরে গেল। তার বড় বােনেরা তাকে দেখ্‌তে ছুটে এল। তখন তার সুন্দর পােষাক দেখে, আর তার কাছে সিংহের বাড়ীর গল্প শুনে, তাদের ত আর হিংসা ধরে না! তারা কেবল ভাব্‌তে লাগল কি করে তাকে জব্দ কর্‌বে। একদিন তারা কর্‌ল কি, সুন্দরীর ঘর থেকে তার শাদা গোলাপ ফুলটি চুরি ক’রে নিয়ে পালিয়ে এল। তারা শুনেছিল যে সেই ফুল হাতে নিয়ে যেখানে ইচ্ছা যাওয়া যায়। তাই তারা ফুল হাতে নিয়ে বল্‌ল, “আমাদের খুব সুন্দর আর খুব বড় বাড়ীতে নিয়ে যাও।” এ কথা বল্‌তে বল্‌তেই একটা ভয়ানক শব্দ হল, যেন কোন রাক্ষস, না কি তাদের খেতে আস্‌ছে। সেই শব্দ শুনে তারা দুজন ভয়ে কাঁপ্‌তে কাঁপ্‌তে তাড়াতাড়ি ফুলটাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে পালাল।

 এদিকে সুন্দরী বাবার কাছে এসে এত খুসী হয়েছে যে সাত দিনের দিন সিংহের কাছে ফিরে যাবার কথা আর তার মনেই নেই। তারপর হটাৎ যখন একদিন সে কথা তার মনে পড়্‌ল, তার ঢের আগেই সাত দিন হয়ে গিয়েছে। তখন সুন্দরীর মনে বড় দুঃখ হ’ল আর লজ্জা হ’ল। সে তাড়াতাড়ি তার ঘরে ফুল আন্‌তে গিয়ে দেখ্‌ল সেখানে ফুল নেই! খুঁজতে খুঁজতে সে তার বােনদের ঘরে গিয়ে দেখল যে ফুলটি শুকিয়ে মাটিতে প’ড়ে আছে। যেই সুন্দরী সেই ফুলটি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল, অমনি সেটি আবার আগের মত তাজা হয়ে উঠ্‌ল। তখন তার বােনদের কাছে আর বাবার কাছে বিদায় নিয়ে সে সিংহের বাড়ীতে ফিরে এল। কিন্তু এসে দেখে একি! চারদিকের সে সুন্দর বাগান একে বারে জঙ্গল হয়ে গেছে। বাড়ীর ভিতরে গিয়ে দেখে সেখানেও জিনিষ পত্র সব চারদিকে ছড়ান, কেউ যেন দেখবার নেই। সেই হাতগুলি আগের মতনই সব কাজ কর্‌ছে, কিন্তু তাদের যেন তেমন জোর নেই। সেদিন আর খাবার সময় বাজ্‌না বাজ্‌ল না। সন্ধ্যার সময় সুন্দরী ভাব্‌ছে “এখনই সিংহ আস্‌বে। সে হয়ত কত রাগ করেছে। তা’কে বল্‌ব যে আর আমি কখন এমন কর্‌ব না।”

 কিন্তু কই সিংহ ত এল না! সমস্ত রাত সুন্দরীর ভাল করে ঘুম হ’ল না, কেবল মনে হতে লাগল, “তবে কি সিংহ খুব রাগ করেছে? নাকি তার অসুখ করেছে? সে আমাকে এত যত্ন করে, কেন আমি তার কথা শুন্‌লাম না!”

 সকাল হতেই সুন্দরী উঠে সমস্ত বাড়ীময় সিংহকে খুঁজল কিন্তু কেথাও তাকে দেখ্‌তে পেল না। তারপর বাগানে খুঁজ্‌তে গেল। বাগানও জঙ্গল হয়ে আছে। সেখানেও অনেকক্ষণ তাকে খুঁজে পেল না। শেষে হটাৎ দেখ্‌ল এক গাছের নীচে সে মরার মত হয়ে পড়ে আছে। অমনি ছুটে তার কাছে গিয়ে সুন্দরী কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে বল্‌ল, “সিংহ, সিংহ ওঠ। তোমার কি অসুখ করেছে? আমি আর কখন এমন কর্‌ব না। তখন সিংহ চোখ চেয়ে বল্‌ল “বল আমাকে বিয়ে কর্‌বে কি না?”

 সুন্দরী বলল, “তাতে তুমি যদি ভাল হও, নিশ্চয় কর্‌ব।” কি আশ্চর্য্য! এ কথা বল্‌তে বল্‌তেই চারদিকে বাজ্‌না বেজে উঠল, সে জঙ্গল কোথায় চলে গেল, বাগানের সমস্ত ফুল ফুটে উঠল চারদিকে পাখী গান কর্‌তে লাগল। আর সিংহ? সুন্দরী চেয়ে দেখে সিংহ ত নাই, তার জায়গায় এক রাজার ছেলে দাঁড়িয়ে আছেন।

 রাজার ছেলে বললেন, “এ বাড়ী, এ বাগান সব আমার। এক যাদুকর আমাকে সিংহ করে দিয়েছিল, আর বলেছিল, যদি কোন সুন্দরী মেয়ে আমাকে বিয়ে কর্‌তে রাজি হয় তবে আমি মানুষ হব।”

 এদিকে সে বাড়ীর চাকর বাকরেরা, যাদের শুধু হাত ছিল। আর কিছু ছিল না, তারাও সকলে মানুষ হয়ে গেল। চারদিক লােক জনে ভরে গেল। তখন রাজার ছেলে সুন্দরীকে নিয়ে সওদাগরের বাড়ী গেলেন। তাঁর মুখে সকল কথা শুনে আর সওদাগরের সুখের সীমা রইল না। আর সুন্দরীর সেই বােন দুটোর ত খুবই হিংসা হল। কিন্তু হিংসা করে তারা কি কর্‌বে? সেই হিংসায় জ্বলে পুড়ে তারা নিজেরাই খুব সাজা পেল।