গল্পের বই/হরি আর গিরি
হরি আর গিরি।
হরি আর গিরি দুটি ভাই বোন। তাদের মা নাই; বাপ আছে আর সৎ মা আছে। তারা এতই গরীব, যে বোজ দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না।
একদিন রাত্রে হরি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুন্তে পেল তাদের সৎমা তাদের বাবাকে বল্ছে, “হরি আর গিরিকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দাও। আমরা ওদেরও ভাল করিয়া খেতে দিতে পারি না, নিজেরাও পেট ভরে খেতে পাইনা। ওদের তাড়িয়ে আমরা দুজনে এক রকম খেয়ে পরে থাক্তে পার্ব।”
তা শুনে তাদের বাবা বল্ল, “কখন না, তা কি হয়? আমরা না খেয়ে মরি সে ও ভাল তবু ওদের তাড়াতে পার্ব না।”
কিন্তু সৎ মা খুব তেজ কর্তে লাগ্ল, “ওদের না তাড়ালে চল্বেই না। শেষে আমরা না খেয়ে মর্ব না কি? চল এক কাজ করি। কাল সকালে কাঠ কাট্তে যাচ্ছি ব’লে, ওদের নিয়ে বনে যাব। তারপর তারা যখন খেলা কর্তে কর্তে আমাদের কথা ভুলে যাবে তখন তাদের ফেলে বাড়ী চলে আস্ব। অত বনের ভিতর থেকে তারা কখন পথ চিনে বাড়ী আস্তে পারবে না।” এমনি করে অনেক বকুনি খেয়ে তাদের বাবা আর তাদের সৎমর সঙ্গে পেরে উঠ্ল না। কাজেই সে তার কথায় রাজি হল।
হরি সবই শুন্ল; শুনে আর ঘুম হল না। সে খানিক চুপ ক’রে শুয়ে থেকে, সকলে ঘুমুলে পরে উঠে বাইরে গেল। বাইরে। পথের দুধারে অনেক শাদা শাদা নুড়ী পাথর পড়ে আছে, হরি কাপড়ের কোঁচড় ভ’রে সেই সব পাথর কুড়িয়ে নিয়ে, ঘরে। এসে ঘুমিয়ে রইল।
পরদিন সকাল হতে না হতেই সৎমা তাদের জাগিয়ে বল্ল, “ওঠ্ ওঠ্! বনে কাঠ কাটতে যেতে হবে সন্ধ্যার সময় বাড়ী ফিরে আস্ব। ঘরে আর কিছু খাবার নেই, দুটো রুটী আছে। তােরা দুজনে সমস্ত দিন ঐ রুটী খেয়ে থাক্বি।” বলে সে তাদের দুজনকে দুখানা রুটী দিল। তারপর সকলে মিলে কাঠ কাট্তে চল্ল।
হরি চল্ছে আর কেবল পিছন ফিরে ফিরে কি যেন কর্ছে। তার বাবা বল্ল, “হরি কি করছিস্? অত পিছনে পড়ে থাকছিস্ কেন?” হরি বল্ল, “জানালার উপর বেড়াল ছানাটা বসে আছে। তাই দেখ্ছি।” তার বাবা ধমক দিয়ে বল্ল, “না, বেড়াল ছানা দেখ্তে হবে না। শীগ্গীর চল্।”
বেড়াল ছানার কথা কিন্তু সবই ফাঁকি। আসলে হরি করেছে কি, কোঁচড় ভরে যে নুড়ী পাথর এনেছে, তারি একটা একটা করে পথে ফেল্তে ফেল্তে যাচ্ছে।
বনে গিয়ে হরি আর গিরিকে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে তাদের বাবা বল্ল, “তােরা এখানে বসে খেলা কর্। আমরা কাঠ কাটতে যাই। যতক্ষণ না আমরা ফিরে আসি ততক্ষণ তােরা কোথাও যাস্নে যেন।” এই বলে তারা তাদের সেখানে রেখে চলে গেল।
দুটি ভাই বোনে সমস্ত দিন ধরে খেলা কর্ছে, তবু তাদের বাপ মা ফিরে আস্ছে না। সন্ধ্যা বেলায় তাদের ক্ষিদে পেয়েছে, ঘুম পেয়েছে, কিন্তু তখনও তাদের বাপ মা তবু আস্ছে না। হরি বুঝতে পার্ল তারা তাদের ফেলে পালিয়ে গেছে। গিরি ভয়ে চীৎকার করে কাঁদ্তে লাগ্ল। হরি তাকে অনেক বুঝিয়ে বল্ল, “ভয় নেই বোন্। একটু পরেই চাঁদ উঠ্বে। আমি রাস্তায় নুড়ী পাথর ফেলে এসেছি। চাঁদ উঠলেই সেই পাথর দেখে দেখে আমরা বাড়ী যাব।” খানিক পরেই চাঁদ উঠ্ল আর তার আলোতে নুড়ীগুলো ঝক্ ঝক্ করতে লাগ্ল। তখন সেই পাথর গুলো দেখে পথ চিনে বাড়ী যেতে তাদের কোন কষ্টই হলনা।
তারা বাড়ী ফিরে এসেছে দেখে তাদের বাবা খুব খুশী হল। তাদের সৎমা বল্ল, “আরে তোরা কোথায় ছিলি? আমরা যে তোদের ডেকে ডেকে না পেয়ে চলে এলাম।” সেদিন রাত্রেও হরি শুন্তে পেল, তাদের সৎ মা আবার তাদের বনে ফেলে আস্বার ফন্দি করছে। সেদিনও সকলে ঘুমলে পর সে পাথর কুড়োবার জন্য উঠ্ল, কিন্তু তার সৎমা আগেই দরজায় তালা দিয়ে রেখেছিল, তাই পাথর কুড়োতে পার্ল না।
পরদিন ভোরে তাদের সৎমা আবার তাদের দুজনের হাতে দুখানা রুটী দিয়ে কাঠ কাট্বার কথা ব’লে বনে নিয়ে গেল। আজ ত আর পাথর কুড়োন হয় নি, তাই হরি আজ তার রুটীখানাকেই ছিঁড়ে তার টুক্রো রাস্তায় ফেল্তে ফেল্তে চল্ল। আজও তাদের এক জায়গায় বসিয়ে রেখে তাদের বাপ মা কাঠ
মিঠাই মণ্ডার বাড়ীতে হরি আর গিরি। কাট তে চলে গেল, আর বলে গেল, “যতক্ষণ আমরা না আসি, ততক্ষণ কোথাও যাস্না।” তারা ভাই বোনে সমস্ত দিন খেলা করে, একখানা রুটী দুজনে ভাগ করে খেয়ে, বসে আছে; সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, কিন্তু বাবা কি সৎমা কারোর দেখা নেই। গিরি ত কাঁদতে আরম্ভ কর্ল। হরি বল্ল, “ভয় নাই। চাঁদ উঠ্লেই আমরা বাড়ী যাব।” চাঁদ যখন উঠ্ল, তখন তারা আর সেই রুটীর টুকরোর একটি ও খুঁজে পেল না। তার আগেই পাখীতে সব খেয়ে গিয়েছিল। এখন কি হবে! অত বড় বনের মধ্যে ছোট্ট দুটি ভাই বোন একলা, চারদিকে বাঘ ডাক্ছে, ভাল্লুক ডাক্ছে। তারা কোথায় যাবে, কি করবে বুঝতে না পেরে এক গাছের উপর উঠে জড়সড় হয়ে বসে রইল, ভয়েতে কারোর ঘুম হল না।
সকাল হ’লে পর দুজনে গাছ থেকে নেমে, বনের ভিতর দিয়ে চল্ল। খানিকদূর গিয়ে তারা দেখ্ল বনের ভিতরে একটি ছোট ঘর রয়েছে। সে ঘর এমনি আশ্চর্য্য যে তেমন আর কেউ দেখেনি। ঘর খানা দেয়াল থেকে চাল অবধি খালি মিঠাই মণ্ডা দিয়ে তৈরী। দেয়াল সব সন্দেশের, চাল মালপুয়ার, জানালা শার্শী সব মিছরির। এমন মজা কি আর হয়? হরি আর গিরি ত কেবল হাস্ছে আর নাচ্ছে আর দুহাতে তুলে খালি মুখে দিচ্ছে।
এমন সময় ঝাঁ ক’রে ঘরের দরজা খুলে এক বুড়ী বেরিয়ে এসে বল্ল, “কে রে, আমার ঘর ভাঙছিস্?”
বুড়ী যে সে বুড়ী নয়, সে এক রাক্ষসী। সে এখন বুড়ো হয়েছে, তরে দাঁত নড়ছে তাই এখন আর শক্ত মাংস চিবিয়ে খেতে পারে না, খালি খোকা খুকী ধরে খায়, আর তাদের ভূলিয়ে আন্বার জন্য মিঠাই মণ্ডা দিয়ে বনের ভিতরে ঘর বানিয়ে রেখেছে।
বুড়ীকে দেখে হরি আর গিরির এমনি ভয় হল যে তারা দুজনে কাঁদতে লাগ্ল। বুড়ী তাদের ভােলাবার জন্য ভারী মিষ্টি করে বল্ল, “কেন বাছারা কাঁদছ কেন? এস আমার ঘরে এস। তােমাদের জন্য কত খাবার রেখেছি; কেমন সুন্দর বিছানা করে বেখেছি।” তারা ত জানে না যে সেটা রাক্ষুসী, তারা তার কথায় খুসী হয়ে তার সঙ্গে ঘরে গেল।
প্রথম দিন বুড়ী তাদের খুবই যত্ন কর্ল। কিন্তু তার পরদিনই হতভাগী হরিকে নিয়ে এক ঘরে বন্ধ করে গিরিকে বল্ল, “খুব ভাল করে রান্না কর্। তাের ভাইকে খাইয়ে খাইয়ে মােটা কর্তে হবে, তারপর আমি তাকে খাব।”
এই কথা শুনেইত গিরি কেঁদে গড়াগড়ি দিল। কিন্তু রাক্ষুসী তার কান্না শুন্বে কেন? সে রােজ তাকে দিয়ে ঘর ধােয়াতে আর রান্না করাতে লাগ্ল।
এর মধ্যে হরি আর গিরি এক ফন্দি করেছে। হরিকে যে ঘরে রেখেছিল তার দরজা জানালা সব বন্ধ, কেবল একটা জানালায় একটা ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে তাকে খাবার দেয়। রাক্ষুসী এসে রােজ সেই ফুটোর কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, “দেখিত কত মােটা হয়েছিস্। তাের আঙ্গুল দেখি।, তখন হরি করে কি, তার আঙ্গুল না দেখিয়ে, ফুটো দিয়ে এক টুক্রা হাড় বার করে দেয়।
বুড়ী ত ভাল ক’রে চোখে দেখতে পায় না, সে হাড় খানাকে টিপে বলে, “বড্ড রোগা, বড্ড শক্ত।”
এমনি ক’রে রোজ রাক্ষুসী আঙ্গুল দেখতে চায়, আর ্জরো হরি তাকে হাড় দেখায়। শেষে একদিন বুড়ী রেগে বল্ল, “এত করে খাওয়াই তবু মোটা হ’স্ না। আজ তোকে খাবই খাব।”
তারপর সে গিরিকে ডেকে বল্ল, “উনুন জ্বাল, কড়ায় তেল চড়া। তোর ভাইকে আজ ভেজে খাব।” গিরি উনুন ধরিয়ে এই বড় এক কড়া করে তেল চড়িয়ে দিল।
দেখ্তে দেখ্তে সেই এককড়া তেল টগ্বগ্ করে ফুট্তে লাগ্ল। রাক্ষুসী গিরিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, “দেখ্ত তেল গরম হয়েছে কিনা।” গিরি বল্ল, “তেল গরম হল কিনা তাত আমি দেখতে জানি না। তুমি এসে দেখিয়ে দাও না।”
তা শুনে বুড়ী নিজেই দেখ্তে গেল, তেল গরম হয়েছে কিনা। গিয়ে সবে কড়ার উপর উপুড় হয়েছে, অমনি গিরি ছুটে এসে পিছন থেকে মেরেছে তাকে এক ধাক্কা। ধাক্কা খেয়ে দুষ্টু বুড়ী হীঁক্ করে চেঁচিয়ে সেই তেলের উপর পড়ে দেখ্তে দেখ্তে চিংড়ি মাছের মতন ভাজা হয়ে গেল!
তার আগেই গিরি ছুটে এসে হরিকে দরজা খুলে দিয়েছিল। তার পর,বুড়ীর ঘরে যত হীরা মাণিক ছিল, দুজনে মিলে সব সিন্ধুক থেকে বার করে পুটুলী বেঁধে নিল।
সেই পুটুলী কি তারা বয়ে আন্তে পারে? অনেক কষ্টে ঠেলে ঠেলে তারা গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের বাড়ী নিয়ে গেল।
তখন ত খুব মজাই হল।