গীতবিতান/পরিশিষ্ট/নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা
মায়ার খেলা
প্রথম দৃশ্য
কানন
মায়াকুমারীগণ
সকলে। মোরা জলে স্থলে কত ছলে মায়াজাল গাঁথি।
প্রথমা। মোরা স্বপন রচনা করি অলস নয়ন ভরি।
দ্বিতীয়া। গোপনে হৃদয়ে পশি কুহক-আসন পাতি।
তৃতীয়া। মোরা মদির তরঙ্গ তুলি বসন্তসমীরে।
প্রথমা। দুরাশা জাগায় প্রাণে প্রাণে
আধো তানে ভাঙা গানে
ভ্রমরগুঞ্জরাকুল বকুলের পাঁতি।
সকলে। মোরা মায়াজাল গাঁথি।
দ্বিতীয়া। নরনারী-হিয়া মোরা বাঁধি মায়াপাশে।
তৃতীয়া। কত ভুল করে তারা, কত কাঁদে হাসে।
প্রথমা। মায়া করে ছায়া ফেলি মিলনের মাঝে,
আনি মান অভিমান—
দ্বিতীয়া। বিরহী স্বপনে পায় মিলনের সাথি।
সকলে। মোরা মায়াজাল গাঁথি।
দ্বিতীয় দৃশ্য
গৃহ
গমনোম্মুখ অমর। শান্তার প্রবেশ
শান্তা। পথহারা তুমি পথিক যেন গো সুখের কাননে—
ওগো যাও, কোথা যাও।
সুখে ঢলোঢলো বিবশ বিভল পাগল নয়নে
তুমি চাও, কারে চাও।
কোথা গেছে তব উদাস হৃদয়, কোথা পড়ে আছে ধরণী,
মায়ার তরণী বাহিয়া যেন গো মায়াপুরী-পানে ধাও—
কোন্ মায়াপুরী-পানে ধাও।
অমর। জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত—
নবীন বাসনা-ভরে হৃদয় কেমন করে,
নবীন জীবনে হল জীবন্ত।
সুখ-ভরা এ ধরায় মন বাহিরিতে চায়,
কাহারে বসাতে চায় হৃদয়ে—
তাহারে খুঁজিব দিক-দিগন্ত।
মায়াকুমারীগণের প্রবেশ
সকলে। কাছে আছে দেখিতে না পাও।
তুমি কাহার সন্ধানে দূরে যাও।
মনের মতো কারে খুঁজে মরো—
সে কি আছে ভুবনে।
সে-যে রয়েছে মনে।
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।
তোমার আপনার যেজন, দেখিলে না তারে?
তুমি যাবে কার দ্বারে।
যারে চাবে তারে পাবে না, যে মন
তোমার আছে যাবে তা’ও।
[প্রস্থান]
শান্তার প্রতি
অমর। যেমন দখিনে বায়ু ছুটেছে,
কে জানে কোথায় ফুল ফুটেছে,
তেমনি আমিও, সখী, যাব—
না জানি কোথায় দেখা পাব।
কার সুধাস্বর-মাঝে জগতের গীত বাজে,
প্রভাত জাগিছে কার নয়নে,
কাহার প্রাণের প্রেম অনন্ত—
তাহারে খুঁজিব দিক-দিগন্ত।
প্রস্থান
নেপথ্যে চাহিয়া
শান্তা। আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও—
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও—
আমি যত দুখ পাই গো।
কানন
প্রমদার সখীগণ
প্রথমা। সখী, সে গেল কোথায়। তারে ডেকে নিয়ে আয়।
সকলে। দাঁড়াব ঘিরে তারে তরুতলায়।
প্রথমা। আজি এ মধুর সাঁঝে কাননে ফুলের মাঝে
হেসে হেসে বেড়াবে সে, দেখিব তায়।
দ্বিতীয়া। আকাশে তারা ফুটেছে, দখিনে বাতাস ছুটেছে,
পাখিটি ঘুমঘোরে গেয়ে উঠেছে।
প্রথমা। আয় তো আনন্দময়ী, মধুর বসন্ত লয়ে।
সকলে। লাবণ্য ফুটাবি লো তরুলতায়।
প্রমদার প্রবেশ
প্রমদা। দে লো সখী, দে পরাইয়ে গলে সাধের বকুলফুলহার—
আধোফুট জুঁইগুলি যতনে আনিয়া তুলি
গাঁথি গাঁথি সাজায়ে দে মোরে, কবরী ভরিয়ে ফুলভার।
তুলে দে লো, চঞ্চল কুন্তল কপোলে পড়িছে বারে-বার।
প্রথমা। আজি এত শোভা কেন। আনন্দে বিবশা যেন—
দ্বিতীয়া। বিম্বাধরে হাসি নাহি ধরে, লাবণ্য ঝরিয়া পড়ে ধরাতলে।
প্রথমা। সখী, তোরা দেখে যা, দেখে যা—
তরুণ তনু এত রূপরাশি বহিতে পারে না বুঝি আর।
দ্বিতীয়া। জীবনে পরম লগন কোনো না হেলা,
কোরো না হেলা হে গরবিনী।
বৃথাই কাটিবে বেলা, সাঙ্গ হবে যে খেলা—
সুধার হাটে ফুরাবে বিকিকিনি।
মনের মানুষ লুকিয়ে আসে, দাঁড়ায় পাশে—
হেসে চলে যায় জোয়ার-জলে ভাসিয়ে ভেলা।
দুর্লভধনে দুঃখের পণে লও গো জিনি।
ফাগুন যখন যাবে গো নিয়ে ফুলের ডালা
কী দিয়ে তখন গাঁথিবে তোমার বরণমালা হে গরবিনী।
বাজবে বাঁশি দুরের হাওয়ায়,
চোখের জলে শূন্যে চাওয়ায় কাটবে প্রহর—
বাজবে বুকে বিদায়পথের চরণ ফেলা হে গরবিনী।
তৃতীয়া। সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা
এ কি আর ভালো লাগে।
আকুল তিয়াষ প্রেমের পিয়াস প্রাণে কেন নাহি জাগে।
কবে আর হবে থাকিতে জীবন
আঁখিতে আঁখিতে মদির মিলন—
মধুর হুতাশে মধুর দহন নিতিনব অনুরাগে।
তরল কোমল নয়নের জল নয়নে উঠিবে ভাসি,
সে বিষাদনীরে নিবে যাবে ধীরে প্রখর চপল হাসি।
উদাস নিশ্বাস আকুলি উঠিবে,
আশা-নিরাশায় পরান টুটিবে—
মরমের আলো কপোলে ফুটিবে শরম-অরুণ রাগে।
প্রমদা। ওলো, রেখে দে সখী, রেখে দে— মিছে কথা ভালোবাসা।
সুখের বেদনা, সোহাগযাতনা— বুঝিতে পারি না ভাষা।
ফুলের বাধন, সাধের কাঁদন,
পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন,
‘লহো লহো’ ব’লে পরে আরাধন— পরের চরণে আশা।
তিলেক দরশ পরশ মাগিয়া
বরষ বরষ কাতরে জাগিয়া
পরের মুখের হাসির লাগিয়া অসাগরে ভাসা—
জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া জীবনের সুখ নাশা।
অমরের প্রবেশ
প্রমদার প্রতি
অমর। যেয়ো না, যেয়ো না, যেয়ো না ফিরে।
দাঁড়াও, চরণদুটি বাড়াও হৃদয়-আসনে।
তুমি রঙিন মেঘমালা যেন ফাগুনসমীরে।
প্রমদা। কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই—
আমি কভু ফিরে নাহি চাই।
অমর। তোমায় ধরিতে চাহি, ধরিতে পারি নে—
তুমি গঠিত স্বপনে।
মোরে রেখো না, রেখো না
তব চঞ্চল লীলা হতে রেখো না বাহিরে।
প্রমদা। কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই।
কত ফুল ফুটে উঠে, কত ফুল যায় টুটে—
আমি শুধু বহে চলে যাই।
পরশ পুলকরস-ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা।
উড়ে আসে ফুলবাস, লতাপাতা ফেলে শ্বাস,
বনে বনে উঠে হাহুতাশ—
চকিতে শুনিতে শুধু পাই— চলে যাই।
আমি কভু ফিরে নাহি চাই।
[অমরের প্রস্থান]
অশোকের প্রবেশ
অশোক। এসেছি গো এসেছি, মন দিতে এসেছি—
যারে ভালোবেসেছি।
ফুলদলে ঢাকি মন যাব রাখি চরণে,
পাছে কঠিন ধরণী পায়ে বাজে—
রেখো রেখো চরণ হৃদিমাঝে।
নাহয় দ’লে যাবে, প্রাণ ব্যথা পাবে—
আমি তো ভেসেছি, অকূলে ভেসেছি।
প্রমদা। ওকে বলো সখী, বলো, কেন মিছে করে ছল।
মিছে হাসি কেন সখী, মিছে আঁখিজল।
জানি নে প্রেমের ধারা, ভয়ে তাই হই সারা—
কে জানে কোথায় সুধা কোথা হলাহল।
সখীগণ। কাঁদিতে জানে না এরা, কাঁদাইতে জানে কল—
মুখের বচন শুনে মিছে কী হইবে ফল!
প্রেম নিয়ে শুধু খেলা, প্রাণ নিয়ে হেলাফেলা—
ফিরে যাই এই বেলা চলো সখী, চলো।
চতুর্থ দৃশ্য
কানন
শান্তা। তারে দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ খুলে গো—
বুঝাতে পারি নে হৃদয়বেদনা।
কেমনে সে হেসে চলে যায়, কোন্ প্রাণে ফিরেও না চায়—
এত সাধ এত প্রেম করে অপমান।
সখী। সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না— শুধু সুখ চলে যায়।
শান্তা। এত ব্যথা-ভরা ভালোবাসা কেহ দেখে না,
প্রাণে গোপনে রহিল।
এ প্রেম কুসুম যদি হ’ত প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম,
তার চরণে করিতাম দান—
বুঝি সে তুলে নিত না, শুকাত অনাদরে—
তবু তার সংশয় হত অবসান।
অমর। আপন মন নিয়ে কাঁদিয়ে মরি,
পরের মন নিয়ে কী হবে।
আপন মন যদি বুঝিতে নারি
পরের মন বুঝে কে কবে।
সখী। অবোধ মন লয়ে ফেরো ভবে,
বাসনা কাঁদে প্রাণে হাহারবে।
এ মন দিতে চাও দিয়ে ফেলো—
কেন গো নিতে চাও মন তবে।
অমর। স্বপনসম সব জেনেছি মনে—
‘তোমার কেহ নাই এ ত্রিভুবনে,
যেজন ফিরিতেছে আপন আশে’
তুমি ফিরিছ কেন তাহার পাশে।
সখী। নয়ন মেলি শুধু দেখে যাও, হৃদয় দিয়ে শুধু শান্তি পাও।
তোমারে মুখ তুলে চাহে না যে থাক্ সে আপনার গরবে।
অমর। ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন,
তবে কেন মিছে ভালোবাসা।
সখী। মন দিয়ে মন পেতে চাহি’— ওগো কেন,
ওগো কেন মিছে এ দুরাশা।
অমর। হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা,
নয়নে সাজায়ে মায়া-মরীচিকা,
শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে।
সখী। ওগো কেন, ওগো কেন মিছে এ পিপাসা।
আপনি যে আছে আপনার কাছে।
নিখিল জগতে কী অভাব আছে—
আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ, কোকিলকূজিত কুঞ্জ।
অমর। বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়—
একি ঘোর প্রেম অন্ধরাহুপ্রায় জীবন যৌবন গ্রাসে।
সখী। তবে কেন, তবে কেন মিছে এ কুয়াশা।
প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ
প্রমদা। সুখে আছি, সুখে আছি, সখা, আপন-মনে।
প্রমদা ও সখীগণ। কিছু চেয়োনা, দূরে যেয়ো না—
শুধু চেয়ে দেখো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি।
প্রমদা। সখা, নয়নে শুধু জানাবে প্রেম, নীরবে দিবে প্রাণ।
রচিয়া ললিত মধুর বাণী আড়ালে গাবে গান।
গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি।
প্রমদা ও সখীগণ। মন চেয়ো না, শুধু চেয়ে থাকো—
শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি।
প্রমদা। মধুর জীবন, মধুর রজনী, মধুর মলয়বায়।
এই মাধুরীধারা বহিছে আপনি,
কেহ কিছু নাহি চায়।
আমি আপনার মাঝে আপনি হারা,
আপন সৌরভে সারা।
যেন আপনার মন আপনার প্রাণ
আপনারে সঁপিয়াছি।
অমর। ভালোবেসে দুখ সেও সুখ, সুখ নাহি আপনাতে।
প্রমদা ও সখীগণ। না না না, সখা, ভুলি নে ছলনাতে।
অমর। মন দাও দাও, দাও সখী, দাও পরের হাতে।
প্রমদা ও সখীগণ। না না না, মোরা ভুলি নে ছলনাতে।
অমর। সুখের শিশির নিমেষে শুকায়, সুখ চেয়ে দুখ ভালো!
আনো সজল বিমল প্রেম ছলছল নলিননয়নপাতে।
প্রমদা ও সখীগণ। না না না, মোরা ভুলি নে ছলনাতে।
অমর। রবির কিরণে ফুটিয়া নলিনী আপনি টুটিয়া যায়,
সুখ পায় তায় সে।
চির-কলিকাজনম কে করে বহন চির শিশিররাতে।
প্রমদা ও সখীগণ। না না না, মোরা ভুলি নে ছলনাতে।
প্রস্থান
[পুনঃপ্রবেশ]
প্রমদা। দূরে দাঁড়ায়ে আছে, কেন আসে না কাছে।
যা তোরা যা সখী, যা শুধা গে
ওই আকুল অধর আঁখি কী ধন যাচে।
সখীগণ। ছি ওলো ছি, হল কী, ওগো সখী।
প্রথমা। লাজবাঁধ কে ভাঙিল। এত দিনে শরম টুটিল!
তৃতীয়া। কেমনে যাব। কী শুধাব।
প্রথমা। লাজে মরি, কী মনে করে পাছে।
প্রমদা। যা তোরা যা সখী, যা শুধা গে—
ওই আকুল অধর আঁখি কী ধন যাচে।
অমরের প্রতি
সখীগণ। ওগো, দেখি, আঁখি তুলে চাও—
তোমার চোখে কেন ঘুমঘোর।
অমর। আমি কী যেন করেছি পান, কোন্ মদিরারস-ভোর।
আমার চোখে তাই ঘুমঘোর।
সখীগণ। ছি ছি ছি।
অমর। সখী, ক্ষতি কী।
এ ভবে কেহ জ্ঞানী অতি কেহ ভোলা-মন,
কেহ সচেতন কেহ অচেতন,
কাহারো নয়নে হাসির কিরণ কাহারো নয়নে লোর—
আমার চোখে শুধু ঘুমধোর।
সখীগণ। সখা, কেন গো অচলপ্রায় হেথা দাঁড়ায়ে তরুছায়।
অমর। অবশ হৃদয়ভারে চরণ চলিতে নাহি চায়,
তাই দাঁড়ায়ে তরুছায়।
সখীগণ। ছি ছি ছি।
অমর। সখী, ক্ষতি কী।
এ ভবে কেহ পড়ে থাকে কেহ চলে যায়,
কেহ বা আলসে চলিতে না চায়,
কেহ বা আপনি স্বাধীন কাহারো চরণে পড়েছে ডোর—
কাহারো নয়নে লেগেছে ঘোর।
সখীগণ। ওকে বোঝা গেল না— চলে আয়, চলে আয়।
ও কী কথা-যে বলে সখী, কী চোখে যে চায়।
চলে আয়, চলে আয়।
লাজ টুটে শেষে মরি লাজে মিছে কাজে।
ধরা দিবে না যে, বলো, কে পারে তায়।
আপনি সে জানে তার মন কোথায়!
চলে আয়, চলে আয়।
প্রস্থান
পঞ্চম দৃশ্য
কানন
প্রমদা সখীগণ অশোক ও কুমারের প্রবেশ
কুমার। সখী, সাধ করে যাহা দেবে তাই লইব।
সখীগণ। আহা মরি মরি, সাধের ভিখারি,
তুমি মনে মনে চাহ প্রাণ মন।
কুমার। দাও যদি ফুল, শিরে তুলে রাখিব।
সখীগণ। দেয় যদি কাঁটা?
কুমার। তাও সহিব।
সখীগণ। আহা মরি মরি, সাধের ভিখারি,
তুমি মনে মনে চাহ প্রাণ মন।
কুমার। যদি একবার চাও, সখী, মধুর নয়ানে
ওই আঁখিসুধাপানে চিরজীবন মাতি রহিব।
সখীগণ। যদি কঠিন কটাক্ষ মিলে?
কুমার। তাও হৃদয়ে বিঁধায়ে চিরজীবন বহিব।
সখীগণ। আহা মরি মরি, সাধের ভিখারি,
তুমি মনে মনে চাহ প্রাণ মন।
প্রমদা। এ তো খেলা নয়, খেলা নয়—
এ-যে হৃদয়দহন জ্বালা সখী।
এ-যে প্রাণ-ভরা ব্যাকুলতা, গোপন মর্মের ব্যথা—
এ-যে কাহার চরণোদ্দেশে জীবন মরণ ঢালা।
কে যেন সতত মোরে ডাকিয়ে আকুল করে—
‘যাই যাই’ করে প্রাণ, যেতে পারি নে।
যে কথা বলিতে চাহি তা বুঝি বলিতে নাহি—
কোথায় নামায়ে রাখি, সখী, এ প্রেমের ডালা!
যতনে গাঁথিয়ে শেষে পরাতে পারি নে মালা।
প্রথমা সখী। সেজন কে, সখী, বোঝা গেছে
আমাদের সখী যারে মন প্রাণ সঁপেছে।
দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া। ও সে কে, কে, কে।
প্রথমা। ওই-যে তরুতলে, বিনোদমালা গলে,
না জানি কোন্ ছলে বসে রয়েছে।
দ্বিতীয়া। সখী, কী হবে—
ও কি কাছে আসিবে কভু। কথা কবে?
তৃতীয়া। ও কি প্রেম জানে। ও কি বাঁধন মানে।
ও কী মায়াগুণে মন লয়েছে।
দ্বিতীয়া। বিভল আঁখি তুলে আঁখি-পানে চায়,
যেন কী পথ ভুলে এল কোথায় ওগো।
তৃতীয়া। যেন কী গানের স্বরে শ্রবণ আছে ভ’রে,
যেন কোন্ চাঁদের আলোয় মগ্ন হয়েছে।
প্রমদা। সখী, প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে।
তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে।
যদি শুধায় কে দিল কোন্ ফুলকাননে—
মোর শপথ, আমার নামটি বলিস নে।
সখীগণ। তারে কেমনে ধরিবে, সখী, যদি ধরা দিলে!
প্রথমা। তারে কেমনে কাঁদাবে, যদি আপনি কাঁদিলে!
দ্বিতীয়া। যদি মন পেতে চাও, মন রাখো গোপনে।
তৃতীয়া। কে তারে বাঁধিবে, তুমি আপনায় বাঁধিলে।
নিকটে আসিয়া প্রমদার প্রতি
অমর। সকল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছি যারে
সে কি ফিরাতে পারে সখী!
সংসারবাহিরে থাকি, জানি নে কী ঘটে সংসারে।
কে জানে, হেথায় প্রাণপণে প্রাণ যারে চায়
তারে পায় কি না-পায়— জানি নে।
ভয়ে ভয়ে তাই এসেছি গো অজানা-হৃদয়-দ্বারে।
তোমার সকলই ভালোবাসি— এই রূপরাশি,
ওই খেলা, ওই গান, ওই মধুহাসি।
ওই দিয়ে আছ ছেয়ে জীবন আমারই—
কোথায় তোমার সীমা ভুবনমাঝারে।
সখীগণ। তুমি কে গো, সখীরে কেন জানাও বাসনা।
দ্বিতীয়া। কে জানিতে চায় তুমি ভালোবাস কি ভালোবাস না।
প্রথমা। হাসে চন্দ্র, হাসে সন্ধ্যা, ফুল্ল কুঞ্জকানন—
হাসে হৃদয়বসন্তে বিকচ যৌবন।
তুমি কেন ফেলো শ্বাস, তুমি কেন হাসো না।
সকলে। এসেছ কি ভেঙে দিতে খেলা—
সখীতে সখীতে এই হৃদয়ের মেলা।
দ্বিতীয়া। আপন দুখ আপন ছায়া লয়ে যাও।
প্রথমা। জীবনের আনন্দ-পথ ছেড়ে দাঁড়াও।
তৃতীয়া। দূর হতে করো পূজা হৃদয়কমল-আসনা।
অমর। তবে সুখে থাকো, সুখে থাকো। আমি যাই— যাই।
প্রমদা। সখী, ওরে ডাকো, মিছে খেলায় কাজ নাই।
সখীগণ। অধীরা হোয়ো না সখী।
আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।
অমর। ছিলাম একেলা আপন ভুবনে এসেছি এ কোথায়।
হেথাকার পথ জানি নে, ফিরে যাই।
যদি সেই বিরামভবন ফিরে পাই।
প্রস্থান
প্রমদা। সখী, ওরে ডাকো ফিরে। মিছে খেলা মিছে হেলা কাজ নাই।
সখীগণ। অধীরা হোয়ো না সখী!
আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।
প্রস্থান
ষষ্ঠ দৃশ্য
অমর ও শান্তা
অমর। আমার নিখিল ভুবন হারালেম আমি যে।
বিশ্ববীণার রাগিণী যায় থামি যে।
গৃহহারা হৃদয় যায় আলোহারা পথে হায়—
গহন তিমিরগুহাতলে যাই নামি যে।
তোমায়ই নয়নে সন্ধ্যাতারার আলো,
আমার পথের অন্ধকারে জ্বালো জ্বালো।
মরীচিকার পিছে পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে।
দিন-অবসানে তোমারই হৃদয়ে
শ্রান্ত পান্থ অমৃততীর্থগামী যে।
শান্তা। ভুল কোরো না গো, ভুল কোরো না, ভুল
কোরো না ভালোবাসায়।
ভুলায়ো না, ভুলায়ো না, ভুলায়ো না নিষ্ফল আশায়।
বিচ্ছেদদুঃখ নিয়ে আমি থাকি, দেয় না সে ফাঁকি—
পরিচিত আমি তার ভাষায়।
দয়ার ছলে তুমি হয়ো না নিদয়।
হৃদয় দিতে চেয়ে ভেঙো না হৃদয়।
যেখোন লুব্ধ করে— মরণের বাঁশিতে মুগ্ধ করে
টেনে নিয়ে যেয়ো না সর্বনাশায়।
অমর। ভুল করেছি, ভুল ভেঙেছে।
জেগেছি, জেনেছি— আর ভুল নয়, ভুল নয়।
মায়ার পিছে পিছে
ফিরেছি, জেনেছি স্বপন সবই মিছে—
বিঁধেছে কাঁটা প্রাণে— এ তো ফুল নয়, ফুল নয়।
ভালোবাসা হেলা করিব না,
খেলা করিব না লয়ে মন— হেলা করিব না।
তব হৃদয়ে, সখী, আশ্রয় মাগি।
অতল সাগর সংসারে— এ তো কূল নয়, কূল নয়।
প্রমদার সখীগণের প্রবেশ
দূর হইতে
সখীগণ। অলি বারবার ফিরে যায়, অলি বারবার ফিরে আসে—
তবে তো ফুল বিকাশে।
প্রথমা। কলি ফুটিতে চাহে, ফোটে না— মরে লাজে, মরে ত্রাসে।
ভুলি মান অপমান দাও মন প্রাণ, নিশিদিন রহো পাশে।
দ্বিতীয়া। ওগো, আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও
হৃদয়রতন-আশে।
সকলে। ফিরে এসো ফিরে এসো— বন মোদিত ফুলবাসে।
আজি বিরহরজনী, ফুল্ল কুসুম শিশিরসলিলে ভাসে।
অমর। ডেকো না আমারে ডেকো না— ডেকো না।
চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না।
আমার বেদনা আমি নিয়ে এসেছি,
মূল্য নাহি চাই যে ভালো বেসেছি।
কৃপাকণা দিয়ে আঁখিকোণে ফিরে দেখো না।
আমার দুঃখ-জোয়ারের জলস্রোতে।
নিয়ে যাবে মোরে সব লাঞ্ছনা হতে।
দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে—
অবহেলা তব ছলনা দিয়ে ঢেকো না।
অমরের প্রতি
শান্তা। না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে।
ওগো, কে আছে চাহিয়া শূন্যপথপানে—
কাহার জীবনে নাহি সুখ, কাহার পরান জ্বলে।
পড় নি কাহার নয়নের ভাষা,
বোঝ নি কাহার মরমের আশা, দেখ নি ফিরে—
কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দ’লে।
অমর। যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
তারে বুঝিতে পারি নি—
দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে।
শুভখনে কাছে ডাকিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে গো—
তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে।
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে কে মোরে ডাকিবে কাছে,
কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে—
এ নিরন্তর সংশয়ে আর পারি নে যুঝিতে।
তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে।
প্রস্থান
[শান্তা] হায় হতভাগিনী,
স্রোতে বৃথা গেল ভেসে, কুলে তরী লাগে নি, লাগে নি।
কাটালি বেলা বীণাতে সুর বেঁধে—
কঠিন টানে উঠল কেঁদে,
ছিন্ন তারে থেমে গেল-যে রাগিণী।
এই পথের ধারে এসে ডেকে গেছে তোরে সে।
ফিরায়ে দিলি তারে রুদ্ধদ্বারে।—
বুক জলে গেল গো, ক্ষমা তবুও কেন মাগি নি।
সপ্তম দৃশ্য
কানন
অমর শান্তা, অন্যান্য পুরনারী ও পৌরজন
স্ত্রীগণ। এস’ এস’, বসন্ত ধরাতলে।
আন’ কুহুতান, প্রেমগান।
আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।
আন’ নবযৌবনহিল্লোল, নব প্রাণ—
প্রফুল্পনবীন বাসনা ধরাতলে।
পুরুষগণ। এস’ থরথরকম্পিত মর্মরমুখরিত
নব পল্লবপুলকিত
ফুল-আকুল মালতিবল্লিবিতানে—
সুখছায়ে মধুবায়ে এস’ এস’।
এস’ অরুণচরণ কমলবণ তরুণ উষার কোলে।
এস’ জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে কলকল্লোলতটিনীতীরে।
সুখসুপ্তসরসীনীরে এস’ এস’।
স্ত্রীগণ। এস’ যৌবনকাতর হৃদয়ে,
এস’ মিলনসুখালস নয়নে,
এস’ মধুর শরমমাঝারে— দাও বাহুতে বাহ বাঁধি।
নবীনকুসুমপাশে রচি দাও নবীন মিলনবাঁধন।
প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ
অমর। এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া।
পুরুষগণ। ও কি এল, ও কি এল না—
বোঝা গেল না, গেল না।
ও কি মায়া কি স্বপনছায়া— ও কি ছলনা।
অমর। ধরা কি পড়ে ও রূপেরই ডোরে।
গানেরই তানে কি বাঁধিবে ওরে।
ও-যে চিরবিরহেরই সাধনা।
শান্তা। ওর বাঁশিতে করুণ কী সুর লাগে
বিরহমিলনমিলিত রাগে।
সুখে কি দুখে ও পাওয়া না-পাওয়া,
হৃদয়বনে ও উদাসী হাওয়া—
বুঝি শুধু ও পরম কামনা।
অমর। এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া।
সখীগণ। কোন্ সে ঝড়ের ভুল ঝরিয়ে দিল ফুল,
প্রথম যেমনি তরুণ মাধুরী মেলেছিল এ মুকুল।
নব প্রভাতের তারা
সন্ধ্যাবেলায় হয়েছে পথহারা।
অমরাবতীর সুরযুবতীর এ ছিল কানের দুল।
এ যে মুকুটশোভার ধন—
হায় গো দরদী কেহ থাক যদি, শিরে দাও পরশন।
এ কি স্রোতে যাবে ভেসে দুর দয়াহীন দেশে—
জানি নে, কে জানে দিন-অবসানে কোন্খানে পাবে কূল।
শান্তা। ছি ছি, মরি লাজে।
কে সাজালো মোরে মিছে সাজে।
বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রুপে নিয়ে এল চুপে চুপে
মোরে তোমাদের দুজনের মাঝে।
আমি নাই, আমি নাই—
আদরিণী, লহো তব ঠাঁই যেথা তব আসন বিরাজে।
শান্তা ও স্ত্রীগণ। শুভমিলনলগনে বাজুক বাঁশি,
মেঘমুক্ত গগনে জাগুক হাসি।
পুরুষগণ। কত দুখে কত দূরে দূরে আঁধাৱসাগর ঘুরে ঘুরে
সোনার তরী তীরে এল ভাসি।
ওগো পুরবালা, আনো সাজিয়ে বরণডালা।
যুগলমিলনমহৎসবে শুভ শঙ্খরবে
বসন্তের আনন্দ দাও উচ্ছ্বাসি।
প্রমদা। আর নহে, আর নহে।
বসন্তবাতাস কেন আর শুষ্ক ফুলে বহে।
লগ্ন গেল বয়ে, সকল আশা লয়ে—
এ কোন্ প্রদীপ জ্বালো! এ-যে বক্ষ আমার দহে।
আমার কানন মরু হল—
আজ এই সন্ধ্যা-অন্ধকারে সেথায় কী ফুল তোলো।
কাহার ভাগ্য হতে বরণমালা হরণ করো—
ভাঙা ডালি ভরো
মিলনমালার কণ্টকভার কণ্ঠে কি আর সহে।
অমর। ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি,
যা উড়ে, যা উড়ে, যা রে একাকী।
বাজবে তোর পায়ে সেই বন্ধ, পাখাতে পাবি আনন্দ—
দিশাহারা মেঘ যে গেল ডাকি।
নির্মল দুঃখে যে সেই তো মুক্তি নির্মল শূন্যের প্রেমে।
আত্মবিড়ম্বন দারুণ লজ্জা, নিঃশেষে যাক সে থেমে।
দুরাশার মরাবাঁচায় এতদিন ছিলি তোর খাঁচায়—
ধূলিতলে যাবি রাখি।
শান্তা। যাক ছিঁড়ে, যাক ছিঁড়ে যাক মিথ্যার জাল।
দুঃখের প্রসাদে এল আজি মুক্তির কাল।
এই ভালো ওগো, এই ভালো— বিচ্ছেদবহ্নিশিখার আলো।
নিষ্ঠুর সত্য করুক বরদান— ঘুচে যাক ছলনার অন্তরাল।
যাও প্রিয়, যাও তুমি যাও জয়রথে। বাধা দিব না পথে।
বিদায় নেবার আগে মন তব স্বপ্ন হতে যেন জাগে—
নির্মল হোক হোক সব জাল।
মায়াকুমারী। দুঃখের যজ্ঞ-অনল-জ্বলনে জন্মে যে প্রেম
দীপ্ত সে হেম—
নিত্য সে নিঃসংশয়, গৌরব তার অক্ষয়।
দুরাকাঙ্ক্ষার পরপারে বিরহতীর্থে করে বাস
যেথা জ্বলে ক্ষুব্ধ হোমাগ্নিশিখায় চিরনৈরাশ,
তৃষ্ণাদাহনমুক্ত অনুদিন অমলিন রয়।
গৌরব তার অক্ষয়—
অশ্রু-উৎস-জল-স্নানে তাপস মৃত্যুঞ্জয়।
প্রস্থান
সকলে। আজ খেলা-ভাঙার খেলা খেলবি আয়।
সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়।
মিলন-মালার আজ বাঁধন তো টুটবে,
ফাগুন-দিনের আজ স্বপন তো ছুটবে—
উধাও মনের পাখা মেলবি আয়।
অস্তগিরির ওই শিখর-চূড়ে
ঝড়ের মেঘের আজ ধ্বজা উড়ে।
কালবৈশাখীর হবে-যে নাচন—
সাথে নাচুক তোর মরণ-বাচন,
হাসি কাঁদন পায়ে ঠেলবি আয়।