গুপ্ত রহস্য/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 দস্যগণ যে বাড়ীতে তারামণীকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, প্রথমতঃ তারামণীর সাহায্যে সেই বাড়ীটী কোথায় তাহার অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ—করিলাম। পূর্ব্বে যখন তারামণীকে উহারা তারামণীর বাড়ী হইতে আনয়ন করিয়াছিল তখন তাহারা গাড়ীর ভিতর তারামণীকে বন্ধ করিয়া আনিয়াছিল ও পরিশেষে যখন তাহারা তারামণীকে লইয়া বিচার গৃহে উপনীত হয় তখনও তারামণীকে গাড়ীর ভিতর বন্ধ করিয়া লইয়া গিয়াছিল; অথচ যে পর্য্যন্ত তারামণী সেই গৃহে বাস করিয়াছিল তাহার মধ্যে ক্ষণ কালের নিমিত্ত সে ঐ বাড়ীস্থ বাহিরে যাইতে পারে নাই সুতরাং ঐ বাড়ীটী যে কোন স্থানে স্থাপিত তাহা তারামণী জানিত মা, সুতরাং অনুসন্ধান করিয়া ঐ বাড়ী বাহির করা নিতান্ত সহজ হইল না। ঐ বাড়ীর দরওয়াজার সম্মুখে যে রাস্তা আছে তাহাতে গাড়ী যাইতে পারে, এ কথা তারামণী আমাদিগকে বলিয়াছিল। তারামণীকে সঙ্গে লইয়া সহর, সহরতলি ও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকলের মধ্যে যে যে রাস্তায় গাড়ী যাইতে পারে সেই সেই রাস্তায় গমন করিয়া ঐ বাড়ীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।

 অনবৱত দুই তিন দিবস ঘুরিয়া ঘুরিয়া পরিশেষে তারামণী একটী বাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল, যে বাড়ীতে তাহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল তাহা ঐ বাড়ীর ন্যায় কিন্তু ভিতরে গিয়া দেখিতে না পারিলে ঠিক সে বলিতে পারে না ঐ বাড়ী কি না। ঐ বাড়ীর সদর দরজায় একটী তালা লাগান ছিল সুতরাং অনুমান হইল যে ঐ বাড়ী এখন শূন্য অবস্থায় আছে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম ঐ বাড়ীর কিয়দ্দুরে এক খানি মুদিখানার দোকান আছে, সেই মুদির নিকট ঐ বাড়ীর চাবি থাকে। মুদির নিকট গমন করিয়া জানিতে পারিলাম ঐ বাড়ী খানি কলিকাতা সহরের জনৈক প্রসিদ্ধ ধনাঢ্য ব্যক্তির। সহর হইতে অনেক দূরে ঐ বাড়ী খানি স্থাপিত আছে বলিয়া উহাতে প্রায়ই স্থায়ী ভাড়া হয় না; সময় সময় আবশ্যক অনুষায়ী কোন ব্যক্তির কিছু দিবসের জন্য উহার প্রয়োজন হইলে ঐ বাড়ী ভাড়া হয়, নতুবা ঐ বাড়ী প্রায়ই খালি থাকে। ঐ মুদির নিকট হইতে আরও জানিতে পারিলাম যে গত ছয় মাস হইতে কয়েকটা লোক ঐ বাড়ীতে বাস করিতেছিল। সম্প্রতি তাহারা বাড়ী পরিত্যাগ রিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহাৱা যে কে, কোথায় তাহাদিগের বাসস্থান ও কি কার্য্য করিত তাহার কিছুই সে বলিতে পারিল না। ঐ মুদির নিকট হইতে চাবি লইয়া ঐ বাড়ীটি খুলিলাম। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবা মাত্র তারামণী কহিল বাড়ীতেই সে এত দিবস বাস করিয়া গিয়াছে ও, মস‍্লিম প্রভৃতি সকলে ঐ বাড়ীতে-বাস করিত। ঐ বাড়ীতে মতিয়া বিবি হত হয় ও ঐ বাড়ী হইতেই তাহার মৃত দেহ স্থানান্তরিত হয়। যে ঘরে তারামণী বাস করিত সে ঘর আমাদিগকে দেখাইয়া দিল, যে ঘরে মতিয়া বিবি হত হইয়াছিল, যে ঘরে মস‍্লিম প্রভৃতি সকলে বাস করিত, মতিয়া বিবির মৃত্যুর পর যে ঘরে তাহার মৃত দেহ রাখিয়া দিয়াছিল তাহা সমস্তই আমরা দেখিয়া লইলাম। ঘরের অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে তারামণী আমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহার একটা কথাও মিথ্যা নহে।

 ঐ বাড়ীর ভিতর আমরা উত্তম রূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু আমাদিগের আবশ্যক উপযোগী কোন দ্রব্য উহার মধ্যে প্রাপ্ত হইলাম না। সমস্ত ঘর গুলি বিশেষ পরিষ্কার অবস্থায় রক্ষিত ছিল, কোন দ্রব্যাদি উহার মধ্যে ছিল না। ঐ বাড়ীর দ্বিতলের উপর কিছু মাত্র প্রাপ্ত না হইয়া নিম্ন তলে আসিলাম। সমস্ত ঘর পরিস্কার করিয়া সমস্ত ঘরের আবর্জ্জনা যে স্থানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, সেই স্থানটী উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম উহার মধ্যে নিতান্ত ছিন্ন অবস্থায় দুই এক খানি পত্র পড়িয়া আছে; ঐ ছিন্ন পত্রগুলি বিশেষ সতর্কতার সহিত সংগ্রহ করিলাম, দেখিলাম, উহা নাগরি ভাষায় লিখিত। পত্র ডাকে আসিয়াছে বলিয়া অনুমান হইল। আমাদিগের মধ্যে যে সকল কর্মী ছিলেন তাহাদিগের মধ্যে একজন কিছু নাগরি জানিতেন, ঐ ছিন্ন পত্রগুলি তাহাকেই প্রদান করিলাম, উহাতে যে কি লেখা আছে তাহা জানিতে তাহায় প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। ঐ পত্র হইতে অবগত হইলাম, ঐ পত্রগুলি রাইবেরেলী জেলার অন্তর্গত কোন এক খানি পল্লি হইতে মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তি তাহার পুত্র ওসমান আলিকে লিখিতেছে—ঐ পত্রের সার মর্ম্ম এইরূপ;—অনেক দিবস ওসমান আলি কলিকাতা হইতে তাহার দেশে যায় নাই, তাহার পরিবারবর্গ তাহার নিমিত্ত অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে, যাহাতে ওসমান অভাব পক্ষে দুই চারি দিবসের নিমিও বাড়ীতে যাইয়া তাহার পরিবারবর্গের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিয়া আসিতে পারে এই নিমিত্ত ওসমান এই পত্র লিপিতেছে। আরও লিখিতেছে ওসমান আলি ডাকে যে সকল দ্রব্য পাঠাইয়া দিয়াছিল তাহার সমস্তই মহম্মদ আলি প্রাপ্ত হইয়াছে।

 ঐ নাগরি পত্র হইতে যাহা কিছু অবগত হইতে পারিলাম তাহাতে বুঝিতে পারিলাম ঐ বা বাড়ীতে যাহারা বাস করিত তাহাদিগের মধ্যে ওসমান আলি নামক এক ব্যক্তি ছিল ও তাহার বাসস্থান রায়বেরেলী।

 মস‍্লিম্ ও তাহার অনুচরবর্গ এখানে যে যে স্থানে বাস করে বলিয়া আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিল পুনরায় আমরা সেই সকল স্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম ও সহর ও সহরতলীর মধ্যে তন্ন তন্ন করিয়া উহাদিগের অনুসন্ধান করিতে ক্রটী করিলাম না, কিন্তু কোন স্থানই উহাদিগের কিছুমাত্র সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। তখন একবার রায়বেরেলী গমন করিয়া ওসমান আলির অনুসন্ধান করিতে প্রস্তুত হইলাম।

 উহাদিগের দলস্থিত প্রায় সমস্ত ব্যক্তিকেই আমি চিনিতাম, সুতরাং উহাদিগকে দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত অপর কোন ব্যক্তি বা তারামণীকে সঙ্গে লওয়ার কোনরূপ প্রয়োজন হইল না। আমি কেবলমাত্র একটা কনেষ্টবল সঙ্গে লইয়া রায়বেরেলী অভিমুখে গমন করিলাম। যে গ্রামে ওসমান আলির বাসস্থান সেই গ্রামে না গিয়া মহম্মদ আলির অনুসন্ধান করায় জানিতে পারিলাম যে সেই গ্রামে মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তি আছে, তাহার একটী পুত্রও আছে; উহার নাম ওসমান আলি। আজ কয়েক দিবস ওসমান আলি কলিকাতা হইতে বাড়ী আসিয়াছে।

 এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া সেই স্থানের স্থানীয় পুলিশের জনৈক কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম ও ওসমান আলিকেও প্রাপ্ত হইলাম। উহাকে দেখিবা মাত্রই চিনিতে পারিলাম। সেও আমাকে উত্তমরুপে চিনিল। ঐ ব্যক্তি আমাদিগের সেই সর্ব্বজন পরিচিত মস‍্লিম্ ভিন্ন আর কেহই নহে। মস‍্লিমের ঘরের খানা তল্লাসি করিয়া কতকগুলি অর্থ প্রাপ্ত হইলাম, ও কতকগুলি অলঙ্কারও পাইলাম। ঐ সকল অলঙ্কারের মধ্যে কতকগুলি তারামণীর ঘর হতে অপহৃত অলঙ্কার বলিয়া পরিশেষে তারামণী সনাক্ত করিয়াছিল। আর যে সকল গিল‍্টীর গহনা পাওয়া গিয়াছিল তাহার অধিকাংশই বেলার গৃহন। বলিয়া পরিশেষে সাব্যস্ত হইয়াছিল।

 মস‍্লিম‍্কে ধৃত করিবার পর তাহার নিকট হইতে তাহার অনুসঙ্গিগণের ঠিকানা জানিয়া লইবার নিমিত্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই তাহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারি নাই। এমন কি মস‍্লিমের সঙ্গে তাহার যে সকল পারিষদ, তারামণীকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হয়, এখন সে তাহাদিগের পর্য্যন্ত নাম বলিল না, কহিল তাহারা কে জানি না, তাহাদিগকে চিনি না, বা তাহাদিগের সহিত একত্র কখন সে বাস করে নাই। তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে লইয়া যখন আমরা নিতান্ত পিড়াপিড়ি করিতে লাগিলাম তখন সে মুক্তকণ্ঠে কহিল সে কোন কথার উত্তর প্রদান করিবে না, তাহাকে মারিয়া ফেলিলে বা তাহাকে টুকরা টুকরা করিয়া কাটিয়া ফেলিলৈও সকলে দেখিবে যে তাহার একই কথা, সে কিছুতেই কোন কথার উত্তর প্রদান করিবে না। যাহা হউক মস‍্লিম‍্কে সেই স্থান হইতে কলিকাতায় আনিলাম।

 অপরাপর যে সকল কর্ম্মচারী এই মকর্দ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন তাহারাও মস‍্লিম‍্কে লইয়া নানারূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কেহ বা তাহাকে নানারূপ ভয় প্রদর্শন করিতে লাগিলেন, কেহ বা তাহাকে মিষ্ট কথায় ভূলইয়া তাহার অন্তরের কথা বাহির করিয়া লইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু কেহই কোনরূপে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। মস‍্লিমে‍র অনুচরগণ যখন প্রথম ধৃত হয় সেই সময় আমরা তাহাদিগের দেশ প্রভৃতির বিষয়, জিজ্ঞাসা করিয়া ছিলাম, ও তাহার উত্তরে তাহার যাহা বলিয়াছিল তাহা লিখিয়াও লইয়াছিলাম, সেই সকল স্থানে লোক পাঠাইয়া অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু সেই নামের কোন ব্যক্তি বা সেরূপ কোন স্থান পাওয়া গেল না।

 মস‍্লিমের ঘরে যে সকল অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছিল কেবল ঐ সকল অলঙ্কার লইয়াই উহার উপর দুইটী মকর্দ্দমা পুনরায় রুজু হইল। একটী তারামণীর গৃহে সিঁদ দিয়া তাহার যথা সর্ব্বস্ব অপহরণ করায়, অপরটী বেলা নাম্নী স্ত্রীলোকের অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, ও যে সকল অলঙ্কারের সহিত তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না, সেই সকল অলঙ্কার অপহরণ করায়।

 বেলা যে হত হইয়াছে তাহার মৃতদেহ তারামণীর লোহার সিন্ধুকের ভিতর পাওয়া গিয়াছে; ইহা অকাট্য সত্য হইলে ও ইংরাজ আইনের গুণে যে কথা প্রমণিত করিতে পারিলাম না। বেলাকে হত্যা করার প্রধান প্রমাণ তারামণী, কিন্তু সে বলিতে পারে না যে স্ত্রীলোকটীকে তাহার সম্মুখে হত্যা করা হইয়াছে তাহার নাম বেলা। যে মৃতদেহ লোহার সিন্ধুকের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে উহা যে বেলার মৃতদেহ তাহা প্রমাণ করিবার ক্ষমতাও আমাদিগের নাই কারণ সেই সময় ঐ মৃতদেহ সনাক্ত হয় নাই বা উহার ফটোগ্রাফ প্রভৃতি কিছুই সেই সময় লওয়া হয় নাই, কারণ মৃতদেহ যখন পাওয়া যায় সেই সময় উহা নিতান্ত গলিত অবস্থায় ছিল; ফটোগ্রাফ লইবার কোনরূপ উপায় ছিল না। সুতরাং মস‍্লিম্ ওরফে ওসমান আলির উপর খুনি মকর্দ্দমা কোন রূপেই রুজু হইত পারিল না।

 উভয় মোকর্দ্দমাই কিন্তু আমরা পরিশেষে বিচারার্থ প্রেরণ করিলাম। মেজিষ্ট্রেট সাহেব সমস্ত প্রমাণাদি গ্রহণ করিয়া তিনিও এই মোকর্দ্দমার প্রকৃত অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিলেন কিন্তু তিনি নিজে উহাদিগকে কোনরূপ দণ্ডে দণ্ডিত না করিয়া উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইবার নিমিত্ত তিনি উহাদিগকে দায়ৱায় সোপরদ্দ করিলেন।

 দায়রার বিচারে সর্ব্বপ্রথম এক মহাতর্ক উখিত হইল। একবার যখন তারামণীকে হত্যা করা অপরাধে ও তাহার অলঙ্কারপত্র অপহরণ করা অপরাধে মস‍্লিমের বিচার হইয়া সে অব্যাহতি পাইয়াছে তাহার উপর তখন এই মোকর্দ্দমা পুনরায় চলিতে পারে না। এই তর্কের মিমাংসা পরিশেষে হাইকোর্ট হইতে হইয়া মস‍্লিমের পুনরায় বিচার হয়, ও বিচারে তারামণীর অলঙ্কার অপহরণের নিমিত্ত তাহার কঠিন পরিশ্রমের সহিত পাঁচ বৎসর কারাদণ্ড হয়। বেলার মোকর্দ্দমা বেলার অবর্ত্তমানে প্রমাণিত হয় না সুতরাং ঐ মোকর্দ্দমায় তাহাকে কোনরূপে দণ্ড গ্রহণ করিতে হয় না।*


*আষাঢ় মাসের সংখ্যা,

মণিপুরের

“সেনাপতি।”

(প্রথম অংশ।)

(অর্থাৎ টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের জন্ম হইতে ১৩ই আগষ্ট ফাঁসী হওয়ার

দিবস পর্য্যন্ত যাবতীয় ঘটনার আশ্চর্য্য রহস্য!)

যন্ত্রস্থ।