গুপ্ত রহস্য/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
যে দিবস দিবা দ্বিপ্রহরের সময় মসলিমের সহিত আমার কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, সেই রাত্রিতে ঐ বাড়ীর ভিতর একটী ভয়ানক লোমহর্ষণ ব্যাপার সংঘটিত হয়। সেই দিবস সন্ধ্যার পর মসলিম্ ও অপর দুই ব্যক্তি ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায় ও রাত্রী আন্দাজ নয়টার সময় উহারা একটা স্ত্রীলোকের সহিত পুনরায় প্রত্যাগমন করে। ঐ স্ত্রীলোকটী যখন ঐ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয় তখন আমি উহাকে দেখিয়াছিলাম। ঐ স্ত্রীলোকটী অতিশয় সুন্দরী না হইলেও বয়ঃক্রমে তাহাকে যুবতী বলিয়া অনুমান করিয়াছিলাম ও দেখিয়াছিলাম উহার অঙ্গে অনেকগুলি সুবর্ণনির্ম্মিত অলঙ্কার ছিল। কিন্তু ঐ স্ত্রীলোকটী যে কে, কোথায় হইতে সে আনীতা হইল ও কেনই বা আসিল তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। যে ঘরে আমার থাকিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল, তাহারই পার্শ্বে একটা প্রকোষ্ঠে উহাকে রাখিল। কেবল একমাত্র স্ত্রীলোককে ঐ বাড়ীর ভিতর দেখিতে পাইয়া তাহার সহিত কথা কহিবার মানসে আমি তাহার নিকট গমন করিলাম, কিন্তু মসলিন্ উহা দেখিতে পাইয়া আমাকে উহার নিকট যাইতে নিষেধ করিল; সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আমি আপন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম। এই উভয় প্রকোষ্ঠের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র গবাক্ষ ছিল। উহা সর্ব্বদা বন্ধ থাকিত, আমার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়া ঐ গবাক্ষটী ধীরে ধীরে অতি অল্প পরিমাণে উন্মোচীত করিলাম। অর্থাৎ এরূপ ভাবে ও এরূপ পরিমাণে উহা খুলিলাম ধে উহা দেখিয়া কেহ অনুমান করিতে না পারেন যে আমি উহা খুলিয়াছি। অথচ উহার মধ্য দিয়া আমি দেখিতে পাই যে অপর প্রকোষ্ঠে কি হইতেছে।
ঐ স্ত্রীলোকটীকে মসলিম্ প্রথমতঃ সঙ্গে লইয়া সেইঘরের ভিতর উপবেশন করিল। ঐ দস্যগণের মধ্যে হইতে এক এক করিয়া ক্রমে আরও পাঁচ ছয় জন লোক ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া ক্রমে সকলে একত্রে উপবেশন করিল ও ঐ স্ত্রীলোকটীর সহিত ক্রমে উহারা হাসি ঠাট্টা আরম্ভ করিয়া সময় অতিবাহিত করিতে লাগিল। ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল, যে বাড়ীটীর কথা আমি বলিতেছি তাহা একে নির্জন স্থানে স্থাপিত ছিল, তাহার উপর রাত্রি অধিক হইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ স্থান আরও নিস্তব্ধ হইয়া পড়িল। সেই সময় দেখিলাম একটা সামান্য তুচ্ছ কথা অবলম্বন করিয়া ঐ স্ত্রীলোকটীর সহিত উহারা ক্রমে বচসা আরম্ভ করিল। আমি আমার ঘরে বসিয়া উহাদিগের আদ্যোপান্ত অবস্থা দর্শন ও উহাদিগের কথাবার্ত্তা সমস্তই শ্রবণ করিয়াছিলাম, সুতরাং আমি বেশ জানিলাম যে এই কলহে ঐ স্ত্রীলোকটীর কিছুমাত্র দোষ ছিল না, সমস্ত দোষই ঐ দস্যুগণের। স্ত্রীলোকটী ভাল কথা বলিলেও উহারা তাহার বিপরীত অর্থ করিয়া, তাহার সহিত মিথ্যা কলহ করিতে আরম্ভ করিল। প্রথম প্রথম আমি বুঝিতে পারিলাম না যে উহারা নিরর্থক ঐ স্ত্রীলোকটীর সঙ্গে কলহ করিতেছে কেন? আমি তখন বুঝিতে পারিলাম না যে এই নিরর্থক কলহের উদ্দেশ্য কি? ও তখন আমি বুঝিতে পারিলাম না যে ঐ কলহে ঐ দস্যুগণের কোনরূপ স্বার্থ আছে কি না? কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, কিরূপ ভয়ানক স্বার্থের বশবর্ত্তী হইয়া উহারা ঐ স্ত্রীলোকটীর সহিত এই মিথ্যা কলহ উপস্থিত করিয়াছিল। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে উহারা সামান্য স্বার্থের বশবর্ত্তী হইয়া কি ভয়ানক নিসৃংস কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার মানসে এই কলহের সূত্রপাত করিয়াছিল। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে সেই নিতান্ত সামান্য স্বার্থ কি ও সেই স্বার্থের বশবর্ত্তী হইয়া উহার কিরূপ ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল।
আপনারা অনেক দস্যু দেখিয়াছেন; দস্যুবৃর্ত্তি যাহাদিগের ব্যবসা, দস্যুবৃর্ত্তি করিয়া যাহারা জীবন ধারণ করিয়া থাকে এরূপ শত সহস্র দস্যু আপনাদিগের হস্তগত হইলেও এরূপ দস্যু আপনারা কখনই দেখেন নাই। আপনারা অনেক হত্যাকারী দেখিয়াছেন, অনেক হত্যা মোকদ্দমার আপনার অনুসন্ধান করিয়াছেন, অনেক হত্যাকারী আপনাদিগের সম্মুখে দণ্ডনীয় হইয়া চির জীবনের নিমিত্ত ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া পরলোক গমন করিয়াছে; কিন্তু আমি বলিতে পারি এরূপ হত্যাকারী এ পর্যন্ত আপনাদিগের হস্তগত হয় নাই।
ঐ স্ত্রীলোকটার সহিত কলহ বাধাইয়া দিয়া দেখিলাম সকলেই একপক্ষ অবলম্বন করিল। সকলেই ঐ স্ত্রীলোকটীর বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া তাহাকে যংপরোনাস্তি গালিগালাজ করিতে, লাগিল, কেহ কেহ বা তাহাকে অল্প অল্প প্রহার দিতেও পশ্চাৎপদ হইল না; কেহ বা তাহার অঙ্গ হইতে কতকগুলি অলঙ্কার উন্মাচিত করিয়া লইল। স্ত্রীলোকটীকে সকলই সহ্য করিতে হইল। প্রথম প্রথম সে একটু জোর করিয়াছিল, কিন্তু পরে বুঝিল সেই স্থানে সেই অবস্থায় জোর করিলে তাহার অপকার ভিন্ন উপকারের সম্ভাবনা নাই। প্রথম প্রথম সে চিৎকার করিয়াছিল কিন্তু পরে দেখিল চিৎকার করিতে গিয়া হিতের পরিবর্ত্তে তাহার বিপরীত ফল ফলিতে আরম্ভ করিল। উহাদিগের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল যদি ও চিৎকার করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে উহার মুখের ভিতর একখানি বস্ত্র প্রবিষ্ট করাইয়া দেও। এই কথা শুনিয়া ঐ স্ত্রীলোকটী আর কোনরূপ কথা বলিতে সাহসী হইল না। সেই স্থানে বসিয়া বসিয়াই মনের দুঃখে কষ্টে ও যন্ত্রণায় কেবল অশ্রুজল বিসর্জ্জন করিয়া আপনার বুক ভাসাইতে লাগিল। ঐ স্ত্রীলোকটী যে কে কেনই বা সে ঐ স্থানে আসিল ও কি নিমিত্তই বা তাহার উপর এইরূপ অত্যাচার হইতেছে তাহার কিছুমাত্র আমি অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। সেই সময় দেখিলাম আর একটী লোক সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, তাহাকে দেখিয়া অপরাপর ব্যক্তিগণ যেন একটু জড়সড় হইয়া পড়িল। সেই ব্যক্তি উহাদিগকে গালি দিতে আরম্ভ করিল ও কহিল “এই নিঃসহায় স্ত্রীলোকটীর উপর তোরা এরূপ অত্যাচার করিতেছিস কেন? সামান্য স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার করিয়া তোদের কি লাভ হইতেছে?” এই বলিয়া ঐ স্ত্রীলোকটীর দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল—“তোমার দেখিতেছি বড়ই কষ্ট হইয়াছে, ও পিপসায় তোমার মুখ শুখাইয়া গিয়াছে। জল আনিয়া আমি তোমাকে দিতেছি, পান করিয়া একটু সুস্থ হও, তাহার পর আমি তোমাকে তোমার স্থানে পাঠাইয়া দিব। এই বলিয়া এক গ্লাস জল আনিয়া সে ঐ স্ত্রীলোকটীর হস্তে প্রদান করিল। স্ত্রীলোকটী প্রকৃতই অতিশয় তৃষাতুরা হইয়া পড়িয়াছিল। জলপূর্ণ গ্লাস তাহার হস্তে প্রদান করিবা মাত্র সে এক নিশ্বাসে ঐ এক, গ্লাস জল পান করিল। জল পান করিবার পর হইতেই তাহার অবস্থা যেন কেমন একরূপ বোধ হইতে লাগিল। ক্রমে যন্ত্রণায় সে ছটফট করিতে আরম্ভ করিল; এইরূপে কিয়ৎক্ষণ পর্যন্ত সে ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করিয়া ক্রমে সে সেই স্থানে শয়ন করিল, ও ক্রমে সে সমস্ত যন্ত্রণার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইল।
এই অবস্থা দৃষ্টে তখন আমার যেন অনুমান হইল যে যাহারা তাহার সহিত মিথ্যা কলহ উৎপাদন করিয়া তাহাকে নানারূপে যন্ত্রণা প্রদান করিতেছিল, তাহার উপর যাহারা তাহাকে প্রহারাদি করিয়া তাহার মনের কষ্ট ও যন্ত্রণাকে দ্বিগুণিত করিতেছিল, তাহাদিগকে নিতান্ত নির্দ্দয় ভাবে গ্রহণ করিলেও এখন দেখিতেছি ঐ স্ত্রীলোকের নিতান্ত ইষ্টকারী পরিচয়ে যিনি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, তাহার অপেক্ষা উহারা সহস্র গুণে ভাল। উহারা শত্রু পরিচয়েই উহাকে কষ্ট প্রদান করিতেছিল কিন্তু মিত্র পরিচয়ে উহার সর্ব্বনাশ সাধন করে নাই। মিত্র জ্ঞানে যাহাকে বিশ্বাস করা যায়, তাহার দ্বারা এইরূপ কার্য্য সমাধান হইলে তাহাকে কি বলিয়া যে অভিবাদন করিতে হয়, তাহা আমার ন্যায় সামান্য বুদ্ধির স্ত্রীলোক অবগত নহে। জানিনা এই কার্য্য সকলের পরামর্শ মত হইল কি না, জানিনা সকলে পরামর্শ করিয়া কেহ বা তাহার শত্রু ও কেহ বা তাহার মিত্র সাজিয়া এই ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়া ঐ স্ত্রীলোকটীর সর্ব্বনাশ সাধন ও তাহার পরিহিত অলঙ্কার গুলি অপহরণ করিল কি না? জানিনা এই হত্যা কাণ্ডে সকলেই সম্মিলিত আছে কি না?
এই রূপে হত হইয়া ঐ স্ত্রীলোকটী ঐ ঘরের মধ্যেই পড়িয়া রহিল। দস্যগণ উহার অঙ্গস্থিত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া লইয়া, ঐ ঘরে তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া তাহাদিগের থাকিবার ঘরে গমন করিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমারও অন্তরাত্মা শুখাইয়া গেল, আমিও এক রূপ হতবুদ্ধি ও অজ্ঞান হইয়া আমার ঘরের মধ্যে পড়িয়া রহিলাম। পর দিবস প্রত্যুষে দেখিলাম যে ঘরের ভিতর উহারা ঐ মৃত দেহ তালাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল ঐ ঘর উন্মোচিত অবস্থায় রহিয়াছে ও উহার ভিতর মৃত দেহ প্রভৃতি কিছুই নাই। রাত্রিকালে উহারা যে ঐ মৃত দেহ কোথায় লইয়া গেল তাহার কিছু মাত্র অবগত হইতে পারিলাম না।