গুপ্ত রহস্য/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
এই রূপে ক্রমে বেলা দুই প্রহর অতীত হইয়া গেল। সেই সময় আমি দেখিলাম যে মসলিম্ (অবশ্য তাহার নাম আমি সেই সময় জানিতাম না) আমার ঘরের সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছে। আমি তাহাকে ডাকিলাম, সেও আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। তখন আমি তাহাকে কহিলাম, “বাবা তোমরা তো আমার যথা সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছ, কিন্তু তাহাতে আমি তোমাদিগকে কিছুই বলি নাই। আমার বৃদ্ধ বয়সের নিমিত্ত যাহা কিছু সংস্থান ছিল তাহার সমস্তই তোমরা গ্রহণ করিয়াছ বলিয়া আমি এখনও তোমাদিগকে কিছু বলিতেছি না; কিন্তু আমাকে এখানে ধরিয়া আনিলে কেন? আমি এখন বৃদ্ধা হইয়া পড়িয়াছি। আমার দ্বারা তোমাদিগের কোনরূপ উপকারের সম্ভাবনা নাই, বা আমার দ্বারা যে তোমাদের কোনরূপ কার্য্য সম্পন্ন হইবে এরূপ আশাও তোমরা করিও না। তোমরা আমাকে এখন ছাড়িয়া দেও, আমি আপন স্থানে গমন করি। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে, তোমরা আমাকে ছাড়িয়া দিলে তোমাদিগের কথা, বা তোমাদিগের বাসস্থানের কথা আমি কাহাকেও বলিব না; এমন কি আমার ঘরে যে সিঁদ হইয়াছে তাহাও আমি কাহাকেও কহিব না।”
আমার কথার উত্তরে মসলিন্ কহিল, “আমাদিগের কোনরূপ উদ্দেশ্য আছে বলিয়াই আমরা তোমাকে এই স্থানে আনিয়াছি ও এই স্থানে তোমাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। তুমি যতই কেন রোদন করনা বা এই স্থান হইতে পলায়ন করিবার যতই কেন চেষ্টা করনা কিছুতেই তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না। অভাব পক্ষে পোনের দিবস কাল তোমাকে এই স্থানে থাকিতে হইবে, তাহার পর তোমাকে ছাড়িয়া দিব, তুমি ইচ্ছামত আপন স্থানে গমন করিও। এখানে যে কয় দিবস তুমি থাকিবে, সেই কয় দিবস তোমার কোনরূপ কষ্ট হইবে না, তুমি আমাদিগের প্রস্তুত আহারীয় খাইতে চাহিলে অনায়াসে খাইতে পারিবে; আর তাহা যদি না চাও তাহা হইলে তোমার যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইবে তাহা আমাদিগকে বলিবা মাত্রই প্রাপ্ত হইবে ও স্বহস্তে অনায়াসেই রন্ধনাদি করিয়া খাইতে পারিবে। এই স্থানে তোমাকে আর একটা কথা বলিয়া রাখি, মনোযোগ দিয়া তাহা শ্রবণ কর। তোমার যথা সর্ব্বস্ব যে আমরা অপহরণ করিয়া আনিয়াছি, তাহাতে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু জানিও, যে পোনের দিবস কাল তুমি এই স্থানে অবস্থিতি করিবে সেই পোনের দিবসের মধ্যে আমরা জানিতে পারিব তুমি কিরূপ চরিত্রের স্ত্রীলোক, তুমি কিরূপ আমাদের আজ্ঞানুবর্ত্তী হইয়া চল ও তুমি কোনরূপ দয়ার পাত্রী কি না? যদি বুঝিতে পারি যে তুমি প্রকৃতই দয়ার পাত্রী, তাহা হইলে তুমি নিশ্চয় জানিও যে তোমার অপহৃত দ্রব্যের কিয়দংশ আমরা তোমাকে প্রত্যার্পন করিব। উহা লইয়া তুমিও আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিতে পারিবে। আর যদি জানিতে পারি যে তুমি দয়ার পাত্রী নহ, তাহা হইলে ঐ পোনের দিবস পরে তোমাকে এই স্থান হইতে দূরীভূত করিয়া দিব”। এই বলিয়া মসলিম্ এই স্থান হইতে প্রস্থান করিল।
মসলিমের প্রমুখাৎ এই অবস্থা অবগত হইয়া আমি মনে মনে স্থির করিলাম যে দস্যুগণের সহিত কলহ করিয়া কোন লাভ নাই। পোনের দিবস কাল উহারা আমাকে এই স্থানে রাখিবে বলিতেছে। এখন আমি যতই চেষ্টা করি না কেন ইহাদিগের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইবার কোনরূপ উপায় করিয়া উঠিতে পারিব না; অথচ যদি উহাদিগের কথা প্রকৃত হয়, উহাদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারিলে আমার ঘর হইতে অপহৃত দ্রব্যের কিয়দংশ যদি প্রত্যর্পন করে, তাহা হইলেও আমার বৃদ্ধ বয়সে কিছু না কিছু সংস্থান হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই স্থানে পোনের দিবস কাল অবস্থিতি করিয়া যদি উহাদিগকে কোনরপে সন্তুষ্ট করিতে পারি তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। আহারাদি করিবার নিমিত্ত যে কোন দ্রব্য আমি উহাদিগের নিকট হইতে যাচিঞা করিতাম তাহা প্রাপ্ত হইতাম। উহা স্বহস্তে রন্ধন করিয়া আমি ভক্ষণ করিতাম ও আমার নির্দ্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে শয়ন ও উপবেশন করিয়াই দিনযাপন করিতাম।