গুপ্ত রহস্য/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 তারামণি কহিল যে দিবস ও যেরূপ ভাবে আমার ঘর হইতে চুরি হয় তাহাই আপনাদিগকে অগ্রে বলিতেছি।

 যে রাত্রিতে আমার ঘরে সিঁদ হয় সেই রাত্রিতে নিয়মিতরূপ আহারাদি করিয়া আমি আমার ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া নিয়মিতরূপ আপন শয্যার উপর শয়ন করি ও ক্রমে নিদ্রিত হইয়া পড়ি। রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় কোনরূপ শব্দ শুনিয়া হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়; সেই সময় আমার ঘরের মধ্যে একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। ঐ আলোর সাহায্যে আমি দেখিতে পাই আমার ঘরের ভিতর তিন জন লোক প্রবেশ করিয়াছে ও আমার ঘরস্থিত দ্রব্যাদি অপহরণ করিবার চেষ্টা করিতেছে। আরও দেখিলাম আমার ঘরের পশ্চাৎ দিকের দেওয়ালে একটী প্রকাণ্ড সিঁদ হইয়াছে। বুঝিলাম ঐ সিঁদের মধ্য দিয়াই চোরগণ আমার ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আমি স্ত্রীলোক, বিশেষ ঐ ঘরের মধ্যে আমি একাকী শুইয়াছিলাম। হঠাৎ নিদ্রা ভঙ্গ হইলে, ঘরের ভিতর দস্যুদিগকে দেখিয়া আমি একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। আমার মুখ দিয়া একটা কথাও বহির্গত হইল না। এরূপ অবস্থায় সাহসিক পুরুষগণের অবস্থা যেরূপ হইয়া থাকে তাহা আপনারা অবগত আছেন। আমি স্ত্রীলোক, এরূপ অবস্থা দৃষ্টে সেই সময় আমার অবস্থা যে কিরূপ হইয়াছিল তাহা আর আপনাদিগের নিকট আমাকে বলিতে হইবে না। বিশেষ সেই অবস্থা বর্ণন করিবার ক্ষমতাও আমার নাই। আপনারা অনায়াসেই আমার সেই সময়ের অবস্থা অনুমান করিয়া লইতে সমর্থ হইবেন।

 আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ দস্যুগণের মধ্যস্থিত দুই ব্যক্তি আমার সন্নিকটে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। উহাদিগের মধ্যে এক জনের হস্তে এক খানি তীক্ষ ছুরিকা বা ভোজালী ছিল। সে ঐ অস্ত্র খানি আমার বুকের নিকট ধরিয়া, আমাকে কহিল, এখন যদি তুই কোনরূপ গোলযোগ করিবি বা চেঁচাইবার জন্য বা কথা কহিবার চেষ্টা করিবি তাহা হইলে দেখিবি এই তীক্ষ্ণ অস্ত্র এখনই তোর বুকের ভিতর প্রবিষ্ট হইবে।

 সেই সময় অপর ব্যক্তি কহিল তোর বাক্স প্যাঁটরা প্রভৃতির চাবিগুলি কোথায়? উহা আমাদিগকে এখনই প্রদান কর। নতুবা আমার হস্তে এখনই তুই শমন সদনে গমন করিবি। তাহাদিগের কথা শুনিয়া আমি ভাবিলাম, অপরের হস্তে অপঘাত মৃত্যু অপেক্ষা আমার যথা সর্ব্বস্ব অপহৃত হওয়াই মঙ্গল। এই ভাবিয়া আমার চাবিগুচ্ছ যাহা আমি আমার বিছানার নিম্নে লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা বাহির করিয়া উহার হস্তে প্রদান করিলাম। সেই ব্যক্তি উহা দ্বারা তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্যে আমার ঘরস্থিত বাক্স প্যাঁটরা প্রভৃতি খুলিতে আরম্ভ করিল। যে ব্যক্তি ছুরিকা হস্তে আমার নিকট দণ্ডায়মান ছিল, সে আমার অঙ্গস্থিত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া দিতে কহিল। আমি নিতান্ত ভীতিবিহ্বল চিত্তে এক একখানি করিয়া আমার পরিহিত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া তাহার হন্তে অর্পন করিলাম। যাহারা বাক্স প্যাঁটরা প্রভৃতি খুলিতেছিল তাহারা একটা বাক্সের মধ্য হইতে আমার লোহার সিন্দুকের চাবি বাহির করিল; ও ঐ চাবি দ্বারা ঐ লোহার সিন্দুক খুলিয়া তাহার ভিতর সোনা রূপার অলঙ্কার ও নগদ অর্থাদি যাহা কিছু ছিল তাহা সমস্তই বাহির করিয়া লইল। এইরূপে যাহা কিছু মূল্যবান দ্রব্য আমার ঘরে ছিল তাহার সমস্তই উহারা আত্মসাৎ করিয়া পরিশেষে দুই বাক্তি আমার ঘরের দরওয়াজা খুলিয়া ও আমাকে তাহাদিগের সঙ্গে লইয়া সেই ঘর হইতে বহির্গত হইল। আমরা ঘরের বাহিরে আসিলে তৃতীয় ব্যক্তি যে ঘরের তিতর ছিল সে পুনরায় ঐ ঘরের দরওয়াজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া সিঁদের মধ্য দিয়া ঘরের বাহিরে আসিল, ও পরিশেষে তিন জন একত্রিত হইয়া অপহৃত দ্রব্য সকল ও আমাকে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। সেই সময়ে আমি উহাদিগের ভয় প্রদর্শনে এপ ভীত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে আমার মুখ দিয়া একটা মাত্র কথাও বহির্গত হইল না। ইহারা যেরূপ ভাবে আমাকে যাইতে বলিল, আমি সেইরূপ ভাবেই উহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতে লাগিলাম। আমি জানি না যে কোথায় যাইতেছি ও কেনই বা যাইতেছি। উহারা আমাকে বলিল না যে আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছে ও কেনই বা লইয়া যাইতেছে; তথাপি কিন্তু আমি তাহাদিগের ইচ্ছানুবর্ত্তী হইয়া তাহাদিগের সমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিলাম। যে পাড়ার ভিতর আমার বাসস্থান, ক্রমে সেই পাড়া অতিক্রম করিয়া আমি তাহাদিগের সহিত চলিতে লাগিলাম। গভীর রজনীর আবরণে পাড়ার কেহই আমাদিগকে দেখিতে পাইল না—বা কেহই জানিতে পারিল না যে আমরা কোথায় যাইতেছি। ক্রমে আমরা সকলেই সদর রাস্তায় আসিয়া উপনীত হইলাম, দেখিলাম সেই স্থানে এক খানি গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। —গাড়ীর উপরে এক জন কোচওয়ান ভিন্ন আর কেহই নাই, ভিতরেও কেহ ছিল না। গাড়ীর নিকট আগমন করিয়া ঐ তিন ব্যক্তি আমার ঘর হইতে অপহৃত দ্রব্যাদির সহিত সেই গাড়ীর ভিতর আরোহণ করিল। আমাকেও সেই সঙ্গে উঠাইয়া লইল। আমরা গাড়ীতে উপবিষ্ট হইবার পর, ঐ গাড়ীর উভয় পার্শ্বের দরওয়াজা উহারা বন্ধ করিয়া দিল ও গাড়ী চলিতে আরম্ভ করিল। অনেকক্ষণ চলিবার পর ঐ গাড়ী এক স্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। সেই স্থানে ঐ গাড়ীর দরওয়াজা খুলিলে দেখিতে পাইলাম একটী দ্বিতল বাড়ীর সম্মুখে ঐ গাড়ী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ঐ স্থানে আরোহিগণ গাড়ী হইতে অবতরণ করিল ও আমাকেও গাড়ী হইতে নাবাইয়া লইয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমরা বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইবা মাত্র ঐ বাড়ীর সদর দরওয়াজা এক ব্যক্তি ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিল। বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলাম যে বাড়ীটী নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। উপর ও নিম্নে প্রায় পোনের যোলটী ঘর, কিন্তু ঘরগুলি অধিকাংশই শূন্য অবস্থায় পতিত আছে। কেবল মাত্র একটা ঘরে উহারা বাস করে, ও অপর একটী ঘরে উহাদিগের রন্ধনাদি হইয়া থাকে।

 ঐ বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলে উহারা ঐ বাড়ীর মধ্যস্থিত একটা খালি ঘরে আমার থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিল। অনন্যোপায় হইয়া আমাকে সেই স্থানেই থাকিতে হইল। তখন পর্য্যন্ত আমি জানিতে পারিলাম না, যে কেনই বা উহারা আমাকে সেই স্থানে লইয়া গেল, ও কেনই বা আমাকে সেই স্থানে রাখিয়া দিল। আমি যখন সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিলাম তখন রাত্রি ভোর হইয়া আসিয়াছিল ক্রমে সূর্যদেব উদয় হইলেন, আমিও আমার ঘর হইতে বহির্গত হইয়া দেখিলাম ঐ বাড়ীর সংলগ্ন আর কাহারও বাড়ী আছে কি না। আরও দেখিলাম ঐ বাড়ীর মধ্য হইতে বাহিরের কোন লোকের সহিত কথা কহিবার কোনরূপে উপায় আছে কি না ও আরও দেখিবার চেষ্টা করিলাম যে ঐ বাড়ীর মধ্য হইতে কোনরূপ উপায়ে পলায়ন করিবার পথ আছে কি না। কিন্তু দেখিলাম ঐ বাড়ীটী একটী বাগানের মধ্যে সংস্থাপিত। উহার এক দিকে রাস্তা ও অপর তিন দিকে আম্রাদি বৃক্ষ সংযুক্ত পতিত জমি; নিকটেও কাহারও বাসস্থান নাই, ঐ বাড়ী হইতে অপর কাহারও সহিত কথা কহিবার উপায় নাই বা কোন দিক্ দিয়া ঐ বাড়ী হইতে পলায়ন করিবার সুবিধা নাই। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে আমার থাকিবার নিমিত্ত উহারা ঐ বাড়ীর দ্বিতলের উপর একটা প্রকোষ্ঠ নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিল। আমি দ্বিতল হইতে ক্রমে নিম্নতলে গমন করিলাম। যে প্রকোষ্ঠে আট দশজন দস্যু অবস্থিতি করিতেছিল, তাহারা প্রায় সকলেই আমাকে নিম্নতলে যাইতে দেখিল কিন্তু কেহই আমাকে কিছুই বলিল না বা জিজ্ঞাসা করিল না যে আমি কোথায় যাইতেছি উহাদিগের মধ্যে কেবল দুই এক জন আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া একটু হাসিল মাত্র। আমি নীচে গমন করিলাম, ঐ বাড়ীর নিয়তলে গমন করিবার আমার এই মাত্র উদ্দেশ্য ছিল যে যদি দেখিতে পাই ঐ বাড়ীর কোন দরওয়াজা খোলা আছে বা ঐ রাড়ী হইতে বহির্গত হইবার অপর কোন উপায় আছে তাহা হইলে আমি ঐস্থান হইতে পলায়ন করিবার চেষ্টা করিব; কিন্তু নিম্নতলে গমন করিয়া দেখিলাম যে আমার উদ্দেশ্য সফল করিবার কোনরূপ উপায়ই নাই। বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিবার বা বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার কেবল মাত্র দুইটী দরওয়াজা আছে। একটী সদর দরওয়াজা অপরটী খিড়কী। দরওয়াজার নিকট গমন করিলাম, কিন্তু দেখিলাম আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার কোনরূপ উপায় নাই। দুইটা দরওয়াজার ভিতর হইতে তালা বদ্ধ ও দুইটা দরওয়াজার নিকটেই দুই জন করিয়া লোক উপবিষ্ট। আমি উহাদিগের প্রত্যেককেই ঐ দরওয়াজা খুলিয়া দিতে বলিলাম, কিন্তু কেহই আমার কথা, শুনিল না। অধিকন্তু আমাকে যৎপরোনাস্তি গালি দিয়া সেই স্থান হইতে আমাকে তাড়াইয়া দিল। আমি অনন্য উপায় হইয়া আমার থাকিবার নির্দ্দিষ্ট ঘরে পুনরায় গমন করিলাম ও সেই স্থানে বসিয়া অশ্রুজলে আপন বস্ত্র অভিষিক্ত করিতে লাগিলাম। আমার দিকে কেহই দৃষ্টিপাত করিল না, বা কেহই আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। আমি সেই ঘরের মধ্যে শুইয়া কেবল ক্রন্দন করিতে লাগিলাম।