গুপ্ত রহস্য/প্রথম পরিচ্ছেদ

গুপ্ত-রহস্য


প্রথম পরিচ্ছেদ।


 তারামণি যে কে তাহা পাঠকগণ ইতিপূর্ব্বে “মতিয়া বিবি” নামক পুস্তক পাঠে অবগত আছেন। তাঁহারা আরও অবগত আছেন যে, কিরূপে সিঁদ হইয়া তাহার ঘর হইতে তাহার যথাসর্ব্বস্য অপহৃত হয়, ও কিরূপে তাহার লোহার সিন্দুকের মধ্য হইতে একটী স্ত্রীলোকের মৃত দেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়। আরও অবগত আছেন যে ঐ লোহার সিন্দুকের ভিতর-প্রাপ্ত মৃত দেহ তারামণির মৃত দেহ সাব্যস্ত করিয়া আমরা কি ভয়ানক ভ্রমে পতিত ও কিরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলাম। ইতিপূর্ব্বে যদি আমাদিগের মনে কিছুমাত্র সন্দেহ হইত যে ঐ মৃত দেহ তারামণির নহে, অপর কোন স্ত্রীলোকের মৃত দেহ; তাহা হইলে মসলিম্‌কে তারামণির হত্যাকারী বলিয়া কখনই আমরা সাব্যস্ত করিয়া লইতাম না, বা হত্যাপরাধে বিচারকের নিকট তাহাকে বিচারার্থ কখনই প্রেরণ করিতাম না। সে যাহা হউক এখন তারামণি জীবিত, মসলিম্ বিচারকের নিকট হইতে অব্যাহতি পাইয়া তাহার দলবল বা বন্ধুবান্ধবের সহিত স্থানান্তরিত।

 প্রধান কর্মচারীর ইচ্ছা যে, তারামণির ঘরস্থিত লোহার সিন্দুকের অভ্যন্তরিণ প্রাপ্ত মৃত দেহের রহস্য যাহাতে উদঘাটিত হয়। এই নিমিত্তই তিনি আমাদিগের উপর ইহার পুনঃ অনুসন্ধানের ভার অর্পন করিয়াছেন।

 এখন এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইবার পর আমাদের মনে এই সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল যে মতিয়া বিবির মৃত দেহের সহিত, তারামণির লোহার সিন্দুকের মধ্যস্থিত মৃত দেহের কোনরূপ সম্বন্ধ আছে কি না? আর যদি সম্বন্ধই থাকে তাহা হইলেই বা কিরূপে ইহার যথাযথ অবস্থা নির্ণয় করিতে আমরা এখন সমর্থ হইব। ইতিপূর্ব্বে যে পর্য্যন্ত মসলিম্ ও তাহার অনুচরবর্গ আমাদিগের আয়ত্তাধিনের ভিতর ছিল তখন তাহাদিগের নিকট হইতে এ সম্বন্ধে কোন কথা প্রকাশ পাই নাই। এখন উহারা সকলেই আমাদিগের হস্তের বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছে ও কোথায় যে এখন ইহাৱা গমন করিয়াছে তাহার কিছুই আমরা এখন স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না; সুতরাং এই মোকদ্দমায় প্রধান কর্ম্মচারীর শেষ আদেশ যে আমরা কত দুর প্রতিপালন করিতে পারিব, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই অনুমান করিয়া লইতে পারেন। সে যাহা হউক, এখন দেখা যাউক তারামণি রহস্য কি? যে তারামণি হত হইয়াছে বলিয়া সর্ব্বসাধারণে অবগত হইয়াছিলেন, যাহার হত্যা সংবাদ, সংবাদ পত্র সম্পাদকগণ দ্বারে দ্বারে প্রচারিত করিয়াছিলেন; সেই তারামণির এখন জীবিতাবস্থায় সর্ব্ব সমক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইবার রহস্যই বা কি? এত দিবস পর্য্যন্ত তারামণি কোথায় ছিল, কিরূপেই বা মসলিম্ তাহাকে বিচারালয়ে আনিয়া উপস্থিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল এখন তাহাই দেখা যাউক। আরও দেখা যাউক তারামণির ঘর হইতে কোন মূল্যবান দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না? আর যদি অপহৃত হইয়াই থাকে তাহা হইলে কি কি দ্রব্য কিরূপে ও কাহা কর্ত্তৃক অপহৃত হইল।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমরা তায়ামণিকে ডাকিলাম, আমাদিগের কথা শুনিয়া, তারামণি আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলে আমরা তাহাকে কহিলাম, “তারামণি তোমার ঘর হইতে তোমার কোন মূল্যবান দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি? ও যদি হইয়াই থাকে তাহা হইলে বলিতে পার কি, কাহা কর্ত্তৃক তোমার সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে? ও তুমিই বা কিরূপে তোমার ঘর হইতে স্থানান্তরিত হইয়াছিলে ও এত দিবস পর্য্যন্ত কোথায় ও কিরূপে অবস্থিতি করিতেছিলে? ইহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা আমরা জানিতে বাসনা করি। আমাদিগের প্রস্তাবে যদি তোমার কোনরূপ আপত্য না থাকে তাহা হইলে, এই সকল বিষয়ের নিগুঢ় রহস্য কি, তাহা প্রকাশ করিয়া আমাদিগের কৌতুহল নিবারণ ও আমাদিগের বাসনা পরিতৃপ্ত কর।”

 আমাদিগের কথার উত্তরে তারামণি কহিল, “আমার ঘর হইতে, দস্যুগণ কিরূপে আমার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া যায় ও সেই সময় হইতে আমার অদৃষ্টে যে কিরূপ ভয়ানক কষ্ট ও দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হয়, ও এত দিবস পর্য্যন্ত যেরূপে আমি দিনযাপন করিয়াছি তাহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা আমি যতদুর স্মরণ করিয়া বলিতে পারিব তাহা আপনাদিগের নিকট বর্ণন করিতেছি। আমার অবস্থা শুনিলে, আমি কিরূপ দুর্ব্বিপাকে পতিত হইয়াছিলাম তাহা জানিতে পারিলে, আপনারা অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন যে, সভ্য অধিবাসীগণ পূরিত, ও সুবিজ্ঞ রাজ কর্ম্মচারীগণের দ্বারা শাসিত এই ভারত রাজধানীর মধ্যে এখন পর্য্যন্ত কিরূপ ভয়ানক ভয়ানক কার্য্য সকল চলিতেছে। আমার কথা শুনিলে আপনারা জানিতে পারিবেন যে, এই সুসভ্য ইংরাজ রাজত্যের মধ্যে শান্তির স্রোত প্রবাহিত থাকিলেও ভয়ানক ভয়ানক অশান্তি তরঙ্গ উখিত হইয়া নিরীহ অধিবাসীগণকে সময় সময় কিরূপে আপ্লুত করিতেছে। বিচারকগণের হস্তে শাসন দণ্ড স্থাপিত থাকিলেও সময়ে সময়ে সেই দণ্ড একেবারে অকর্ম্মণ্য হইয়া প্রজাহিতের পক্ষে অন্যরূপ ধারণ করিয়া নিরীহ অধিবাসীবর্গের সর্ব্বনাশ সাধন করিতেছে। আমার চিরদিবসের বিশ্বাস ছিল যে পাপ করিলে তাহার প্রতিফল আছে, কিন্তু এখন দেখিতেছি আমার সেই বিশ্বাস ভ্রমাত্মক। আমার বিশ্বাস ছিল যে পুণ্যেরই সদা সর্ব্বদা জয় লাভ হইয়া থাকে, কিন্তু এখন দেখিতেছি পাপের জয় ক্রমে সর্ব্বব্যাপী হইয়া দাঁড়াইতেছে। আমার বিশ্বাস ছিল দুষ্কর্ম্ম করিলে তাহাকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইতে হয়, কিন্তু এখন দেখিতেছি যে যে দুষ্কর্ম্মকারী তাহারই জয়লাভ হইয়া থাকে; আর যে সৎপথ অবলম্বন করিয়া নিরীহ ভাবে দিনাতিপাত করিবার চেষ্টা করে, পদে পদে তাহাকেই বিপদ সাগরে পতিত হইয়া হাবুডুবু খাইতে হয়। আগে জানিতাম সর্ব্বস্থানে নিরীহ লোক মনের সুখে দিনযাপন করিয়া থাকে, কিন্তু এখন দেখিতেছি দুষ্ট লোকেই সুখ স্বচ্ছন্দে দিনযাপন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যে সকল ব্যক্তি এখন পদে পদে দুষ্কর্ম্ম করিতেছে, প্রত্যেক কথায় মিথ্যা কথা কহিতেছে, পরের দ্রব্য সদা সর্ব্বদা অপহরণ করিয়া যে জলের মত অর্থ ব্যয় করিতেছে, পরের কুলে কালি লাগাইয়া যে দূরে দাঁড়াইয়া হাঁসিতেছে এখন দেখিতেছি তাহাদিগেরই জয়। তাহারাই মনের সুখে দিনযাপন করিতেছে। জানি না এখনও ভগবান আছেন কি না, জানি না, ঐ সকল লোককে তাহাদিগের কৃত কর্ম্মের ফলাফল ভোগ। করিতে হইবে কি না। সে যাহা হউক আমি দুষ্ট লোকের হস্তে পতিত হইয়া যেরূপ কষ্ট ও মনঃস্তাপ সহ্য করিয়াছি তাহাই আমি এখন আপনাদিগের নিকট বর্ণন করিতেছি।