গোপীচন্দ্রের গান (প্রথম খণ্ড)/নাপিত খণ্ড

নাপিত খণ্ড

পণ্ডিত খণ্ড গান গ্যাল উত্তরিয়া।
নাপিত খণ্ড গান পড়িল আসিয়া॥
কিবা কর ভাই খেতুআ নিছন্তে বসিয়া।
জলদি নাপিত বেটাক জোগাও তো আনিয়া॥[১]
জখন ধম্মি রাজা একথা বলিল।
রদুনা পদুনা রানি কান্দিতে নাগিল॥
এই তো দিদি নাপিতক রাজা আনেছে ডাকিয়া।
মস্তক মুড়িয়া প্রানপতি জায়ত ছাড়িয়া॥
পাশ্‌শ টাকা দেই বান্দিক আঞ্চলে বান্দিয়া।
খোসা দিয়া আসুক নাপিতের মহলতে জাএয়া॥১০
আট দিন থাকে জ্যান নাপিত ভুঞিঘরা সোন্দাইয়া।
এই বুদ্ধি বান্দি দাসিক দিলেত শিখাএঞা॥
পাশ্‌শ টাকা ধরি গ্যাল বান্দি মহলক নাগিয়া॥
নাপিত নাপিত বলিয়া ডাকিতে নাগিল।
জ্যান কালে নাপিত বেটা বান্দিক দেখিল।১৫
বান্দির তরে কথা বলিতে নাগিল॥
এতদিন না আইস বান্দি মহলক চলিয়া।
আ’জ ক্যানে আইলেন বান্দি আমার মহলক নাগিয়া॥

বান্দি বলে—শোনরে নাপিত আমি বলি তোরে।
রানি মা পাঠাইয়া দিলে আপনার মহলে॥২০
পাশ্‌শ টাকা এক দুই করি ন্যাও আরো গনিয়া।
আট দিন থাকবু ভুঞিঘরাএ সোন্দেয়া॥
জ্যান কালে নাপিত বেটা এই কথা শুনিল।
কোর্‌দ্দ হৈয়া বান্দিক কথা বলিতে নাগিল॥
নিয়া জা তুই টাকাকড়ি ফিরিয়া জা তুই ঘর।২৫
রানি সক্কল মারতে পারে এক ঋন দুই ঝুন।
ধম্মিরাজ শুনলে না থুইবে বংশেতে বিছন॥
জখনে নাপিত বেটা টাকা ফেরত দেবার চাইল।
ঘর হৈতে নাপিতের মাইয়া চটকিয়া ব্যারাইল॥
কোন দ্যাশে থাকহে নাপিত কোন দ্যাশে তোর ঘর।৩০
কোন দরিয়ার জল খাএয়া সব্বাঙ্গে পাতল॥
দিনান্তরে ব্যাড়াইস নাপিত কনি কাটিয়া।
চাউল মুস্‌ট কাচা কলা না পাইস খুঁজিয়া॥
পাশ্‌শ টাকা আসিল তোর দরজায় সাজিয়া।
ঐ গিলা টাকা নাপিত ক্যান দেইস আরো ফিরাইয়া॥৩৫
ন্যাও ন্যাও নাপিত টাকা ন্যাও গনিয়া।
এয়াতে জদি ধম্মি রাজা মন্দ ব’লবে তাত।
না থাকিম উঙার দ্যাশে অন্য দ্যাশে জাব।
ঐ গিলা টাকা দিয়া গরস্তি করি খাব॥
সুবুদ্ধি ছিল নাপিতের কুবোধ নাগাল পাইল।৪০
ঘরের মাইয়ার বুদ্ধিতে নাপিত বেটা টাকা হাত করিল॥
হাচি জেটি বাদা গিলা পড়িতে নাগিল॥
এক টাকা দিয়া একনা ভ্যাংনিয়া আ'ন্‌লো ডাক দিয়া।
বড় ঘরত মাজোত নিল ভুঞিঘরা খুড়িয়া॥
আট দিনকার খোরাক নাপিতক এক সাঞ্জ খোআএঞা।৪৫
ছাইলা ছোটর চুমুক খাইলে বদন ভরিয়া॥

আট দিন থাকিল নাপিত ভুঞিঘরা লুকাইয়া॥
আত্রি করে ঝিকিমিকি কোকিলাএ কাড়ে রাও।
শেত কাগাএ বলে আত্রি প্রভাও প্রভাও॥
রাজা বলে নাপিত বেটাকও আনিয়া জোগাও॥
রাজবাক্য খেতুআ ব্রথা না করিল।৫০
নাপিতক নাগিয়া খেতু গমন করিল॥
নাপিতের মহলে জাইয়া খেতু খাড়া হৈল॥
নাপিত নাপিত বলিয়া খেতু তুলি কাড়িল রাও।
হাতত তালি দিয়া ব্যারাইল নাপিতক বুড়া মাও॥[২]
ওরে খেতুআ,—কাইল নাপিত চলি গেইছে বইনেরো ঘর।৫৫
আটদিন অন্তরে আসিবে আপনার মহল॥
তেমনি চলিয়া জাইবে রাজার দরবার॥
একথা শুনিয়া খেতু ফিরিয়া ঘরে গ্যাল।
রাজার চাক্‌খসে জাএয়া কথা বলিতে নাগিল॥
মহারাজ, নাপিত বোলে গেইছে বইনেরি ঘর।৬০
আট দিন অন্তরে আইসবে আপনার মহল॥
রাজা বলে,—শোনেক খেতুআ প্রানের ভাই।
ইগিলা কথা মিছা আমি বিশ্‌শাস না পাই॥

দৌড় দিয়া জা খেতু পণ্ডিতের মহলক নাগিয়া।
বাপ কালিয়া পণ্ডিত ঠাকুরক আনেক ডাকিয়া॥
কোণ্টে গেইছে নাপিত বেটা দিয়া জাউক গনিয়া॥
একথা শুনিয়া খেতু কোন কাজ করিল।
পণ্ডিতের মহলক নাগি গমন করিল॥
পণ্ডিতের দারে জাএয়া খেতুআ খাড়া হৈল।
পণ্ডিত পণ্ডিত বলি খেতু ডাকাইতে নাগিল॥৭০
তুই বড় রসিয়া ঠাকুর তুই বড় রসিয়া।
মাতার উপর দুপর ব্যালা তাও আছ শুতিয়া॥
রাজার ধন ধরিয়া হইছে নুটানুটি।
আদ্দেক ধন ধরিয়া ঠাকুর তোমাক ডাকাডাকি॥
জখন ঠাকুর ধনের নাম শুনিল।৭৫
হাউক দাউক করিয়া ঠাকুর সাজিতে নাগিল॥
পাঞ্জি পুস্তক নিলে পণ্ডিত ঝোলোঙ্গা ভরিয়া।
রাজার দরবারক নাগি জাএছে চলিয়া॥
জখন ধর্ম্মিরাজ পণ্ডিতক দেখিল।
আপনা পালঙ্গ রাজা ঠাকুরক ছাড়িয়া দিল॥৮০
এই কারনে দৈবক ঠাকুর আন্নু ডাক দিয়া।
কোণ্টে গেইছে নাপিত বেটা দিয়া জাও গনিয়া॥
রাজবাক্য দৈবক ঠাকুর ব্রথা না করিল।
পাঞ্জি পুস্তক হস্তে নিয়া গনিতে নাগিল॥
গনিতে গনিতে ঠাকুর এক দুপর করিল।৮৫
সত্যরুপ কথা রাজাক বলিতে নাগিল॥
ওগো মহারাজ, তোমার ঘরের টাকা দেখি খোলায়া খাপর।
পাশ্‌শ টাকা খোসা দিছে রানি সক্কল॥

খোসা খাএয়া নাপিত আছে ভুঞিঘরার ভিতর॥
জ্যান কালে ধর্ম্মি রাজা একথা শুনিল।৯০
ঝাড়ির মুখের গামছা দিয়া ঠাকুরক ভিড়িয়া বান্ধিল॥
পালঙ্গের খুড়াএ ঠাকুরক আখেক বান্ধিয়া।
খেতুআক তরে কথা দ্যাএছে বলিয়া॥
কিবা কর ভাই খেতুআ নিছন্তে বসিয়া।
পাগলা হস্তি নেরে খেতু সাজন করিয়া॥৯৫
একখান কোদাল দে হস্তির শুড়তে বান্ধিয়া॥
নাপিতের বাড়িবনটা আইসেক খুড়িয়া।
ক্যামন গননা গ’নলে ঠাকুর ন্যাও পরিক্‌খা করিয়া॥
রাজার বাক্য খেতুআ ব্রথা না করিল।
পাগলিা হস্তিক খেতুআ সাজাইতে নাগিল॥১০০
মদ ভাং খোআইলেক হস্তিক বিস্তর করিয়া।
একখান কোদাল দিলে হস্তির শুড়তে বান্ধিয়া॥
নাপিতের মহলক নাগি জাএছে চলিয়া॥
নাপিতের বাড়িবন্দে জাএয়া হাতি চ্যাঁচাইল।
ভুঞিঘরাত থাকিয়া নাপিত কান্দিতে নাগিল॥১০৫
হাত ধরোঁ নাউআনি পাও ধরোঁ তোক।
তোমার ধন্মের দোহাই নাগে মোর প্রান অক্‌খা কর॥
নাপিতের কান্দন দেখি নাউআনির দয়া হৈল।
হাউক দাউক করিয়া নাউআনি হস্ত আনি দিল॥
ভুঞিঘরাত হতে নাউআক তুলিল টান দিয়া।১১০
পাচ হাতিয়া ধুতি নিলে পরিধান করিয়া॥
বাপকালিয়া খুর নিল জোর শান দিয়া।
খুষের তোরপা নিলে নাপিত বগলে করিয়া।I
পাচ দুআর দিয়া নাপিত ব্যারাইল জুরকুটু মারিয়া॥
খেতুআ বলে শোন নাপিত বচন মোর হিয়া।১১৫
হস্তির আগে আগে তুমি জাও আরো চলিয়া॥

রাজার দরবারত জাএয়া নাপিত খাড়া হৈল।
গইড়মুণ্ড হৈয়া রাজাক প্রনাম জানাইল॥[৩]
রাজা বলে শোনেক নাপিত আমি বলি তোরে।
এত দেরি ক্যানে কইল্লেন আপনার মহলে॥১২০
নাপিত বলে,—ওগো মহারাজ! কইতে ধম্মিরাজ বড় নাগে ভয়।
পাশ্‌শ টাকা খোসা দিছে রানি সক্কল।
খোসা খাএয়া আচিনু আমি ভুঞিঘরার ভেতর॥
জখন নাপিত বেটা কবুল করিল।
দৈবক মুনির বন্ধন রাজা খলাস করিয়া দিল।১২৫
লৈক্‌খ টাকার কণ্টমালা ঠাকুরক ফ্যালাইয়া দিল॥

দুধ কলা খোআইল ঠাকুরক সন্তোস করিয়া।
পাশ্‌শ টাকা ভিক্‌খা দিল ঠাকুরক গনিয়া॥
দৈবক মুনি গ্যাল এখন মহলক নাগিয়া॥
নাপিত খণ্ড গান গ্যাল ফুরিয়া।১৩০
মস্তক মুড়ি জাইবে রাজ্য সন্ন্যাসক নাগিয়া॥


  1. পাঠান্তর—

    বাবাকালিয়া মধু নাপিতক আন ধরিয়া।
    মস্ত মুড়ি জাই আমি সন্ন্যাস হইয়া॥

  2. পাঠান্তর:—

    জখন খেতু ছোড়া এ সংবাদ শুনিল।
    নাপিতের মহলে গমন করিল॥
    নাপিতের মহলে জাইয়া দরশন দিল।
    নাপিত নাপিত বলি ডাকিতে নাগিল॥
    ঘরে থাকি নাপিত বাহিরে আও দিল।
    খেতুকে বসিতে দিল দিব্ব সিঙ্গাসন।
    ক্রোফুল তাম্বুল দিয়া জিগ্‌গাসে বচন॥
    ক্যান ক্যান খেতু ছোড়া হরসিত মন।

    কি জন্য আসলু তার কও বিবরন॥

    খেতু বলে হারে নাপিত কার প্রানে চাও।
    মহারাজা সন্ন্যাস হএছে রাজ্যের ঈশ্বর।
    মস্তক মুড়াইতে নাপিত তোমার তলপ॥

  3. পাঠান্তর:—

    জখন মধু নাপিত এ সংবাদ শুনিল।
    ভাইর খুর নিল বগলে করিয়া।
    পাচ হস্ত ধুতি নইল পরিধান করিয়া॥
    চিরা চাদর নইলে ঘাড়ে করিয়া।
    রাজার দরবারক নাগি চলিল হাটিয়া॥
    কত দুর জাইয়া নাপিত কত পন্ত পায়।
    আর কতক দুর জাইয়া রাজার লাগ্য পায়।
    রাজদরবারে জাইয়া নাপিত দরশন দিল।
    জখন ধর্ম্মি রাজা নাপিতক দেখিল॥
    নাপিতক বসিতে দিলে গামারি চোকরি।
    মস্তক ভিজাইতে দিলে জল মানিকের ভিঙ্গারি॥


    গ্রীয়ার্সন সাহেবের সংগৃহীত পাঠে পাই:—

    বাপর কালর নাপিতক আনিয়া হাজির কর॥
    নাপিতর মহলক লাগিয়া গেল চলিয়া।
    নাপিতক তবে আনিল ডাকিয়া।
    ভাঁইড় ক্ষুর লইয়া আস চলিয়া॥
    ভর কাচারি রাজা করে ডাম্বা ডৌল।
    হেনকালে খাড়া হইল নাপিতর কুমর॥