গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড)/গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস (যোগীর পুঁথি)

গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস

সুকুর মহম্মদ বিরচিত

গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস

প্রথমে বন্দিল সিদ্ধা ধর্ম্ম নিরাঞ্জন।
যাহা হইতে হইল যোগ পৃথিবীর সৃজন॥
নম মাতা সরস্বতী বিখ্যাত সংসারে।
যাহার প্রসাদে ভাল হইল সবারে॥
নম নম বন্দি মাতা পিতার চরণ।
গুরুর চরণ মুই করিনু বন্দন॥
যোগ মধ্যে সিদ্ধা বন্দ গোরেক হরিহর।
তবে তো বন্দিব সিদ্ধা হাড়িফা জলন্ধর॥
কানুফা বন্দিব আর বাইল ভাদাই।
মছনন্দি সিদ্ধা বন্দ নামেতে মিন্যাই॥
মিন্যাথ মেহেরনাথ বন্দ ময়নামন্ত্রি[১] রাই।
মস্তকে ধারণ মুঁই সকল গোঁসাই॥
বন্দিব সকল সিদ্ধা জ্ঞান বৈসে যাত।
সকলের প্রধান সিদ্ধা বন্দিব ভোলানাথ॥
কার নাম জানি কার নাম নাহি জানি।
সকলের চরণ বন্দি যোড় করি পাণি॥
ছোট বড় পণ্ডিত আছয়ে যত জন।
সবে শুরু হয় আমি শিষ্য অভাজন॥
সবার চরণ মুই একত্র বন্দিয়া।
লিখিলাম যোগান্ত পুথি পয়ারে রচিয়া॥
শুন শুন সকল লোক বিধাতার নিরবন্ধ[২]
যোগ সাধিয়া যোগী হইল গোপীচন্দ্র॥

অতি অসম্ভব স্থান আছে মুকুল সহর।
পৃথিবীতে স্থান নাই তাহার দোসর॥
ব্রাহ্মণ যবন[৩] আর প্রজার বসতি।
মাণিকচন্দ্র নামে রাজা তাহার নরপতি।
অতি জ্ঞানমন্ত[৪] রাজা ইন্দ্রের অধিক।
জ্ঞানে শীলে ছিল রাজা গন্ধের বণিক॥
তাহার মহাদেবী হয় ময়নামন্ত্রি রাই।
চন্দ্র সূর্য্য থাকিতে তাহার মৃত্যু নাই॥
স্বামীপরায়ণা তিনি অতিশয় সতী।
তিলেকচন্দ্র নামে রাজার কন্যা ময়নামন্ত্রি রাই
এক রাত্রি না বঞ্চিল স্বামীর বাসরে।
এক পুত্র হইল মুনির[৫] গোরখের বরে॥
ময়নামন্ত্রি হয়েছিল গোরখের সেবক।
গুরুর প্রসাদে মুনির হইল বালক॥
যখন ময়নামন্ত্রি বালক প্রসব করিল।
আকাশের চন্দ্র যেন ভূমিতে উঠিল॥
পুত্রমুখ দেখে মুনি আনন্দ হইল।
শরদ পূর্ণিমা যেন উজালা করিল॥
ছয় দিবসে কৈল ছেলের ষষ্ঠী[৬] আচার।
পণ্ডিতে লিখিল কুষ্ঠী[৭] করিয়া বিচার॥
পণ্ডিত পাঠক যত মহন্ত গোঁসাই।
গণে দেখে আঠার বৎসর বালকের পরমাঁই॥
আঠার বৎসর প্রমাই উনিশে মরিবেক।
হাড়িফায় চরণ সেবি অমর হইবেক॥
একথা শুনিয়া মুনির আনন্দ হৈল মন।
ব্রাহ্মণকে দিল মুনি বস্ত্র আভরণ॥

রজত কাঞ্চন দিল তাহার নাই সীমা।
সহস্ৰ মুদ্রা দিল মুনি কুম্ভীর দক্ষিণা॥
ধন মাল গাভী মুনি বিস্তর দিল দান।
একত্রিশ দিবসে কৈল কর্ণের ছেদন॥
জ্ঞাতি কুটুম্ব যত আর পুরোহিত।
নিমন্ত্রণ করিল মুনি সকলের পুরিত॥
দিগ দিগান্তর হইতে আইল যত রাজা।
মৃকুল সহরে আইল যত ছিল প্রজা॥
রাজা প্রজা মুনি সবে হইয়া আনন্দ।
সুন্দর দেখিয়া নাম রাখিল গোপীচন্দ্র॥
নামকরণ করি সবে হইল বিদায়।
পুত্র লয়ে আনন্দিত মুনির হৃদয়॥
মুনির বাড়ীতে ছিল গুণবতী দাই।
তাহার কোলে দিল পুত্র ময়নামন্ত্রি রাই॥
মুনি বলে গুণবতী শুন দিয়া মন।
দুগ্ধ দিয়া পালন কর রাজার নন্দন॥
তোমার দুগ্ধের জোশে হইবে যুবক।
হাড়িফার চরণে তখন করাব সেবক॥
এতেক বলিয়া মুনি বালক সুঁপিল।
গোরখের নাম লয়ে মুনি গুফাতে বসিল॥
গোফাতে বসিল যায়া ময়নামন্ত্রি রাই।
রাজ্য পুত্র পালন কর গুণবতী দাই॥
পঞ্চ মাসের বালক হইল যখন।
মাণিকচন্দ্র করে বালকের অন্নপ্রাশন॥
দুগ্ধ দিয়া গুণবতী পালন করিল।
চন্দ্রের সমান বালক বাড়িতে লাগিল॥
যখন হইল বালক দ্বাদশ বৎসর।
বিভার কারণে তখন চিন্তা করে রাজেশ্বর॥

রাজা বলে সংসারে আমার দোসর নাই।
সবে এক পুত্র মোকে দিয়াছেন গোঁসাই॥
আমি অভাবে রাজা হবে ময়নামন্ত্রি রাই।
পুত্রেক করিবে আমার কতেক দুৰ্গতিই॥
যুগী করিয়া কি পাঠাবে দেশান্তরে।
পুত্রেক না বসাইবে রাজপাটের উপরে॥
যুগী ধিয়ানে মুনির আর নাহি মনে।
পুত্র গোপীচন্দ্রকে পাঠাব দেশান্তরে
আমি থাকিতে যদি বিভা দিতে পারি।
বধূকে ছাড়িয়া পুত্র না হবে দেশান্তরী॥
এতেক ভাবিয়া রাজা যুক্তি স্থির কৈল।
কোথায় করিব সম্বন্ধ ভাবিতে লাগিল॥
হেনকালে আইল রাজার তিন পুরোহিত।
দুর্গারাম নবরত্ন হরিদেব পণ্ডিত॥
রাজা বলে শুন তোমরা পুরোহিত ব্রাহ্মণ।
পুত্রকে করিব আমি মঙ্গলাচরণ॥
তিন শত টাকা তোমরা তিন জনে লও।
গোপীচন্দ্রের সম্বন্ধ শীঘ্র করি দাও॥
মুনি শুনিলে বিভা দিতে নাহি দিবে।
সম্বন্ধ করিয়া শীঘ্র পাতিল ডুবাইবে॥
সুলক্ষণ কন্যা দেখি প্রতি কুল শীল।
গোপীচন্দ্রের নামে তোমরা ডোবাবে পাতিল
গোপীচন্দ্রের বিভা যেমন করাবে তৎকাল।
তাহার তরে মান্য দিব রত্ন প্রবাল॥
মান্য দিতে প্রতিজ্ঞা করিল নরপতি।
তিন দিকে তিন জনে গেল শীঘ্রগতি॥
শুনিয়া আনন্দ হৈল তিন পুরোহিত।
পূর্ব্ব দিকে গেলেন তবে হরিদেব পণ্ডিত॥

পূর্ব্বদিকে ছিল মহেশ্চন্দ্র রাজেশ্বর।
তাহার ঘরে কন্যা ছিল চন্দনা সুন্দর॥
তাহার বাড়িতে গেল হরিদেব ব্রাহ্মণ।
দেখিয়া আনন্দ রাজা বন্দিল চরণ॥
ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা সত্বরে উঠিল।
পাদ্যার্ঘ্য আচরণে চরণ বন্দিল॥
রাজা বলে ব্রাহ্মণ তুমি থাক কোন দেশে।
কি কার্য্য আইলে হেথা কহিবে বিশেষে॥
হরিদেব বলেন তুমি শুন রাজেশ্বর।
কি কার্য্যে আইলাম তাহার শুনহ খবর॥
মৃকুল সহরে আছে রাজা মাণিকচন্দ্র।
তাহার পুত্রের আইলাম করিতে সম্বন্ধ॥
রাজা বলে দেখ কন্যা যদি যোগ্য[৮] হয়।
স্বরূপেতে কন্যা দিব কহিলাম নিশ্চয়॥
ময়নামন্ত্রির ছেলে হয় রাজারি কুমার।
তাহার পরে কন্যা দিব করিলাম স্বীকার॥
দেখিয়া ব্রাহ্মণ কন্যা অনন্দ হইল।
সুলক্ষণ তিথি দেখি পাতিল ডুবাইল॥
হরিদেব করিল হেথা মঙ্গলাচরণ।
উত্তর দিকে গেল ব্রাহ্মণ নবরতন॥
উত্তর দিকে হইল নেহালচন্দ্র নরপতি।
তাহাব ঘরে কন্যা ছিল ফন্দনা যুবতী॥
তাহার বাড়িতে গেল সম্বন্ধের কারণ।
দেখিয়া আনন্দ বড় হইল রাজন॥

রাজা বলে শুন তোমরা নবরতন।
কি কার্য্যে আইলে হেথা কহিবে কারণ॥
ব্রাহ্মণ বলেন কহি যে তোমার ঠাঁই।
মৃকুল সহরে আছে ময়নামন্ত্রি রাই॥
তাহার ঘরে এক পুত্র আছে রাজা গোপীচন্দ্র।
আমি আইলাম তাহার করিতে সম্বন্ধ॥
রাজা বলে দেখ কন্যা যদি যোগ্য হয়।
তাহার ঘরে কন্যা দিব কহিলাম নিশ্চয়॥
দেখিয়া রাজার কন্যা আনন্দ হইল।
শুভ লগ্ন তিথি দেখিয়া পাতিল ডুবাইল॥
এইরূপে নবরত্ন করিল শুভ কাম।
পশ্চিম দিগে গেল ব্রাহ্মণ দুর্গারাম॥
পশ্চিম দিগে ছিল রাজা হরিচন্দ্র নরপতি।
তাহার ঘরে কন্যা ছিল অদুনা যুবতী॥
তাহার বাড়ীতে গেল সম্বন্ধের কারণ।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা আনন্দিত মন॥
ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা সত্বরে উঠিল।
পাদ্য অর্ঘ্য আচরণে চরণ বন্দিল॥
বসিতে আনিয়া দিল উত্তম সিংহাসন।
পদ প্রক্ষালিয়া তখন বসিল ব্রাহ্মণ॥
রাজা বলেন শুন ব্রাহ্মণ পুরোহিত।
কি কার্য্য তোমার এখন আমার পুরিত॥
দুর্গারাম বলেন তুমি শুন রাজেশ্বর।
মাণিকচন্দ্র রাজা আছে মৃকুল সহর॥
তাহার এক পুত্র আছে রাজা গোপীচন্দ্র।
তাহার বিভার আইলাম করিতে সম্বন্ধ॥
রাজা বলে যাহার মা মৈনামন্ত্রি রাই।
তাহার ঘরে কন্যা দিব আমার বড়াই॥

এহিত সংসারের মধ্যে মুনি ধর্ম্ম জ্ঞান।
অবশ্য তাহার পুত্রকে কন্যা দিব দান॥
এতেক বলিয়া রাজা নির্ব্বন্ধ করিল।
ব্রাহ্মণ পুছিয়া রাজা পাতিল ডুবাইল॥
এইরূপে তিন জনে সম্বন্ধ করিয়া।
মাণিকচন্দ্র রাজা কাছে আইলেন চলিয়া॥
রাজা বলেন তোমারা ব্রাহ্মণ সকল।
শুভ কাজের তোমরা কহিবা কুশল॥
হরিদেব বলেন গেলাম মহেশ্চন্দ্র পুরী।
তাহার এক কন্যা আছে পরমা সুন্দরী॥
অধিক সুন্দর কন্যা নজরে দেখিনু।
শুভ লক্ষণ দেখি পাতিল ডুবাইনু॥
নিহালচন্দ্র নামে রাজা বলে নবরত্ন।
তাহার বাড়িতে গেলাম সম্বন্ধের কারণ॥
ফন্দনা নামে কন্যা রূপের মুরারি।
পাতিল ডুবাইলাম আমি শুভ লক্ষণ করি॥
দুর্গারাম বলেন রাজা কর অবধান।
পশ্চিম দিকে আছে রাজা হরিশ্চন্দ্র নাম॥
তাহার কন্যার রূপ কহিতে না পারি।
চন্দ্রের রোহিণী তিনি শঙ্করের গোরী॥
দেখিনু কন্যার রূপ আপন নয়নে।
ডুবাইনু পাতিল আমি অতি শুভক্ষণে॥
তিন সম্বন্ধের কথা শুনে নরপতি।
হেটমুণ্ড করিয়া ভাবিল সংপ্রতি॥
কোন রাজার পাঁচ পুত্র দিয়াছেন গোঁসাই।
পাঁচ পুত্রের বিভা তারা দিবে পাঁচ ঠাই॥
আর কেহ নাই আমার বিনে গোপীচন্দ্র।
পুত্রের করিব আমি তৃতীয় সম্বন্ধ॥

এতেক ভাবিয়া রাজা নির্ব্বন্ধ করিল।
ধন মাল দিয়া ঘটক বিদায় করিল॥
এইরূপে গোপীচন্দ্রের সম্বন্ধ করিল।
ধ্যানেতে আছিল মুনি কিছু না জানিল॥
আপনার মনে রাজা যুক্তি বিচারিল।
ব্রাহ্মণে পুছিয়া রাজা শুভ দিন কৈল॥
পাত্র মিত্র আসিয়া করিল অতি যোগ।
করিতে লাগিল রাজার বিবাহের সম্ভোগ॥
মৃকুল সহরে হাড়ি আসিল যত জনা।
রাজ বাড়িতে বাজে বিবাহের বাজনা॥
ঢাক ঢোল বাজে আর ধাঙসা নাকারা।
দক্ষিণ জোড়খাই বাজে কাড়া টিকারা॥
রণসিঙ্গা ভেউড় বাজে হয়ে একসঙ্গ।
রাজা বলে তোমরা না কর তরঙ্গ বাজনা।
ধ্যান ভঙ্গ হইলে মুনি বিবাহ দিবে না॥
বাদ্যের শব্দে যদি মুনির ধ্যান ভঙ্গ হয়।
গোপীচন্দ্রের বিভা দিতে দিবে নয়॥
একথা শুনিয়া বাদ্য রাখে বাদ্যকেরা।
খোল মৃদঙ্গ বাজে পাখয়াজ মন্দিরা॥
মোহন মুরারী বাজে সারিন্দা দুতারা।
পরা কপিনাস[৯] বাজে মোচঙ্গ তানপুরা॥
মোহন বাঁশী বাজে আর বাজে কাড়া।
দেখে শুনে মাণিক রাজা সুখী হৈল বড়া॥
ব্রাহ্মণে পুছিরা রাজা শুভদিন কৈল।
শুভ তিথি লগ্ন দেখে মঙ্গলাচরণ॥
চারিদিকে চারি সারি কদলী[১০] পুতিল।

আলম গাড়িল তথা অপূর্ব্ব শোভিল॥
নর্ত্তকী নাচয়ে পাইলে গায় গীত।
চতুর্দ্দিকে নাচে গায় অপূর্ব্ব শোভিত॥
আদেশ করিল মন্ত্রীক মহারাজন॥
পুত্র গোপীচন্দ্রের বিবাহের সাজন॥
শুনিয়া এতেক মন্ত্রী আনন্দ হইল।
সুগন্ধি উপটন দিয়া স্নান করাইল॥
রাজবস্ত্র অলঙ্কার অঙ্গে পরাইয়া।
সুবর্ণের পাল্‌কিতে লইল তুলিয়া॥
বায়ু সেবনেতে ইন্দ্রের গমন।
সেইরূপ হৈল রাজার বিবাহ সাজন॥
হস্তী ঘোড়া রথ রথা আর সেনাপতি।
বিবাহ করিতে গেল লইয়া বৈরাতি॥
প্রথমে বিভা করে মহেশ্চন্দ্রের দুহিতা।
যার রূপে মগ্ন হয় স্বর্গের দেবতা॥
জামতা দেখিয়া আনন্দ নরপতি।
যৌতুক দিলেন রাজা মদনমোহন হাতী॥
তাহা পরে বিবাহ কৈল নিহালচন্দ্র ঝি।
দেবতা জিনিয়া কন্যা রূপের কব কি॥
কন্যার পাত্র দেখে আনন্দ রাজন॥
যৌতুক দিলেন কত বস্ত্র আভরণ॥
সুন্দর কামিনী দিল আর খাসা ঘোড়া।
চড়িবার কারণে দিল মদন নামে ঘোড়া॥
জলপথে মান্য দিল নৌকা জলকর।
তাহার উপরে ছিল সুবর্ণের ঘর॥
তার পরে করিল বিভা হরিশ্চন্দ্র কন্যা।
পৃথিবী উপরে সেই গুণে বড় ধন্যা॥
হরিশ্চন্দ্রে কন্যা অদুনা তার নাম।

শশধর জিনিয়া তার রূপে অনুপাম॥
অরুণ জিনিয়া রূপ মুখ শশধর।
ধ্যান ভঙ্গ হয় যে দেখিলে মুনিবর॥
দশ[ন] মুক্তা জিনিয়া সদাই পান তামাক খায়।
কোকিল জিনিয়া যেন মধুর কথা কয়॥
নাসিকায় শোভে যেন কানুর হাতের বাঁশী।
ভুবন মোহিত করেন চন্দ্র মুখের হাসি॥
যেমন কন্যা অদুনা তেমনি গোপীচন্দ্র।
এক ভাবে দুই তক্ষু বিধাতার নির্ব্বন্ধ॥
কন্যা পাত্রকে দেখে রাজার মনেতে কৌতুক।
ছোট কন্যা পদুনা[১১] ছিল দিলেন যৌতুক।
তিন বিভা করিল রাজা পাইল চারি রাণী।
বিভা করিয়া আইল আপনার পুরিত॥
বিভা হইল রাজার মধুর বাজনে।
ধ্যানেতে আছিল মন রাজার মধুর বাজনে।
ধ্যানেতে আছিল মুনি কিছু নাহি জানে॥
এইরূপে বিভা হইল মৃকুল সহরে।
ধ্যানেতে আছেন মুনি যোড়মন্দির ঘরে॥
গোরক্ষনাথের নিজ নাম অন্তরে জপিয়া।
ধ্যানেতে আছেন মুনি আসন করিয়া॥
গোফাতে আছেন মুনি গুরু সেবনে।
মুনির স্মরণে নাথ আইল আপনে॥
গুরুকে দেখিয়া মুনি ধ্যান ভঙ্গ হৈল।
গলায় বসন জুড়ি চরণ বন্দিল।
বসিতে আনিয়। দিল যোগের আসন॥
ভৃঙ্গারের জলে কৈল পদ প্রক্ষালন॥

পদ প্রক্ষালিয়া নাথ আসনে বসিল।
চরণ বন্দিয়া মুনি শয্যাতে বসিল॥
গোরক্ষনাথ বলে বাছা হইবে অমর।
পূর্ব্বকার কথা বাছা না জান খবর।
গোরক্ষনাথ বলে বাছা ময়নামন্ত্রি রাই।
আঠার বৎসর তোমার বালকের পরমাই॥
গত কার্য্য বিস্মরিলে কিছু নাহি গুণ।
হাটকুর বলিবি বাছা যম নিদারুণ॥
এতেক বলিয়া নাথ মুনিকে বুঝায়।
গুরু না ভজিলে বাচা নাহিক উপায়॥
তোমার বালকের পরমায়ু আঠার বৎসর।
সেবিলে গুরুর চরণ হইবে অমর॥
এতেক কহিয়া নাথ করিল গমন।
একথা শুনিয়া মুনির আকুল জীবন॥
এথা মাণিকচন্দ্র রাজা কোন কর্ম্ম করে।
পুত্রকে বসাইল রাজা পাটের উপরে॥
গোপীচন্দ্রের তরে রাজা দিলেন রাজাই।
মৃকুল সহরে ফিরে গোপার দোহাই॥
মৃকুল সহরে হইল গোপীচন্দ্র রাজা।
শুনিয়া আনন্দ হৈল মৃকুলের প্রজা॥
রাজা হইল গোপীচন্দ্র পাত্র মনোহর।
সাক্ষাতে রহিল খেতুয়া খাড়া নফর॥
রাজা প্রজা পাত্র মিত্র সবে আনন্দিত মন।
শুনিয়া ময়নামন্ত্রির হইল চিন্তন॥
ভাবিতে লাগিল মুনি আপনার মনে।
বৃথায় করিলাম বাদ যম রাজার সনে॥
যমের সঙ্গে বাদ করিয়া স্বামী রাখিলাম।
স্বামীকে রাখিয়া আমি পুত্র হারাইলাম॥

যদি মাণিকচন্দ্র রাজা যাইত মরিয়া।
তবে পুত্র গোপীচন্দ্র না করিত বিয়া॥
যদি কোন দিন রাজা মাণিকচন্দ্র মরে।
যুগী করিব পুত্র পাঠাব দেশান্তরে॥
এইমতে ভাবে মুনি আপনার গোফাতে।
আর দিন গেল মুনি গুরু সন্তাষিতে॥
গোরক্ষনাথ যেখানে আছে করিয়া আসন।
তথা চলেন মুনি দেখিতে চরণ॥
সিংহনাদ পূরিয়া মুনি সাক্ষাতে বসিল।
সিংহনাদ শুনিয়া মুনির ধ্যান ভঙ্গ হৈল॥
গলে বসন দিয়া মুনি বন্দিল চরণ।
গুরু তো বলেন বাছ। না হবে মরণ॥
প্রণাম করিয়া তখন কহেন সে মুনি।
গুপ্ত ভেদ কহ নাথ যোগের কাহিনী॥
বেদান্ত ভেদান্ত কথা মুনিকে বুঝায়।
শুনিয়া মুনির হইল আনন্দ হৃদয়।
এহিমনে রৈল মুনি গুরুর সাক্ষাতে।
মৃকুল সহরে আইল যম রাজাকে লইতে॥
তিন দিনের জ্বরেতে হইল মরণ।
তাহা দেখি গোপীচন্দ্র করয়ে রোদন।
কান্দেন গোপীচন্দ্র লোটায়া ধরণী।
মহলের মধ্যে কান্দেন তাহার চারি রাণী॥
অদুনা পদুনা আর চন্দনা ফন্দনা।
শ্বশুরের কারণে কান্দে করিয়া করুণা॥
প্রজা আদি কান্দে আর পাত্র মনোহর।
কান্দিতে লাগিল রাজার খেতুয়া নফর॥
মুনিকে আনিয়া রাজা করিল বিসৰ্জ্জন।
কান্দিতে কান্দিতে খেতু গেল শীঘ্রগতি।

যথা গুরুর স্থান আছিল ময়নামন্ত্রি॥
মুনি বলে কেন খেতু কান্দ বারেবার।
শীঘ্র করি কহ খেতু রাজ্যের শুভাচার॥
ষোড় হাতে কহে খেতু মুনির হুজুর।
মুছিয়া ফেলাও তোমার সিতের সিন্দূর॥
মৃকুলে মরিল তোমার স্বামী মাণিকচন্দ্র।
শুনিয়া মুনির তখন হইল আনন্দ॥
গুরু প্রণামিয়া মুনি করিল গমন।
মৃকুলে আসিয়া মুনি দিল দরশন॥
পাত্রমিত্র দেখিল যদি আইল মা মুনি।
কান্দিয়া আকুল সবে লোটায় ধরণী॥
মুনি বলে শুন পাত্র কান্দ অকারণ।
শীঘ্র করি লহ রাজাক করিতে দাহন॥
মাণিকচন্দ্র রাজা ষোল রাজ্যের ঈশ্বর।
রজত কাঞ্চন তার আছে হাজার ঘর॥
সে সকল ধন মুনির রহিল পড়িয়া।
একখানি ডুলিতে লইল বান্ধিয়া॥
বুকে বাঁশ দিয়া রাজার করিল বন্ধন।
গঙ্গার কূলে লইল রাজার করিতে দাহন॥
উত্তর শিওরে এক চুলী থুড়িল।
গঙ্গাজল দিয়া রাজার স্নান করাইল॥
আপনি ময়নামন্ত্রি করিলেক স্নান।
পরনে থাকিল মায়ের ভিজা বস্ত্রখান॥
উত্তর শিয়রে রাজার চুলীতে রাখিল।
রাজার বাম পাশে মুনি আসন করিল॥
চতুর্দ্দিকে কাষ্ঠ খড়ি দিলেন সাজাইয়া।
মুর্নির আজ্ঞাতে অগ্নি দিল জ্বালাইয়া॥

জ্বলিয়া উঠিল অগ্নি ব্রহ্ম হুতাশন।
নিজ নামে জপ মুনি করিয়া আসন॥
মাণিকচন্দ্র পুড়িয়া হইয়া ভস্মধূল।
ভিজা বস্ত্রে উঠিল মুনি লয়া ভিজা চুল॥
সপ্ত দিন রাত্র যদি হুতাশন জ্বলে।
কি করিতে পারে মুনির নিজ নামের বলে
অগ্নিতে পুড়িয়া রাজা হইল সংহার।
মৃকুলে চলিল মুনি পুত্র বুঝাইবার॥
গোপীচন্দ্র দেখিল যদি আইল জননী।
কান্দিতে লাগিল রাজার চারি রাণী॥
অকারণ কান্দ বাছা শুন দিয়া মন।
মনুষ্যের উদরে আছে যম নিদারুণ॥
মনুষা হইয়া যেবা গুরু নাহি ভজে।
প্রহার করিয়া তাহাকে লইবে যমরাজে॥
গুরুর চরণে যার মন নাহি বান্ধে।
অবশ্য পড়িবেন সেই যমরাজের ফান্দে॥
গুরু সেব নাম জপ বাড়িবে পরমাই।
গুরুর মতন সার ধন পৃথিবীতে নাই॥
গুরু আদ্য গুরু সাধ্য গুরু করতার।
গুরু না ভজিলে বাছা সকলি অন্ধকার॥
গুরুর চরণে যার না হইল মন।
নিশ্চয় জানিও তার বিধি বিড়ম্বন।
মুনি বলেন শুন বাছা গোপীচন্দ্র।
গুরু ভজিলে বাছা অমর হয় কন্ধ॥
গুরুর মহা সমতুল কহা নাহি যায়।
ভজিলে গুরুর চরণ অমর হয় কায়॥
মায়ে বলে শোন পুত্র রাজার কুমার।
ভজন সাধ নাম জপ হইবে অমর॥

রাজা বলে শুন মা ময়নামন্ত্রি রাই।
সেবক হইয়া আমি করিব রাজাই॥
যে জ্ঞান দিবে গুরু আমার শরীরে।
মিথ্যা হইলে পুতিব ঘোড়ার পৈখরে॥
দুখী সুখী হইয়। মা মুনি।
শুকুর মামুদে ভণে অপূর্ব্ব কাহিনী॥


শুনহ সকল লোক যতি গোরক্ষের করে।
যেমন প্রকারে রাজা জ্ঞান শিক্ষা করে॥
পুত্রেক বুঝাই মুনি আনন্দ হরিষে।
তখন চলিল মুনি হাড়িফার উদ্দেশে॥
ফুল বাড়ীর মধ্যে আছে এক গোফা।
সেইখানে জ্ঞান করিছেন বসিয়া হাড়িফা॥
হাড়িফার উদ্দেশে[১২] মুনি করিল গমন।
ফুল বাড়ীতে যায়া মুনি দিল দরশন॥
যেখানে হাড়িফা সিদ্ধা ধ্যানেতে আছিল।
সিংহনাদ শুনিয়া হাড়ির ধ্যান ভঙ্গ হইল॥
গলে বসন দিয়া মুনি প্রণাম করিল।
হাড়িফা বলেন বাছা সিদ্ধা দিলাম বর।
যে কার্য্যে আইলে বাছা কহিবে খবর॥
মুনি বলেন এবে শোনহ গোঁসাই।
আমি সেবক হয়েছিলেম যক্তি গোরক্ষের ঠাই
সেবক করিয়া মুনি দিয়াছেন বর।
গুরুর প্রসাদে আমার হইল কুমার[১৩]
মুনি বলে শুন হাড়িফা গোঁসাই।
পুত্র গোপাঁচন্দ্রকে সঁপিব তোমার ঠাই॥

সেবক করিয়া তুমি রাখিবে চরণে।
হাড়িফা বলেন বালক কি বয়স হইল।
মুনি বলেন বালকের বার বৎসর গেল॥
হাড়িফা বলেন শুন ময়নামন্ত্রি রাই।
মৃকুল সহরে রাজা করিছেন রাজাই॥
রাজ্য করেন গোপীচন্দ্র লয়ে চারি রাণী।
কেমন প্রকারে তাকে জ্ঞান দিতে পারি॥
যে জন করিতে চাহে স্ত্রী লয়ে ঘর।
জ্ঞান না সাধিলে সেই না হবে অমর॥
নারী ছাড়িয়া যদি হয় দেশান্তরী।
তবে সে তাহার তরে জ্ঞান দিতে পারি॥
মুনি বলে কর তুমি অক্ষয় অমর।
অবশ্য ছাড়াব রাজ্য পাঠাব দেশান্তর॥
হাড়িফা বলেন পুত্র আন গিয়া তুমি।
নিশি অবশেষে আইজ জ্ঞান দিব আমি॥
এতেক শুনিয়া মুনি করিল গমন।
পুত্রের নিকটে গিয়া দিল দরশন॥
চৌষট্টি জনে পুত্রকে করাইল স্নান।
হাড়িফার নিকটে নিল শিখাইতে জ্ঞান।
পুত্রকে সঁপিয়া মুনি হাড়িফার হাতে।
আসিয়া বসিল মুনি আপন গোফাতে॥
এথায় হাড়িফা সিদ্ধা করে কোন কাম।
পাপযোগ কুলক্ষণে শুনাইল নাম॥
এই নাম জপিয় বাচা সরোবর কূলে[১৪]
শুখনা পুষ্করিণী ভরিব নামের বলে॥
শুখনা পুষ্করিণী যদি জলেতে ভরিবে।
নিশ্চয় জানিও তবে অমর হইবে॥

এতেক কহিল নিজ নামের মহিমা।
স্বর্গ মর্ত্ত পাতালে নাই নামের সীমা॥
পড়িয়া পণ্ডিত নাম শাস্ত্র নাহি জানে।
খুজিয়া না পায় নাম ভাগবত পুরাণে॥
এই নিজ নাম জপিলে বাছা হইবে অমর।
চতুর্দ্দশ ভুবন এই নামে হবে পার॥
সুকুর মহম্মদ কহে এই ব্রহ্মসার॥

ত্রিপদী॥

এহিত নামের গুণ, কর্ণ পাতিয়া শুন,
প্রথমে জপিল রঘুনাথ।
নিজ নামের বলে, পাথর ভাসিল জলে,
সবংশে রাবণে কৈল পাত॥
শত প্রহরের সেতু, বান্ধিল নামের হেতু
ভালুক বানর হৈল পার।
নিজ নামের জোরে, বানরে রাক্ষস মারে,
লঙ্কাপুরী কৈল ছারখার॥
সীতা উদ্ধারিয়া রাম, লয়ে গেল নিজ ধাম,
লোকে বলে অপযশ কথা।
লোকের গঞ্জনা ব্যথা, যজ্ঞ ঘর করিল সীতা,
নিজ নামে পাইল ক্ষমতা॥
পাণ্ডব রাজার রাণী, বাপ ঘরে অকুমারী,
গুরু মুখে নাম কৈল শিক্ষা।
কোশল[১৫] রাজার কন্যা, গুরু মুখে নাম শুন্যা,
নিজ নামে পেয়েছিল দীক্ষা॥

নিজ নাম জপে মনে, সূর্য দেখে নিকেতনে,
নিকুঞ্জেতে ভোগ কৈল রতি।
অকুমারী গর্ভ ধরে, কর্ণ রৈল কর্ণদ্বারে,
নিজ নামে রক্ষা পাইল সতী॥
নিজ নামে করি পুজা, শিব পাইল দশভুজা,
পুত্র যার দেব লম্বোদর।
শনি দৃষ্টে গেল মুণ্ড, কাটি গজ মাথা মুণ্ড,
নিজ নামে স্থাপি কৈল বর॥
দশভুজা মহামায়া, শিব মুখে নাম শুন্যা,
কালীরূপে বধিল অসুর।
মথুরাতে জন্মিল হরি, নিজ নাম জপ করি
বধ কৈল দুষ্ট কংসচর॥
স্বর্গপুর রঘু বুনে, গৌতম মুনির স্থানে,
নিজ নামে স্বর্গের অধিকারী।
মুনি জপি নিজ নাম, সাধন ভজন কাম,
সৃষ্টি কৈল অমরা নগরী॥
ব্যাস আদি জত মুনি, জপে নিজ নাম ধনী,
নামের প্রতাপে স্বর্গবাসী।
নদীয়া নন্দনগরে, জগন্নাথ মুনির ঘরে,
নিজ নামে চৈতন্য সন্নাসী॥
অবধূত গোরক্ষ যতি, তার স্থানে ময়নামন্ত্রি,
নিজ নামে হইল অমর।
মীন্যাথ কানুফা আদি, নিজ নামে যোগ সাধি,
অমর হইল জলন্ধর॥
নৌ লাখ বৈরাগী সিদ্ধা, পাইয়া নামের বিদ্যা,
নিজ নামে ভবসিন্ধু পার।
স্বর্গ মর্ত্ত পাতালের, ত্রিভুবন নামে তেজের,
নাম বিনে সকলি অসার॥

যেরূপেতে জপে নাম, তার সিদ্ধ মনস্কাম,
সাধিলে অমর হয় কায়।
কহে শুকুর মামুদে, যদি নাম যোগ সাধে,
নিজ নামে অমর নিশ্চয়॥

পয়ার॥

একে একে তিন নাম শুনাইল অধিকারী।
মিথ্যা মাথা নাড়ি রাজা পূরিল হুহুঙ্কারী॥
একেবারে তিন নাম শুনাইল কাণে।
স্ত্রীর উপর চিত্ত নাম না থাকিল মনে॥
স্ত্রী লয়ে যেমন করে সংসারে বসতি।
অমর হইতে পারে কি তার শকতি॥
স্ত্রীর পর যার বান্ধা রৈল মন।
সেইত কারণ গেল জ্ঞান অকারণ॥
গোপীচন্দ্রের নামে হাড়ি নিজ নাম দিল।
চিত্ত স্থির নহে রাজার জ্ঞান মিথ্যা হইল॥
এইরূপে গোপীচন্দ্র জ্ঞান না পাইল।
গুরু প্রণামিয়া রাজা নিজ গৃহে গেল॥
এথায় হাড়িফা সিদ্ধা আপন গোফাতে।
ধ্যানেতে বসিয়া হাড়ি ভাবি ভোলানাথে॥
চক্ষু মুদিয়া রহিল নাথ অন্তর ধিয়ানে।
দিবা রাত্রি জপে নাম কিছু নাহি জ্ঞান॥
এথা রাজা গোপীচন্দ্র আপন মহলে।
রাত্রি বঞ্চিল রাজা কামিনীর কোলে॥
একে একে তিন দিন ভুঞ্জিল শৃঙ্গার।
তিন দিন বাদে গেল জ্ঞান সাধিবার॥
সরোবর কূলে রাজা করিয়া আসন।
চিত্ত স্থির নহে রাজা জপে অকারণ॥

আকার প্রকার আর হুঙ্কার।
এ সব ভুলিয়া নাম লাগিল জপিবার॥
এহিরূপে রূপে নাম সরোবর কূলে।
পুষ্করিণী শুখান রৈল না ভরিল জলে॥
গোস্‌সা হইল গোপীচন্দ্র আপনার মনে।
বাড়ীতে আইল রাজা রজনী বিহানে॥
প্রভাতে আসিয়া রাজা দরবারে বসিল।
পাত্র মিত্র আসিয়া রাজাকে সম্ভাষিল॥
রাজা বলে পাত্র মিত্র আমার আজ্ঞা লিবে।
যোগী মহন্তু বেটাক চোমুড়া বান্ধিবে।
রাজার আজ্ঞা হইল পাত্র না পারে লঙ্ঘিতে
লোক জন লয়ে গেল হাড়িফাক বান্ধিতে॥
বিধাতার নির্ব্বন্ধ যত না যায় কনে।
হাড়িফার তরে সবে করিল বন্ধন॥
হাতে পায়ে দড়ি দিয়া কমরে বান্ধিল।
ধ্যানেতে আছিল মুনি কিছু না জানিল॥
রাজার আদেশে সব বেলদার আইল
ঘোড়ার পৈঘরে এক খন্দক খুড়িল॥
সেই খন্দকের মধ্যে হাড়িফাকে থুইয়া।
বাইশ মণ পাথর দিল বুকেতে চাপিয়া॥
হাড়িফাকে পুতিল ঘোড়ার পৈঘরে।
শুন ভাই সকল লোক ভবানীর বরে॥
যেরূপে হাড়িফা পোতা ঘোড়ার পৈঘরে।
তাহার বৃত্তান্ত কথা কহি সবের তরে॥
হাড়িফাকে পুতিতে পারে কাহার শকতি।
পূর্ব্বে শাপ দিয়াছিলেন গৌরী পার্ব্বতী

যখন করিল যজ্ঞ দেবী মহেশ্বরী।
নিমন্ত্রণ করিল সিদ্ধা সকল পুরী॥
দিগ দিগান্তর হইতে আইল সিদ্ধাগণ।
গাইল সকল সিদ্ধা যজ্ঞের কারণ॥
প্রথমে আল সিদ্ধা গোরেক হরিহর।
হাড়িফা আইল বাহার নাম জলন্ধর॥
মীন্যাথ আইল আর বাইল ভাদাই।
মেহেরনাথ আইল আর সিদ্ধা কানাই॥
হরেঙ্গা চরেঙ্গা আর সিদ্ধা বনমালী।
মীন্যাথ আইল আর যাহার নাম মছন্দালী॥
নও লাক চোরাশী সিদ্ধা আইল যত জন।
আসিয়া বন্দিল সবে শিবের চরণ॥
আইল সকল সিদ্ধা চণ্ডীর আদেশে।
ভোজনে[১৬] বসিল সবে পর্ব্বত কৈলাসে॥
সিদ্ধাগণের মন দেবী বুঝিবার কারণ।
বেশ করিল দুর্গা ভুবন মোহন[১৭]
অলঙ্কার পরিল দুর্গা হীরা মাণিকের।
বসন পরিল দুর্গা ভুবন বিলাসের॥
যত বস্ত্র পরিল দুর্গা কহিতে না পারি।
দণ্ডে দণ্ডে বসন ফিরায় মহেশ্বরী॥
আপনে সে বাড়ে চণ্ডী আপনে পরসে।
টলিল সিদ্ধার মন জানিল ভবানী।
সকলকে শাপ দিল অসুরঘাতিনী॥
নটী লয়ে মীন্যাথ থাকিবে কদলীতে[১৮]
গোৰ্খেক হইল শাপ গরু চরাইতে॥

ডাহুকার গড়ে যাবে কানুফার কন্ধ।
মৃকুলে পুতিবে হাড়িক রাজা গোপীচন্দ্র॥
নও লাখ চোরাশী সিদ্ধার মধ্যে এ চারি ভাজন
চারি সিদ্ধাক শাপ দিল এহিত কারণ॥
এহি মতে শাপ দিল হেমন্তদুহিতা॥
সেই শাপ হন্তে গেল হাড়িফা পোতা॥
মাটির ভিতরে হাড়ি নাহি পায় ব্যাথা॥
মন দিয়া শুন সবে হাড়িফার কথা॥
হুহু শব্দ করি সিদ্ধা হুহুঙ্কার চাড়িল।
বন্ধন আছিল যত বিমোচন হইল॥
হাতেতে আছিল বন্ধন হইল জপমালা।
বুকেতে আছিল পাথর যোগপাটা হৈলা॥
বন্ধনের দড়ি হইল কমরের ডোর।
নিজ নাম লয়ে হাড়ি হইল বিভোর॥
মাটীর ভিতরে তখন হইল এক গোফা।
আসন করিয়া তথা বসিল হাড়িফা॥
ভাল মন্দ তখন কিছু নাহি জানে।
চক্ষু মুদে রৈল হাড়ি গুরুর ধিয়ানে॥
এইরূপে রৈল সিদ্ধা গোড়ার পৈঘরে।
চার রাণী লয়ে রাজা সুখে বিরাজ করে॥
ঘোড়ার পৈখরে হাড়িফা রৈলেন পোতা।
এখন কহিব আমি কানুফার কথা।
হুকুর মামুদ কয় গুরুর চরণে।
অশুদ্ধ থাকিলে শুদ্ধ করিবে মহাজনে॥

মাটীর ভিতরে হাড়ি আসন করিয়া।
মহাদেবের নিজ নাম অন্তরে জাপিয়া॥

এইরূপে হাড়িফা রৈল পঞ্চ বৎসর।
কানুফা জানে না কিছু গুরুর খবর॥
ধ্যানেতে কানুফা সিদ্ধা আছিল বসিয়া।
খেদান্বিত হইল গুরুকে না দেখিয়া॥
কানুফা বলেন ধ্যান করি অকারণ।
গুরুর চরণে যার মন নাহি বান্ধে।
পার হৈতে নাহি নৌকা হাতে মাথে কান্দে॥
কানুফা বলেন আমি করিব কেমন।
কোথা গেলে পাব আমি গুরুর দরশন॥
এতেক ভাবিয়া কানাই ধ্যান ভঙ্গ দিল।
বাইল ভাদাই তরে ডাকিতে লাগিল॥
গুরুর আদেশে তারা আইল চলিয়া।
সাক্ষাতে বসিল গুরুর চরণ বন্দিয়া॥
কানুফা বলেন শুন বাইল ভাদাই।
শীঘ্র করি আন রথ শুন মোর ঠাই॥
শুনিয়া কানুফার কথা বিজয় গমন।
ত্বরিত করিয়া যাইয়া রথের সাজন॥
গঙ্গাজল দিয়া রথের স্নান করাইল।
হীরা মাণিক্যে রথ সাজাইতে লাগিল॥
হীরা দিয়া বান্ধিল রথের বত্রিশ চাকা।
রথেতে তুলিয়া দিল সুবর্ণ পতাকা॥
চূড়াতে বান্ধিল রথের হাড়িয়া চামর।
সুগন্ধের লোভে তাথে বেড়িল ভ্রমর॥
নানান প্রকারে রথের করিল সাজন।
রাজহংসে বহে রথ সারথি পবন॥
নানান প্রকারে রথের সাজন করিল।
প্রণাম করিয়া তবে সাক্ষাতে কহিল॥
কানুফা বলেন বাছা বাড়ুক প্রমাই।

চারি যুগ ভিতরে বাছা আর মরণ নাই॥
রথ দেখিয়া আনন্দিত হইল কামাই।
গুরুর উদ্দেশে[১৯] সিদ্ধা সাজিতে লাগিল।
কমরপটী দিয়া সিদ্ধা কমর বান্ধিল॥
রুদ্রাক্ষ ফলের মালা গলে তুলে দিল॥
কপালেতে দিল সিদ্ধা চন্দনের ফোটা।
কর্ণেতে কুণ্ডল দিল গলে যোগপাটা[২০]
হাড়িফার নিজ নাম অন্তরে জপিয়া।
রথেতে চড়িল সিদ্ধা সিংহনাদ পূরিয়া॥
কানুফার রথের আমি কি কহিব কথা।
পূর্ব্বদিকে গেল রথ দিবাকর যথা॥
উদয়গিরি[২১] পর্ব্বতে সিদ্ধা রথ রাখিয়া।
ঘরে ঘরে বেড়ায় সিদ্ধা গুরু তল্লাসিয়া॥
ভিক্ষার ছলে ঘরে ঘরে করিল ভ্রমণ।
কোন খানে না পাইল গুরু দরশন।
না পাইয়া গুরুর উদ্দেশ[২২] ভাবিতে লাগিল।
গুরু সত্বরিয়া পুনঃ রথেতে চড়িল॥
চলিল কানুফার রথ বাঁয়ে করি ভর।
দক্ষিণ দিগে গেল রথ যথাতে সাগর॥
সেতুবন্ধ স্থানে সিদ্ধা রথ রাখিয়া।
কিষ্কিন্ধ্যা নগরে সিদ্ধা উতরিল গিয়া॥
ঘরে ঘরে তালাসিয়া বানরের নগর।
তথাতে না পাইল গুরুর খবর।
পঞ্চবটী দিয়া রথ করিল গমন।
গুহক চণ্ডালের পুরীত দিল দরশন॥
অরণ্য মাঝারে সিদ্ধা রথ রাখিল।

গুহক চণ্ডালের পুরী ঘরে ঘর ভ্রমিল॥
না পাইয়া গুরুর নাগ ভাবে মনে মন।
রথে চড়িয়া পুনঃ করিল গমন॥
রাজহংসে বহে রথ সারথি পবন।
কদলী[২৩] সহরে গিয়া দিল দরশন॥
কদলী সহর খান ভ্রমিল ঘরে ঘরে।
মীন্যাথকে দেখিল তথা নটিনীর বাসরে॥
চুল দাড়ী পাকিল তাহার নাহিক উপায়।
দেখিয়া কানুফা সিদ্ধা বলে হায় হায়॥
কপালে মারিয়া ঘা কান্দিল কানাই।
এই রূপে ভুলিয়া রহিল হাড়িফা গোঁসাই
এতেক ভাবিয়া হৈল রথে আরোহণ।
যাইয়া উতারিল রথ কানাইর বৃন্দাবন॥
কালিন্দী যমুনার তীরে রথ রাখিয়া।
বৃন্দাবন পুরীখান ঘর ঘর ভ্রমিয়া॥
না পার গুরুর তত্ত্ব হইল ভাবিত।
রথে চড়ি পুনরায় চলিল তুরিত॥
এহি রূপে যায় কানাই গুরুর তল্লাসে।
যায়ে উত্তরিল রথ পর্ব্বত কৈলাসে॥
শিবপুরী ব্রহ্মপুরী সব তল্লাসিল।
না পায়ে গুরুর লাগ ফাফর হইল॥
মলয়া গিরি তলাসিল হিমালয় পর্ব্বত।
সুমেরু ভ্রমিয়া গুরুর না পাইয়া তত্ত্ব॥
পুনর্ব্বার রথে চড়ি করিল গমন।
একঠেঙ্গিয়া দেশে গিয়া দিল দরশন॥
একঠেঙ্গিয়ার রাজ্য খান ঘর ঘর ভ্রমিল।

না পায়ে গুরুর তত্ত্ব কামরূপেতে গেল॥
কামরূপ পাটনা গয়া ভ্রমিল সকল।
না পায়ে গুরুর লাগ হইল বিকল॥
অস্থির হইল কানাই গুরুর কারণ।
কোথায় পাইব গুরুক ভাবে মনে মন॥
ভাবিতে ভাবিতে কানাই স্থির কৈল মন।
গুরুর তলাসে লঙ্কায় করিল গমন॥
লঙ্কাপুরী যায় কানাই গুরু তলাসিতে।
ঝুলতলিতে[২৪] ঝুল খেলে যতি গোর্খনাথে॥
ঝুলতলিতে ছিল এক দল পণ্ডিত।
গরু চরায় গোর্খনাথ তাহার বাড়িত॥
গরু চরায় গোর্খনাথ না খায় অন্ন পানী।
ঝুল টঙ্গিতে ঝুল খেলে দ্বিস রজনী॥
রাত্রি-দিন কুল খেলে মনের হরিষে।
সেই পথে যায় কানাই গুরুর তল্লাসে॥
গুর্খনাথ ঝুল খেলে না জানে কানাই।
গোর্খেক লাগিল তখন রথের এ ছাই॥
গোস্‌সা হইল তখন নাথ আপনার মনে।
ডাল ভাঙ্গি ডাল কোমর সৃজিল তখনে॥
নাথ বলে ডাল কোমর আমার আজ্ঞা লিবে।
কোন জন রথে যায় শীঘ্র ফিরাইবে॥
নাথের আদেশে ডাল করিল গমন।
কানুফার রথ যায় ধরিল তখন॥
ডাল দেখিয়া কানাই করিল হুহুঙ্কার।
হুহুঙ্কার কৈল ডাল ছাই আঙ্গার॥

ছাই হইয়া ডাল শূন্যে উড়ে যায়।
ঝুলতলিতে থাকিয়া তাহা দেখিবার পায়॥
থাবা দিয়া নাথ তখন আঙ্গার ধরিল।
বট বৃক্ষ করি নাথ তাহাকে সৃজিল॥
গোস্‌সা হইয়া নাথ হুহুঙ্কার ছাড়িল।
শূন্য পথে ছিল রথ ভূমিতে নামিল॥
কানুফা দেখিল যদি যতি গোর্খনাথ।
নিবেদন করে সিদ্ধা জোড় করি হাত॥
একত্রে বসিল দুইজন করিয়া আসন।
বাহু ধরাধরি দোহে প্রেম আলিঙ্গন॥
নাথ বলে শোন কানাই কহিবে কারণ।
রথে চড়িয়া তোমার কোথাতে গমন॥
কহিতে লাগিল তবে সিদ্ধা কানাই!
পঞ্চ বৎসর হইল আমি গুরু দেখি নাই॥
আজ কাল করিয়া হৈল পঞ্চ বৎসর।
কোথায় রহিল আমার গুরু জলন্ধর॥
আমি ফিরিতেছি ভাই গুরুর তল্লাসে।
রথে চড়িয়া আমি খুজিনু দেশে দেশে॥
নাথ বলে শুন তুমি সিদ্ধা কানাই।
কোন রাজ্য তল্লাসিলে কহ মেরা ঠাই॥
কানুফা বলেন ভাই শুনহ খবর।
যে যে রাজ্য তল্লাসিলাম শুন জলন্ধর॥
উদয়গিরি তল্লাসিলাম যথা উঠে দিনকর।
তথা না পাইলাম গুরুর সমাচার॥
কিষ্কিন্ধ্যা ভ্রমিলাম যথা বানরের পুরী।
আযোধ্যায় তলাসিয়া গেলাম গুহকের বাড়ী॥
বৃন্দাবন পুরীখান ঘর ঘর ভ্রমিনু।
কৈলাস ভ্রমিয়া গুরুর তত্ত্ব না পাইনু॥

অস্তগিরি ভ্রমিয়া আমি বানরের পুরী
সুমেরু ভ্রমিয়া গেলাম হিমালয় গিরি॥
দেবপুরী না পাইমু গুরুর খবর।
একঠেঙ্গিয়ার দেশে গেলাম তল্লাসে জলন্ধর
শুনেছিলাম লোক মুখে একঠেঙ্গিয়ার দেশ।
এক পায়ে সর্ব্বলোক ভ্রমেন বিশেষ॥
দুই পাও দেখিয়া আমায় লাগিল কহিতে।
আদ্য পান্ত যত কন্যা যেমত আছিল।
একে একে সকল কথা কহিতে লাগিল॥
পূর্বের আছিল রাজা চন্দ্রকিশোর।
একঠেঙ্গিয়া তার ঘরে জন্মে এক কুমার[২৫]
তাহার নাম করিয়া এক পুরী বসাইল।
একঠেঙ্গিয়া রাজ্য নাম সেই জন্য হৈল॥
সেই রাজ্যে না পাইলাম গুরুর খবর।
গয়া পাটনা গেলাম তল্লাসে জলন্ধর॥
আশ্চার্য্য দেখিলাম সেই রাজ্যের ব্যবহার।
স্ত্রী বিনে নাহি রাজ্যে পুরুষের সঞ্চার॥
স্ত্রী রাজ্য স্ত্রী প্রজা স্ত্রী রাজ্যের দেওয়ান।
স্ত্রী রাজা হইয়া করে রাজ্যের পালন॥
অপূর্ব্ব রাজ্যের কথা শুনিতে অনুরূপ।
ঋতুস্নান করি নারী[২৬] যায় কামরূপ॥
কামরূণ সহরে আছে পুরুষের বসতি।
তথা যায় যেবা নারী হয় ঋতুবর্তী॥
কামরূপে যাইয়া রতি ভুঞ্জেন শৃঙ্গার।
ঋতু রক্ষা করে নারী হয় গর্ভের সঞ্চার॥
যে নারীর উদরে সৃজন হয় বেটা।

রামচক্র বাণে তার মুণ্ড যায় কাটা॥
বৎসর অন্তরে ফিরে রামচক্র বাণ।
স্ত্রীয়া পাটনে নাই পুরুষের পরিত্রাণ॥
সেই জন্যে নাহি রাজ্যে পুরুষের লেশ।
স্ত্রীবেশে সেই রাজ্যে করিনু প্রবেশ॥
হুহুঙ্কার ছাড়িনু আমি ভাবি জলন্ধর।
আউট হাত কেশ হইল মাথার উপর॥
হৃদয়ে হইল আমার উভ দুইটা স্তন।
স্ত্রীবেশে সেই রাজ্যে করিনু ভ্রমণ॥
বাগ দ্বারায় কামরূপ ঘর ঘর ভ্রমিনু।
কোন খানে গুরুর খবর না পাইনু॥
না পাইয়া গুরুর লাগ হইনু ভাবিত।
এখন যাইব আমি লঙ্কার পুরীত॥
এইরূপে ভ্রমিনু আমি গুরু তলাসিতে।
রাত্রি হইল আমার সহর কদলীতে॥
তোমার গুরু মীন্যাথ আছে কদলী সহরে।
রাত্র দিন থাকে নাথ নটিনীর বাসরে॥
নটী লয়ে মীন্যাথ সিদ্ধা হয়াছে বিভোর।
চুল দাড়ি পাকেছে সিদ্ধা যাবে যমনগর॥
তুমিত ভাজন সেবক নাম গোৰ্খ যতি।
তুমি থাকিতে তাহার এতেক দুর্গতি॥
গোরেক বলে নাহি জানি এতেক সমাচার।
কল্য যাইব গুরুর করিতে উদ্ধার॥
মরে যদি থাকে গুরুর হাড় লাগাল পাব।
হাড় সঞ্চে জোড়া দিয়া গুরু মিলাইব॥
গোরেক বলেন ভাই প্রাণের দোসর।
শুনিলাম তোমার মুখে গুরুর খবর॥
আমার গুরুর কথা কয়া দিলে তুমি।

তোমার গুরুর কথা কয়া দিব আমি॥
গোরেক বলেন ভাই শুন আমার ঠাঁই।
মৃকুল সহরে আছে ময়নামন্ত্রি রাই।
গোপীচন্দ্র নামে রাজা তাহার নন্দন।
উনিশ বৎসর কালে তাহার মরণ॥
যখন হইল বালক দ্বাদশ বৎসর।
জ্ঞান দিতে গেল হাড়ি করিতে অমর॥
নিজ নাম বীজমন্ত্র কর্ণে শুনাইল।
স্ত্রীর উপরে চিত্ত নাম মনে না থাকিল॥
জ্ঞান পরীক্ষিতে গেল পুষ্করিণীর কূলে।
পুষ্করিণী শুখান রৈল না ভরিল জলে।
সত্য বলে দিল নাম মিথ্যা বলে ধরে।
গোস্‌সায় পুতিল হাড়িক ঘোড়ার পৈঘরে॥
গোরেক বলেন দাদা শুন মেরা ঠাই।
চণ্ডীর শাপে পোতা গেল দোষ কিছু নাই॥
আমার সেবক হইয়াছিল ময়নামন্ত্রি।
তাহার পুত্রক বাঁচাইতে করহ যুকতি॥
আপন গুরুকে তুমি করগা উদ্ধার।
বাঁচাইয়া লহ তুমি মুনির কুমার॥
শাপ দিয়া মুনির যদি পুত্র পায় কাল।
দূষী হইবে হাড়ী বাড়িবে জঞ্জাল॥

শ্লোক


কোকিলানাং স্বরোরূপং নারীরূপং পতিব্রতা।
বিদ্যারূপং কুরূপানাং ক্ষমারূপং তপস্বিনাম্॥
কোকিলের রূপের কথা শুন মেরা ঠাই।
সর্ব্বাঙ্গ শরীর কাল রূপের কিছু নাই॥
রাঙ্গা দুটী চক্ষু কুলীর কি গুণে বাখানি।
শাস্ত্রে নাহি রূপ কুলীর রূপের কেবল ধ্বনি॥

নারীর রূপের কথা কর অবধান।
দেখিতে সুন্দর নারী যদি রাখে মান॥
আপনার মান যদি না রাখে যুবতী।
স্বামীর সেবা নাহি করে নারী অধোগতি॥
রূপে গুণে বিদ্যায় নারীর চঞ্চল হয় চিত।
কোন শাস্ত্রে নাহি নারীর রূপের বিয়াখিত॥
পতিব্রতা নারী হয় স্বামীর সেবা করে।
স্বামী ছাড়া পিতার রূপ জানে এ সংসারে॥
শুদ্ধমতি ধীর হয় গুণবতী রামা।
সর্ব্ব শাস্ত্রে শুনি নারী দেবীর উপমা॥
পুরুষের রূপের কথা শুন দিয়া মন।
দেখি যে সুন্দর পুরুষ না হয় ভাজন॥
দেখিতে সুন্দর পুরুষ জ্ঞান নাহি ধরে।
তাকে অকর্ম্মা পুরুষ বলে এ সংসারে॥
দেখিবার যুক্ত নহে শাস্ত্রেতে পণ্ডিত।
জ্ঞানমন্ত পুরুষের জ্ঞানী বিয়াখিত॥
সিদ্ধা মহন্তের কথা শুনহ কানাই।
ব্রহ্মসিদ্ধা পুরুষের মনে কোন নাই॥
সে বড় মহন্ত হয় ক্ষমে অপরাধ।
হতজ্ঞানী হয় যেমন করিবে সম্পদ॥
কাম ক্রোধ মোহ মদ ক্ষমা দেয় চিতে।
মহন্তের মহন্ত হয় শুনেছি ভারতে॥
তোমার গুণ সব ভাই রহিবে সংসারে।
কোন রূপে বাঁচাইবে মুনির কুমারে॥
দোহার গুরুর কথা কয়া দুইজন।
বাহু ধারাধরি করে প্রেম আলিঙ্গন॥
কদলী সহরে গেল গোরেক হরিহর।
মৃকুলে চলিল কানাই যথা জলন্ধর॥

শুনিয়া গুরুর কথা আকুল জীবন।
রথে চড়েয়া পুনঃ করিল গমন॥
ষাইটগতি শিকারপুর হস্তিনানগর।
সোনাপুর দিয়া রথ করিল গমন॥
চন্দ্রকণা সুর্য্যভাগ পশ্চাতে রখিয়া।
কাঞ্চননগর খান বামেতে থুইয়া॥
বিষ্ণুপুর চাঁপাপুর খাসহরা নগর।
সুনতিলা দিয়া রথ গেল কাঞ্চিপুর॥
ভদ্রাখণ্ডা নিশাভাল হেমন্তনগর।
চিন্তপুর দিয়া রথ যায় তরাতর॥
শ্রীকলা বিমলা আর নগর কর্ণাট।
বিক্রমপুর দিয়া রথ গেল চাইরঘাট॥
সীতা শঙ্কর পৈ আর আড়াগাড়া।
দুর্জননগর দিয়া গেল চান্দের আড়া॥
গজমন দিয়া পার হইল দামোদর।
নিশিন্তপুর দিয়া গেল বিজয়ানগর॥
রাত্রি দিবা চলে রথ না করে বিশ্রাম।
কৌতুকে চলিয়া গেল কত কত গ্রাম॥
যত গ্রাম পার হইল না যায় কহন।
তুরিত গমনে গেল মুনির ভুবন॥
মুনির গোফাতে যায়ে সিংহনাদ পূরিল।
সিংহনাদ শুনিয়া মুনির ধ্যান ভঙ্গ হৈল॥
গলে বসন দিয়া মুনি বন্দিল চরণ।
বসিতে আনিয়া দিল যোগের আসন॥
আসনে বসিল সিদ্ধা দিয়া আশীর্বাদ।
কহিতে লাগিল মুনিক গুরুর সংবাদ॥
কানুফা বলেন মুনি শুন সমাচার।
গোপীচন্দ্র নামে আছে তোমার কিঙ্কর॥

আমার গুরুক পোঁতে ঘোড়ার পৈঘরে।
কাইল আইজ নহে হৈল পঞ্চ বৎসরে॥
এ কথা শুনিয়া মুনির চক্ষে পড়ে পানি।
গুরুকে পুতিল পুত্র আমিত না জানি॥
এ ভব সংসারে যার নাম জলন্ধর।
চুলে করে পিতে পারে এমন্ত সাগর॥
তাহাকে পুতিল বেটা কোন প্রাণে ধরে।
হুহুঙ্কারে পাঠাবে বেটাকে জমের নগরে॥
হায় হায় করে মুনি ভাবে মনে মনে।
হাড়িফার কোপে পুত্র বাঁচিবে কেমনে॥
আঠার বৎসর সবে বালকের প্রমাই।
সেই পুত্র পুতিল আমার হাড়িফা গোঁসাই॥
গোরক্ষের সেবক আমি যমের নাহি ডর।
হাড়িফার কারণে প্রাণ বিয়াকুল আমার॥
হাড়িফার নাম শুনি যমরাজা ডরে।
তাহার সনে বাদ করে মনুষ্য শরীরে॥
হায় হায় করে মুনির চক্ষের পড়ে জল।
কান্দিতে কন্দিতে মুনি পড়ে ভূমিতল॥
কানুফা বলেন মুনি কান্দ অকারণ।
পুত্রেক বাঁচাবার হেতু করহ এখন॥
যতি গোরক্ষের বরে হইল কুমার।
যেরূপে বাঁচিবে ইঁহার করহ বিচার॥
সোনার আনিয়া কর সোনার গোপীচন্দ্র।
সাক্ষাতে রাখিব তাহাকে করিয়া প্রবন্ধ॥
যখন জিজ্ঞাসিবে গুরু করিতে স্বীকার।
সোনার গোপীচন্দ্রক কর মুনির কুমার॥
কোপ করি শাঁপ দিবে গুরু জলন্ধর।
সোনার গোপীচন্দ্র যাবে যমের নগর॥

কোপ ক্ষমা হবে যখন হইবে আনন্দ।
সাক্ষাতে রাখিয়া দিও পুত্র গোপীচন্দ্র॥
বাঁচিবে তোমার পুত্র না ভাবিহ আর।
সুকুর মামুদে কয় এই যুক্তি সার॥
সায়ের অল্লার নাম ফকির গুণমন্ত।
তাহায় তনয় পুথি রচিল যোগান্ত॥
মন দিয়া শুন এখন যোগের কাহিনী।
ভবসিন্ধু তরিবারে পাইব তরণী॥
সাধিলে অমর হয় শুনিলে হয় জ্ঞান।
অন্তিম কালেতে সেই পাইবে পরিত্রাণ॥


শুনহ সকল লোক বিধাতার নির্ব্বন্ধ।
যেরূপে বাঁচিল মুনির পুত্র গোপীচন্দ্র॥
শুনিয়া কানুফার কথা আনন্দ হইল।
সোনার আনিতে মুনি খেতুকে পাঠাইল॥
মুনির আজ্ঞাতে খেতু করিল গমন।
ডাকিয়া আনিল আরো সোনার পঞ্চজন॥
গলে বসন দিয়া মুনি করিল প্রণাম।
সোনার বলেন মা করি কুন কাম॥
মুনি বলে বাছা তোমার বাড়ুক আব্বল।
শীঘ্র বানাবে বাছা সোনার পুত্তল॥
সহস্র মোহর মুনি সোনারকে দিল।
মুনির আজ্ঞাতে সোনার পুতুল বানাইল॥
পুতুল বানাইল মুনির পুত্রের প্রমাণ।
দেখিয়া হইল শোভা গোপীচন্দ্রের জ্ঞান॥
আনন্দ হইল দেখি ময়নামন্ত্রি রাই।
সেই পুতুল লয়ে গেল কামুফার ঠাই॥

কানুফা বলেন মুনি আনহ বেলদার।
এবে সে জানিবে তোমার পুত্রের নিস্তার॥
এতেক শুনিয়া মুনি বেলদার আনিল।
ঘোড়ার পৈঘরে তখন খুঁড়িতে লাগিল॥
খুঁড়িতে পাইল তখন হাড়িফার গোফা।
যোগ ধ্যানে বসি তথা আছেন হাড়িফা॥
চক্ষু মুদিয়া আছে হাড়ি কিছু নাহি জানি।
কানুফা বলেন পুতুল আনহ ছামনি॥
হাড়িফার ছামনে পুতুল আনিয়া রাখিল।
মানুষের আকৃতি পুতুল দাঁড়াইয়া রহিল॥
হাড়িফার সাক্ষাতে কানাই সিংহনাদ পূরিল
সিংহনাদ শুনিয়া মুনিব ধ্যান ভঙ্গ হইল॥
চেতন পাইল যখন হাড়িফা জলন্ধর।
কানুফা প্রণাম করেন জুড়ি দুটী কর॥
গলে বসন দিয়া মুনি বন্দিল চরণ।
একে একে প্রণাম করিল সর্ব্বজন॥
প্রণাম করিল সবে সিদ্ধা যত জন।
প্রণাম না করে কেবল পুতুল রতন॥
দেখিয়া জ্বলিল হাড়ি অগ্নি অবতার।
কানুফার তরে বলে কি নাম ইহার॥
কহিল কানুফা তখন করি মায়াবন্ধ।
সাক্ষাতে আছেন রাজা সোনার গোপীচন্দ্র॥
শুনিয়া হাড়িফা সিদ্ধা হুহুঙ্কার ছাড়িল।
সুবর্ণ পুতলী তখন ভস্ম হয়ে গেল॥
ভস্ম হইয়া গেল যখন সুবর্ণ পুতুলী।
তখনে আনিয়া দিল সিদ্ধের ঝুলী॥
সোওা কুচলা সিদ্ধা হস্তে করি নিল।
সোওা মণ ধুতুরার ফল তাথে মিশাইল॥

সোওা মণ কুচলা সিদ্ধা একত্র করিয়া।
মুখে তুলে দিল নাথ শিব নাম লিয়া॥
সিদ্ধাগণ সিদ্ধিয়ে মহা ব্যস্ত হইল।
যোগান্ত বেদান্ত কথা কহিতে লাগিল॥
যখন হইল হাড়ির গোস্বা নিবারণ।
কহিতে লাগিল হাড়ির ধরিয়া চরণ॥
মুনি বলেন গোঁসাই ক্ষম অপরাধী।
দুটী কর জুড়ি মুই করেছি মিন্নতি॥
হাড়িফা বলেন মুনি বাড়িবে আব্বল।
কোন চিন্তা নাই তোমার সর্ব্বয়ে কুশল॥
এত শুনি কহে মুনি হইয়া আনন্দ।
তোমার সেবক হবে পুত্র গোপীচন্দ্র॥
গলে বসন দিয়া মুনি করিয়া প্রণাম।
পুত্র গোপীচন্দ্র আমার তোমার গোলাম॥
গোপীচন্দ্র হবে গোঁসাই তোমার নফর।
সেবক করিয়া তুমি করহ অমর॥
শুনিয়া হাড়িফা মুনিক কিছু না বলিল।
কানুফার তরে হাড়িফা সাঁপ দিল॥
শিশুর তরে রক্ষা কর গুরু জলন্ধর।
গুরু ইন্দ্র গুরু চন্দ্র গুরু সর্ব্বসার॥
গুরু বিনে সেবকের নাহিক নিস্তার।
তুমি গুরু পরমব্রহ্ম ত্রিভুবনের সার॥
সর্ব্ব মায়া নানা ছল জ্ঞান গতাগতি।
গুরু হইয়া সেবকের করিলেন দুর্গতি
প্রলয় কালে তুমি গুরু করিবেন নিস্তার।
এখন সাঁপ দিয়া মুনি কর ছারখার॥
গুরু বিনে সেবকের আর কিছু নাই।
নিস্তার করহ নাথ পরম গোঁসাই॥

গুরু হইয়া সেবকের করহ উদ্ধার।
প্রলয় কালেতে তার করিবে বিচার॥
মুনির বচনে হাড়ীর গোস্বা হইল মন।
কহিতে লাগিল সিদ্ধা সাঁপ বিমোচন॥
হাড়িফা বলেন শুন ময়নামন্ত্রি রাই।
উদ্ধার করিবেক পুনঃ বাইল ভাদাই॥
এতেক শুনিয়া সবে আনন্দ হইল।
জয়ধ্বনি শঙ্খধ্বনি সিংহনাদ পূরিল॥
কানুফা বন্দিল পুনঃ হাড়িফার চরণ।
ডাহুকার গড়ে যায়া চড়ে রথে আরোহণ॥
ডাহুকার গড়ে গেল সিদ্ধা কানাই।
হাড়িফার নিকটে গেল ময়নামন্ত্রি রাই॥
মুনি বলে শুন তুমি হাড়িফা গোঁসাই।
আঠার বৎসর আমার বালকের প্রমাই॥
উনিশ বৎসর কালে নাহিক উপায়।
সেবক করিয়া তুমি রাখ রাঙ্গা পায়॥
সংসারের মধ্যে গুরু তুমি ব্রহ্মজ্ঞান।
সেবক করিয়া দিয়া রাখ নিজ নাম॥
হাড়িফা বলেন শুন ময়নামন্ত্রি রাই।
নিজ নামের কথা মুনি শুন আমার ঠাই॥
স্ত্রী লয়ে করে যে জন সংসারে বসতি।
অমর হইতে পারে কি তার শকতি॥
রাজ্য করে গোপীচন্দ্র লয়া চারি রাণী।
কেমন করিয়া তারে জ্ঞান দিতে পারি॥
নারী পুরী ছাড়িয়া যখন হইবে দেশান্তর।
সেবক করিয়া তখন করিব অমর॥
গলে কেথা পরাইবে চিম্‌টা লবে হাতে।
মাথা মুড়াইয়া যখন দাঁড়াবে রাজপথে॥

মুখেতে ভুসন মাখি যুগী হয়ে যায়।
তখন করিব সেবক কহিলাম নিশ্চয়॥
এতেক শুনিয়৷[২৭] মুনি বন্দিল চরণ।
তখন চলিল মুনি ছাড়াতে রাজন॥
বসি আছে গোপীচন্দ্র পাটের উপর।
বামে বসিয়াছে রাজার পাত্র মনোহর॥
খেলার সখি গেছে রাজার বালা লখিন্দর
তাম্বুল যোগায় রাজার খেতুয়া নফর॥
সেনাপতি আছে কত তাহার লেখা নাই।
সেই খানে দাঁড়াইল ময়নামন্ত্রি রাই॥
মুনিকে দেখিয়া তখন সবে খাড়া হইল।
শতে শতে প্রজাগণ মস্তক নওয়াইল॥
পাত্র মিত্র খাড়া হইয়া বন্দিল চরণ।
বসিতে আনিয়া দিল রাজসিংহাসন॥
খেতুয়া আনিয়া দিল ভৃঙ্গারের পানি।
পদ প্রক্ষালিয়া তখন বসিল মা মুনি॥
লক্ষের পতুকা রাজা গলেতে জড়িল।
অষ্টাঙ্গে প্রণাম করি চরণ বান্দল॥
বাহু পসারিয়া মুনি পুত্র লইল কোলে।
লক্ষ লক্ষ চুম্ব দিল বদন কমলে॥
মায়ে পুত্রে হাসিয়া বসিল এক ঠাই।
পুত্রেক বুঝায় মা ময়নামন্ত্রি রাই॥
মুনি বলে শুন তুমি পুত্র গোপীচন্দ্র।
রাজ্য পাট যত দেখ সব মিথ্যা ধন্ধ॥
রাজ্য কর গোপীচন্দ্র লয়া চারি নারী।
মনুষ্য উপরে আছে যমের অধিকারী॥

মরণ কর আগ বাছা জীবন কর পাছ।
নারী পুরী ত্যাগ বাছা দৃঢ় কর গাছ॥
উজান বহে যায় নাহি দেয় ভঙ্গ।
যোগে মনেক দেহ[২৮] না ছাড়িবে সঙ্গ॥
বিষম শিকল বন্দে মনকে না দেয় ঠাই।
মনেক বান্ধিলে বাছা তলের লাগাল পাই॥
এই সংসার মাঝে মন ডাকত বড়।
বিপদ পাথারে মন দাগা দিবে বড়॥
মন রাজা মন প্রজা মন মায়া ফন্দ।
মন বান্ধ তন চিন্ত শুন গোপীচন্দ্র॥
ছাড় বাছা রাজ্য পাট আর উত্তম ভোগ।
ছাড়ে দেও কামিনীর মায়া সাধে লেও যোগ॥
যোগ পদ বড় পদ যদি জ্ঞান পায়।
যমের মুখে ছাই দিয়ে চার যুগ বেড়ায়॥
রাজা বলে শুন মা ময়নামন্ত্রি রাই।
নিশ্চয় জানিলাম তোমার পুত্রের দয়া নাই॥
অন্যের মায়ে বলে বাছা দুগ্ধে অন্ন খাও।
তু মাও সদাই বল যোগী হয়া যাও॥
যোগী হয়ে যাব মা কি ধন পাব নিধি।
এ সুখ সম্পদ কালে মা বাম হৈল বিধি॥
মা হয়ে সদাই বল হইতে দেশান্তরী।
পিতা মোরে দিল বিয়া এ চারি সুন্দরী॥

ত্রিপদী॥

আগে বিভা দিল পিতা, মহেশ্চন্দ্রের দুহিতা,
নাম তার চন্দ্রসেনা যুবতী।

যৌতুক দিলেন যত, তাহা বা কহিব কত,
চড়িতে দিলেন মদন নামে হাতী॥
বিভা দিল তার পরে, নিহালচন্দ্রের ঘরে,
তাহার নাম ফন্দনা যুবতী।
নিহালচন্দ্রের ঝি, রূপ তাহার কব কি,
যেন দেখি স্বর্গের বিদ্যাধরী॥
যৌতুক দিলেন ধন, দাসী দিল পঞ্চজন,
চড়িবার দিল খাসা ঘোড়া।
নৌকা দিল জলকর, তার পার্শ্বে স্বর্ণ ঘর,
আর দিল মদন নামে ঘোড়া॥
তার পরে বিভা করি, হরিশ্চন্দ্রের কুমারী,
নাম তার অদুনা রূপসী।
বচন কোকিলার ধ্বনি বাঁশীর হেন রব শুনি,
সর্ব্বক্ষণ মধু মধু হাসী॥
তার ছোট দিল কন্যা, তার নাম পদুনা ধন্যা,
খঞ্জন চলন যেন ধীরে।
যত ছিল আভরণ, সর্ব্বাঙ্গে পরিধান,
আইল কন্য। বিভার বাসরে॥
দেখেন কন্যার রূপ, আয়গণ অপরূপ,
মহারাজার মনের কৌতুক।
কন্যার হাতেতে ধরি, দেব ব্রহ্মা সাক্ষী করি,
বিভা রাত্রে দিলেন যৌতুক।
এহি তিন বিভা করি, পানু চারি সুন্দরী,
দেবকন্যা জিনিয়া রূপে গুণে।
মৃকুলের রাজপথ, এমন সুখ সম্পদ,
ইহা ছাড়ি যাবে কোন স্থানে॥
অদুনার বাসর ঘরে, যদি যাই যমের পুরে,
তবে তো না হবে দেশান্তরী।

সুকুর মামুদ কয়,  মরণ কোথা থাকে ভয়,
তবে রাজা ছাড় নারী পুরী॥

পয়ার

মুনি বলে বাছা তুমি না বুঝিবে ভাল।
মা হয়ে পুত্রেক আর বুঝাব কত কাল॥
এই রাজ্যে ছিল রাজা কত নরপতি।
এ সুখ সম্পদ তারা থুয়ে গেল কতি॥
অযোধ্যায় ছিল রাজা রাম রঘুপতি।
স্ত্রীর কারণে তার কতেক দুর্গতি॥
শুনেছিমাম লঙ্কাতে ছিল লঙ্কেশ্বর।
সীতাকে হরিয়া সেই গেল যানগর॥
গোকুল মথুরায় জন্মেছিল নারায়ণ।
রাধিকার কারণে তার বিধির বিড়ম্বন॥
এহি রাজ্যে ছিল রাজা রোজা ধন্বন্তরি।
স্ত্রীর ঠাই মর্ম্ম কহি সেহ গেল মরি॥
সর্ব্বখানি দোষ নারীর একখানি গুণ।
স্ত্রীর পেটে[২৯] যদি জন্মিল মহাজন॥
এক নারী তোমার ময়নামন্ত্রি রাই।
আর যত নারীর কথা শুন আমার ঠাই॥
এক নারী গঙ্গাদেবী যাহাতে করি স্নান।
আর নারী লক্ষ্মীদেবী যাক খাইলে পরিত্রাণ॥
আর নারী সরস্বতী ভজিলে বিদ্যা পাই।
আর নারী নিদ্রাআলী সংসারে নিদ্রা যাই॥
আর নারী বসুমতী সংসারে লৈল ভার।
ইহা ছাড়া যত নারী সব দুরাচার॥
হাটে নারী ঘাটে নারী নারী পতিঘরে।

যত পুরুষ দেখ নারীর বেগার খেটে মরে।
সহস্র কৌটা রত্ন হয় অতি মহারস।
সে ধন ফুরাইলে পুরুষ নারীর হয় বশ॥
সিংহের আকার নারীর বাঘের মত চায়।
হাড় মাংস থুয়া বাছা মহারস লয়॥
পুরুষের ধন লয় স্ত্রী বেপার করে।
লোভেতে থাকিয়া পুরুষ বেগার খাটে মরে॥
আপনার হাল গরু বেগানার ভুঁয়ে চাস।
আব্বলের ক্ষয় আর বেছোনের সর্ব্বনাশ॥
লোহা দিয়া বান্ধে লাঙ্গল মাটিতে যায় ক্ষয়।
থোর কলা বাদুলে খাইলে কলা ডাঙ্গর লয়।
কাঁচা বাঁশে ঘুন লাগিলে কত ভার[৩০] সয়।
মূল খুঁটিতে ঘুন লাগিলে ঘর পড়িবার চায়॥
বন্ধন ছুটিলে ঘরের নাহিক উপায়।
ছাঁটনেতে ঘুন লাগিলে ঘর পড়ে যায়॥
“আট হাত বৃক্ষ বাছা যোড়ামুটি ফল।
নজরের পাপ কারণ সংসার ব্যকুল॥
পুরুষের ভক্ষণ নয় খাইতে না জুয়ায়।
সেই ধন ফুরাইলে পুরুষ যমঘরে যায়।
আধার[৩১] ভুঞ্জিলে বাছা ভাণ্ড হয় খালি।
দিনে দিনে রসাতল পুরুষের গাবুরালী॥
এ সুখ সম্পদ বাছা থাকিবে পড়িয়া।
আর আসিবে যমের দূত লইবে বান্ধিয়া॥
ইষ্ট মিত্র ভাই বন্ধু কান্দিবে বেড়িয়া।
বুকে বাঁশ দিয়া বাছা ফেলিবে বান্ধিয়া॥
সুস্থির হইলে কান্দিবে দিন দুই চারি।
অন্ন জল খাইলে বাছা যাইবে পাসরি।

স্ত্রী পুত্র কান্দে বাছা ঠাণ্ডা পানি পিয়ে॥
কুকধরণী মায়ে কান্দে যাবৎ প্রাণে জিয়ে॥
মৎস্যে চিনে গভার গঙ্গা পক্ষী চিনে ডাল।
মায়ে জানে পুত্রের মায়া জীবে যত কাল॥
ছাড় বাছা রাজ্য পাট মুখে মাখ ছাই।
মায়ে পুত্রে যুগী হয়ে চার যুগ বেড়াই॥
রাজা বলে তোমার বাক্য লঙ্ঘিতে না পারি।
পাকিলে মাথার চুল যাব দেশান্তরী॥
মায়ে বলে বাছা তুমি তত্ত্ব কথা শুন।
কিরূপে পাকিবে চুল যম নিদারুণ॥
আঠার বৎসর বাছা তোমার প্রমাই।
উনিশ বৎসর কালে যমের ঠাঁই॥
উনিশ বৎসর কালে তোমার মরণ।
কেমনে পাকিবে চুল যম নিদারুণ॥
রাজা বলে শুন মা বলি তোমার তরে।
আমি রাজা যুগী হব যম রাজার ডরে॥
যম এক রাজা মা আমি এক রাজ্যেশ্বর।
কি করিতে পারে মা করিব সংহার॥
ষোল বঙ্গের রাজাই আমাক দিয়াছেন গোঁসাই।
মারিব যমেক আমি করিয়া লড়াই॥
মুনি বলেন যমেক আমি দেখিতে না পাই।
কি মত প্রকারে বাছা করিবে লড়াই॥
লস্কর লইয়া যম নাহি যায় রণে।
শূন্য পথে থাকে যম ব্রহ্মগুণে টানে॥
রাজা বলে শুন মা ময়নামন্ত্রি রাই।
এক নিবেদন তোমার চরণে জানাই॥
আঠার বৎসর মা আমার প্রমাই।
সেবক করাবে আমার কোন গুরুর ঠাই॥

মুনি বলে শুন বাছা তুমি আমার স্থানে।
সেবক করাব তোমাকে হাড়িফার চরণে॥
যেই মাত্র গোপীচন্দ্র শুনিল হাড়ির নাম।
কর্ণে হাত দিয়া রাজা বলে রাম রাম॥
হাড়িফার কথা শুনি রাজা কান্দিতে লাগিল।
মুখের তাম্বুল রাজা তখনি ফেলিল॥
গোপীচন্দ্র বলে মা গেল জাতি কুল।
হাড়িফার সেবক হব আর নাহি মূল॥
মালী তেলী আছে যত আছে কায়স্থ কামার।
ব্রাহ্মণ যবন[৩২] আছে সবার প্রধান॥
এতেক থাকিতে আমি লব হাড়ির জ্ঞান।
লোকেতে দুর্নাম গাবে না থাকিবে মান॥
এহিত সংসারে আছে কত জাতি লোক।
রাজা হয়ে হব আমি হাড়িফার সেবক॥
এহি বলে কান্দে রাজা চক্ষে পড়ে পানি।
পিতা অসম্ভবে জাতি ডুবাইল জননী॥
হায় হায় বলিয়া রাজা মারিল কপালে।
বসন ভিজিল রাজার নয়নের জলে॥
মুনি বলে শুন বাছা রাজার কুমার।
জাইতে ছাড়ি লয়ে বাছা হাড়িফা জলন্ধর॥
ছোট বলি বল বাছা হাড়িফা শুনিলে কানে।
সাঁপ দিয়ে ভস্ম করিলে বাছা রাখে কোন জনে
হাড়ি য় হাড়ি নয় হাড়িফা জলন্ধর।
চুলে করি পিতে পারে এ সপ্ত সাগর॥
জ্ঞানে ধ্যানে হাড়িফা বান্ধিয়াছে চূড়া।
দিবা রাত্রি ফিরে হাড়ি যমকে করি ঘোড়া॥
যম রাজা হয় যার নিজের চাকর।

চন্দ্র সূর্য্য দুই জন কুণ্ডল কানের॥
পঞ্চ বৎসর পোতা ছিল ঘোড়র পৈথরে।
অন্ন জল না খাইল তবু তো না মরে॥
রাত্রি দিবা করে যে জন গুরুর সেবন।
তাহাকে না জানে কোন মনুষ্য রতন॥
হেন গুরু মিলিল বাছা কপালের ফলে।
বুদ্ধি হারাইলে কেন কামিনীর ছলে॥
তোমাকে বলি বাছা ছাড় স্ত্রীর আশ।
হাড়িফার চরণ সেবি হওগা সন্ন্যাস॥
মুনি বলে শুন তুমি রাজার কুমার।
যেরূপে হইল শুন জনম সিদ্ধার॥

ত্রিপদী।

হাড়িফার যত গুণ, কর্ণ পাতিয়া শুন,
যেরূপে জন্মিল জলন্ধর।
অনাদ্যের ঘাম হৈতে, চণ্ডিকা জন্মিল তাথে,
দুর্গা হইল পরমা সুন্দর॥
ডাহুকার অধিষ্ঠাত্রী, নাম ধরেন পার্ব্বতী,
ত্রিভুবনে মোহন আকার।
চণ্ডিকার রূপ দেখি, অনাদ্য হইল সুখী,
নাহি ছিল সংসারের সার॥
অনাদ্য ঘটাইল মায়া, দেবী বাম হস্তে লয়া,
তাহাতে জন্মিল চারি জন।
ব্রহ্মা বিষ্ণু দুই ভাই, ছোট হইল শিবাই,
নাম (?) গেল পাতাল ভুবন॥
দেখি প্রভু ভাবে মনে, মরি তবে নিরাঞ্জনে,
কেবা চণ্ডী করিবে পালন।
অনাদ্যের অঙ্গীকার, সংসাস সৃষ্টি করিবার,
কারে চণ্ডী করি সমর্পণ॥

বুঝিয়া সভার মতি, বিভা দিব ভগবতী,
আগে বুঝি কার কেমন ভার।
এতেক ভাবিয়া মনে, ডাক দিল তিন জনে,
পুষ্প দিল পুজা করিবার॥
তিন ঘাটে তিন জন, পূজে নাম নিরাঞ্জন,
মৃতরূপে ভাসে নিরাঞ্জনে।
ভাসিয়া জলের পরে, মৃতরূপে মায়াধরে,
গেলেন প্রভু নিকটে ব্রহ্মার॥
নৈরাকারে মৃত দেখি, ভয় পায় চর্ম্মুখী,
পূজা ছাড়ি উঠিয়া পালায়॥
সে ঘাট করিয়া পাছে, গেলেন বিষ্ণুর কাছে,
দেখি বিষ্ণু বিমুখ হইল।
বুঝিয়া বিষ্ণুর মন, মৃতরূপে নিরাঞ্জন,
গেলেন যথা পূজিছেন শঙ্কর।
ব্রহ্মদেব না জানে মতি, বিষ্ণু হইল প্রজাপতি,
কিঞ্চিৎ ধ্যানে মহেশ্বর॥
ধ্যানে জানিল হরি, কোন জন গেল মরি,
মৃতরূপে আইল আপনে।
যারে আমি পূজা পূজি, মৃতরূপে সেই বুঝি,
পুষ্প দিল মৃতের চরণে॥
মৃত পূজা পূজে ভোলা, নিরাঞ্জন গেল গল্যা,
শিব চন্দন বলে মাখে গায়।
বুঝিয়া শিবের মন, মৃতরূপে নিরাঞ্জন,
নিজরূপে দিল পরিচয়॥
পরিচয় পায়ে হরি, মাথে নিরাঞ্জন করি,
গেল শিব হাতে সিঙ্গা করি।
বমাবম গাল বাজায়, ঘন ঘন বিষ্ণু গায়,
কমণ্ডুলে গঙ্গা ত্রিপুরারি॥

সেই গঙ্গা ভগীরথে, আনিলেন পৃথিবীতে,
হইল গঙ্গা পতিতপাবনী।
বুঝে সেবকের মতি, বিভ। দিল ভগবতী,
ব্রহ্মা বিষ্ণু করে কানাকানী॥
শিব কৈল্য অবিচার, পৃথিবীতে কুলাঙ্গার,
শিব জননীক বিভা করে।
শিব করে কুকাজ, আমরা পাইব লাজ,
কেমনেতে বধিব শঙ্করে॥
শিকার করিব মনে, লয়া গেলেন অরণ্যে,
হাতে করি লোহার মুদ্গর।
এতেক ভাবিয়া চিতে, শিবেক লইয়া সাতে,
উতরিল জঙ্গল ভিতর॥
সবে এই তিন ভাই, পৃথিবীতে আর নাই,
এক তরুতলেতে বসিয়া।
মুদ্গর লইয়া হাতে, মারিল শিবের মাথে,
মস্তক চৌচির হয়ে গেল॥
শিবের মাথে দিল বাড়ী, শিব যায় গড়াগড়ি,
অচৈতনা হইলেন শিব।
জন্মিলেন চারিজন, শুন তাহার বিবরণ,
তাহা হইতে হইল চারি জীব॥
বিধাতার কি হইল সায়, শিব গড়াগড়ি যায়,
গোর্খনাথ হইল শিব মুণ্ডে।
কানে কানুফা হইল, হাড়ে হাড়িফা জন্মিল,
মীন্যাথ জন্মিল নাভি কুণ্ডে॥
এক ছিল পঞ্চানন, সিদ্ধা হইল চারিজন,
তার পরে চৈতন্য শঙ্কর।
অনন্ত (?) সাগর কূলে, শিব নিজ নাম বলে,
জ্ঞান সাধি হইল অমর॥

এইরূপে সিদ্ধাগণ, জন্মিলেন চারি জন,
সিদ্ধার প্রধান মহেশ্বর।
এমতে জনম যার, সেবক হইবে তার,
কেন হেলা কর হাড়িফার॥
সুকুর মামুদে ভণে শুনে হিন্দুর পুরাণে,
যবনের নহে হিন্দুবানী।
কিছু যে তাল কয়, সে কথা অন্যথা নয়,

হাদিছে জানিয় মুসলমানী॥

পয়ার।

শুনিয়া হাড়িফার কথা প্রণাম করিল।
মুনির গুরুর কথা পুছিতে লাগিল॥
রাজা বলে শুন ময়নামন্ত্রি রাই।
তুমি সেবক হয়েছিলেন কোন গুরুর ঠাই॥
রাজকন্যা হও তুমি তিলকচন্দ্রের ঝি।
তোমাকে যে জ্ঞান দিল তাহার নাম কি॥
রাজঘরে জন্ম তোমার সর্ব্বলোকে জানে।
রাজকন্যা হয়ে জ্ঞান সাধিলে কেমনে॥
কেমনে মহন্তে তোমাক দিয়াছিল জ্ঞান।
রাজকন্যা হয়ে তুমি সাধিলে নিজ নাম॥
এতেক শুনিয়া মুনি কহিতে লাগিল।
যেমন প্রকারে মুনি জ্ঞান পেয়েছিল॥
মুনি বলে শোন বাছা রাজার কুমার।
তিলকচন্দ্র বাপ আমার রাজরাজ্যেশ্বর॥
বালক অবধি আর নাহি কাম [আন]।
সর্ব্বক্ষণ শুনি আমি ভাগবত পুরাণ॥
এতেক ভাবিয়া পিতা আপনার মনে।
পড়িবার দিল আমাক দ্বিজ গুরুর স্থানে॥

প্রাতঃকালে স্নান করি হস্তে লইলাম খড়ি।
পড়িবার কারণে যাই দ্বিজ গুরুর বাড়ী॥
এইরূপে শাস্ত্র পড়ি গুরু পাঠশালে।
উদয় হইল গুরু আমার কপালে॥
গুরুর বাড়ী যাই [আমি] শাস্ত্র পড়িতে।
দৈবযোগে দেখা হইল যতি গুর্খের সাতে॥
অপূর্ব্ব গমনে নাথ যায় শূন্যপথে।
আমার রূপ দেখি নাথ লাগিল কহিতে॥
গুরু বলে কন্যার রূপের বালাই যাই।
এমন সুন্দর কন্যা কভু দেখি নাই॥
হাতে পদ্ম পায়ে পদ্ম কপালে রত্ন জ্বলে।
এমন সুন্দর কুমারী শরীর নির্ম্মলে॥
করতলে পদ্মফুল নখ চাম্পার কলি।
রূপ দেখি যেন আমি চন্দ্রের পুতলী॥
রূপের করিয়া ব্যাখ্যা লাগিল কহিতে।
এমন বালক যাবে যমের পুরীতে॥
গুরু বলে আজ নাম খিয়াতেক রাখিব।
নিজ নাম দিয়া কন্যাক অমর করিব॥
এতেক ভাবিয়া নাথ আপনার চিতে।
রথ হইতে দাঁড়াইল নাথ রাজপথে॥
পুরুন আছিল নাথের তাম্রের পতি।
আছিল দর্শনে নাথের কর্ণে দিল মোতি॥
মুখেতে আছিল নাথের পরিপক্ক দাড়ি।
পায়েতে সোনার খড়ম হাতে সোনার নড়ী॥
গলায় দেখিনু তার ভাঙ্গ ধুতুরার ঝুলী।
সিংহ আছিল আর বগলে বগলী॥
রুদ্রাক্ষ ভদ্রাক্ষ মালা গলেতে শোভন।
যুগীরূপ দেখিনু চিতে না ভাবিনু আন॥

গলে বসন দিয়া করিলাম প্রণাম।
যোড়হাতে গুরুদেবের বন্দিনু চরণ॥
দেখিয়া তুষ্ট হইলেন গুরু মহাজন।
নাথ বলে কন্যা ধর্ম্মজ্ঞান অতি।
অতিত দেখিয়া করে এতেক ভকতি॥
অলপ বয়সে কন্যা বুদ্ধির সাগর।
বুঝিব কন্যার মন আছে কত দূর॥
এতেক ভাবিয়া নাথ আপনার চিত্তে।
প্রবন্ধ করিয়া নাথ লাগিল কহিতে॥
গুরু বলেন বছা শুন আমার ঠাই।
সাত দিন হইল আমি কিছু খাই নাই॥
যদি তুমি আমার তরে করাও ভোজন।
আশীর্ব্বাদ দিব বাছা না হবে মরণ॥
গুরুর চরণে যদি এতেক শুনিনু।
গুরু সঙ্গে লয়ে আমি নিজ গৃহে গেনু॥
ফুল টঙ্গিতে দিমু মুই বসিতে আসন।
ভৃঙ্গারের জলে নাথের ধোয়ানু চরণ॥
দুইখানি পাদুকা নাথের মুছাইনু কেশে।
অন্ন আনিতে গেনু মনের হরিষে॥
সুবর্ণের থালিখানি আমরুলে মাজিয়া।
গঙ্গাজল লই এক ভৃঙ্গার ভরিয়া॥
আতব চাউলের অন্ন থালিতে ভরিনু।
বার বৎসরের ভোজন তাথে সাজাই॥
সেই অন্ন ব্যঞ্জন বাছা থালিতে রাখিয়া।
খোয়া দুগ্ধ দিলু আর কোটর ভরিয়া॥
আর থালে ছাপাইয়া লইনু যোড়হাতে।
ভক্তি করিয়া সব দিনু গুরুর সাক্ষাতে॥
থাল সরাইয়া গুরু করিল নজর।

দেখিয়া আনন্দ হইল গুরু হরিহর॥
হুহু শব্দ করি নাথ হুহুঙ্কার ছাড়িল।
থালি হইতে অন্ন ব্যঞ্জন শূন্যে উড়াইল॥
নাহি জানি অন্ন ব্যঞ্জন গেল কোন ঠাই।
স্থানে স্থানে দুগ্ধ পান করিল গোঁসাই॥
সিদ্ধা মহন্ত যোগী পান নাহি খায়।
পানের বদলে তারা হরতকী চাবায়॥
হরতকী আনিয়া দিনু গোটা পাঁচ সাত।
দেখিয়া আনন্দ হৈল যতি গোর্খনাথ॥
হস্তে ধরি গুরুদেব সাক্ষাতে বসাইল।
এক নামে চোদ্দ বেদ কর্ণে শুনাইল॥
ব্রহ্মনাম পায়ে তখন শূন্যেতে উড়িনু।
চতুর্থ ভুবন বাড়া পলকে দেখিনু॥
থাবা দিয়া গুরুদেব ধরে বাম হাতে।
জ্ঞান আসনে নাথ বসাইল সাক্ষাতে॥
এক অক্ষরে তিন নাম সর্ব্ব নামের সার।
সে নাম কর্ণে শুনাইল গুরু হরিহর॥
এক নাম অনন্ত নাম নাম অন্ত হয়।
সেইত অনন্ত নাম গুরুদেব কয়॥
এহি নাম জপিও বাছা আাসন করিয়া।
কি করিতে পারে যম আপনে আসিয়া॥
আসনে বসিয়া নাম সাধিলে সাক্ষাতে।
ভঙ্গ দিব জরা মৃত্যু যম কালদূতে॥
যোগ আসনে যখন সাধিনু নিজ নাম।
গুরুদেব বলে বাছা সিদ্ধি মনস্কাম॥
আশীর্ব্বাদ দিল আমাক গুরু হরিহর।
আর মরণ না হইবে চারি যুগ ভিতর॥
আশীর্ব্বাদ দিয়া নাথ পুছে আর বার।

সেবক হইলে বাছা কি নাম তোমার॥
গলে ঘসন দিয়া গুরুক করিনু প্রণাম।
গুরুর চরণে কৈন্তু আপনার নাম॥
পিতায় রাখিল নাম সুবদনী রাই।
ধরিলে গুরুর চরণ যেবা নাম পাই॥
গুরু বলেন বাছা শুন আমার ঠাই।
যোগপথে নাম তোমার ময়নামন্ত্রি রাই॥
শুন নিবেদন করি গুরুর চরণে।
বিভা হইবে আমার কোন রাজার সনে।
গুরু বলেন বাছা কি কথা কহিলে।
যোগপদ সাধিয়া বাছা বিভা নাম নিলে।
এহি রাজ্যে আছে নাম মৃকুল সহর।
বাইলচন্দ্র নামে ছিল তাহার রাজ্যেশ্বর॥
তাহার এক পুত্র আছিল পালচন্দ্র।
তাহার পুত্র রুকচন্দ্র বিধাতার নির্ব্বন্ধ॥
তাহার ঘরে পুত্র আছিল মাণিকচন্দ্র।
তাহার সঙ্গে হবে তোমার বিবাহ সম্বন্ধ॥
মাণিকচন্দ্রের বিভা হবে তোমার সনে।
শৃঙ্গার বাসনা তোমার না রহিবে মনে॥
এত শুনি নিবেদিনু হইয়া ব্যাকুল।
যদি পুত্র না হইবে বিভাতে কিবা ফল॥
সেবক করিয়া গুরু হইলে নিষ্ঠুর।
বালক না হবে যদি হইব আটকুর॥
নিবেদন শুনি কহিলেন হরিহর।
এক পুত্র হবে মুনি আমি দিলাম বর॥
শৃঙ্গার স্বামী বিনে হবে গর্ভের সঞ্চার।
গোপীচন্দ্র নামে পুত্র হইবে তোমার॥
আঠার বৎসর যখন হইবে বালক।

বালকে করাবে তখন হাড়িফার সেবক॥
তখন সেবিবে গুরু হাড়িকার চরণ।
বাড়িবে পরমাই আর না হবে মরণ॥
কহিল সকল কথা গুরু মহাজন।
আশীর্ব্বাদ দিয়া গুরু করিল গমন॥
মুনি বলে শুন বাছা রাজাপুত্র সুত।
আমার গুরুর নাম গোর্খ অবধুত॥
তুমি যদি হইলে বাছা গোর্খের বরে।
দশ মাস দশ দিন ধরিনু উদরে॥
তোমাকে কহিনু বাছা তত্ত্ব বচন।
হাড়িফারর চরণ সেব না হবে মরণ॥
ছাড় বাছা রাজা পাট কিছু নহে সার।
গুরু বিনে পৃথিবীতে নাহিক নিস্তার॥
ছাড় বাছা রাজা পাট মুখে মাখ ছাই।
মায়ে পুত্রে যুগী হয়ে চার যুগ বেড়াই॥
শুনিয়া মায়ের কথা প্রণাম করিল।
পুনর্ব্বার ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল॥
রাজা বলে শুন মা ময়নামন্ত্রি রাই।
আর এক নিবেদন চরণে জানাই॥
উচিত কহিব কথা দোষ কিছু নাই।
ক্রোধ করিয়া গালি দাও বাবার দোহাই॥
এমন জ্ঞানী মা ছিলে বাপের ঘরে।
তুমি থাকিতে কেনে আমার বাবা মরে॥
সেই সকল কথা মা শুনিবার চাই।
নিশ্চয় হইব যুগী মনে কিছু নাই॥
যেইমাত্র গোপীচন্দ্র যোগী হতে চাহিল।
পুত্রের কথা শুনি মুনি হাতে স্বর্গ পাইল॥
বাহু পসারিয়া মুনি পুত্র লইল কোলে।

লক্ষ লক্ষ চুম্ব দিল বদন কমলে॥
মুনি বলে বাছা কহি তোমার তরে।
যেরূপে তোমার পিতা গেল যমঘরে॥
যখন বয়স আমার হৈল পঞ্চ বৎসর।
জ্ঞান দিয়া গুরুদেব করিল অমর।
যখন হইলাম আমি সপ্ত বৎসর।
বিবাহ করিল তোমার পিতা রাজেশ্বর॥
বিভার বাসরে আমি ধ্যানেতে বসিনু।
স্বর্গ মর্ত্ত পাতাল আমি সকল গুণিনু॥
তোমার পিতার প্রমাই গণিনু সকল।
তোমার পিতার প্রমাই বৎসর ষোল॥
রাজার প্রমাই বাছা পাইনু পরতেক।
যোগবলে রাখিয়াছিলাম বৎসর শতেক॥
তোমার পিতাক কহিলাম জ্ঞান সাধিবার।
স্ত্রী বলিয়া রাজ। আমাক করে অস্বীকার॥
স্ত্রীর সেবক হয় যেই পুরুষ বর্ব্বর।
সভাতে বসিয়া স্ত্রীর করিব আদর॥
সংসার জিনিয়া স্ত্রী যদি হয় জ্ঞানী।
তার সেবক স্বামী হয় শাস্ত্রে নাহি শুনি॥
স্ত্রীর সেবক হয়ে করিব বিলাস।
সকল সংসারের লোক করিবে উপহাস॥
এইত সংসারের মধ্যে আছে কত লোক।
কোন পুরুষ হয়েছিল নারীর সেবক॥
জন্মিলে মরণ আছে সর্ব্বলোক কয়।
আমি রাজা যোগী হব যম রাজার ভয়॥
তোমার পিতা বলে আমি যদি প্রাণে মরি।
তবেত স্ত্রীর সেবক হইতে নাহি পারি॥
এহি কহিয়া রাজা করে অহঙ্কার।

তে কারণে গেল রাজা যমের দুয়ার॥
শুন বাছা গোপীচন্দ্র যোগের কাহিনী।
বাইন শক্ত হইলে বাছা নৌকায় না লয় পানি
খাকের খাটী মাটী বাছা খাকের আবর।
পবনেতে গুণ টানে নৌকায় এত জোর॥
অসার সার করিলে বাছা কামিনীর কোলে।
মরিবে খাইবে মাংস শকুন ও শৃগালে॥
কাগা কাণ্ডারী নৌকার শগুন ভাণ্ডারী।
শৃগাল বলেন আমি নায়ের অধিকারী॥
দুই খানি চোহুড় লায়ের চৌহুড় দুইখান।
ব্রহ্মা কুণ্ডেতে বসে লায়ের দেওয়ান॥
পাঁচ পণ্ডিত লয়া মনুরা চলে বাঁয়ে।
সাধন কর বাছা হৃদয় সবায়ে॥
জ্ঞান সাধ ধ্যান কর পাইবে পরিচয়।
কাণ্ডারী থাকিতে কেন যাও অন্য ঘাটে।
বাছিয়া লাগাও নৌকা নিরঞ্জন জিটে॥
নিরাঞ্জনের ঘাট বাছা অমূল্য কাণ্ডারী।
সেই ঘাটে নাই বাছা ঘমের অধিকারী॥
নিরাঞ্জন বদলে বাছা গুরুক যেবা মানে।
গুরুকে না চিনিলে বাছা নিরাঞ্জন চিনে॥
দেহের মধ্যে গয়া গঙ্গা ত্রিবেণীর[৩৩] ঘাট।
কিনি বিকি কর বাছা শ্রীকলার[৩৪] হাট॥
বাছিয়া খরিদ কর অজপা নামের ধ্বনি।
মুখে জপ নিজ নাম দুই কর্ণে শুনি॥
পাঁচ মাণিক আছে বাছা নৌকার ভিতর।
গুরুকে ভজিয়া কর রত্ন হস্তান্তর॥

সর্ব্বদেব হইতে বাছা গুরুদেব বড়।
গুরু ভজ নাম জপ মায়া জাল ছাড়॥
মায়া জাল বিষম জাল যমরাজের থানা।
গৃহ বাস করিলে বাছা যমে দিবে হানা॥
হাড়িফার চরণ সেব চিন দিবা রাতি।
কি করিতে পারে তোমাক যমের কি শকতি
দুই লোচন সর্ব্ব জীবের কিবা পশু পক্ষ।
জ্ঞান সাধন করে দেখ প্রতি লোমে চোক্ষ॥
ধ্যান করিলে দেবগণ হয় আজ্ঞাকারী।
জ্ঞানের উপরে নাহি যমের অধিকারী॥
আব আতশ থাক বাদ দিবাকর নিশি।
বৃক্ষের তলে রহ বাছা ছাড় গৃহবাসী॥
মুনি বলে গোপীচন্দ্র কেন হইলে ভোলা।
হাড়িফার চরণ সেব নাহি কর হেলা॥
ছাড় বাছা রাজ্য পাট মুখে মাখ ছাই।
মায়ে পুত্রে যোগী হয়ে চার যুগ বেড়াই॥
সুকুর মামুদে ভণে ভাবি নিরাঞ্জনে।
রাজ্য পাট ছাড় বাড়া মায়ের বুঝানে॥
এতেক শুনিয়া রাজা কহে মায়ের ঠাই।
নিশ্চয় হইব যোগী মনে কিছু নাই॥
যাই রাণীর কাছে আমি বিদায় হয়ে আসি।
কন্যা বিহনে আমি হইব সন্ন্যাসী।
যখন গোপীচন্দ্র যোগী হইতে চাহিল।
শুনিয়া মুনির মন আনন্দ হইল॥
মুনি বলে খেতু বাছা আমার কথা লেও।
মহলে যাইবে গোপীচন্দ্র তার সঙ্গে যাও॥
রাণীর মায়াতে রাজা ভুলিবে যখন।
উচিত কহিয়া বাছা বুঝাবে তখন॥

চারি নারীর মায়া বাছা পার ছাড়াইবার।
রাজ্য পাট যত দেখ সকলি তোমার॥
মুনির আদেশ খেতু শুনিয়া শ্রবণে।
ঝারি হাতে যায় খেতু গোপীচন্দ্রের সনে॥
গোপীচন্দ্র বসিল যায়া যোড়মন্দির ঘরে।
নারীকে কহিতে খেতু গেল একশ্বরে॥
চারি রাণী খেলে পাশা হরষিত হয়া।
কহিতে লাগিল খেতু প্রণাম করিয়া॥
চারি রাণী কর কিবা পালঙ্গে বসিয়া।
দেখ গিয়া যায় রাজা সন্ন্যাসী হইয়া॥
খেতু বলেন তোমরা খেলা কর দূর।
যুগী হয়ে যায় তোমার শিথের সেন্দুর॥
শুনিয়া খেতুর কথা চারি রাণী কান্দে।
সরম না করে কাপড় কেশ নাহি বান্ধে॥
সুকুর মামুদ কহে কান্দ অকারণ।
যে জন যাইতে চায় কপালের লিখন॥

ত্রিপদী।

শুনিল যেই দণ্ডে, আকাশ পড়িল মুণ্ডে,
স্বামী রাজা হয়ে যাবে যুগী।
চারি রাণী ক্রোধভরে, শাশুড়ীকে তিরস্কার করে,
এত করি মুনি হবে সুখী॥
রাত্রি দিবা যার মায়, ভিক্ষা মাঙ্গিয়া খায়,
তাথে রাজা [রাখে] কোন জন।
ছাড়িবেক রাজ্য পদ, এত সুখ সম্পদ,
এবে মুখে মাখিবে ভুসন॥
এরূপ যৌবন কালে, এই ছিল কপালে,
যুগী হইবে নয়নের কাজল।

পতি যাবে যুগী হয়ে, ঘরে রব কারে লয়ে,
চারি রাণী খাইব গরল॥
কি বলিব পিতার তরে, জন্ম ভিখারীর ঘরে,
বিভা দিল কিবা ভাবিয়া মনে।
স্বামী বিনে হব আঁড়ী, যাইব বাপের বাড়ী,
না হয় শেষে তেজিব জীবন॥
বিষ পানে প্রাণ ত্যজিব, কন্যা বাদলা লিবে তব,
বাপ মায় কন্দিয়া হয়রান।
ইহা বলি লোটায়া কান্দে, কেশ বেশ নাহি বান্ধে,
কহ খেতু কহিবে উপায়॥
এতেক শুনিয়া খেতু, স্বামী রাখিবার হেতু,
চারি রাণী কান্দ অকারণ।
আপন মোহন বেশে, যাহ না স্বামীর পাশে,
রূপ দেখি ভুলিবে রাজন॥
হেকমত লাগিল মন, গেল রাণী চারি জন,
আনিলেন রত্ন পেটারী।
বেশ করে চারি রাণী, সম্মুখে দর্পণ ধরি,
খেতুক মান্য দিল চারি চারি॥
চিরুণী লইয়া করে, ধরিয়া মাথার পরে,
চিরে কেশ করিয়া যতন।
দুই দিকে কুঞ্জবন, মধ্যেতে দেবগণ,
চলিতে না পারেন যৌবন॥
থরে গাঁথি বিয়ানি যেন হইলেন ফণী,
মনঝুরী বান্ধিলেন খোপা।
তাহাতে কদম্বফুল, আগরী কস্তুরী গুল,
জাদ দিল মাণিকের ঝাপা॥
ললাট দ্বিতীয়ার চন্দ্র ভূষণ মদন ফন্দ,
সেন্দুরে উদিত দিনকর।

মৃগমদ চারি পাশে, রাহু যেন ভানু গ্রাসে,
তাথে যেন বসিল ভ্রমর॥
শ্রবণ গৃধিনী জিনি, তাথে পরে রত্ন মণি,
চাকি করি হীরায়ে জড়িত।
যে দেখে কন্যার পাশে, সেই পড়ে কর্ম্মফাসেঁ,
কন্যা দেখি ভুবন মোহিত॥
কুরঙ্গ জিনিয়া আঁখি, রক্তেতে প্রাবল দেখি,
যেন রাখি মণি রত্ন জ্বলে।
তাহাতে কাজল রেখা, মেঘের সঙ্গেতে ইন্দ্রের দেখা,
কটাক্ষে যোগীজন ভোলে॥
নাসিকা খগের শোভা, যুবাজনের মনোলোভা,
যেন তিলফুলের আকৃতি।
নাসা অতি মনোহর, তাহাতে সুন্দর বেশর,
তাহাতে পরিল গজমতি॥
অধর পদ্মের ফুল, দশন মুক্তার তুল,
কর্পূর তাম্বুল শোভা করে।
কোকিলা বনে ধ্বনি, বংশীর সুনাদ শুনি,
তাহা জিনিয়া বচন সরে॥
বদনচন্দ্র দর্শনে, যুবক মনের মান,
কাম বাসেতে হয় অজ্ঞান।
বচন রসিক হাসি, জিনিয়া শরদ শশী,
দেখে মুনির ভঙ্গ হয় ধ্যান॥
দেখিতে শারিন্দার লীলা, সুবর্ণ ঝারির গলা,
হংসরাজ গ্রীবার গঠন।
তাথে শতেশ্বরী[৩৫] হার, দূরে গেল অন্ধকার,
দেখে সবে হয় অচেতন॥

ইক্ষুর নাহিক মূল, বাহু সম সমতুল,
তাহে তাড় পরে বাহুবন্দ।
বাজু পরিল যত, তাহা বা কহিব কত,
তাথে দেখ পুন কমরবন্ধ॥
নগরী গহুরি সাজে, কিঙ্কণী কঙ্কণ বাজে,
অঙ্গুলেতে পরিল অঙ্গুরী।
অতিকুল করতাল, জিনিয়া সদল দল,
রূপে জিনে শঙ্করের গৌরী॥
কমল কলিকা ফুল, দেখে প্রাণ হয় আকুল,
তাহা জিনি দু কুচ মণ্ডল।
তাহা দেখে যত নরে, দেখে মুনির মন হরে,
তাহা দেখি ভুবন ব্যাকুল॥
সিংহ ডম্বু জিনি, অতি ক্ষীণ মাজাখানি,
খুন্দুরু কন পরিল হাতলী।
পরিল লঙ্কার সাড়ী, কান্তি কুম্ভের বেড়ী,
যেন দেখি চন্দ্রের পুতলী॥
নিতম্ব অতি মনোহর, পদ্ম যেন পদ্মকর,
পদনখ যেন চাম্পার কলি।
চুলটী উছটি যত, বাঁকপাতা মল কত,
পায়ে শোভে সুবর্ণ পাসলী॥
এহিরূপে চারি রাণী, নানা অলঙ্কার পরি,
দেখে রূপ ধরিয়া দর্পণ।
দেখিয়া আপন মুখ, চারি রাণী মনে সুখ,
রূপ দেখে হইল অচেতন॥
অদুনা বলে পদুনারে, চন্দনার ফন্দনার তরে,
এহিরূপে ভুলিবে রাজন।
সুকুর মামুদ কয়, এইরূপে ভুলি যায়,
যুগী হবে মায়ের বচন॥

বার মাসের কথা।
এইরূপে চারি নারী করিয়া শৃঙ্গার।
সুগন্ধি পরিল অঙ্গে স্বামী ভুলাইবার॥
অগরী চন্দন চুয়া কুম্‌কুম্ কস্তুরী।
সুবেশ অঙ্গে পরিল চারি নারী॥
আতর গোলাপ অঙ্গে করিয়া ভূষিত।
মধুকর মধু লোভে হইল উপস্থিত॥
ক্ষীণ মাজা রাণীর বাতাসে হেলে গাও।
কোকিল জিনিয়া তার হুরে কাড়ে রাও॥
ঝুমর ঝুমর বাজে পায়েতে নেপুর।
অগ্নি জিনিয়া জ্বলে কপালে সিন্দুর॥
দেবকন্যা নাগকন্যা চন্দ্রের রোহিণী[৩৬]
তাহাকে জিনিয়া রূপ হৈল চারি রাণী॥
অহল্যা জিনিয়া রূপ না পারি কহিতে।
রূপে গুণে যায় নারী স্বামী ভুলাইতে॥
আপন গমনে যখন যায় চারি নারী[৩৭]
স্বর্গপুরে নাচে যেন ইন্দ্রের অপ্সরী[৩৮]
নবীন যৌবন কন্যার রূপ গুণ সার।
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন নাহি অন্ধকার॥
রাজার মহলে আছে যত দাসীগণ।
চারি নারীর রূপ দেখি হইল অচেতন।
আট বার বৎসরের নারী তের নাহি পূরে।
যৌবনের ভরে নারী গর্টিতে না পারে॥
গজেন্দ্র গমনে সবে করিল গমন।
স্বামীর নিকটে গিয়ে দিল দরশন॥

বসিয়াছে গোপীচন্দ্র সুবর্ণ পালঙ্কে।
চারি নারী সম্মুখে দাঁড়ায় রঙ্গে ভঙ্গে॥
রাণীকে দেখিয়া রাজা না তুলিল মুখ।
অন্তরে ভাবিয়া রাণী মনে পাল্য দুখ॥
চারি রাণীর মধ্যে অদুনা প্রধান।
যোড়হাতে কহে কথা স্বামীবিদ্যমান॥
অদুনা বলেন শুন প্রভু গুণমণি।
স্ত্রীলোকের স্বামী বিনে বিফল জীবনী॥
নারী কুলে জন্ম যার নাহি প্রাণপতি।
চন্দ্র বিনে দেখে যেন অন্ধকার রাতি॥
জল বিনে মৎস্যের জীবনের নাহি আশ।
স্বামী বিনে নারীকুলের সকলি বিনাশ॥
জিউ বিনে শরীরের নাহিক উপায়।
স্বামী বিনে নারীর যে মিথ্যা রূপ হয়॥
এই চারি যুবহাঁ ছাড়ি যাইবে সন্ন্যাসে।
স্বামী বিনে নারীর দুঃখ শুন বারমাসে॥
শোন শোন ওরে স্বামী নারীর দুঃখের কথা।
স্বামী বিনে নারীগণের যতেক অবস্থা॥
বার মাস বর্ণন।
কার্ত্তিক মাসেতে স্বামী নির্ম্মল রয় রাতি।
দিবানিশি মিলে যারা ঘরে লয়ে পতি॥
যৌবন কালেতে নারী ভাবে রাত্র দিন।
স্বামী বিনে নারীগণের সদাই মলিন॥
অঘ্রাণ মাসেতে স্বামী হেমন্তের ধান।
যাহার স্বামী ঘরে তার যৌবনের গুমান॥
নানা উপহারে স্বামী খায় পঞ্চগ্রাস।
যার স্বামী ঘরে তার যৌবনের বিলাস॥

পৌষ মাসেতে স্বামী পৌষা আন্ধারি।
স্বামী ও যুবতীর যৌবন হয় মহা ভারি॥
যার স্বামী ঘরে তার মদন বিলাসি।
আন্ধার ঘরে দেখি যেন পূর্ণিমার শশী॥
মাঘ মাসেতে স্বামী অতিশয় শীত।
স্বামীর কারণে নারীর সদাই চিন্তিত॥
লেপ লিয়ালি মার যত আভরণ।
স্বামী বিনে নাহি নারীর শীতের উড়ন॥
ফাগুন মাসেতে স্বামী কোকিলের রব করে।
স্বামীর কারণে নারী ফাফর খায়ে মরে॥
পশু পক্ষ কাকাতুয়া আর ময়না শুক।
স্বামীকে পাইয়া করে নানান কৌতুক॥
চৈত্র মাসেতে স্বামী লিত নিবারিণী।
স্বামী আশে স্নান করে নারী সোহাগিনী॥
স্বামী বিনে নারীগণের কিসের গঙ্গাস্নান।
যুবতীর সম্বল স্বামী আর নাহি ধন॥
বৈশাখ মাসেতে স্বামী ডহ ডহ ঘরণী।
নারীর যৌবন জ্বলে বিরহ অগনি॥
ধন সম্পৎ নারীর মনে নাহি লয়।
শৃঙ্গার বিনে নারীর বাধিছে হৃদয়॥
জ্যৈষ্ঠ মাসেতে স্বামী কৃষাণের ধান।
ইন্দ্রার জল বিনে জমি থাকেন হুখান॥
স্ত্রী পুরুষে ঘর করে বিধির সৃজন।
স্বামী বিনে নারীর যৌবন সব অকারণ॥
আষাঢ় মাসে স্বামী নিসাড়ে পোহায় রাতি।
স্বামীর কোলে থাকে নারী বড় ভাগ্যবতী॥
ভাগাবতী নারী যার স্বামী আছে ঘরে।
কমলেত মধুপান করেত ভ্রমরে॥

শ্রাবণ মাসেতে স্বামী যমুনার তরঙ্গ।
গঙ্গা ও সাগর দুহে হয় এক সঙ্গ॥
সংসারে তরিব স্বামী বরসার জলে।
যুবতী পুড়িয়া মরে মদন অনলে॥
ভাদ্র মাসেতে স্বামী পাকিয়া পড়ে তাল।
স্বামী বিনে যুবতীর যৌবন মহাকাল॥
যুবতীর যৌবন প্রভু তরল সাঁতার।
স্বামী থাকিলে বিরহ সাগর করে পার॥
আশ্বিন মাসেতে স্বামী চণ্ডিকার পূজা।
যার স্বামী ঘরে সেহ নারী চতুর্ভুজা॥
স্বামীর কারণে সবে পূজে চণ্ডিকারে।
অভাগীর স্বামী তুমি যাবে দুরান্তরে॥
নব যৌবন প্রভু নিবেদেয় কালে।
যুগী হয়ে প্রাণের নাথ এই ছিল কপালে॥
স্বামীর নিকটে রাণী এই কথা বলি।
ফেলায় গায়ের বসন বুকের কাচুলি॥
যুগী হবে প্রাণের নাথ কি ধন পাবে নিধি।
এ সুখ সম্পদ তোমায় বঞ্চিত হইল বিধি॥
কান্দিয়া আদুনা কহে রাজার চরণে।
নারার যৌবন প্রভু স্বামার কারণে॥
পতি বিনে নারী যেন ধুতুরার ফুল।
তাঁতির বাড়ার কাপড় নয় যে ধুবির বাড়ী দিব।
ধুবির বাড়ীর কাপড় নয় যে ভাঙ্গিয়া পরিব[৩৯]
অন্ন ব্যঞ্জন নয় যে খাইব বসিয়া॥
ধানের বাড়ীর সেন্দুর নয় যে রাখিব কৌটায় পূরিয়া।
অষ্ট অলঙ্কার নয় যে পেটারি ভরিব॥

ধন সম্পদ নয় যে মোহর বান্ধিব।
স্বামী বিনf নারীর যৌবন কি দিয়া রাখিব॥
এ রূপ যৌবন নয় যে কার বাড়ীতে যাইব॥
কার বাড়ীতে যাব আমরা যাব কার বাড়ী।
স্বামী থাকিতে আমরা জীয়ন্তে হব আঁড়ী॥
এতেক শুনিয়া রাজা বদন তুলিল।
অদুনার গায়ে রাজা নিজ বস্ত্র দিল॥
লক্ষের কাবাই রাজা অদ্ভুনাকে দিয়া।
কহিতে লাগিল রাজা গুরুকে ভাবিয়া॥
রাজা বলে শুন রে অভাগী নারীজন।
নিশির স্বপন জান নারীর যৌবন॥
আষাঢ় শ্রাবণে গঙ্গা উথলে সাগর।
চৈত্র মাসেতে গঙ্গা দেয় বালুচর॥
ধন যৌবন যত দেখ জোয়ারের পানি।
আসিবার কালে দেখি যাইতে নাহি জানি॥
তেমনি জানিও রাণী[৪০] নারীর যৌবন।
রজনী প্রভাতে মিথ্যা নিশির স্বপন॥
স্বপনে যতেক দেখি নিধি পাই হাতে।
সব মিথ্যা হয় যেন রজনী প্রভাতে॥
নারীর যৌবন মহাক্‌কালের আকার।
উপরে সুচিক্কণ দেখি ভিতরে আঙ্গার[৪১]
নারীর যৌবন যেন মহাক্‌কালের ফল।
নজরের পাপ কারণ সংসার ব্যাকুল॥
মুখের সুন্দর দন্ত তোমার খসিয়া পড়িবে।
উভ আছে দুটী স্তন ভাটিয়া সরিবে॥
এই রূপ যৌবন ছারখার হয়ে যাবে।

একে শুনিয়া কহে অদুনা যুবতী॥
নিশ্চয় হইবে যুগী শুন প্রাণপতি॥
যদি যুগী হবে প্রভু শুন রাজেশ্বর।
দেবদারু বৃক্ষেয় তলে বন্ধি এক ঘর॥
সেই ঘরের মধ্যে এক আসন করিয়া।
যোগ ধ্যান কর প্রভু সেখানে বসিয়া॥
কিসের কারণে প্রভু যাবে দূর দেশে।
জ্ঞান সাধ্যে নাম জপ কেশ কর মাথে॥
রাত্রি দিবা বসি প্রভু তুমি কর ধ্যান।
ভিক্ষার সময় হইলে প্রভু আমরা দিব দান॥
আপনার রাজ্যের জ্ঞান সাধিবে রাজন।
আমরা থাকিব তোমার সেবার কারণ॥
রাজা বলে শুন তোমরা রাণী চারিজন।
দেশেতে থাকিলে মন কাঁপিবে ঘনে ঘন॥
এ সুখ সম্পদ রাণী সদাই পড়িবে মনে।
রাজ্যেতে থাকিয়া জ্ঞান সাধিব কেমনে॥
রাজ্যেতে থাকিলে আমি না হব অমর।
সেই ত কারণে আমি যাব দেশান্তর॥
এতেক শুনিয়া কহে অদুনা যুবতী।
ছাড়িবে আপন রাজা হবে দেশান্তরী॥
পুনরায় অদুনা বলে শুন প্রাণনাথ।
আমার বাপের বাড়িতে আছে যুগী পাঁচ সাত॥
আমার পিতা হয় প্রভু তোমার শ্বশুর।
সেই খানে চলুন সাধু হইয়া ঠাকুর॥
আপন রাজ্যে থাকিলে মন টলিবে ঘনে ঘন।
সেহি রাজ্যেতে জ্ঞান কর সাধন॥
যোগ সাধিয়া তুমি হবে মহাজ্ঞানী।
সেবা করিব তোমার আমরা চারি রাণী॥

কর্ণ পাতিয়া শুন যোগের কাহিনী।
হাতে সাদা গলে কাঁথা যোগী নাহিন হয়।
গুরু শিষ্য জ্ঞান সাধে তাকে যুগী কয়॥
তোমার বাপের যুগী যায় শুঁড়ীপাড়া।
মদ পানে নিদ্রা পাড়ে শুঁড়ার দামিড়া॥
মদ পানে মত্ত হয়ে নাহি জানে জ্ঞান।
নাহি জানে গুরুর পদ নাহি জানে ধ্যান॥
আমার হইবে গুরু হাড়িফা জলন্ধর।
আমি রাজা হব যুগী তাহার কিঙ্কর॥
রাণী বলে শুন রাজা রূপের বিদ্যাধর।
এহি ত বয়সে তুমি হবে দেশান্তর॥
রাজ্য পাট কর তুমি প্রথম বয়সে।
পাকিলে মাথার চুল যাইবে দূরদেশে॥
রাজ পুত্র হও তুমি রাজ্যের অধিকারী।
কি দুঃখে হইবে যুগী ছাড়ি নারী পুরী॥
রাজা হয়ে যুগী হবে শুনিতে অসম্ভব।
ভুসন মাখিবে মুখে কিবা পাবে লাভ॥
রাজা বলে শুন তোমরা নারী চারি জন।
উনিশ বৎসর কালে আমার মরণ॥
আঠার বৎসর কেবল আমার প্রমাই।
উনিশে মরণ আমার শুনিনু মুনির ঠাই॥
রাজা বলে রাণীগণ তত্ত্ব কথা শুন।
কিরূপে পাকিবে চুল যম নিদারুণ॥
এত শুনি চারি রাণী পুনর্ব্বার কয়।
স্বামী তুমি হবেন যুগী যম রাজার ভয়॥
যম এক রাজা প্রভু তুমি এক রাজা।
তাহার ডরে ছাড় তুমি মৃকুলের প্রজা॥
মুখে রাজ্য কর রাজা পাটের উপর।

চারি রাণী যাব আমরা যমের গোচর॥
যমের স্ত্রীর সঙ্গে আমরা সয়ালি পাতাব।
নানা উপহারে আমরা যমকে পূজা দিব॥
মস্তকের চুল কাটিয়া চামুর ঢুলাইব।
জিহ্বা কাটিয়া আমরা পলেতা পাকাইব॥
পৃষ্ঠের চর্ম্ম কাটি আমরা চান্দয়া টাঙ্গাইব।
দশ নখ কাটিয়া আমরা দশ বাতি দিব॥
পায়ের মালই কাটিয়া মোরা প্রদীপ জ্বালাব।
নানান পুষ্প জলে যমের সেবায় মানাব॥
সেবায় মানায়া আমরা স্বামী বর লিব।
রাজা বলে শুন তোমরা রাণী চারি জন।
কি মত প্রকারে যাবে যমের ভূবন॥
যমের স্ত্রীর দেখা কোথা গেলে পাবে।
কি মত প্রকারে তোমরা সয়ালি পাড়াবে॥
চুল কাটিলে লোকে নেড়িয়া বলিবে।
জিহ্বা কাটিলে তোমরা কালী যে হইবে৷
মালই কাটিলে তোমরা হাঁটিতে নারিবে।
মস্তক কাটিলে তোমরা পরাণ হারাবে।
চক্ষু কাটিলে রাণী অন্ধ যে হইবে।
নখ কাটিলে রাণী টুণ্ডা যে হইবে॥
কি মত প্রকারে যমেক সেবায় মানাইবি।
কোথায় থাকিয়া তোমরা স্বামী বর নিবি॥
এতেক শুনিয়া রাণী পুনরায় বলে।
একটা বালক দেও তোমার বদলে॥
লালিব পালিব বালক কোলেতে লইব।
বালক দেখিয়া প্রভু তোমায় পাসরিব॥
রাজা বলে স্ত্রীর মায়া এড়াইতে না পারি।
বালক দিয়া যাব আমরা কোন প্রাণে ধরি॥

স্ত্রীর দাড়ুকা হবে বালক মনে হইল স্থির।
বেগর বন্ধনে পায়ে চড়িবে জিঞ্জির॥
মায়া না কর অদুনা না বইস আমার আগে।
নিশ্চয় কহিলাম আমি যাইব বৈরাগে॥
দেশান্তরে যাবে প্রভু বলি তোমার আগে।
দয়া করি গুণের স্বামী লয়া চল সঙ্গে॥
তুমি রাজা হবে যোগী আমরা যোগিনী।
তোমার নিকটে আমরা বঞ্চিব রজনী॥
দুরু দেশে তরুতলে থাকিবে বসিয়া।
আমরা আনিয়া দিব ভিক্ষা করিয়া॥
ক্ষুধার সময় প্রভু রাঁধিয়া দিব ভাত।
অন্ধকার যামিনী হইলে থাকিব সাক্ষাত॥
রাজা বলে যাবে রাণী হাঁটিতে না পারিবে।
বনের বাঘেতে রাণী ধরিয়া খাইবে॥
রাণী বলে খাবে বাঘে তাতে কিবা মন্দ।
স্বামীর আগে মরণ হবে এ বড় আনন্দ॥
ভাগ্যবতী নারী যেই স্বামীর আগে মরে।
অভাগিনা নারী যার স্বামী নাহি ঘরে॥
স্বামী নারীর ঈশ্বর হয় শুনেছি পুরাণে।
সঙ্গে লয়ে চল প্রভু যাব তোমার সনে॥
রাজা বলে শুন তোমরা নারী চারি জন।
স্ত্রী সঙ্গে করিয়া জ্ঞান সাধিব কেমন॥
স্ত্রী সঙ্গে করিয়া যদি হইব সন্ন্যাসী।
সর্ব্বলোকে কহিবে আমাক ভণ্ড তপস্বী॥
নারী সঙ্গে করিয়া যে জন যুগী হতে চায়।
মাগুয়াযুগী বলি তারে সর্ব্বলোকে কয়॥
স্ত্রী সঙ্গে করিয়া যদি নিজ জ্ঞান পাই।
তবে কেন তেজিব আমি মৃকুলের রাজাই॥

এত শুনি পুনরায় বলে ধীরে ধীরে।
স্ত্রী ছাড়ি তপ করে কোন মুনিবরে॥
অদুনা বলেন তুমি শুন প্রাণেশ্বর।
কোন দেব স্ত্রী ছাড়ি হইল অমর॥
স্ত্রী থাকিতে যদি না হয় অমর।
শচী কেনে নাহি ছাড়ে দেব পুরন্দর॥
ইন্দ্ররাজের দেব হয় গৌতম নামে মুনি।
গৌতম কেন না ছাড়িল অহল্যা নামে রাণী
সর্ব্বদেবের গুরু হয় নামে বৃহস্পতি।
সেহ কেন না ছাড়িল আপনার যুবতী॥
অগস্ত্য নামে ছিল মুনি সকলের প্রধান।
সেহ কেন স্ত্রী ছাড়ি না করিল ধ্যান॥
সাতকাণ্ড রামায়ণ রচিল বাল্মীক।
সেহ কেন না ছাড়িল আপনার স্ত্রীক॥
স্ত্রী ছাড়িলে যদি অমর হয় কায়া।
কেন ভোলানাথকে না ছাড়িল মায়া॥
তোমার মা ময়নামন্ত্রি জানে সর্ব্বলোকে।
স্বামী লইয়া রাজ্য করিল মহাসুখে॥
স্ত্রী পুরুষে যদি নাহি করে শৃঙ্গার।
কেমনে হইল মুনির গর্ভের সঞ্চার॥
স্বামী সঙ্গে মুনি যদি না করিত ধর্ম্ম।
কেমনে হইল রাজা তোমার জন্ম॥
রাজা বলে শুন রাণী চারি জনা।
মনুষ্য হইয়া দিলেন দেবের তুলনা॥
রাজা বলে শুন রাণী অদুনা সুন্দর।
যেমত প্রকারে হইল দেব অমর॥
অমৃত হইল যত সমুদ্র মন্থনে।
অমর হইল দেব সেই সুধা পানে॥

যখন হইল দেব করিল বণ্টন।
আপন বাহনে আইল দেবগণ॥
ত্রিশ কোটী দেবতা আইল স্ত্রীপুরুষে।
আসিয়া বসিল সবে শিবের কৈলাসে॥
বসিল সকল সিদ্ধা স্ত্রী পুরুষেতে।
অমৃত খাইতে রাহু চণ্ডাল আছিল সভাতে॥
রাহু চণ্ডাল নামে সিংহিকার তনয়।
দেবমূর্ত্তি ধরে বৈসে দেবের সভায়॥
বসিল চণ্ডাল না চিনিল দেবগণে।
অম্লত না বাটে চন্দ্র সূর্য্য অপেক্ষণে॥
অমাবস্যা পায়ে চন্দ্র সূর্যদেব আইল।
তখনে অমৃত দেব বাটিতে লাগিল॥
অমর হইল দেব অমৃত ভক্ষণে।
না চিনিয়া অমৃত দিল রাহুর বদনে।
চন্দ্র সূর্য্য বলে দেব করিলে জঞ্জাল।
ও বেটা দেবতা নয় রাহুক চণ্ডাল॥
যেই মাত্র চন্দ্র সূর্য্য এতেক কহিল।
খড়্গে ছেদিয়া রাহুক মস্তক কাটিল॥
মুণ্ড কাটা গেল রাহুর হইল দুইখান।
তবু তো না মরে রাহু অমৃত গুমান॥
অমৃতপানে চন্দ্র সূর্য্য রাহুর দুস্মন।
সেই হইতে হইল চন্দ্র সূর্য্যের গ্রহণ॥
মুণ্ড কাটা গেল তবু না মরিল রাহু।
চন্দ্র সূর্য্যেক ধরে বেটা নাহি স্কন্ধ বাহু॥
নিত্য নিত্য রাহু চণ্ডাল চন্দ্র সূর্য্যেক হিংসে।
দেবগণে ভোগ দিল মনুষ্যের অংশে॥
মনুষ্যের অংশে রাহু থাকে বার মাস।
তিথি পাইলে করে চন্দ্র সূয্যেক গ্রাস॥

সেই তিথি পাইলে লক্ষণের যোগ।
সেই দিন চন্দ্র সূর্য্যেক রাহু করে ভোগ॥
সেই লক্ষণে যোগ পায়ে সেই তিথি।
রাহু যাইয়া চন্দ্র সূর্য্যেক ধরে শীঘ্রগতি॥
কাটা মুণ্ড যায় রাহু অমৃত গুমানে।
অমর হইল দেব সেই সুধাপানে॥
সুধাপ্রানে দেবগণ হইল অমর।
এই জন্য দেবগণ করে স্ত্রী লয়া ঘর॥
মা মুনির কথা তোমরা কহিলে চারি রাণী।
যে মতে জন্ম আমার শুন তার কাহিনী॥
তিলকচন্দ্র নামে রাজ্য সান্তনা নগরে।
আমার মা ময়নামন্ত্রি জন্মে তার ঘরে॥
যখন হইল মাতা পঞ্চ বৎসর।
জ্ঞান দিয়া গোর্খনাথ করিল অমর॥
সেবক হইয়া মাতা জিজ্ঞাসে গুরুর স্থানে।
বিবাহ হইবে আমার কোন রাজার সনে॥
শুনিয়া মুনির কথা কহে হরিহর।
মাণিকচন্দ্রের সঙ্গে বিভা হইবে তোমার॥
না হইবে কামভাব না হইবে রতি।
এহি কথা কহেছিল গুরু গোৰ্খ যতি॥
মুনি বলেন গুরু করিলেন সেবক।
হাটকুর বলিবে লোকে যদি না হয় বালক॥
এতেক শুনিয়া কহে গুরু হরিহর।
একটি বালক মুনি হইবে তোমার॥
স্বামীর চরণামৃত করিবে ভক্ষণ।
তাহাতে হইবে তোমার গর্ভের সৃজন॥
গোপীচন্দ্র নামে পুত্র হইবে তোমার।
আঠার বৎসর প্রমাই হইবে তাহার॥

আঠার বৎসর অন্তে উনিশে মরিবে।
সেবিলে হাড়ির চরণ অমর হইবে॥
এতেক কহিয়া নাথ করিয়া সেবক।
গুরুর প্রসাদে মুনির হইল বালক॥
পিতার চরণামৃত মাতায় খাইল।
যতি গোর্খের বরে আমার জনম হইল॥
আমার জনম হইল যতি গোর্খের বরে।
দশ মাস দশ দিন ছিনু জননীর উদরে॥
উদরে ধরিল মাতা নাহি দিল খির।
গুণবতীর দুগ্ধে আমার বাড়িল শরীর॥
সাত বৎসর প্রমাই হইল রাজ কার্য্য করি।
আঠার বৎসর পর আমি যাব মরি॥
ইহার মধ্যে যদি জ্ঞান নাহি পাই।
উনিশ বৎসরে যাব যমের ঠাই॥
মায়া দূর কর রাণী না বইস আমার পাশে।
নিশ্চয় হইব যুগী যাইব সন্ন্যাসে॥
এ সুখ সম্পদ রাণী কিছু না লয় মনে।
চিত্ত বান্ধা আছি আমি হাড়িফার চরণে॥
হাড়িফার চরণে আমার মন রৈল বান্ধা।
রাজা পাট নারী পুরী সব মিথ্যা ধান্ধা॥
শুনিয়া অদুনা বলে মনে পায়ে ব্যথা।
নিশ্চয় যাইবে রাজা গলে দিয়া কাঁথা॥
অখণ্ড সরল গুয়া বিড়া বান্ধা পান।
এ সুখ সম্পদ তোমাক বিধি হইল বাম॥
এতেক বলিয়া তখন কান্দে চারি রাণী।
অঝর নয়নে পড়ে দুই চক্ষের পানি।
কান্দি কান্দি চারি রাণী অঝুরেতে ঝুরে।
বসন ভিজিয়া গেল নয়নের নীরে॥

কান্দিতে কান্দিতে রাণী হইল ফাঁফর।
যুক্তি বিচারে রাণী মারিতে জলন্ধর॥
চারি রাণী বলে আমরা কান্দি অকারণ।
হাড়িফাক মারিলে রাজ্যে রহিবে রাজন॥
হাড়িফাক মারিতে যদি কোনরূপে পারি।
তবে সে থাকিবে রাজ্য রাজ্যের অধিকারী॥
এতেক ভাবিয়া সবে যুক্তি করিল।
কিরূপে মারিব হাড়িক ভাবিতে লাগিল॥
ভাবিতে ভাবিতে রাণী স্থির কৈল মন।
হাড়িক মারিব বিষ করায়া ভক্ষণ॥
এতেক কহিয়া রাণী মহলেতে গেল।
খেতু নফর বলি ডাকিতে লাগিল॥
ডাক শুনিয়া খেতু সাক্ষাতে আসিল।
খেতুকে দেখিয়া রাণী কহিতে লাগিল॥
রাণী বলে বাছা খেতু টাকা লয়া যাও।
একশত টাকার বিষ শীঘ্র আমি দাও॥
শত মুদ্রা লয়া খেতু করিল গমন।
বাজারের দক্ষিণেতে বিষের কারণ॥
মৃকুল সহরে ছিল বাদিয়া এক হাজার।
কালু সাপুড়ে ছিল সকলেব সরদার॥
সহস্র ঘর বাদিয়ার মধ্যে কালুসা ভাজন।
তাহার বাড়ীতে গেল বিষের কারণ॥
কালু বলে খেতু তোমাক দেখি যে চঞ্চল।
কি কার্য্যে আইলে তাহার কহিবে কুশল॥
খেতুয়া বলেন তবে শুনত শ্রবণে।
শত মুদ্রার বিষ কালু দেহ এহিক্ষণে॥
এতেক বলিয়া টাকা দিল কালুর হাতে।
টাকা লয়া গেল কালু বিষ আানিতে॥

বাদিয়া সকলে বিষ দিল থোড়া থোড়া।
শত টাকার বিষ কালু দিল দুই ঘড়া॥
দুই ঘড়া বিষ খেতু লইল দুই হাতে।
আনিয়া দিলেন বিষ রাণীর[৪২]সাক্ষাতে॥
চারি রাণী দেখিল যখন বিষ দুই ঘড়া।
খেতুকে বকশীস দিল কত জামা জোড়া॥
চারি রাণী বলে খেতু শুনহ বচন।
হাড়িফার তরে আজি করাব ভোজন॥
চারি রাণী বলে খেতু শীঘ্র তুমি যাবে।
হাড়িফাক যইয়া তুমি নিমন্ত্রণ করিবে॥
এতেক শুনিয়া খেতু করিল গমন।
হাড়িফার নিকটে গিয়া দিল দরশন॥
গলে বসন দিয়া খেতু প্রণাম করিল।
যোড়হাত করি খেতু সাক্ষাতে রহিল॥
হাড়িফা বলেন খেতু রাজার নফর।
কি কার্য্যে পাঠাইল রাণী কহিবে খবর॥
খেতু বলেন গোঁসাই কি কহিব আমি।
যে কার্য্যে পাঠাইল রাণী সব জান তুমি॥
হাড়িফা বলেন খেতু আমি দিলাম বর।
মৃকুলের রাজাই তোমাক করিবেন ঈশ্বর॥
চারি রাণীকে যায়া কহ করিতে রন্ধন।
শত টাকার বিষ আজি করিব ভক্ষণ॥
বার বৎসর হইল আজি নাহি উদরে ভাত।
ভোজন করিব আজ মনে বড় সাধ॥
এতেক শুনিয়া খেতু ভাবে মনে মন।
শত টাকার বিষ সিদ্ধা জানিল কেমন॥

এত বলি ভাবে খেতু আপনার চিতে।
কাহার শকতি আছে গুরু হাড়িফাক মারিতে॥
প্রণাম করিয়া খেতু করিল গমন।
রাণীকে কহিল যায়া করিতে রন্ধন॥
চারি রাণীর মধ্যে ছিল অদুনা প্রধান।
গঙ্গা জলে যাইয়া রাণী করিলেন স্নান॥
স্নান করিয়া যায় রন্ধন করিতে।
এক অন্ন পঞ্চ বাঞ্ছন রান্ধিল তুরিতে॥
ভৃঙ্গারে ভরিল বিষ পূরি কলসিতে।
সুবর্ণের থালি খানি বিষ দিয়া তাতে॥
এইরূপে চারি রাণী করিল রন্ধন।
সেইক্ষণে আইল হাড়ি করিতে ভোজন॥
বিষ দিয়া হাড়িফা সিদ্ধা পাও প্রক্ষালিল।
বিষের পিড়িতে সিদ্ধা ভোক্তনে বসিল॥
অন্ন পারশ করে রাণী মনের অতি সুখে।
শিবনাম লয়া সিদ্ধা তুলে দিল মুখে॥
অন্ন ব্যঞ্জন রাণী ভরে সোনার থাল।
একবারে দিল মুখে না ভরিল গাল॥
আর থাল ভরে রাণী অন্ন আানি দিল।
সে থাল তুলিয়া হাড়ি মুখেতে ঢালিল॥
অন্ন দিতে না পারিয়া রাণী হইল ফাফর।
সব খায়ে বলে হাড়ি না ভরে উদর॥
বিষ দিয়া রাণী যত করিল রন্ধন।
সকল খাইল হাড়ি না হইল ভোজন॥
ভোজন করিয়া হাড়ি বিষিতে আঁচাইল।
চালের খেড় দিয়া সিদ্ধা দন্ত খুঁটিল॥
ভোজন করিল সিদ্ধা মনের কৌতুকে।
ভৃঙ্গার ভরা ছিল বিষ তুলে দিল মুখে॥

বিষ পান করিয়া সিদ্ধা জীর্ণ করিল।
মিথ্যা মরণে হাড়ি ঢলিয়া পড়িল॥
অচেতন হইল সিদ্ধা মিথ্যা মরণে।
দেখিয়া আনন্দ বড় রাণী চরি জনে॥
রাণী বলে ভালাই হইল মরিল হাড়িফা।
আগুনের পোড়া দিব হাড়িফার গোফা॥
হাড়িফা মরিল এখন শব্দ যাবে দূর।
দেশেতে থাকিব এখন সীসের সেন্দুর॥
হাড়িফার মরণে চারি জন হইল আনন্দ।
সুকুর মামুদ কহে হাড়িফার মায়া ছন্দ॥



একখানি তালাই রাণী বাহির করিল।
সেহিত তালাই পরে হাড়িফাক রাখিল॥
তালাই উপরে রাণী হাড়িফাকে থুইয়া।
খেতুকে কহিল তখন বান্ধ দড়ি দিয়া॥
তালাইতে জড়িয়া খেতু বন্ধন করিল।
গঙ্গার তীরে দাহন করিতে চলিল॥
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি অগ্নি নাহি দিল।
ঢেকা দিয়া হাড়িফাকে গঙ্গায় ফেলিল॥
গঙ্গা দিয়া খেতু চলিয়া গেল ঘরে।
হাড়িফা ভাসিয়া যায় জলের উপরে॥
চারি রাণী গেল স্নান করিতে ঘাটেতে।
সেই ঘাটে গেল হাড়ি ভাসিতে ভাসিতে॥
দেখিয়া হাড়িফার মরণ চারি রাণী হাসে।
মায়া করে হাড়িফা সিদ্ধা জলের উপর ভাসে
স্নান করিয়া চারি রাণী চলে গেল ঘরে।
ভাসিতে লাগিল হাড়িফা জলের উপরে॥

সোয়া প্রহর রাত্রি যখন গগনেতে হইল।
সিদ্ধির ঘোটনা হাড়ির খাইতে মনে লৈল॥
হুহু শব্দ করি সিদ্ধা হুহুঙ্কার ছাড়িল।
শিবনামে ব্রহ্মজ্ঞানে বন্ধন ছুটিল॥
যে সমুদ্রে ছয় মাসে পাথর না যায় তল।
সেই সমুদ্রে হইল হাড়ির হাটুখানিক জল॥
গঙ্গাজল দিয়া হাড়ি স্নান করিল।
শূন্যরাজে সিদ্ধের ঝুলী শীঘ্র আনি দিল॥
সোয়া মন সিদ্ধি হাড়ি হস্তে করি নিল।
সোয়া মন ধুতুরার ফল তাতে মিশাইল॥
সোয়া মন কুচলা হাড়ি একত্র করিয়া।
মুখেতে তুলিয়া দিল শিবনাম লইয়া॥
সিদ্ধি খাইয়া নাথ গঙ্গাজল খাইল।
এক প্রহরের পথ গঙ্গা বালুচর হইল॥
শুকুর মামুদে কয় ফকীরের কিঙ্কর।
এহিত কারণে হাড়িফার নাম জলন্ধর॥



সিদ্ধি জল খাইয়া নাথ আনন্দ হইল।
ফুলবাড়ীতে যাইয়া নাথ গোফাতে বসিল॥
যোগ আসনে নাথ বসিল গোফাতে।
চারি রাণী ঘরে রইল হরসিত চিতে॥
ফুলবাড়ীতে গেল অদুনা ফুল তুলিতে।
দেখেন হাড়িফা আছেন গিয়া গোফাতে॥
হাড়িফাকে দেখে রাণী ভাবে মনে মনে।
বিষ পান করিয়া হাড়িফা বাঁচিল কেমনে॥
কল্য দেখিলাম হাড়িফা ভাসিতে জলেতে।
আজ বসিয়া আছে হাড়ি আপন গোফাতে॥
বিষ পান করি যার না হইল মরণ।

না জানি মনুষ্য রূপে আছে কোন জন॥
মনুষ্যের শক্তি কিবা বিষ খাইবার।
নিশ্চয় জানিলাম হাড়ি চারি যুগের সার॥
সিদ্ধি খায় সোয়া মন ধুতুরার ফল।
কি করিতে পারে তারে বিষের গরল॥
ব্রহ্মজ্ঞান নিজনাম জপে সেই জন।
গরল অমৃত তারে একুই সমান॥
কি কাজ করিনু আমরা নিজ মাথা খাইয়া।
হাড়িফার সঙ্গে রাজা যাউক সন্ন্যাসী হইয়া॥
রাজ্য ছাড়িয়া রাজা যাইবে যখন।
মৃকুলে হইবে ত্বরা রাজা তিন জন।
পদুনা বলেন বিভা না করিল মোরে।
পিতা মোরে দিল দান বিভার বাসরে॥
দান মোরে দিল পিতা না হইল বংশ।
কিরূপে পাইব আমি মৃকুলের অংশ॥
রাজ্য ছাড়িয়া যখন রাজা হইবে সন্ন্যাসী।
সকলে বলিবে পদুনা রাজার দাসী॥
এতেক ভাবিয়া রাণী আপনার চিতে।
রাজার নিকটে গেল কান্দিতে কান্দিতে॥
শুকুর মামুদে কয় রাণীর করুণা।
নাচাড়ীতে কহে কবি শুন সর্ব্বজনা॥


ত্রিপদী।


করিয়া যুগল পানি, কহে কথা পামুমিনী,
শোন রাজা মোর নিবেদন।
শোন মোর দুঃখের কথা, প্রসব কালে মৈল মাতা,
মাসীমায়ে করিল পালন॥
আমার যতেক দুঃখ, কহিতে বিদরে বুক,
কিছুই কারণ নাহি জানি।

দেখিয়া আমার মুখ, মাসীমায়ের মনে সুখ,
নাম থুইল পদুমিনী॥
লইয়া চুকার মালা, সর্ব্বক্ষণ করি খেলা,
ধূলা মাটী লয়া নানা রঙ্গে।
এ বড় দারুণ ঘাত, না দেখিনু বাপ মাত,
সর্ব্বক্ষণ থাকি মাসীর সঙ্গে॥
ভগ্নীর বিভার কালে, আইলাম বাপের কুলে,
বাদ্য নাচ দেখিতে কৌতুক।
মরি আমি মনস্তাপে, বিভা নাহি দিল বাপে,
পিতা মোরে দিলেন যৌতুক॥
শুনিয়া যৌতুকের কথা, মাসীমা পাইল ব্যথা,
মনস্তাপে ছাড়ে রাজার বাড়ী।
বিভ। না হইল মোর, না হইল স্বতন্তর,
অদুনার হইমু আমি চেড়ী॥
কি মোর জীবনের আশ, না হইল গৃহবাস,
তাথে নাথ হইবে সন্নাসী।
মোর না হইল বংশ, না পাইব রাজ্যের অংশ,
সকলে বলিবে রাজার দাসী॥
জন্মিনু রাজার ঘরে, কি মোর কপালের ফেরে,
দুঃখ ভিন্ন সুখ নাহি জানি।
এই ভব ভূমণ্ডল, স্বর্গ মর্ত্ত পাতাল
পৃথিবীতে নাহিক [হেন] শুনি॥
স্বর্গ মর্ত্ত নাগপুরী, কত শত আছে নারী,
কোন নারীর এতেক অবস্থা।
তনু পাথরের প্রায়, সেও ফাটি নাহি যায়,
অন্তরে অন্তরে লাগে ব্যথা॥
যেন চকমকী পাথর, তাতে অগ্নি নিরন্তর,
ডুবাইলে নাহি নিবে জলে।

অগ্নি যেন জ্বলে উঠে, কৈতে মোর বুক ফাটে,
এই বুঝি ছিলেন কপালে॥
কিবা করি গুণমণি, আমি অতি অভাগিনী,
না ঘুচিল মন অভিমান।
কিবা জানি তাপরাধ, কিবা বিধির ছিল বাদ,
জুড়াইতে নাহি কোন স্থান॥
পতি হবে পরবাস, কিবা তার জীবনের আশ,
জল বিনে মৎস্যের কি জীবন।
দিবসে জুড়ায় বাতি, যেন অমাবস্যার রাতি,
কি করিবে স্বর্গের তারাগণ॥
নারীর যৌবনকাল, কত দিনে ভালে ভাল,
কিরূপে হইবে নিবারণ।
নাহি আমার জ্যেষ্ঠ ভাই, জুড়াইতে নাহি ঠাঁই,
কোন জন করিবে পালন॥
কি মোর জীবনের ফল, আনি দেহ হলাহল,
করিব মাহুর বিষ পান।
মরিব তোমার আগে, তবে যাইও বৈরাগে,
আমার করিয়া পিণ্ডিদান॥
যদি ইহা নাহি কর, কি গতি হইবে মোর,
স্ত্রীবধ[৪৩] লাগিবে রাজেশ্বর।
তুমি যদি হবে যুগী, হইবে বধের[৪৪] ভাগী,
ধ্যান জ্ঞানে না হবে সুসার॥
পদুনার বিলাপ শুনি, রাজা মনে মনে গণি,
স্ত্রীবধে হইবে প্রলয়।
রাজা বলে পদুনা, নাহি কর করুণা,
রাজ্যে অংশ পাইবে নিশ্চয়॥

নাহি কর অনুরাগ, ছয় আনা তোমার ভাগ,
দশ আনা পাইবে তিন রাণী।
ন আনা সোয়া তের গণ্ডা, আর পোনে সাত গণ্ডা,
পত্র লেখি দিল দুই খানি॥
লিখি পাঠ পত্রেতে, দিল পদুনার হাতে,
তিন রাণী মনে হৈল দুখী।
আলিম উদ্দিন কয়, ভাবিলে বাড়িবে লয়
ছাত্রগণ আছে ইহার সাক্ষী॥

রাজা গোপীচন্দ্র যোগী হইয়া যায় তাহার বয়ান।

এহি মতে সকলেতে রহিল ঠাই ঠাই।
পুত্রেক যুগী করে এথা ময়নামন্ত্রি রাই॥
নাপিতে আনিয়া রাজার মাথা মুড়াইল।
মুখেতে খেউর করি ভুসঙ্গ চড়াইল॥
বগলে বগলি দিল সিংহনাদ [গলে]।
রক্ত চন্দনের ফোটা দিলেন কপালে॥
চকমকী পাথর দিল বাটুয়া আধারী।
মুঞ্জের (?) মেখলি দিল বাশের খপরী॥
গলাতে পরিতে দিল রুদ্রাক্ষের মালা।
কটিতে পরিতে মুনি দিল বাঘের ছালা॥
কর্ণ চিরি মুদ্রা দিল মালা দিল হাতে।
গুরু সেবিতে যায় রাজা মায়ের সাতে॥
আগে যায় ময়নামন্ত্রি পিছে যায় রাজা।
দেখিয়া হায় হায় করে মৃকুলের প্রজা॥
কান্দে কান্দে প্রজাগণ করে হায় হায়।
ষোল বৎসরের রাজা দেখ যুগী হয়ে যায়॥
প্রজা আদি পাত্র মিত্র লাগিল কান্দিতে।
সব মায়া ছাড়িয়া যায় গুরু সম্ভাষিতে॥

যেখানে হাড়িফা সিদ্ধা আছিল বসিয়া।
সেইখানে গেল মুনি পুত্র সঙ্গে লইয়া॥
গুরুকে দেখিয়া রাজা চরণ বন্দিল।
গলায় বসন দিয়া সাক্ষাতে রহিল॥
হাড়িফা দেখিল যদি যুগীরূপ ধারণ।
দেখিয়া বলেন সিদ্ধা না হবে মরণ॥
মুনি বলে শুন তুমি গুরু জলন্ধর।
গাজ হৈতে হৈল পুত্র তোমার কিঙ্কর॥
তোমার চরণ বিনে অন্য নাহি জানে।
এতেক বলিয়া মুনির সঁপিল চরণে॥
হাড়িকা বলেন মুনি থাক [নিজ] বাস।
গোপীচন্দ্রেক লয়া আসি করিয়া সন্ন্যাস॥
এতেক বলিয়া সিদ্ধা আসন তুলিল।
সিংহনাদ পুরিয়া সিদ্ধা যাত্রা করিল॥
মায়ের চরণে রাজা প্রণাম করিয়া।
গুরু সঙ্গে যায় রাজা বিদায় হইয়া॥
সন্ন্যাসী হইতে রাজা গুরুর সঙ্গে যায়।
একুশ বুড়ি কড়ি রাজার ঝুলিতে দেয়॥
সন্ন্যাসে চলিল সিদ্ধা বালক লয়া সাথে।
রাজপথ ছাড়িয়া সিদ্ধা যায় বনপথে॥
মায়ের বচনে গোপী ছাড়ে গৃহবাস।
সুকুর মামুদে কয় রাজার সন্ন্যাস॥


রাজা গোপীচন্দ্র সন্ন্যাসে যায় তাহার বয়ান।

ত্রিপদী।

বালক লইয়া সাথে, যায় হাড়ি বনপথে;
ভ্রমে হাড়ি সকল পর্ব্বতে।

শুন অবধান কর, যথা নাই মনুষ্য নর,
গমন করিলে সেই পথে॥
যথায় মনুষ্য নাই, যায় হাড়ি সেই ঠাই,
নাহি নগর বসত বাস।
এলাং ঢুকার খাটা, যথা নাই পথ ঘাটা,
যথা নাই সূর্য্যের প্রকাশ॥
কিবা রাত্রি কিবা দিন, দিবা রাত্রি নাহি চিন,
তথা হাড়ি করিল গমন।
বসে পূর্ব্বমুখ আসনে, জপে নিজমন্ত্র মনে,
ডাকে হাড়ি পবননন্দন॥
তুমি চন্দ্র তুমি ব্রহ্মা, তুমি সে পরম ধর্ম্ম,
তুমি গুরু বিনে নাহি পার।
তুমি জল তুমি স্থল, তুমি গুরু রসাতল,
তুমি গুরু সংসারের সার॥
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, এই তিন সহোদর,
তাতে হয় তোমার জনম।
জানি সিদ্ধা তোমার জন্ম, তপ জপ তোমার কর্ম্ম,
শুন গুরু মোর নিবেদন॥
শীঘ্র করি কহ গুরু, কি কাজ করিব গুরু,
বল গুরু সেই ত বচন॥
তোমার আদেশ পায়া, হাতেমাথে আইনু ধায়া,
আজ্ঞা হইলে করি সে পালন।
হাড়ি বলে হনুমান, শীঘ্র কর এই কাম,
এথা আজি বঞ্চিব রজনী॥
আদেশ পাইয়া খাড়া, আটিলেন পিন্দন ধড়া,
কেন মারে পবন নন্দন।
বড় গাছ হাতে ধরে, ছোট গাছ পদে মারে,
কেন মারি কৈল নিপাতন॥

পবনের পুত্র হনু, পাথরের প্রায় তনু,
বল যার অপূর্ব্ব অপার।
যত গাছ ছিল বড়া, পদাঘাতে কৈল গুঁড়া,
দন্তে বন করে পরিষ্কার॥
ঝোপ ঝাপ সব মারি, অতি স্থান নির্ম্মল করি,
বিদায় হইল হনুমান।
হৃদয়েতে জপি নাম, সাধিয়া হাড়ির কাম,
নিজ স্থানে করিল গমন॥
এথা হাড়ি জলন্ধর, মনেতে জপে শঙ্কর,
সেবে হাড়ি ইন্দ্রের অপ্সরী।
ডাহিনে চন্দন বাটা, বাম করে সুবর্ণ ঝাটা,
আইলেন এক বিদ্যাধরী॥
পরনে পাটের সাড়ি, আগে দিল ছড়া ঝাড়ি,
আমোদিত করিল চন্দনে।
হাতেতে তৈলের খুরি, দীপ জ্বলে সারি সারি,
আইল সব নাচনীর বেশে।
চাঁচর মাথার চুলে, কবরী জাতি ফুলে,
ভ্রমর গুঞ্জরে কেশপাশে।
সীমন্তে সিন্দুরের ফোটা, নয়নে কাজলের ঘটা,
কর্ণে ফুল দিছে কর্ণপুর।
অধর অরুণ আভা মুখে যেন চন্দ্র শোভা,
দন্ত গুলি যেন মোতিচূর॥
নাসিকা মোহন বাঁশী, যেন পূর্ণিমার শশী,
কর্পূর তাম্বল শোভা করে।
বুকে কুচু পদ্মকলি, মধুমর্ম্ম জানে অলি,
মধুলোভে শব্দ করি ফিরে॥
গলায় মালতী মালে, রত্ন প্রবাল জ্বলে,
যেন শশী তারাগণ মাঝে।

বাহু যেন মৃণালনলে, করতল শতদলে,
শব্দ করি কঙ্কণ বাজিছে॥
অপরূপ কর্ম্মস্থান, দ্বিতীয় অতি নির্ম্মাণ
তাহাতে কন্নি উপধর (?)।
হিয়া যেন পদ্মকলি, তাহাতে রত্ন কাচলী,
নিশ্বাসের আগে পঞ্চশর॥
কটিয়া পরে কিঙ্কিণী, ইন্দ্রের সব নাচনী,
যৌবন যেন অমৃতকদলী।
চাম্পা যেন পদ অঙ্গুলি, হীরার কনক পাসলী,
যোগান্ত ভোগান্ত সব গলে।
কেওয়া ও গোলাপ বাসে ফকীর যোগীর বেশে,
কবি সুকুর মামুদে ভুলে॥
যোগ পাঁচলীতে গায়, নাচনী নাচিয়া যায়,
বাজে খোল মৃদঙ্গ পাখয়াজ।
কিঙ্কিণী কঙ্কণ বাজে, যেন তারাগণ সাজে,
নর্ত্তকী করিল নানা সাজ॥
ঝনাঝন রণারণ, জয়ঘণ্টা ঠনাঠন,
নাচে যেন ইন্দ্রের অপ্সরী।
চরণে বাজে নেপুর, শুনিতে যেন মধুর,
ঝুমর ঝুমর শব্দ করি॥
যেন চিতে বাদ্য শুনি, চলিতে নাগরী জিনি,
চটকে যেন পূর্ণিমার শশী।
নাগরী নাগর সলে থমকে থমকে চলে,
যেন দেখি পূর্ণিমার শশী॥
সুকুর মামুদ ভণে, ইন্দ্রের অপ্সরীগণে,
গোপীচন্দ্রেক নারিল ভুলাতে।
হাড়িফার চরণেতে, শরণ করি গোপীনাথে,
ছিল গোপী বৈসে একভিতে॥

এইরূপে নাচনীতে, নর্ত্তকী গায় আমোদিতে,
বঞ্চিলেন এক নিশি এথা।
নাচনী বিদায় হইল, যার যে পুরীত গেল,
গোপীচন্দ্র না ভুলিল তথা॥
আর দিন তথা হইতে, রাজাকে লইয়া সাতে,
বনপথে করিল গমন।
দিবা নিশি ভেদ নাই, গেল হাড়ি সেই ঠাই,
পূর্ব্ব মুখে করিল আসন॥
ঊর্দ্ধ করি দুই হাত, স্মরে হাড়ি ভোলানাথ,
বীজমন্ত্র জপিল যখন।
ভালুক বানর বাঘ, সর্প অজাগর নাগ,
আসি হাড়ির বন্দিল চরণ॥
চারি দিকে চারি নারী, বাঘ ভালুক প্রহরী,
দেখি রাজা মনে গণি ভয়।
খাইয়া আপন মাথা, রাখিনু গুরুক পোত৷,
অপযশ হইল সঞ্চয়॥
যার আজ্ঞাকারী নাগ, বনের ভালুক বাঘ,
যার তরে সহস্র জানয়ার।
ঘোড়ার পৈঘরে পুঁতি, আমি হইলাম অধোগতি,
আমা সম পাপী নাই আর॥
করিনু আমি কুকাজ, সংসারে পাইব লাজ,
কলঙ্ক হইল ঘোষণা।
যদি মোরে বাঘে খায়, বাঁচিব শমনের দায়,
এড়াইব লোকের গঞ্জনা॥
এত বলে বাঘে খাও, সর্পের ধরি দুই পাও,
হাড়িফা জলন্ধরের ডরে।
নাগে নাহি চোট করে, দুই পাও জড়ে ধরে,
বাঘে খায় না মুনির কুমারে॥

বাঘ সর্পে করে কাম, রাজার পায়ে প্রণাম,
ভাবিয়া মনে আপনার।
এহিরূপে রাত্র দিনে, গুরু শিষ্য দুই জনে,
কাননে ভ্রমেণ নিরন্তর॥
শূন্যপথে হাড়ি যায়, কাঁটা ফুটে রাজার পায়,
জরজর হইল কলেবর॥

গোপীচন্দকে বেশ্যার ঘরে বন্ধক রাখে তাহার বয়ান।

পয়ার।

আব্দুল সুকুর নাম পিতায় রাখিল।
সুকুর মামুদ নাম কুলেতে ঘুষিল॥
শুন শুন সকল লোক বিধাতার নিরবন্ধ।
যেরূপে বেশ্যার ঘরে বান্ধা গোপীচন্দ্র॥
সাত দিন বন পথে ভ্রমে জলন্ধর।
কাঁটায় জরজর রাজার কলেবর॥
হাড়িফা জানিল রাজা হইল কাতর।
কেন ছাড়ি গেল নাথ কনক নগর॥
গোপীচন্দ্র বলে নাথ শুন নিবেদন।
হাটিতে না পারি নাথ করিব কেমন॥
সৃজছ শকা বৃক্ষ গুরু সরোবর কূলে।
এক দণ্ড বসি নাথ সেই তরু তলে॥
হাড়িফা বলেন তবে বৈস সেই ঠাই।
সিদ্ধি জল খাইতে আামি যদি কিছু পাই॥
গোপীচন্দ্র বলে গুরু খাও সিদ্ধের বড়ি।
নকুল করিতে নাথ আমি দিব কড়ি॥
এতেক শুনিয়া নাথ ধ্যানেতে বসিল।
একুশ বুড়ি কড়ি আছে আগমে জানিল॥

হাড়িফা বলেন আজ খিয়াতেক রাখিব।
একুশ বুড়ি কড়ি শূন্যে উড়াইব॥
এতেক বলিয়া নাথ হুহুঙ্কার ছাড়িল।
ঝুলির ভিতর কড়ি শূন্যরাজে নিল॥
ঝুলিতে আছিল কড়ি রাজার ছিল বল।
রাজা বলে গুরুদেব খাও সিদ্ধি জল॥
রাজার বচনে নাথ সিদ্ধি খাইল।
নকুল করিতে নাথ হাত বাড়াইল॥
ঝুলিতে হাত দিল রাজা ভাবিয়া হুতাশ।
কড়ি না পাইয়া রাজা ছাড়িল নিশ্বাস॥
নকুল করিতে নাথ পাতিয়া রৈল হাত।
দেখিয়া রাজার মূণ্ডে পড়িল বজ্রাঘাত॥
কড়ি না পাইয়া রাজা করে হায়রে হায়।
গুরুর নিকটে আমি ঠেকিলাম দায়।
কান্দে কান্দে গোপীচন্দ্র চক্ষে পড়ে পানি।
এবে সে জানিনু দড় হারানু পরাণী॥
আগে যদি জানিতাম ঝুলিতে কড়ি নাই।
তবে কেন করার করিমু গুরুর ঠাই॥
প্রথমে গুরুর স্থানে হইবে করার।
অধঃপাতে রাজার বুঝি নাহিক নিস্তার॥
এতেক বলিয়া রাজ্য ভাবে মনে মন।
গলে বসন দিয়া টিপ্‌ল গুরুর চরণ॥
চরণ ধরিয়া বলে হইয়া ব্যকুল।
আমাকে বেচিয়া কর সিদ্ধের নকুল॥
শুনিয়া হাড়িফা সিদ্ধা ভাবে মনে মনে।
রাজাকে বেচিব আজ নটিনীর স্থানে॥
যোগী হইয়া গোপী ছাড়ে চারি নারী[৪৫]

নটিনীর ঘরে বেটার বুঝিব চাতুরী॥
চারি রাণী[৪৬] ' হইতে আছে নটিনী সুন্দর
নটিনীর ঘরে বন্ধা দিব রাজেশ্বর॥
নটিনীকে দেখে যদি না ভুলে রাজন।
শৃঙ্গার না ভঞ্জে আর না করে হরণ॥
আপন রক্ষা করে যদি নটিনীর ঠাই।
তবে যোগী হবে রাজা মনে কিছু নাই॥
বার মাস বঞ্চে যদি নটিনীর ঘর।
সেবক করিয়া তবে করিব অমর॥
নটিনীর সঙ্গে যদি করেন শৃঙ্গার।
নিশ্চয় যাইবে তবে যমের দুয়ার॥
এক দিন যদি বেটা ভুঞ্জয়ে সুরতি।
অমর হইতে পারে কি তার শকতি॥
নিগূঢ় শৃঙ্গার করে হইয়া সন্ন্যাসী।
তবে তো জানিব বেটা ভণ্ড তপস্বী॥
আপনার মনে হাড়ি যুক্তি বিচারিল।
এক গাছি দড়ি রাজার হস্তে লাগাইল॥
রাজার হস্তে সিদ্ধা দড়ি লাগাইয়া।
বান্ধা দিতে যায় নাথ নগর হাঁটিয়া॥
নকর বান্ধা দিব নাথ বলে উচ্চৈঃস্বরে।
সুলোচনী[৪৭] ব্যো যায় স্নান করিবারে॥
রাজারে দেখিয়া বেশ্যা ভাবে মনে মন।
মৃকুলের রাজা যোগী হইল কেমন॥
ধন দিয়া পারে রাজা বান্ধিতে[৪৮] সাগর।
কোন সম্ভবেতে হৈল যোগীর কিঙ্কর॥

কিছু বান্ধা রাখে লয়া অল্প ধন।
তবে বান্ধা লব আমি মৃকুলের রাজন॥
রূপে বিদ্যাধর রাজা মোহনমূরতি।
লইয়া রাজাকে আমি ভুঞ্জিব সুরতি॥
যার রূপ দেখে ভুলে কামিনীর মন।
অবশ্য লইব বান্ধা দিয়া কিছু ধন॥
এতেক ভাবিয়া কহে নটিনী সুন্দর।
কত ধন লয়া বাছা রাখ রাজেশ্বর॥
সিদ্ধা বলে যদি কড়ি একুশ বুড়ি পাই।
তবে নকর বান্ধা দিয়া কিছু কিনে খাই॥
এতেক শুনিয়া বেশ্যা লাগিল হাসিতে।
দাসীকে কহিল বেশ্যা কড়ি আনি দিতে॥
কড়ি আনিয়া দাসী হাড়িফার হাতে দিল।
রাজাকে বান্ধা দিয়া তখন হাড়িফা চলিল॥
একুশ বুড়ি কড়ি লইয়া করিল গমন।
বাজারে চলিয়া গেল নকুলের কারণ॥
মুদির দোকানে কড়ি দিল একুশ বুড়ি।
সিদ্ধের নকুল খাইল কামেশ্বরের বড়ী॥
কামেশ্বরের নাড়ু, খাইয়া আনন্দ হইল।
ফুলবাড়ীতে যাইয়া নাথ গোফাতে বসিল॥
আনন্দ হইল নাথ গোফার ভিতরে।
রাজাকে লইয়া হেথা বেশ্যা গেল ঘরে॥
রাজাকে লইয়া বেশ্যা হরষিত মন।
নানান অলঙ্কার বেশ্যা পরে আভরণ॥
রত্ন পেটারির বেশ্যা ঘুচাল ঢাকুনি।
যে স্থানে যে গহনা লাগে পরেন আপনি।
হস্তে করি নিল বেশ্যা সুবর্ণ চিরুণী।
মস্তকে চিরিয়া কেশ গাথেন বিয়ানী॥

গন্ধ পুষ্প তৈল বেশ্যা পরিল মাথাতে।
সুবর্ণের জাদ বেশ্যা পরিল খোপাতে॥
কামসিন্দুরের ফোটা দিলেন কপালে।
উদিত দিনকর যেন বিহানের কালে॥
গৌর বরণ বেশ্যা দিব্য করতলে।
কপালে সিন্দুর যেন রত্ন হেন জ্বলে॥
ভুরুর মধ্যতে যেন তিলকের রেখা।
সেন্দুরিয়া মেঘের আড়ে বিজলীর দেখা॥
নয়ানে কাজল পরে মেঘের সাতে বাদ।
লক্ষের বেসর পরে আপন নাসিকাত॥
মন্ত্র পড়ি তৈল বেশ্যা পরিল বদনে।
যুবজনের মন হরে দেখিয়া যৌবনে॥
অধর শোভিত কৈল কর্পূর তাম্বুলে।
দশন ভ্রমর যেন বসিল কমলে॥
কপালের সেঁতিপাটী হীরায় জড়িত।
কিঞ্চিত হাসিতে যেন তারা ঝলকিত॥
গলাতে পরিল বেশ্যা গজমতিহার।
সোনার পুতলা যেন হরে অন্ধকার॥
বাহু নির্ম্মল যেন নখ চাম্পার কলী।
আঙ্গুলে আঙ্গুঠী পরে বাহু তাড়ফলী॥
কর্ণেতে কুণ্ডল যেন নিশানাথের শোভা।
হৃদয়ে কমলকুচ অতি মনোলোভা॥
অপূর্ব্ব কাচলী পরে হিয়ার উপর।
দেখিয়া যুবকজনের লাগে পঞ্চশর॥
কটিত পরিল বেশ্যা লক্ষ মূল শাড়ী।
কর্ণেতে পরিল বেশ্যা হীরা গয়না কড়ি॥
উরু যুগল বেশ্যার রামের কদলী।
বাঁক পাতা মল পরে সুবর্ণ পাশলী॥

গোলাপ চন্দনের ফোটায় করিয়া ভুষিত।
মধুলোভে অলি ধায় দেখিয়া কিঞ্চিত॥
বসন পরিয়া বেশ্যা কান্যা মায়াধর।
বেশ করি হইল যেন দ্বাদশ বৎসর॥
নব যৌবন বেশ্যা রূপের মুরালী।
অলঙ্কার পরিয়া হৈল চন্দ্রের পুতলী॥
এতেক বেশ্যার মায়া রূপের নাই সীমা।
সুবেশ করিয়া নারী হইল তিলোত্তমা॥
রূপে বিদ্যাধরী যেন বেশ্যা সুলোচনী।
মর্ত্তেতে নামিল যেন ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী॥
নানা বস্ত্র অলঙ্কার সুবেশ হইল।
পাটবস্ত্র আনিয়া বেশ্যা রাজার তরে দিল॥
শীতল মন্দির ঘরে হিঙ্গুলের রং।
তাহাতে বিছায়ে দিল সুবর্ণ পালং॥
পালং বিচায় বেশ্যা না করে আলিস।
আশে পাশে লেপ গির্দ্দা কৌতুকের বালিশ॥
সুবর্ণের বাটা ভরি তাম্বুল আনিয়া।
সুবাসিত গঙ্গাজল রাখে ভৃঙ্গার ভরিয়া॥
উপরে টাঙ্গায়ে দিল ফুলগিরি চান্দয়া।
পালঙ্গে বসিল বেশ্যা সুবেশ করিয়া॥
স্নানের বস্ত্রে আনি রাখিলেন কোরা।
দাসীকে কহে রাজাক শীঘ্র স্নান করা॥
বেশ্যা বলে শুন রাজা মৃকুলের ঈশ্বর।
স্নান করি আসি বৈস পালঙ্গ উপর॥
না করিব আর আমি আপনার ব্যবসা।
এখন করিতেছি আমি তোমার ভরসা॥
অন্য বঁধু বলি আমার মনে কিছু নাই।
এ ধন যৌবন আমি সঁপিব তোমার ঠাই॥

রাজা বলে শুন তুমি বেশ্যা সুলোচনী।
ময়নামন্ত্রি নামে আছে আমার জননী॥
ধন মাল আছে কত লেখা নাই তার।
রজত কাঞ্চন আছে সপ্ত ভাণ্ডার॥
সুবর্ণ পালঙ্ক কত আছে ঠাই ঠাই।
তোসক মশারি কত লেখা জোখা নাই॥
পাটবস্ত্র আছে কত আর খাসা জোড়া।
পিলখানাতে হাতী আছে পৈঘরেতে ঘোড়া।
দালান কোঠা আছে কত সারি সারি।
তোমার অধিক আছে আমার চারি নারী॥
আর যত আছে তাহা কহিতে না পারি।
সকল ছাড়িয়া হইলাম কড়ার ভিকারী॥
তোমার সঙ্গে যদি আমি ভুঞ্জিব ছুরতি।
তবে কেন ছাড়িব আমি এ চার যুবতী॥
পুনর্ব্বার যদি আমি করিব শৃঙ্গার।
গুরুর চরণে আমার না হবে নিস্তার॥
তোমার সঙ্গে যদি আমি বঞ্চি এক নিশি।
গুরু কহিবে আমাক ভণ্ড তপস্বী॥
তত্ত্বজ্ঞানী গুরু আমার নাম জলন্ধর।
তবে জ্ঞান নাহি দিবে না হব অমর॥
আঠার বৎসর মোট আমার প্রমাই।
সেই জন্য কৈল মুনি ময়নামন্তি রাই॥
ষোল বঙ্গের আমি ছাড়িয়া রাজাই।
সকল সার করিলাম হাড়িফা গোসাই॥
এ সুখ সম্পদ আমার কিছু না লয় মনে।
মন বান্ধা আছে আমার হাড়িফার চরণে॥
হাড়িফার চরণ বিনে আর নাহি জানি।
তোমাকে দেখি যেন আমার জননী।

যেই মাত্র গোপীচন্দ্র জননী কহিল।
বেশ্যার মস্তকে যেন আকাশ পড়িল॥
বেশ্যা সুলোচনী বলে কাঞ্চনী নাম দাসী।
ইহাকে আনিয়া দেও বোকা এক কলসী॥
নেউড়ী বান্দী তোরা আছ যত জন।
গৃহের মধ্যে সকলেতে করিবেক স্নান॥
স্নান করিতে না যাও সরোবরে।
যত জল লাগে আনি দিবেক নকরে॥
শুকুর মামুদে কয় কপালের নিরবন্ধ।
বেশ্যার ঘরে বান্ধা রৈল গোপীচন্দ্র॥


বেশ্যার ঘরেতে দাসী এতেক শুনিল।
বোকা কলসী আনিয়া রাজার তরে দিল॥
যত বন্ধু লয়া বেশ্যা করেন শৃঙ্গার।
পানি যোগায় গোপীচন্দ্র কান্ধে লয়া ভার॥
শত ভার পানি রাজা তুলে প্রতিদিন।
সোনার বরণ তনু হইল মলিন॥
এহিরূপে পানি রাজা বহে বার মাস।
অন্ন জল নাহি খায় সদায় উপবাস॥
হাড়িফার নাম রাজা জপে দিবা রাতি।
ক্ষুধা তৃষ্ণা রাজার কাছে না করে বসতি॥
দিন প্রতি বহে রাজা শত ভার পানি।
গুরু স্মরিয়া রাজা পোহায় রজনী॥
এহিরূপে জল রাজা বহে নিত্য নিত্য।
অনাহারে বঞ্চে রাজা বেশ্যার পুরীত॥
আর দিন গেল রাজা জল আনিতে।
দৈবযোগে দেখা হইল ব্রহ্মজ্ঞানীর সাতে॥

ব্রহ্মজ্ঞানী কহিতেছে যোগের কাহিনী।
জল আনা বিস্মরিল ব্রহ্মজ্ঞান শুনি॥
জ্ঞান কৈয়া ব্রহ্মজ্ঞানী যায় রাজপথে।
ব্রহ্মজ্ঞান শুনিয়া রাজা বৈরাগী হৈল চিতে॥
যোগ ব্রহ্ম শুনে রাজা সরোবরকূলে[৪৯]
দৈবনির্ব্বন্ধ রাজার দুঃখ কপালে॥
এথা সুলোচনী বেশ্যা ভুঞ্জিয়া শৃঙ্গার।
জল বিনে না পারিল স্নান করিবার॥
গোস্বায় জ্বলিল বেশ্যা যেন হুভাশন।
কাঞ্চনী দাসীর তরে ডাকে ঘনেঘন॥
বেশ্যার নিকটে যখন কাঞ্চনী আইল।
কাঞ্চনীর তরে বেশ্যা কহিতে লাগিল॥
বেশ্যা বলেন দাসী বাটার পান খাও।
জল আনা নকরকে বান্ধিয়া ফেলাও॥
মধ্য উঠানেতে বেটাক চিত করিয়া।
বাইশ মণ পাথর দিবে বুকেতে তুলিয়া॥
এতেক কহিতে রাজা জল লয়ে আইল।
ভার নামাইতে রাজাক চৌমুড়া বান্ধিল॥
কাঞ্চনার সাতে আর দাস শত জন।
রাজাকে করিল সবে বিপত্য বন্ধন॥
মধ্য উঠানেতে রাজাক চিত করিয়া।
বাইশ মণ পাথর বুকেতে তুলিয়া॥
দ্বিতীয় প্রহর বেলা বসন্তের খরা।
তাহাতে রাজার বুকে পাথরের ভরা॥
যাহার শরীরে সয় না এক পুষ্পের ভর।
বাইশ মণ পাথর তার বুকের উপর॥

বিপদে পড়িয়া রাজা করে হায় হায়।
প্রাণ বিদরে আমার পাথরের ঘায়॥
হায় হায় বলিয়া রাজা পড়িল সঙ্কটে।
এহিত আছিল কানাই আমার কপালে॥
সুকুর মামুদ কয় ভাব অকারণ।
সিদ্ধি হইল কাজ বেশ্যার ভুবন॥

ত্রিপদী।

জন্মিনু গোরক্ষের বরে, ময়নামন্ত্রির উদরে,
আঠার বৎসর আমার প্রমাই।
আইনু মুনিক ভাড়াইয়া, পিতা দিল চারি বিয়া,
আর দিল মৃকুলের রাজাই॥
তবে ময়নামন্ত্রি মাতা, বুঝাইয়া কত কথা,
ছাড়াইল এ চারি সুন্দরী।
রাজ্য পাট ছাড়াইয়া, গলে কাঁথা পরাইয়া,
কৈল মোরে কড়ার ভিখারী॥
অমর হইতে কায়, সঁপিল গুরুর পায়,
গুরু জ্ঞান দিলেন আমারে।
হইল আমার কুবুদ্ধি, না পানু জ্ঞানের সুদ্ধি,
গুরুকে পুতিলাম পৈঘরে॥
স্ত্রীর উপরে মতি, গুরুকে পৈঘরে পুতি,
রাখিলাম পঞ্চ বৎসর।
আইল শুনে কানাই, আর ময়নামন্ত্রি রাই,
উদ্ধারিল গুরু জলন্ধর॥
গুরু আমার জ্ঞানী বড়, মনেতে জানিলাম দড়,
মৃত্যু নাহি এ ভব সংসারে।
পঞ্চ বৎসর পোতা ছিল, অন্ন জল না খাইল,
উঠিল গুরু অপূর্ব্ব শরীরে॥

সাবধান আছিল মাতা, নাহি দিল কোন ব্যথা,
বিধাতা দিলেন তাকে ঘর।
যেন মার গর্ভবাসে, বালক থাকে দশ মাসে,
তেমন আছিল জলন্ধর॥
বুঝিয়া জ্ঞানের দায়, ধরিল গুরুর পায়,
গুরু বান্ধা দিল বেশ্যার ঘরে।
বেশ্যার ঘরে বার মাস, রাত্রি দিবা উপবাস,
বাঁচি আমি গুরু নাম জপি।
না জানি কি অপরাধী, কিবা বিধির ছিল বাদী,
বুকে রৈল বাইশ মণ পাথর।
প্রবল পাথর ভার, প্রাণ কান্দে থর থর,
এবে আমি যাব যমঘর॥
যার যে নির্ব্বন্ধ থাকে, ফলে তার কোন পাকে,
সুখ দুখ ললাটের লিখন।
প্রভু রাম রঘুনাথে, পিতার সভ্য পালিতে,
সীতা হরিল দশানন।
লঙ্কা ছিল অধিকার, চোদ্দ যুগ প্রমাই যার,
তবে তার নির্ব্বন্ধ ঘটিল।
রত্ন মটুক পর, বনে চরে বানর,
তবে তারে বিসর্জ্জন দিল॥
এহিত সংসার সাজ, বিধির বাঞ্ছিত কাজ,
নিবন্ধ না লড়ে কোন কালে।
সংসারেতে ধন বড়, যাহার কপাল দড়,
এই লেখা আমার কপালে॥
সুকুর মামুদ ভণে, ভাব রাজা অকারণে,
বড় জ্ঞানী মহন্ত গোঁসাই।
সম্পদ বিপদ কত, দৈবের নিরবন্ধ মত,
আপনার হাতে কিছুই নাই॥

নটিনীর বাসরে রাজা গোপীচন্দ্র কান্দে

তাহার বয়ান।

পদ্মাব ।

কান্দে রাজা গোপীচন্দ্র লোহিত লোচন।
মায়ের বচন রাজার পড়িল স্মরণ॥
রাজা বলে শুনেছিনু মা মুনির ঠাই।
আঠার বৎসর মোটে আমার প্রমাই॥
দ্বাদশ বৎসরে পিতা দিল চারি বিয়া।
পঞ্চ বৎসর রাজ্য করি হাড়িফাক পুতিয়া॥
পাঁচ আর বারয়ে হৈল সতের বৎসর।
এক বৎসর রৈনু বান্ধা নটিনীর বাসর।
একুনে হইল বুঝি আঠার বৎসর।
এখন যাইব আমি যমের নগর॥
নির্ব্বন্ধ লিখন না লড়ে কোন কালে।
যত কিছু হইল হবে কপালের ফলে॥
জনম মরণ বিভা বিধাতার হাতে।
বৃথায় রাখিলাম বাদ ঘোষণা ভারতে॥
এহিত সংসারে আছে কত শত লোক।
উদ্ধার করিল গুরু করিয়া সেবক॥
সংসারে জন্মিয়া আমি করিনু কিবা কাম।
সেবক হইয়া গুরুর ডুবাইনু নাম॥
সংসারের মধ্যে ঘোষিবে সর্ব্বলোক।
নটিনীর ঘরে মৈল হাড়িফার সেবক॥
ত্রিভুবনের মধ্যে হাড়ির বড় নাম।
নটিনীর ঘরে মৈল হাড়িকার গোলাম॥
এহি বড় ঘোষণা রহিল পৃথিবীতে।
জন্মিলে মরণ আছে শুনেছি ভারতে॥

শাস্ত্রেতে শুনেছি আর লোক মুখে।
গুরুর ঘোষণা রৈল সেবকের পাকে॥
আহা গুরু পরমব্রহ্ম সংসারের সার।
নটিনীর ঘর হৈতে করহ উদ্ধার॥
যেই মাত্র গোপীচন্দ্র এতেক কহিল।
গোফাতে বসিয়া নাথ হাড়িফা জানিল॥
তত্ত্বজ্ঞানী হাড়িফা সিদ্ধা জানিল অন্তরে।
আমার সেবক মরে নটিনীর ঘরে॥
হুহু শব্দ করি সিদ্ধা চাড়ে হুহুঙ্কার।
সাত তোলা ভারী হহল বাইশ মণ পাথর॥
সোনার কবজ যেন দিলেন গলায়।
এইরূপে রৈল পাথর রাজার হৃদয়॥
মন্দা মন্দা বাও তখন বহেত পবনে।
সন্তোষ হইল তখন মুনির নন্দনে॥
আছিল রবির ছটা হইল আবছায়া।
সুখে নিদ্রা জায় রাজা মন্দা বাও পায়া॥
হাড়িকা বলেন বেটা কি কাম করিল।
সিদ্ধার সেবক হইয়া বেটা নিদ্রা কেন গেল
অন্ন জল নিাদ্রা তেজিল বার মাস।
বেশ্যার ভবনে রাজা সাধিল সন্ন্যাস॥
নিজনাম ব্রহ্মজ্ঞান শুনাইব কানে।
অমর হইবে রাজা সেই ব্রহ্মজ্ঞানে॥
এতেক ভাবিয়া নাথ হুহুঙ্কার ছাড়িল।
সপ্ত দিনের পথ সিদ্ধা তিন দণ্ডে গেল।
রাজার নিকটে যাইয়া সিংহনাদ পূরিল।
সিংনাদ শুনিয়া রাজার ধ্যান ভঙ্গ হৈল॥
চেতন পাইয়া রাজা দেখে গুরুধাম।
বন্ধনে থাকিয়া গুরুক করিল প্রণাম॥

নাথ বলে জিউ বাছা আমি দিলাম বর।
আর মরণ না হইবে চারি যুগ ভিতর॥
নিজনাম দিব বাছা নাহিক অপেক্ষা।
সেবক হইয়া এখন জ্ঞান কর শিক্ষা॥
এতেক বলিতে বেশ্যা আইল বিদ্যমান।
সুলোচনী এল যত বেশ্যার প্রধান॥
সুলোচনী বেশ্যা বলে শুন জলন্ধর।
বৃথা বান্ধা লয়াছিলাম তোমার নফর॥
কর্ম্ম নাহি করে চিড়া খায় আড়ি আড়ি।
তে কারণে নফরের পায়ে দিলাম বেড়ী॥
নফরের কার্য্য নাই দেহ মোর কড়ি।
তবে তো তোমার নফর আমি দিব ছাড়ি॥
হাড়িফা বলেন বেশ্যা সব আমি জানি।
কর্ম্ম নাহি করে নফর নিত্য বহে পানি॥
এতেক বলিয়া সিদ্ধা শূন্যরাজকে ডাকিল।
অন্তরীক্ষে ছিল শূন্য সাক্ষাতে আইল॥
হাড়ি বলে শূনারাজ শুন দিয়া মন।
বেশ্যার তরে কড়ি দেহ না এখন॥
কড়ি আনিয়া শূন্য দিল গোপীর তরে।
গোপীনাথ লয়ে কড়ি ঝুলির মধ্যে ভরে॥
রাজার ঝুলির মধ্যে কড়ি দিল ছাড়ি।
ঝুলি হইতে কড়ি পড়ে একুশ বুড়ি॥
হুহুশব্দ করি সিদ্ধা ছাড়ে হুহুঙ্কার।
দেখিতে দেখিতে কড়ি হইল সোনার॥
সোনার কড়ি দেখি বেশ্যার মন কলপিল[৫০]
কোছাত করিয়া কড়ি তুরিত তুলিল॥

কড়ি পাইয়া বেশ্যার আনন্দিত মন।
শীঘ্র কাটিয়া দিল হাতের বন্ধন॥
সোনার কড়িতে বেশ্যার বাড়িল উল্লাস।
শুকুর মামুদে কহে রাজার খালাস॥



খালাস পাইয়া রাজা করে কোন কাম।
গলে বসন দিয়া কৈল গুরুকে প্রণাম॥
আশীর্ব্বাদ দিয়া সিদ্ধা সঙ্গে করি নিল।
অনাদ্য সাগরকূলে[৫১] যায়া উত্তরিল॥
অগাধ সাগরজলে করাইল স্নান।
অন্ধ ছিলেন রাজা পাইল চক্ষুদান॥
স্বর্গ মর্ত্ত পাতালেতে যে ছিল যেখানে।
দেখিতে পাইল রাজা আপন নয়নে॥
পূর্ব্ব আসনে পুন বসায়ে ছামনে।
নিরাঞ্জনের নিজনাম শুনাইল কানে॥
যোগান্ত বেদান্ত যত কৈল গুরুধাম।
ভেদ দিল বত্রিশ অক্ষর আর ষোল নাম॥
নিজনাম ব্রহ্মজ্ঞান সর্ব্বনামের সার।
যে নামে হইল চারি যুগের বিচার॥
এক নাম অনন্ত নাম নাম অন্ত হয়।
সেই অজপানাম গুরুদেব কয়॥
এক অক্ষরে তিন নাম নাহিক দোসর।
শুনাইল সেই নাম গুরু জলন্ধর॥
মেরুদণ্ড স্থির করিয়া করিল আসন।
যোগ আসন সাধে হইল মহাজন॥

যোগভেদ দিল গুরু শরীরে বিচার।
স্তুতিমনা ভেদ দিয়া কয়া কর্ণসার॥
শব্দচক্রেতে দিল শব্দ উয়ার।
চৌদ্দভুবন ভেদ দিল খিড়কীর দ্বার॥
চারি কুণ্ডভেদ দিল শরীরের বন্ধ।
তিলান্ত আড়াভেদ ভাঙ্গে মনের ধন্ধ॥
আদ্য অনাদ্য বন্ধ দশনে দিল পাতি।
গগনে মন্দিরে যুবকের গাবুরাথী॥
ভূমর শোভাভেদ দিল স্ত্রীবশর হাট।
পূর্ব্ব পশ্চিমে ভেদ দিয়া লাগাইল কপাট॥
দক্ষিণভেদ দিল হেমন্ত বসন্ত।
বার কলাভেদ দিয়া ভাঙ্গে মনের ধন্ধ॥
ষোলকলা ভেদ দিল কায়া সরোবর।
তিন্তিয়া আড়াভেদ দিয়া মন কৈল একস্তর॥
আদ্য অনাদ্য ভেদ দিয়া তৃতীয় কৈল খানা।
একে একে ভেদ দিল সঙ্গে পঞ্চ জনা॥
পিতার ঔরস বিন্দু জননীর সঙ্গ।
ভেদ দিল সব তত্ত্ব পৃথিবীর বন্ধ॥
উজান বাহিয়া রাজা কামারিয়া শোনে।
ভঙ্গ দিল জরা মৃত্যু দুষ্ট কালযমে॥
নিজনাম সাধিল রাজা গুরুর সাক্ষাতে।
আরোগ্য হইল রাজা মরণের হাতে॥
নিকট আছিল যত মরণের ভয়।
মৃত্যুপথ দূরে গেল হইল অক্ষয়॥
স্বর্গ মর্ত্ত পাতাল ভেদ দিল করতার।
সুকুর মামুদে গায় যুগের বিচার॥
এইরূপে যোগ সাধি হৈল তত্ত্বসার।
শরীরের ভেদ গুরুক লাগিল পুছিবার।

ত্রিপদী।

বুঝ গুরু তত্ত্বসার, সদা ধ্যান করিবার,
নিজ আত্মা চিনিতে না পারি।
বিরলে বুঝাও শুনি, জন্মে কোন ঘরে মুনি,
কোন নামে সঞ্চরিল শিব।
কোন মুখে দশ মাস, কোন মুখে উপবাস,
কেমনে উৎপত্তি হইল জীব॥
নিদ্রার উৎপত্তি কোথা, কোন খানে মন চিন্তা,
কেমনে উৎপত্তি হইল বাই।
অঙ্গুলির কুল কেবা, কহ গুরু ব্রহ্মদেবা,
শূন্যের স্থিতি কোন ঠাই॥
কোন মুখে পাহি ডাল, পরিচয় দেহ ভাল,
আহার উৎপত্তি কোন স্থানে।
কোথা বিন্দু কোথা মন, কোথা বৈসে পবন,
কোথা থাকে আইন গাইন॥
শিব শক্তি বলি কাকে কোন খানে ক্ষমা থাকে
কাকে বলি ত্রিবেণীর[৫২] ঘাট।
নাচার ফকীরে বলে, গুরুর চরণ তলে,
বসুমতী আদ্য জননী।
উৎপত্তিতে প্রলয় যখন যেমন হয়,
হেন তত্ত্ব গুরুর কথা শুনি।
দুই চক্ষু সরোবর, অভয় পরে নিরন্তর,
তার কাছে স্ত্রীবশর হাট।
মাঝ দ্বারে বন্দি কুটা অকুলের কোন ছটা,
কর্ণ ভেদিয়া কৈল ঘাট॥

রসে নিদ্রা আইসে, পাতাল ভেদিয়া বৈসে,
সাগর করিয়া ঘোর বন্ধ।
বুকপর অগ্নি জ্বলে হেন তত্ত্ব গুরু বলে,
মন পবন তাহার ভেদ।
সিসেতে (?) পর্ব্বত ঢাকে, রবি শশী বলি তাকে,
পাতাল ভেদিয়া তার ছেদ॥
* * হইল মেলা, তথায় জীবের খেলা,
তাথে উপজে বাইর পাক।
জন্মিয়াছে থাকে থাকে হেন কথা গুরুর মুখে,
জন্মাইল করে থাক থাক॥
গরীব ফকীরে কয়, ভজিয়া গুরুর পায়,
বাই মধ্যে করিয়া প্রবেশ।
গুরুকে করিয়া সার, বিচারিয়া ভাণ্ডার,
একে একে করিয়া উদ্দেশ[৫৩]

শিষ্যের ছওয়াল।


ত্রিপদী।


গুরু কোথা থাকে নিরঞ্জন, কোন স্থানেতে আসন,
কোন দেব বৈসে কোন আকারে।
নাহি চিনি আপনে, কোথা বৈসে কোন জনে,
ভিন্ন ভিন্ন বোঝাবে আমারে।
কোথা বৈসেন শ্রীহরি, কোথা আছে ব্রহ্মপুরী,
ব্রহ্মলোক সব বৈসে কাত।
কোথা বসে মুনিগণ, কোথা বসে নারায়ণ,
কোন স্থানে বৈসে জগন্নাথ॥
কোন স্থানে দেবের স্থিতি, কোথা বৈসে গণপতি,
কোথাতে বসেন পুরন্দর।

কোথা বৈসে বসুমতী, কোথা বৈসে সরস্বতী,
কোথা আছে মনুরায়ের ঘর॥
কোথাতে চন্দন বন, কোথা বৈসে পবন,
দিবানিশি কোথা রয় তারা।
চন্দ্র সূর্য্য দুইজন, কোন মুখেতে আসন,
কোথা বসে দুই তারা॥
সপ্ত দিন পনর তিথি, কোথা কার বসতি,
কহ গুরু [সে] যোগের ধার।
সুকুর মামুদে কয়, কহ গুরু মহাশয়,
বুঝাইয়া কহ জলন্ধর॥

গুরুর উত্তর।


ত্রিপদী।


দেহের মধ্যে নিরাঞ্জন, ভুলে ফিরে অকারণ,
সকল দেবতা বসে শরীর ভিতরে।
উত্তম আত্মা মহাদে, চিনিতে না পারে কে,
ভিন্ন দেব পূজেত বর্ব্বরে॥
দ্বিতীয়তে বসে হরি, উপরেতে ব্রহ্মপুরী,
ব্রহ্মলোক সব বৈসে তাথ।
উদয়পুরে মুনিগণ, তাথে বৈসে নারায়ণ,
শূন্যস্থানে বৈসে জগন্নাথ॥
মানসিক দেবের স্থিতি, কন্ধে বৈসে গণপতি,
তার পর বৈসে জলন্ধর।
কটিতটে বসুমতী, জিহ্বায় বৈসে সরস্বতী,
তোমার গোফা মনুরায়ের ঘর॥
কস্তুরী চন্দন বন, মলয়া গিরি পবন,
দিবা রাত্রি বহে দুই ধারা।

চন্দ্র সূর্য দুইজন, যোগমুখে আসন,
গগন মন্দিরে রহে তারা॥
সাত দিন পনের তিথি, ললাটে পূর্ণিমার স্থিতি,
বাম পদ নখের উপরে।
সুকুর মামুদ কয়, তিথি কর পরিচয়,
বুঝ তিথি প্রতি ঘরে ঘরে॥
এ ছাড়া পাথর পূজে, হত মূর্খ নাহি বুঝে,
ধন নখ না করে বিচার।
খাইতে বলিতে জানে, পূজে তাকে মনে মনে,
অনায়াসে ভবে হবে পার॥

যোগীর পুথি সমাপ্ত।

প্রকাশকের পরিচয়।

কেতাব হইল শেষ খোদার মদতে।
তিনি অগতির গতি বিপদে আপদে॥
তাঁহার করুণা শুধু ভরসা আমার।
তিনি নিত্য নিরাময় সকলের সার॥
দীননাথ দয়াময় পতিত পাবন।
সর্ব্ব জীবে দয়া তাঁর সদা সর্ব্বক্ষণ॥
হে খোদা অন্তর মম কর পাক ছাফ।
জীবনের যত গুনা করে দাও মাফ॥
তোমার হবিব নবি রছুল করিম॥
ছাবেক তাঁহার দিনে রাখিও রহিম॥
বন্ধুগণ অভাজন করে নিবেদন।
করিবেন খাতা মাফ দোওা বিতরণ॥
আদ্যক্ষরে নাম সহ নীচে সমুদয়।
পাইবেন পদ্যে মম মূল পরিচয়॥

গুনার সাগরকূলে রহেছি বসিয়া।
লাগিছে পাপের ঢেউ সতত আসিয়া॥
মহাম্মদ নাম পরে ভরসা আমার।
রছুল করিলে দয়া তবে তো নিস্তার॥
ছুটিল না মোহ ঘোর জীবনে আমার।
লক্ষ্যহীন পথে [আমি] ভ্রমি অনিবার॥
খোয়াইনু সব পুঁজি কি হবে আখেরে।
না হল নেকির কাজ দুনিয়ার ফেরে॥
কারু কেহ কেয়ামতে না হবে গম্‌খার।
রহিবে আমাল নিজ কাছে আপনার॥
ফুরাইল পুঁজি পাটা হাটা খাটা সার।
জীবনের পানে নাহি চাহি একবার॥
এই তক জানি আমি মূল বিবরণ।
এ ঘোর জগতে আমি হীন অকিঞ্চন॥
খোন্দকার জহিরদ্দিন বাবাজীর নাম।
বংশেতে রইস বটে গরীবানা ঠাম॥
এক ভ্রাতা নাম তার রইসউদ্দিন।
বাহাল ইমানে রাখে এলাহি আলমিন॥
চারিটী ভগিনী মম আছে সহোদরা।
নেকই খাছলত নেক সবাই তাহারা॥
খোদার দরগায় করি এই মোনাজাত।
জেন্দেগী সবার হয় ইমানের সাথ॥
দিয়াছেন দাতা মোরে দুইটী দুহিতা।
দোওয়া করিবেন খোদা নেকি করে আতা॥
মুন্‌সিপাড়া গ্রাম মাঝে বসতি আমার।
সে গ্রাম অধীন হয় জেলা নদীয়ার॥
মস্‌হুর জুনিয়াদহে আছে ডাক ঘর।
মেলায় দোকান মম আছে বরাবর॥

চন্দ্র সূর্য্য দুইজন, যোগমুখে আসন,
গগন মন্দিরে রহে তারা॥
সাত দিন পনের তিথি, ললাটে পূর্ণিমার স্থিতি,
বাম পদ নখের উপরে।
সুকুর মামুদ কয়, তিথি কর পরিচয়,
বুঝ তিথি প্রতি ঘরে ঘরে॥
এ ছাড়া পাথর পূজে, হত মুর্খ নাহি বুঝে,
ধন নখ না করে বিচার।
খাইতে বলিতে জানে, পূজে তাকে মনে মনে,
অনায়াসে ভবে হবে পার॥

যোগীর পুথি সমাপ্ত।

  1. আদর্শে ‘ময়নামন্ত্রি’, ‘ময়নামন্ত্রী’ প্রভৃতি পাঠ পাওয়া যায়।
  2. আদর্শে ‘নিরবন্দ’।
  3. ‘যোবন।
  4. ‘জ্ঞানমন্ত্র’।
  5. ‘মনির’ ‘মনী' মনি’ ইতাদি।
  6. ‘ষষ্টি’।
  7. ‘কুষ্টি’; ‘কুষ্টীর’
  8. আদর্শের পাঠ:—
    ‘যুগ্য’।
  9. ‘কবিলাক’
  10. ‘কুদালী’
  11. ‘অদুনা’।
  12. ‘উদ্দিশে”।
  13. ‘কোমার'।
  14. ‘কোলে'।
  15. ‘কুশল’
  16. ‘ভূজনে’।
  17. ‘মহীন’।
  18. ‘কোদালিতে’।
  19. ‘উদ্দিশে’
  20. ‘গজপাটা’।
  21. ‘উদাগিরি’।
  22. ‘উদ্দীশ’।
  23. ‘কোদালী’
  24. ‘ঝুলতুলীতে’
  25. ‘কোমর’।
  26. ‘রানী’।
  27. আদর্শে ‘কহিয়া’ আছে
  28. আদর্শে ‘যুগে মানিক দেহ’
  29. আদর্শে ‘পিঠে’ আছে।
  30. আদর্শে ‘বার’।
  31. ‘আন্ধার’।
  32. ‘যৌবন’
  33. ‘ত্রিপিণীর।’
  34. ‘স্রীকলার।’
  35. ‘সরস্বতী'।
  36. ‘বেসিনী’।
  37. ‘রাণী’।
  38. ‘অধিকারী’।
  39. ‘পারিয়া ভাঙ্গিব’।
  40. ‘রাজা'।
  41. ‘আন্ধার’।
  42. ‘নারীর।’
  43. ‘স্ত্রীবদ’।
  44. ‘বদের’।
  45. ‘রাণী’।
  46. ‘নারী’।
  47. ‘সুলচনী।’
  48. ‘বান্দিত’
  49. ‘সরোবর কোলে’।
  50. ‘কলিপল।’
  51. ‘কোলে।’
  52. ‘ত্রিপণীর’।
  53. ‘উদ্দিশ’।