গৌড়রাজমালা/বিজয়সেন ২
লক্ষ্মণাব্দের মূল যাহাই হউক, আমরা কুমরদেবীর সারনাথ-লিপিতে, রামপালচরিতে, বৈদ্যদেবের এবং মদনপালের তাম্রশাসনে, বরেন্দ্রদেশের যে ইতিহাস প্রাপ্ত হই, তাহার উপর নির্ভর করিতে গেলে, দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের পূর্ব্বে বিজয়সেন কর্ত্তৃক বরেন্দ্রে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা একেবারে অসম্ভব বোধ হয়। বিজয়সেন যখন বরেন্দ্রে স্বাধীনতা অবলম্বনে উদ্যত ইয়াছিলেন, তখন প্রথমেই অবশ্য তাঁহার সহিত গৌড়পতি পাল-নরপালের সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল। দেবপাড়ার প্রশস্তিতে উক্ত হইয়াছে,—বিজয়সেন “গৌড়েন্দ্রকে সবলে আক্রমণ” করিয়াছিলেন (২০ শ্লোক)। সম্ভবত এই আক্রমণের ফলেই “গৌড়েন্দ্র” বরেন্দ্র ত্যাগ করিয়া, মগধে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তৎপর প্রতিবেশী নৃপতিমাত্রই হয় ত তাঁহার প্রতিকূলতাচরণে উদ্যত হইয়াছিলেন। কার্য্যত না হউক, নামতঃ কামরূপ-রাজ এবং কলিঙ্গ-রাজ, গৌড়েশ্বরের অনুগত ছিলেন। গৌড়েন্দ্রকে বরেন্দ্র হইতে বিতাড়িত হইতে দেখিয়া, হয়ত তাঁহারা বিদ্রোহী বিজয়সেনকে আক্রমণ করিয়াছিলেন। প্রশস্তিকার উমাপতি ধর লিথিয়াছেন—বিজয়সেন “কামরূপভূপকে দমন করিয়াছিলেন, এবং কলিঙ্গ[রাজকে] পরাজিত কবিয়াছিলেন (২০)।” মিথিলাপতি নান্যদেব বিজয়সেনকে আক্রমণ করিতে আসিয়া, ধৃত এবং কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন। উমাপতি ধর লিখিয়াছেন,—বিজয়সেন নান্য ব্যতীত রাঘব, বর্দ্ধন, এবং বীর নামক আরও তিনজন নৃপতিকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন (২১ শ্লোক)। গৌড়রাষ্ট্রের পশ্চিমাংশ [“পাশ্চাত্য-চক্র”] জয় করিবার জন্য, তিনি যে “নৌবিতান” প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা অধিকদূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছিল বালয় বোধ হয় না (২২ শ্লোক)। দক্ষিণ দিকে, বঙ্গে এবং রাঢ়ে, বর্ম্মরাজ কর্ত্তৃক বিজয়সেনের গতি রুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু বরেন্দ্রে বিজয়সেনের আধিপত্য বদ্ধমূল হইয়াছিল, এবং সেখানে তিনি অনেক লোকহিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠানের অবসর পাইয়াছিলেন। উমপতি ধর লিখিয়া গিয়াছেন,—বিজয়সেন অনেক “উত্তুঙ্গ দেবমন্দির” এবং “বিস্তীর্ণ (বিতত) তল্ল” প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। বিজয়সেন-প্রতিষ্ঠিত প্রদ্যুম্নেশ্বর-মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এবং তাঁহার রাজধানী—[জনশ্রুতির “বিজয়রাজার বাড়ী”—বিজয়নগর বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। উমাপতি ধর-বিরচিত বিজয়সেনের প্রশস্তি-সম্বলিত শিলা-ফলক বরেন্দ্রের অন্তর্গত দেবপাড়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল।