গৌড়রাজমালা/মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার নামক খল্‌জ্ বা খিলজি বংশীয় একজন তুরূষ্ক, মুইজুদীন মহম্মদের সেনাশ্রেণীতে কর্ম্মের অনুসন্ধানে, গজনী গমন করিয়াছিলেন। মহম্মদের চেহারা পছন্দসহি না হওয়ায়, সেনাসংগ্রহ-বিভাগের প্রধান কর্ম্মচারী তাঁহাকে একটি অল্প বেতনের কর্ম্ম দিতে চাহিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার প্রস্তাবিত কর্ম্ম গ্রহণ না করিয়া হিন্দুস্থানে—দীল্লিতে গমন করিলেন। মহম্মদঘোরীর প্রতিনিধি কুতবুদ্দীন তখন দীল্লীতে অবস্থান করিতেছিলেন। দীল্লীতেও মহম্মদের আকৃতি তাঁহার মনোমত পদপ্রাপ্তির অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইল। হতাশ হইয়া, মহম্মদ অযোধ্যায় গিয়া, মালিক হুসামুদ্দীন আগুল্‌বকের শরণাগত হইলেন। হুসামুদ্দীন মহম্মদের ক্ষিপ্রকারিতার এবং সাহসের পরিচয় পাইয়া, তাঁহাকে “ভগবত” এবং “ভিউলি” নামক দুইটি পরগণা জায়গীর দান করিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের জায়গীর দক্ষিণ বিহার বা মগধের পশ্চিম সীমা কর্ম্মনাশা নদীর পশ্চিমে, চুনারগড়ের নিকটে অবস্থিত ছিল। এখান হইতে মহম্মদ মাঝে মাঝে মগধে (বিহারে) প্রবেশ করিয়া, গ্রাম লুটপাট আরম্ভ করিলেন; এবং লুণ্ঠিত অর্থের দ্বারা ক্রমশঃ যুদ্ধের অশ্ব, অস্ত্রশস্ত্র, এবং সেনা সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। তাঁহার বীরত্বের খ্যাতি চারিদিকে ব্যাপ্ত হইলে, হিন্দুস্থানের যত খল্‌জ্ বা খিলজি-বংশীয় তুরূষ্ক ছিল, তাহারা আসিয়া তাঁহার সহিত মিলিত হইল। সুলতান কুতবুদ্দীন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের সুখ্যাতি শুনিয়া, তাঁহাকে খিলাত পাঠাইয়া দিলেন। প্রোৎসাহিত হইয়া, মহম্মদ পুনঃ পুনঃ “বিলায়ৎ বিহার” আক্রমণ করিয়া, অনেক স্থান লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। “এক দো সাল” এইরূপ আক্রমণ ও লুণ্ঠন চলিল।

বিহার-বিজয়

 অবশেষে মহম্মদ বিহার দুর্গ অধিকার করিতে মনস্থ করিলেন। এই “কিল্লা-বিহার” পাটনা জেলার অন্তর্গত বর্ত্তমান বিহার মহকুমার প্রধান নগর বিহার বলিয়া অনুমিত হয়। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক “বিহার-দুর্গ”, এবং তৎপর বৎসর, “নোদিয়া” অধিকারের সময় লইয়া, পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। রেভার্টির মতে, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে বিহার-দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন।[১] ব্লক্‌ম্যান এই ঘটনা ১১৯৭ কি ১১৯৮ খৃষ্টাব্দে স্থাপন করিতে চাহেন। ব্লক্‌ম্যানের অনুমানই সমীচীনতর বোধ হয়। “বিহার” এবং “নোদিয়া” অধিকারের বিবরণ সম্বন্ধে আমাদের প্রধান অবলম্বন—মিন্‌হাজুদ্দীনের “তবকাত্-ই-নাসিরি” নামক পারস্য ভাষায় রচিত ইতিহাস গ্রন্থ।

 ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে, কুতবুদ্দীন কর্ত্তৃক দীল্লি অধিকারের বৎসরে, মিন্‌হাজুদ্দীন জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন; এবং সুলতান ইয়াল্ তিমিসের এবং তাঁহার বংশধরগণের রাজত্বকালে, প্রথমে গোয়ালিয়রের এবং পরে দীল্লির প্রধান কাজির পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১২৪২ খৃষ্টাব্দে প্রধান কাজির পদ ত্যাগ করিয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বাঙ্গলায় আসিয়াছিলেন; এবং এখানে দুই বৎসরকাল অবস্থান করিয়া, দীল্লি ফিরিয়া গিয়াছিলেন। এই সুযোগেই, মিন্‌হাজ বিহার এবং বাঙ্গালার তৎকালীন ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলেন। “বিহার” এবং “নোদিয়া” অধিকারের ৪৫ বৎসর পরে, বিবরণ-সঙ্কলনে ব্রতী হইয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বৃদ্ধ সৈনিক এবং “বিশ্বস্ত লোকের” মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মিন্‌হাজুদ্দীন যখন “তবকাত্” রচনায় প্রবৃত্ত, তখন অবশ্যই পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণের প্রবর্ত্তিত প্রমাণ-পরীক্ষা-রীতি কাহারও জানা ছিল না, এবং তৎকালের জনসাধারণের ন্যায় মিন্‌হাজেরও অতিপ্রাকৃত এবং আজগুবি কথায় বিশ্বাস স্থাপনের প্রবৃত্তি যথেষ্ট ছিল। উপরন্তু, স্বধর্ম্মে অনুরাগ এবং পৌত্তলিকতায় অশ্রদ্ধা, মিন্‌হাজের ন্যায় লেখকগণকে স্বজাতির একান্ত পক্ষপাতী করিয়া রাখিয়াছিল। সুতরাং মিন্‌হাজ-বর্ণিত “বিহার” এবং “নোদিয়া”-অধিকারের বিবরণ বিশেষ বিচার পূর্ব্বক গ্রহণ করা কর্ত্তব্য।

 “বিশ্বাসী লোকের” এবং ঐ ঘটনায় লিপ্ত একজন বৃদ্ধ সৈনিকের মুখের কথা শুনিয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বিহার-কিল্লা অধিকারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যখন “বিহার” আক্রমণ করেন, তখন তাঁহার অনুচরগণের মধ্যে নিজামুদ্দীন এবং সমসামুদ্দীন এই দুই ভ্রাতা ছিল। ১২৪৩ খৃষ্টাব্দে মিন্‌হাজুদ্দীন যখন “লখ্‌নাবতী” নগরে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন সমসামুদ্দীনের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল; এবং সমসামুদ্দীনের মুখে যেরূপ শুনিয়াছিলেন, তিনি তাহাই লিথিয়া গিয়াছেন। বিহার-অধিকার-প্রসঙ্গের সূচনায় মিন্‌হাজুদ্দীন লিখিয়াছেন,—“বিশ্বাসী লোকেরা এইরূপ বলিয়াছেন যে, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার, দুই শত বর্ম্মাচ্ছাদিত-গাত্র অশ্বারোহী লইয়া, বিহারদুর্গের দ্বারদেশে উপনীত হইয়াছিলেন; এবং হঠাৎ ঐ স্থান আক্রমণ করিয়াছিলেন।” পরে সমসামুদ্দীনের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন,—আক্রমণকারিগণ দুর্গের দ্বারে উপস্থিত হইলে, “মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার সাহসে ভর করিয়া, দ্বারের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। তাঁহারা কিল্লা অধিকার করিয়াছিলেন, এবং বিস্তর দ্রব্য লুণ্ঠিত করিয়াছিলেন। ঐ স্থানের অধিকাংশ অধিবাসী ব্রাহ্মণ ছিলেন, এবং ইঁহাদের সকলেরই মস্তক মুণ্ডিত ছিল। তাঁহারা সকলেই নিহত হইয়াছিলেন। ঐ স্থানে অনেকগুলি পুস্তক ছিল। যখন এই সকল পুস্তক মুসলমানগণের নয়নগোচর হইল, তখন উহাদের মর্ম্ম বুঝাইবার জন্য তাঁহারা কতকগুলি হিন্দুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কিন্তু সমস্ত হিন্দুই নিহত হইয়াছিল। যখন তাঁহারা [প্রকৃত কথা] জানিতে পারিলেন, তখন দেখা গেল—“তামাম হিসার (দুর্গ) ও সহর একটা বিদ্যালয়, এবং হিন্দী ভাষায় বিদ্যালয়কে (মাদ্‌রাসাকে) ‘বিহার’ বলে।”[২]

 এস্থলে দেখিতে পাওয়া যায়,—মিন্‌হাজুদ্দীন “কিল্লা বিহার” অধিকারের প্রকৃত বিবরণ জানিতে যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার বিবরণ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য। কিন্তু তিনি যে শ্রেণীর লোকের নিকট হইতে বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাদের পর্য্যবেক্ষণ-শক্তি যে কত দুর্ব্বল, তাহার দুইটি প্রমাণ পাওয়া গেল। তাহারা একটি বৌদ্ধ-বিদ্যালয়কে “কিল্লা” বলিয়া ভ্রম করিতে সমর্থ হইয়াছিল; এবং অনুসন্ধান করিয়াও, তাহারা ঠিক করিয়া উঠিতে পারে নাই যে—মুণ্ডিত-মস্তক বিহারবাসীরা ব্রাহ্মণ নহে, বৌদ্ধ শ্রমণ।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার “কিল্লা-বিহার” লুণ্ঠন করিয়া, বহু ধন লাভ করিয়াছিলেন। যে বৌদ্ধ-বিহার আক্রমণকারিগণের নিকট কিল্লা এবং সহর বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল, তাহাতে যে বহু কালের বহু ভক্ত-জনের প্রদত্ত বহু অর্থ সঞ্চিত থাকিবে, ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কি? মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার এই লুণ্ঠিত দ্রব্য লইয়া, স্বয়ং দীল্লিতে কুতবদ্দীন আইবকের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। কুতবুদ্দীন তাঁহাকে বহু সম্মান করিয়াছিলেন। মিন্‌হাজ লিখিয়াছেন,—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার দীল্লি হইতে ফিরিয়া আসিয়া, “বিহার জয় করিয়ছিলেন [বিহার ফতে কর্‌দ]”। এই “বিহার ফতের” কথাটা অতি সাবধানে গ্রহণ করিতে হইবে। “বিহার” বলিতে এখন আমরা যাহা বুঝি, মিন্‌হাজুদ্দীন সে অর্থে বিহার-শব্দের ব্যবহার করেন নাই। তিনি সুলতান ইয়াল্‌তিমিসের রাজত্বের বিবরণের শেষে, বিজিত প্রদেশ-সমূহের যে তালিকা দিয়াছেন, তাহাতে “বিহার” এবং “তিরহুত” স্বতন্ত্র উল্লিখিত হইয়াছে। মিন্‌হাজের “বিহার” দক্ষিণ বিহার বা সাহাবাদ, পাটনা, গয়া, মুঙ্গের, এবং ভাগলপুর জেলা। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার তিরহুত জয় করা দূরে থাকুক, কোন দিন উহার কোন অংশ আক্রমণও করিয়াছিলেন না। যাঁহার শৈথিল্যে বা দুর্ব্বলতায়, দক্ষিণ-বিহার মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের ন্যায় সামান্য জায়গীরদার কর্ত্তৃক পুনঃ পুনঃ আক্রান্ত লুণ্ঠিত এবং অবাধে বিজিত হইতে পারিয়ছিল, সেই “গৌড়েশ্বরের” রাজধানীতে “বিহার ফতের” কাহিনী ঘোর আতঙ্ক উপস্থিত করিয়া, নির্বিরোধে বরেন্দ্র এবং রাঢ়দেশ অধিকারের পথ পরিষ্কার করিয়া থাকিবে।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের অভ্যুদয়-কালে, যিনি উত্তরাপথের পূর্ব্বাংশের প্রধান নরপাল বা “গৌড়েশ্বর” [মিন্‌হাজের ভাষায় “হিন্দের রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খালিফাস্থানীয়”] ছিলেন, মিন্‌হাজুদ্দীন তাঁহাকে “রায় লখ্‌মনিয়া” এবং তাঁহার “দার-উল্-মুল্‌ক্” বা রাজধানীকে “সহর নোদিয়া” নামে উল্লেখ করিয়াছেন। মিন্‌হাজ “রায় পিথোরার” [চৌহান-রাজ পৃথ্বীরাজের] এবং “রায় জয়চাঁদের” [গাহড়বাল-রাজ জয়চ্চন্দ্রের] নামোল্লেখ মাত্র করিয়াছেন, কিন্তু “রায় লখ্‌মনিয়ার” জীবনচরিত লিপিবদ্ধ করিতেও যত্ন পাইয়াছেন; তাঁহার শাসনরীতির সুখ্যাতি করিয়াছেন; দানশীলতার জন্য তাঁহাকে “সুলতান করিম কুতবদ্দীন হাতেমুজ্জমান” বা সেই যুগের হাতেম কুতবুদ্দীনের সহিত তুলনা করিয়াছেন; এবং উপসংহারে পৌত্তলিক-বিদ্বেষ বিস্মৃত হইয়া, আশীর্ব্বাদ করিয়াছেন;—“আল্লা [নরকে] তাঁহার শাস্তির লাঘব করুন।”[৩] এই “রায় লখ্‌মনিয়া” কে, তদ্বিষয়ে পণ্ডিত-সমাজে বিস্তর মতভেদ আছে। মিন্‌হাজুদ্দীনের “রায় লখ্‌মনিয়া” গৌড়াধিপ লক্ষ্মণসেনের নামের অপভ্রংশ বলিয়াই বোধ হয়। মিন্‌হাজুদ্দীন লখ্‌মনিয়ার যে জীবনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা তিনি “বিশ্বাসী লোকের” উক্তি (সেফাৎ রোয়াৎ) বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। জনশ্রুতির বাহক এই সকল “বিশ্বাসী লোক” যাঁহাকে ভক্তির চক্ষে দেখেন, তাঁহার জীবনীকে অনেক অলৌকিক ঘটনায় সাজাইতে ভাল বাসেন। মিন্‌হাজুদ্দীন-লিখিত লক্ষ্মণসেনের জন্মবৃত্তান্ত, জন্মমাত্র রাজ্যাভিষেক, এবং সুদীর্ঘ-রাজ্যশাসন-কাহিনী “বিশ্বাসী লোকের” কল্পনা বলিয়াই মনে হয়। তবে মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের “নোদিয়া” আক্রমণের সময় লক্ষ্মণসেন ঠিক অশীতিবর্ষীয় না হউন, বার্দ্ধক্যে পদার্পণ করিয়াছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করা যাইতে পারে।

লক্ষ্মণাবতী ও নোদিয়া

 তাহার পর জিজ্ঞাস্য—“সহর নোদিয়হ্” কোন্ খানে ছিল? আবুল্ ফজল্ মিন্‌হাজের “নোদিয়হ্‌কে” “নদীয়া” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, এবং বাঙ্গলায় সংস্কৃত-চর্চ্চার গুরুস্থান নবদ্বীপই যে লখ্‌মনিয়ার “নদীয়া” তাহার আভাস দিয়াছেন।[৪] আবুল্ ফজলের মতই এখন সর্ব্বত্র সমাদর লাভ করিয়াছে। কিন্তু আবুল্ ফজলের সময়েও, সকলে “নোদিয়হ্”কে “নদীয়া” বলিয়া মনে করিত না। “মুন্তখাব্-উৎ-তওয়ারিখ”-গ্রন্থে আবদুল কাদির বেদৌনি মিন্‌হাজের “নোদিয়হ্”কে “নোদীয়া” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[৫] সংস্কৃত সাহিতো, লক্ষ্মণসেনের দুইটি স্বতন্ত্র রাজধানী, ‘বিজয়পুর’ এবং ‘লক্ষ্মণাবতীর’ উল্লেখ পাওয়া যায়। “পবনদূতে” ধোয়ী কবি সুহ্ম বা রাঢ়দেশের বর্ণনা করিয়া এবং

“भागीरथ्या स्तपनतनया यत्र निर्य्याति देवी” (३३)

সেই মুক্তবেণী (ত্রিবেণীর) উল্লেখ করিয়া,

“स्कन्धावारं विजयपुर मित्युन्नतां राजधानी” (३६)

বর্ণন করিয়াছেন। “প্রবন্ধচিন্তামণি”-গ্রন্থে মেরুতুঙ্গ আচার্য্য লিখিয়াছেন,—“গৌড়দেশে লক্ষ্মণাবতী নগরে—লক্ষ্মণসেন নামক রাজা দীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন।” মিন্‌হাজ লিখিয়াছেন,[৬] “মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার ঐ (রায় লখ্‌মনিয়ার) মুলুক সকল (মমল্‌কত) দখল (জব্‌ত) করিয়া সহর নোদিয়হ্‌কে “খরাব” করিলেন, এবং যে মৌজা [এখন] লখ্‌ণাবতী, তাহার উপর রাজধানী (দার-উল্-মুল্‌ক্) স্থাপন করিলেন।” এখানে দেখা যায়—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যেন লখ্‌ণাবতী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। “লখ্‌ণাবতী” লক্ষ্মণাবতীর অপভ্রংশ। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যে ইচ্ছাপূর্ব্বক ঐ স্থানের নাম “লক্ষ্মণাবতী” রাখিয়াছিলেন, এমন সম্ভব নহে। ঐ স্থানের নাম আগেই “লক্ষ্মণাবতী” ছিল, এবং উহাই লক্ষ্মণসেনের অন্যতম রাজধানী ছিল। সেনরাজগণের কীর্ত্তিচিহ্ন সেখান হইতে এখনও লুপ্ত হয় নাই। কিম্বদন্তী অনুসারে, লখ্‌ণাবতী বা গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের সমীপবর্ত্তী বিশাল সাগরদীঘি লক্ষ্মণসেন খোদাইয়াছিলেন; এবং সাগরদীঘির অনতিদূরস্থিত একটি প্রাচীন দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনও “বল্লালগড়” নামে কথিত হইয়া আসিতেছে। লক্ষ্মণসেনের অপর রাজধানী “বিজয়পুর” মিন্‌হাজুদ্দীন কর্ত্তৃক “নোদিয়াহ্” নামে অভিহিত হইয়া থাকিতে পারে। “পবনদূতের” প্রকাশক প্রবীণ প্রত্নতত্ত্ববিদ্ শ্রীযুত মনোমোহান চক্রবর্ত্তী “নোদিয়াহ্” এবং “নদীয়া” অভিন্ন মনে করিয়া, নদীয়াই বিজয়পুর এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু রাজসাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়া সহরের ১০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত [জনশ্রুতি অনুসারে] কুমার রাজার রাজধানী “কুমারপুরের” নিকটবর্ত্তী বিজয় রাজার রাজবাড়ীর ভগ্নাবশেষপূর্ণ “বিজয়নগর”ই পবনদূতের ‘বিজয়পুর’ বলিয়া বোধ হয়। বিজয়সেনের নামানুসারে যে বিজয়পুরের নামকরণ হইয়াছিল, এ বিষয়ে সংশয় নাই; এবং ‘বিজয়নগরে’ও জনশ্রুতি অনুসারে এক বিজয় রাজা ছিল। দানসাগর-মতে বিজয়সেনের প্রাদুর্ভাব-স্থানে [বরেন্দ্রেই] “বিজয়নগর” অবস্থিত, এবং ইহার ৭ মাইল ব্যবধানে বিজয়সেনের শিলালিপির প্রাপ্তি-স্থান “দেবপাড়া” অবস্থিত। দেবপাড়ার ‘পদুমসহর’ নামক তল্ল বিজয়সেনের প্রতিষ্ঠত প্রদ্যুম্নেশ্বরের স্মৃতি এখনও জাগ্রত রাখিয়াছে, এবং “পদুমসহরের” তীরে একটি বৃহৎ দেবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান আছে। সুতরাং বিজয়নগরকে বিজয়পুর বলিয়া গ্রহণ করাই সমীচীন বোধ হয়। বিজয়নগর লক্ষ্মণাবতীর ভগ্নাবশেষ হইতে ৪৫ মাইল বাবধানে অবস্থিত; নদীয়া ১১০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত। মিন্‌হাজের বর্ণনানুসারে ‘লখ্‌নাবতী’ হইতে ‘নোদিয়া’ খুব বেশ দূরে অবস্থিত ছিল বলিয়া বোধ হয় না, এবং এই নিমিত্ত বিজয়নগরকেই “নোদিয়াহ্” বলিতে প্রবৃত্তি হয়।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক “কিল্লা-বিহার” অধিকারের বিবরণ সঙ্কলনে ব্রতী হইয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন যেমন সেই ব্যাপারে স্বয়ং লিপ্ত এক জন বৃদ্ধ সৈনিকের সাক্ষ্য গ্রহণে সমর্থ হইয়াছিলেন, “নোদিয়াহ্”-অধিকার সম্বন্ধে তেমন কোন সাক্ষাৎ দ্রষ্টার মুখের কথা শুনিয়াছিলেন বলিয়া উল্লেখ করিয়া যান নাই। “নোদিয়াহ্”-অধিকার-ব্যাপারে তাঁহার একমাত্র অবলম্বন “বিশ্বাসযোগ্য লোকের” উক্তি। এই সকল “বিশ্বাসযোগ্য লোকেরা”, অর্থাৎ ১২৪২-১২৪৩ খৃষ্টাব্দের লখ্‌নাবতীর তুরূষ্ক রাজপুরুষগণ, মিন্‌হাজকে মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের এবং তাঁহার অনুচরগণের কার্য্যকলাপ সম্বন্ধে সম্ভবত খাঁটি খবরই দিতে পারিয়াছিলেন; কিন্তু মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের “নোদিয়াহ্” প্রবেশের পূর্ব্বে এবং তাঁহার পরোক্ষে নোদিয়ায় যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছিল, তৎসম্বন্ধে ইঁহাদের প্রদত্ত বিবরণ তত নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হইতে পারে না। সুতরাং মিন্‌হাজুদ্দীনের বর্ণিত মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক অধিকারের পূর্ব্বের নোদিয়া-বিবরণ বিশেষ বিচার পূর্ব্বক গ্রহণ করা কর্ত্তব্য; এবং যুক্তিবিরুদ্ধ অংশ অমূলক গুজব বলিয়া উপেক্ষনীয়। মিন্‌হাজ লিখিয়াছেন, “যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক “বিহার ফতে” হওয়ার সংবাদ রায় লখ্‌মনিয়ার রাজ্যের “আত্রাফে” পঁহুছিল, তখন এক দল জ্যোতিষী ব্রাহ্মণ-রাজমন্ত্রী রাজার নিকট গিয়া নিবেদন করিল যে, পুরাকালের ব্রাহ্মণগণের পুস্তকে লেখা আছে যে, এই দেশ তুরূষ্কগণের হস্তগত হইবে; এবং এই শাস্ত্রীয় ভবিষ্যৎবাণী সফল হইবার সময়ও আসিয়াছে। সুতরাং সকলেরই এ দেশ হইতে পলায়ন করা উচিত। শাস্ত্রে লেখা ছিল, আজানুলম্বিতবাহু একজন তুরূষ্ক দেশ অধিকার করিবে। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার আজানুলম্বিতবাহু কি না, দেখিয়া আসিবার জন্য রাজা বিশ্বাসী চর পাঠাইলেন; চরেরা আসিয়া বলিল, মহম্মদ বখ্‌তিয়ার যথার্থই আজানুলম্বিতবাহু। যখন এই সংবাদ নোদিয়ায় প্রচারিত হইল, তখন “ঐ মৌজার” ব্রাহ্মণগণ এবং সাহাগণ (ব্যবসায়ীগণ) সঙ্কনতে, বঙ্গে, এবং কামরূপে (কামরূদে) চলিয়া গেল। কিন্তু রাজ্য ছাড়িয়া যাওয়া রায় লখ্‌মনিয়ার পছন্দ “মাফিক” হইল না। সুতরাং মিন্‌হাজের মতে, যাঁহার খান্‌দানকে (বংশকে) হিন্দের “রাইয়ান্” বা রাজগণ “বুজুর্গ” মনে করিত, এবং হিন্দের খলিফা বলিয়া স্বীকার করিত, এবং যাঁহার ফরজন্দান্ [বংশধরগণ] “তবকত-ই-নাসিরি” রচনার সময় [১২৬০ খৃষ্টাব্দ] পর্য্যন্ত বঙ্গের শাসনকর্ত্তা ছিল, সেই রায় লখ্‌মনিয়া একটি বৎসর জনশূন্য নদীয়ায় পড়িয়া রহিলেন!

নোদিয়া-বিজয়

 “দোয়ম সাল (পরের বৎসর) মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার লস্কর প্রস্তুত করিয়া, বিহার হইতে ধাবিত হইলেন; এবং সহসা নদীয়া সহরের নিকট এমন ভাবে উপস্থিত হইলেন যে, ১৮ জনের বেশী সওয়ার (অশ্বারোহী) তাঁহার সঙ্গে ছিল না; এবং “দিগর লস্কর” পশ্চাতে আসিতেছিল। যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার সহরের দরজায় পঁহুছিলেন, কাহাকেও আঘাত করিলেন না, ধীর, স্থির ভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। কেহ মনে করিল না, ইনি মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার; লোকে অনুমান করিল হয়ত একদল সওদাগর বিক্রয় করিবার জন্য ঘোড়া আনিয়াছে। যখন রায় লখ্‌মনিয়ার বাড়ীর (সরাই) দরজায় পঁহুছিলেন, তখন তলোয়ার খুলিয়া হিন্দুদিগকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 “তখন রায় লখ্‌মনিয়া আহারে উপবিষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহার নিকট সঠিক খবর পঁহুছিবার পূর্ব্বেই, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার বাড়ীর ভিতর ঢুকিয়া পড়িয়াছিলেন। তখন বৃদ্ধ রায় নগ্নপদে বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগ দিয়া বাহির হইয়া, সঙ্কনাতে ও বঙ্গে প্রস্থান করিলেন। তথায় অল্পকাল পরেই তাঁহার রাজত্বের পরিসমাপ্তি হইয়াছিল।”[৭]

 লক্ষ্মণসেনের কাপুরুষতায় বাঙ্গালা তুরূষ্কের পদানত হইল, ইদানীং অনেকেই এ কথা বলিয়া থাকেন। কিন্তু মিন্‌হাজুদ্দীন যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহার প্রতি অক্ষরও যদি সত্য হয়, তাহা হইলে লখ্‌মনিয়াকে বা লক্ষ্মণসেনকে “কাপুরুষ” না বলিয়া, বীরাগ্রগণ্য বলিয়া পূজা করাই সঙ্গত। শাস্ত্রের দোহাই দিয়া, সকলে নোদিয়া ছাড়িয়া সুদূর কামরূপে ও বঙ্গে পলায়ন করিলেন, কিন্তু বৃদ্ধ বীর লখ্‌মনিয়া নোদিয়া ছাড়িয়া এক পদও নড়িলেন না, একটি জনশূন্য রক্ষিশূন্য রাজধানীতে একটি বৎসর শত্রুর প্রতীক্ষায় রছিলেন। যখন শত্রু আসিল, তখন যে অপাত্রের হস্তে নগরদ্বার-রক্ষার ভার অর্পিত হইয়াছিল, তাহারা তুরূষ্ক সওয়ারগণকে ঘোড়ার সওদাগর ভ্রমে বাধা দিল না। সতত শত্রুর প্রতীক্ষাকারী নগরদ্বার-রক্ষকগণ সশস্ত্র অশ্বারোহীদিগকে ঘোড়ার সওদাগর ভ্রমে নগর প্রবেশ করিতে দেয়, মিন্‌হাজুদ্দীন ভিন্ন আর কোন ঐতিহাসিক এরূপ অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনার অবসর পাইয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। যখন রাজভবনে প্রবেশ করিয়া, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার হত্যাকাণ্ড আরম্ভ করিয়াছিলেন, তখন খবর পাইয়া, যদি রক্ষকহীন অশীতিবর্ষের বৃদ্ধ রাজা সরিয়া যাওয়া সঙ্গত মনে করিয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে কাপুরুষ বলা যায় না।

 তথাপি লক্ষ্মণসেনের “নোদিয়া” হইতে পলায়ন-কাহিনী প্রকৃত ঘটনা বলিয়া স্বীকার করা যায় না;—তাহা অজ্ঞ লোকের পরিকল্পিত উপকথা মাত্র। বিশ্বরূপ এবং কেশব নামক লক্ষ্মণসেনের অন্যূন দুইটি পুত্র ছিল; তিনি যাঁহাকে বালে রাজপণ্ডিত-পদ, যৌবনে প্রধান মন্ত্রি-পদ, এবং যৌবনান্তে যৌবনশেষযোগ্য ধর্ম্মাধিকারির পদ প্রদান করিয়াছিলেন, হলায়ুধের ন্যায় এরূপ হাতেগড় অমাত্য ছিল; এবং তিনি যাঁহাদিগকে লইয়া কাশী হইতে কামরূপ পর্য্যন্ত যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, এরূপ সৈন্যসামন্তও ছিল। মিন্‌হাজ লখ্‌মনিয়াকে যেরূপ প্রজারঞ্জনকারী এবং দানশীল রাজা বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, তিনি অনেকের ভক্তিও আকর্ষণ করিয়াছিলেন। সুতরাং, এরূপ নৃপতিকে বার্দ্ধক্যে সকলে দল বাঁধিয়া শত্রুর দ্বারা পদদলিত হইবার জন্য “নোদিয়ায়” ফেলিয়া আসিবে, এবং এক বৎসর পর্য্যন্ত তাঁহার কোন খোঁজ খবর লইবে না, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। অনুমান হয়—যখন “ব্রাহ্মণগণ” এবং “ব্যবসায়িগণ” নোদিয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন, “নোদিয়ার” অধীশ্বরও তখনই রাজধানী ত্যাগ করিয়া বঙ্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক এরূপ নির্ব্বিবাদে পশ্চিম-বরেন্দ্র অধিকারের প্রকৃত কারণ এই যে,—যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক মগধ আক্রমণের সংবাদ বিজয়পুরে পঁহুছিয়ছিল, তখনই হয়ত ভয়াতুর মন্ত্রিবর্গের উপদেশে লক্ষ্মণসেন (পূর্ব্ব) বঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন; এবং তাহার অনতিকাল পরে [তুরূষ্ক নায়কের “দোয়ম সালে”, নোদিয়া-আক্রমণের পূর্ব্বে] পরলোক গমন করিয়া থাকিবেন। লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণের যে দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার একখানিতে লক্ষ্মণসেন-পাদানুধ্যাত বিশ্বরূপসেনের নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে; এবং আর একখানিতে অপর একটি নাম বিলুপ্ত করিয়া, লক্ষ্মণসেন-পাদানুধ্যাত কেশবসেনের নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে। ইহাতে মনে হয়,—লক্ষ্মণসেনের অভাবে, সিংহাসন লইয়া পুত্রগণের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। লক্ষ্মণসেনের পরলোকগমনের অব্যবহিত পরে,—এই ভ্রাতৃবিরোধ-বহ্নি প্রধূমিত হইবার সময়ে,—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার পশ্চিম বরেন্দ্র অধিকার করিবার অবসর পাইয়া থাকিবেন।

  1. Raverty's Tabakat-i-Nasiri, App. D.
  2. Raverty’s Tabakat-i-Nasiri, pp. 551-552.
  3. Raverty, pp. 554-536. Text, pp. 148-149.
  4. Jarrett’s Ain-i-Akbari, Vol. II, p. 148.
  5. Text (Bibliotheca Indica), Vol. I, p. 58.
  6. Raverty’s Tabakat-i-Nasiri, p. 569; Text, p. 151.
  7. Raverty, pp. 556-558. Text, 150-151.