গৌড়রাজমালা/লক্ষ্মণসেন
বল্লালসেন যে গৌড়রাষ্ট্র-পুনর্গঠনব্রত অসমাপ্ত অবস্থায় রাখিয়া, পরলোক গমন করিয়াছিলেন; তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণসেন তাহা সমাপ্ত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। লক্ষ্মণসেনের এই অক্ষমতাই গৌড়ের সর্ব্বনাশের কারণ। লক্ষ্মণসেন পিতৃপিতামহের আরব্ধ কার্য্য সুসম্পন্ন করিতে যত্নের ত্রুটি করেন নাই; কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র কিছুই সে মহদনুষ্ঠানের উপযোগী ছিল না। লক্ষ্মণসেনের, ধর্ম্মপাল-মহীপাল-রামপালের তুল্য প্রতিভা ছিল না। প্রজাপুঞ্জের নির্ব্বাচিত [বহুকাল গৌড়সিংহাসনের অধিকারী] গোপালের বংশধরগণকে গৌড়জন যেরূপ ভক্তি-নেত্রে দেখিতেন, বিদেশাগত পালরাজকুল-উন্মূলনকারী বিজয়সেনের এবং বল্লালসেনের উত্তরাধিকারী লক্ষ্মণসেন সেরূপ ভক্তি লাভ করিতে পারিয়াছিলেন না। সেকাল আর একালে প্রভেদও অনেক ছিল। বরেন্দ্রের বিদ্রোহে গৌড়ের প্রজাশক্তি এবং রাজশক্তি এই উভয়ের মধ্যে যে ভেদ উপস্থিত হইয়াছিল, কর্ণাটাগত সেনবংশের অভ্যুদয়ে, তাহা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছিল; এবং “মাৎস্য-ন্যায়” নিবারণের, অথবা “অনীতিকারম্ভের” প্রতীকারের অধিকার বিস্মৃত হইয়া, গৌড়জন কালস্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ারের অভ্যুদয় গৌড়ের সর্ব্বনাশের মূল বা সর্ব্বনাশের ফল বলিয়া কথিত হইতে পারে না; বিজয়সেনের অভ্যুদয়ই গৌড়ের সর্ব্বনাশের প্রকৃত মূল বা ফল বলিয়া কথিত হইতে পারে।
গৌড়াধিপ লক্ষ্মণসেনও অবশ্যই কলিঙ্গ-পতি এবং কামরূপ-পতিকে বশীভূত রাখিতে যত্ন করিয়াছিলেন; এবং ১১৪২ খৃষ্টাব্দে গোবিন্দচন্দ্রর আক্রমণ-মূলে কান্যকুব্জেশ্বরের মগধের উপর যে দাবী জন্মিয়াছিল, তাহার নিকাশ করিবার জন্য, কান্যকুব্জেশ্বরের সহিতও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। মাধাইনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে লক্ষ্মণসেন “বিক্রম-বশীকৃত-কামরূপঃ” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেম। লক্ষ্মণসেনের সময়, গৌড়-সেনা যে কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিল, তৎসম্পর্কে অপর পক্ষও সাক্ষ্যদান করিতেছে। আসামে প্রাপ্ত কুমার বল্লভদেবের ১১০৭ শক-সম্বতের [১১৮৪-৮৫ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসন[১] হইতে জানা যায়, বল্লভদেবের পিতামহ রায়ারিদেব-ত্রৈলোক্যসিংহের সময়, গৌড়সেনা কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিল। এই শাসনে উক্ত হইয়াছে—“ভাস্কর-বংশীয় নৃপ-শিরোমণি রায়ারিদেব বঙ্গের মহাকায় করি-নিচয়ের উপস্থিতি-নিবন্ধন-ভয়াবহ সমরোৎসবে শত্রুগণকে অস্ত্রচালনা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন (৫ শ্লোক)।” রায়ারিদেব গৌড়-সেনা পরাজিত করিয়াছিলেন, এ কথা এখানে স্পষ্ট বলা হয় নাই। সুতরাং মাধাইনগর-তাম্রশাসনে উক্ত-“বিক্রমবশীকৃতকামরূপঃ”—নিরর্থক না হইতেও পারে।
লক্ষ্মণসেনের এবং বিশ্বরূপসেনের প্রশস্তিকার, লক্ষ্মণসেন কর্ত্তৃক কাশি-রাজের (কান্যকুব্জ-রাজের) এবং কলিঙ্গ-রাজেরও পরাজয়ের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। মাধাইনগরের তাম্রশাসনে ক্ষোদিত রহিয়াছে,—“তিনি সমরক্ষেত্রে কাশি-রাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন।” বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—দক্ষিণসাগরের তীরে, পুরুষোত্তম-ক্ষেত্রে—অসি, বরণা, এবং গঙ্গাসঙ্গমে বিশ্বেশ্বরের কাশীধামে—ত্রিবেণী-সঙ্গমে প্রয়াগধামে—লক্ষ্মণসেন উচ্চ যজ্ঞ-যূপের সহিত সমর-জয়স্তম্ভ-মালা স্থাপিত করিয়াছিলেন (১২ শ্লোক)। লক্ষ্মণসেন যখন গৌড়াধিপ, তখন কান্যকুব্জের সিংহাসনে গাহড়-বাল-রাজ জয়চ্চন্দ্র, এবং কলিঙ্গের সিংহাসনে দ্বিতীয় রাজরাজ, এবং তৎপরে দ্বিতীয় অনঙ্গভীম, সমাসীন ছিলেন। ইঁহারা কেহই গৌড়াধিপের তুলা পরাক্রমশালী ছিলেন না। সুতরাং ইঁহাদিগের সহিত যুদ্ধে গৌড়াধিপের জয়লাভ অসম্ভব নহে। কিন্তু লক্ষ্মণসেন গৌড়-রাষ্ট্রের বহিঃশত্রু দমনে সমর্থ হইয়া থাকিলেও, প্রজাপুঞ্জের সহযোগিতার অভাবে, আভ্যন্তরীণ ঐক্যসাধনে, এবং বিভিন্ন অংশের রক্ষার সুব্যবস্থা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। সেই জন্যই মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার অবাধে মগধ এবং বরেন্দ্র অধিকার করিতে পারিয়াছিলেন।
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. V. pp. 184.
“येनापास्त-समस्त-शस्त्र-समयः संग्रामभूमौ रिपु
श्चक्रे वङ्ग-करीन्द्र-सङ्ग-विषमे साटोप-युद्धोत्सवे।
येनात्यर्थमयं स्वयं सफलित स्त्रैलोक्यसिंहो विधिः
सोभूद्भास्कर-वंश-राजतिलको रायारिदेवो नृपः॥”