গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক)/কেশব-প্রশস্তি

কেশব-প্রশস্তি।

[মহাবোধি-লিপি]
প্রশস্তি-পরিচয়।

 ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দের সমসময়ে বুদ্ধ গয়াধামের সুবিখ্যাত মহাবোধি-মন্দিরের দক্ষিণে [স্যর আলেক্‌জণ্ডার] কনিংহাম একখানি প্রস্তর-ফলক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাহার বামভাগে একটিআবিষ্কার-কাহিনী। লিপি এবং দক্ষিণ ভাগে [তিনটি পৃথক্ পৃথক্ প্রকোষ্ঠে] তিনটি শ্রীমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। প্রস্তর-ফলকখানি কলিকাতার যাদুঘরে প্রেরিত হইয়াছিল, এবং কনিংহামের “মহাবোধি” নামক গ্রন্থে[১] প্রস্তরলিপির একটি প্রতিলিপি মুদ্রিত হইয়াছিল।

 এই প্রস্তরলিপি আবিষ্কৃত হইবার পর, ইহার পাঠোদ্ধারের ভার ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রেরপাঠোদ্ধার-কাহিনী। উপর ন্যস্ত হইয়াছিল। তিনিও সোসাইটির পত্রিকায়[২] ইহার পাঠ ও ইংরাজি অনুবাদ মুদ্রিত করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে বিশুদ্ধ পাঠ উদ্ধৃত করিতে অসমর্থ হইয়া, ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল এই প্রস্তরলিপির বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা প্রকটিত করিয়া যাইতে পারেন নাই। প্রস্তরফলকে যে তিনটি শ্রীমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, তাহারও প্রকৃত পরিচয় বহুকাল অপরিজ্ঞাত ছিল।

 কলিকাতার যাদুঘরে সংরক্ষিত পুরাকীর্ত্তির নিদৰ্শনসমূহের পরিচয়-বিজ্ঞাপক বিবরণ-পুস্তকে[৩] ডাক্তার আণ্ডারসন্ এই প্রস্তরলিপিকে বৌদ্ধমত-বিজ্ঞাপক সুবিখ্যাত “যে ধম্মা” মন্ত্র, এবংব্যাখ্যা-কাহিনী। শ্রীমূর্ত্তিত্রয়কে “বোধিসত্ত্ব-মূর্ত্তি” বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছিলেন। প্রকৃত পক্ষে, ইহার সহিত বৌদ্ধমতের কিছুমাত্র সম্পৰ্ক নাই। শ্রীযুক্ত নীলমণি চক্রবর্ত্তী, এম-এ, এই প্রস্তরলিপির পাঠ ও ব্যাখ্যা মুদ্রিত করিয়া,[৪] তৎপ্রতি পণ্ডিতবৰ্গের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়াছেন। কিন্তু এই প্রস্তর-লিপি এখনও বঙ্গসাহিত্যে সুপরিচিত হইতে পারে নাই।

 এই প্রস্তর-ফলকে ৯ পংক্তিতে [সংস্কৃত ভাষা-নিবদ্ধ] চতুঃশ্লোকাত্মক একটি সংক্ষিপ্ত লিপি উৎকীর্ণ রহিয়াছে। তাহার দুই একটি অক্ষর অস্পষ্ট হইলেও, অধিকাংশ অক্ষর এখনও অক্ষুণ্ণলিপি-পরিচয়। অবস্থায় বর্ত্তমান আছে। প্রস্তর-ফলকের দক্ষিণভাগে যে তিনটি প্রকোষ্ঠ আছে, তাহার বাম প্রকোষ্ঠে বিষ্ণুমূর্ত্তি, দক্ষিণ প্রকোষ্ঠে সূর্য্যমূর্ত্তি; এবং মধ্যস্থলের প্রকোষ্ঠে আর একটি [অস্পষ্ট] শ্রীমূর্ত্তি; তাহা [চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের মতে] “হয়ত ভৈরব মূর্ত্তি।”[৫] যে অক্ষরে এই লিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল, তাহা ধর্ম্মপালদেবের শাসন-সময়ের বঙ্গাক্ষর; ধর্ম্মপালদেবের [খালিমপুরে আবিষ্কৃত] তাম্ৰশাসনের অক্ষরের অনুরূপ।

 এই প্রস্তর-লিপিতে লিখিত আছে,—ধর্ম্মপালের রাজ্যাব্দের ষড়্‌বিংশতিতম বর্ষে [৭ পংক্তি] ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে শণিবারে [৮-৯ পংক্তি] উজ্জ্বল নামক ভাস্করের পুত্র কেশব-[১-২ পংক্তি]লিপি-বিবরণ। কর্ত্তৃক একটি চতুর্ম্মুখ মহাদেব [৩ পংক্তি] প্রতিষ্ঠাপিত হইয়াছিল, এবং [তৎকাল-প্রচলিত “দ্রম্ম” নামক মুদ্রার] তিন সহস্ৰ মুদ্রা ব্যয়ে [৬ পংক্তি] একটি “অতি অগাধা” পুষ্করিণী খানিত হইয়াছিল। এই প্রস্তর-লিপিতে কবির বা শিল্পীর নাম উল্লিখিত নাই; ইহাতে কোনরূপ উল্লেখযোগ্য শিল্প-কোঁশলেরও সমাবেশ দেখিতে পাওয়া যায় না।

 যে “রম্য” স্থানে এই প্রতিষ্ঠাকার্য্য সম্পাদিত হইয়াছিল, প্রস্তর-ফলকটি সেই স্থানের ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাহা বুদ্ধগয়াধামের “চম্পশায়তন” নামে [১ পংক্তিতে] উল্লিখিত। এই নামটি সংশয়হীন বলিয়া বোধ হয় না। যাহা হউক,—এই শিলালিপিতেঐতিহাসিক তথ্য। জগদ্বিখ্যাত মহাবোধি নামক বৌদ্ধ-তীর্থক্ষেত্রে শৈব-মূর্ত্তিপ্রতিষ্ঠার যে পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাহা একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য। ধর্ম্মপালদেবের শাসন-নীতির সকল বর্ণকেই [শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট] স্ব স্ব “স্বধর্ম্মে” প্রতিষ্ঠাপিত করিবার কথা তৎপুত্র দেবপালদেবের [মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত] তাম্ৰশাসনে [৫ শ্লোকে] উল্লিখিত আছে। ধর্ম্মপালদেবের শাসন-সময়ে মহাবোধি নামক বৌদ্ধতীর্থক্ষেত্রে এই শৈব-মূর্ত্তির প্রতিষ্ঠা তাহার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ বলিয়া স্বীকৃত হইতে পারে। এই প্রস্তর-লিপিতে “দ্রম্ম” নামক যে মুদ্রার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা যে এক শ্রেণীর রৌপ্য-মুদ্রা ছিল, বিগ্রহপালদেবের শাসন সময়ের “দ্রম্ম” নামক রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়া, তাহার পরিচয় প্রদান করিয়াছে।[৬] ধর্ম্মপালদেবের শাসন-সময়েও “দ্রম্ম” প্রচলিত ছিল,—এই প্রস্তরলিপিই তাহার প্রমাণ। “দ্রম্ম”-শব্দ অমরকোষে দেখিতে পাওয়া যায় না; কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে এই শব্দ 

২৯ পৃষ্ঠা]
কেশব-প্রশস্তি।
K. V. Seyne & Bros.

একেবারে অপরিচিত নহে। ভাস্করাচার্য্যের٭ [|লীলাবতী​] গ্রন্থে ইহার পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। যথা,—

“वराटकानां दशकद्वयं यत् सा काकिणी ता श्च पण श्चतश्रः।
ते षोड़श द्रम्म इहावगम्यो द्रम्मै स्तथा षोड़भिश्च निष्कः॥”

 ইহা মুদ্রা-বিজ্ঞাপক পারিভাষিক শব্দ। কুড়ি কড়ায় এক “কাকিণী”, চারি কাকিণীতে এক “পণ”, ষোল পণে এক “দ্রম্ম”, এবং ষোল দ্রম্মে এক “নিষ্ক”,—এইরূপ নির্দ্দেশ অনুসারে বুঝিতে পারা যায়,—পাঁচ গণ্ডায় এক “পয়সা”, চারি পয়সায় এক “আনা”, ষোল আনায় এক “টাকা”, এবং ষোল টাকায় এক “মোহর” নিতান্ত আধুনিক গণনা-রীতির পরিচয় প্রদান করে না। এই প্রস্তর-লিপির “মহাদেব শ্চতুর্ম্মুখ” আর একটি ঐতিহাসিক তথ্যের পরিচয় প্রদান করিতেছে। এই মহাদেব লিঙ্গমূর্ত্তিবিশিষ্ট ছিলেন বলিয়াই বোধ হয়। বরেন্দ্র-মণ্ডলের নানাস্থানে “চতুর্ম্মুখ” শিবলিঙ্গ দেখিতে পাওয়া যায়। কাশীধামেও এরপ শিবলিঙ্গের অসদ্ভাব নাই। এক্ষণে ইহার প্রতিষ্ঠা-প্রথা তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। মহাদেব “পঞ্চমুখ”, এবং ব্রহ্মা “চতুর্ম্মুখ” বলিয়াই প্রসিদ্ধ। কোন্ সময়ে “চতুর্ম্মুখ” মহাদেবের প্রতিষ্ঠা-প্রথা কি কারণে প্রচলিত হইয়া, আবার কোন্ সময় হইতে কি কারণে অপ্রচলিত হইয়া পড়িয়াছে, তাহা এখনও নিঃসংশয়ে নির্ণীত হইতে পারে নাই। কিন্তু “চতুর্ম্মুখ” শিবলিঙ্গ নিতান্ত আধুনিক বলিয়া কথিত হইতে পারে না। কারণ, মহাভারতেও [অনুশাসনপর্ব্ব ১৭।৭৬] ইহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। যথা,—

“चतुर्म्मुखो महालिङ्ग श्चारुलिङ्ग स्तथैव च৷”


প্রশস্তি-পাঠ।


चम्प (म्पे) शायतने रम्ये उज्ज्वलस्य शिलाभिदः।
के-
शवाख्येन पुत्रेण महादेव श्चतुर्म्मुखः॥(১)
श्रेष्ठाना-
मेव मल्लानां महाबोधि-निवासिनां।
स्नातक-

म्प्रजयास्तु(?) श्रेयसे प्रतिष्ठापितः[॥](২)
पुष्करि-
ण्यत्यगाधा च पूता विष्णुपदीसमा।
त्रितये-
न सहस्रेण द्रम्माणां खानिता सतां॥৩॥
षड़्‌विंशतितमे वर्षे धर्म्मपाले महीभुजि[।]
भाद्रवहुलपञ्चम्यां सूनो र्भास्क-
रस्याहनि॥৪॥


বঙ্গানুবাদ।

(১)

 সুরম্য চম্পেশ[৭] নামক “আয়তনে” [শিলাভিৎ] উজ্জ্বল নামক ভাস্করের কেশব নামক পুত্র কর্ত্তৃক চতুর্ম্মুখ মহাদেব,—

(২)

 মহাবোধি-নিবাসী শ্রেষ্ঠ মল্লগণের[৮] স্নাতক...মঙ্গলার্থ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।

(৩)

 সাধুগণের [মঙ্গলার্থে] তিন সহস্ৰ দ্রম্ম [মুদ্রা] ব্যয়ে [উক্ত কেশব নামক ব্যক্তি কর্ত্তৃক] সুপবিত্রা গঙ্গাতুল্যা[৯] একটি অতি সুগভীরা [অগাধা] পুষ্করিণীও খানিত হইয়াছে।

(৪)

 ধর্ম্মপাল নামক মহীপতির রাজ্যাব্দের ষড়বিংশতিতমবর্ষে ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে শণিবারে [এই পুন্যকীর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইল।]

মূল পাঠের টীকা সম্পাদনা

  “গণক-তরঙ্গিণী” গ্রন্থে “रसरासदशमितं शके” (১০৩৬ শক—১১১৪ খৃষ্টাব্দ) বলিয়া ভাস্করাচার্য্যের জন্মকাল উল্লিখিত হইয়াছে। তখনও “দ্রম্ম” নামক মুদ্রা প্রচলিত ছিল।

^(১)  সকল শ্লোকই অনুষ্টুভ্। প্রথম শ্লোকের “চম্পশায়তনে” পাঠ চম্পেশ + আয়তন বলিয়া বোধ হয়।

^(২)  ‘স্নাতক × ম্প্রজয়াস্তু’ পাঠের অর্থ বোধগম্য হয় না।

প্রশস্তি-পরিচয় ও অনুবাদ-অংশের টীকা সম্পাদনা

  1. Cunningham’s Mahabodhi, pl. XXVIII, 3.
  2. Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1880, p. 80.
  3. A slab with three Bodhisattvas, each in a recess, the right side of this rudely carved stone being occupied with the inscription beginning “ye dhamma”, etc., in nine lines.—Catalogue of the Archeological Collections in the Indian Museum, Vol. II., p. 48.
  4. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. IV (New Series), p. 101-102.
  5. “The figure in the middle is probably that of Bhairava.”
  6. বিগ্রহপালদেবের দুইটি “দ্রম্ম” শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, এম-এ, লেখককে প্রদান করিয়াছিলেন। একটি মালদহের শ্রীযুক্ত কৃষ্ণলাল চৌধুরী মহাশয়ের নিকট এবং একটি লেখকের নিকটে আছে।
  7. প্রস্তর-লিপিতে “চম্পশায়তনে” উৎকীর্ণ রহিয়াছে। “আয়তন”-শব্দ অমরকোষে [২৷২৷৭] “চৈত্যমায়তনং তুল্যে” বলিয়া উল্লিখিত আছে। তাহা হইতে “আয়তন” শব্দ ক্রমে দেবমন্দিরও সূচিত করিয়াছে। এই শব্দ পৃথক করিয়া লইলে, “চম্পশ” শব্দের অর্থ হয় না; তাহাকে সংজ্ঞা শব্দরূপেই গ্রহণ করিতে হয়। “চম্পেশ” পাঠ অভিপ্রেত হইয়া থাকিলে, যে স্থানে চতুর্ম্মুখ মহাদেব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, তাহা “চম্পেশায়তন” নামে প্রসিদ্ধ ছিল বলিয়া, ব্যখ্যাত হইতে পারে।
  8. মল্লগণ বৌদ্ধ সাহিত্যে সুপরিচিত।
  9. ‘বিষ্ণুপদী’ গঙ্গার একটি নাম বলিয়া অমরকোষে [১৷১০।৩১] উল্লিখিত আছে।