গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক)/বালাদিত্য-প্রস্তরলিপি
বালাদিত্য-প্রস্তরলিপি।
[নালন্দা-লিপি।]
প্রশস্তি-পরিচয়।
১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে, নালন্দার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে [বালাদিত্য-মন্দির ভূগর্ভ হইতে বহিষ্কৃত করিবার সময়ে,] কাপ্তান মার্শাল একখানি কারুকার্য্য-খচিত প্রস্তরনির্ম্মিত দ্বারফলকের নিম্নভাগেআবিষ্কার-কাহিনী। এই লিপিটি দেখিতে পাইয়া, ইহার একটি ছাঁচ তুলিয়া, কলিকাতার এসিয়াটিক্ সোসাইটিতে প্রেরণ করিয়াছিলেন।[১] কিন্তু সোসাইটির পত্রিকায় তাহার কোনই উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না;—ছাঁচখানির কি হইল, তাহাও জানিবার উপায় নাই। কালক্রমে এই দ্বারফলক পুনরায় ভূগর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছিল। পরে ব্রোড্লে সাহেব পুনরায় ইহার আবিষ্কার সাধন করায়, ইহা এক্ষণে কলিকাতার যাদুঘরে স্থানপ্রাপ্ত হইয়াছে।
কনিংহাম ইহার প্রথম দুই পংক্তির পাঠ মুদ্রিত করিয়া,[২] লিখিয়া গিয়াছিলেন;—“সমগ্র লিপিটি দশ পংক্তিতে সমাপ্ত।” প্রকৃত পক্ষে, প্রস্তরফলকে দ্বাদশ পংক্তি দেখিতে পাওয়া যায়।পাঠোদ্ধার-কাহিনী। শ্রীযুক্ত নীলমণি চক্রবর্ত্তী এম, এ, তাহার সম্পূর্ণ পাঠ মুদ্রিত করিয়া দিয়াছেন।[৩] তৎপূর্ব্বে এই লিপির সমগ্র পাঠ উদ্ধৃত করিবার জন্য কেহ চেষ্টা করিবার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। অক্ষরগুলি স্পষ্ট ও বৃহৎ; সুতরাং ইহার পাঠোদ্ধার কষ্টসাধ্য বলিয়া কথিত হইতে পারে না।
চক্রবর্ত্তী মহাশয় এই লিপির একটি ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত করিয়াছেন। ইহাতে “শ্রীমহীপালদেবরাজ্য সম্বৎ ১১” লিখিত থাকায়, ইহা কোন্ মহীপালদেবের শাসন-সময়ের প্রস্তরলিপি,ব্যাখ্যা-কাহিনী। তৎসম্বন্ধে সংশয় উপস্থিত হইতে পারিত। কিন্তু অক্ষরের আকৃতি বিচার করিয়া, চক্রবর্ত্তী মহাশয় ইহাকে প্রথম মহীপালদেবের শাসন সময়ের লিপি বলিয়াই স্থির করিয়াছেন। দ্বিতীয় মহীপালদেবের একাদশ বৎসর রাজ্যভোগ করিবার সম্ভাবনা অল্প বলিয়াই বোধ হয়। কারণ, রাজ্যলাভের পর, নিহত হইবার পরিচয় “রামচরিত”[৪] কাব্যে উল্লিখিত আছে।
যে দ্বারফলকের ভগ্নাংশে এই লিপিটি উৎকীর্ণ রহিয়াছে, তাহার আয়তন দুই ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চ × পাঁচ ইঞ্চ মাত্র। লিপিটি ৯ ইঞ্চ × ৫ ইঞ্চ স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে। প্রস্তর-ফলকেরলিপি-পরিচয়। সংকীর্ণ কলেবরই এই ক্ষুদ্র লিপিকে দ্বাদশ পংক্তিতে বিভক্ত করিয়াছে। যে পংক্তিতে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক অক্ষর স্থানলাভ করিয়াছে, তাহাতেও একাদশটির অধিক অক্ষর দেখিতে পাওয়া যায় না। এই লিপিটির ভাষা সংস্কৃত;—ইহা গদ্যলিপি।
নালন্দার যে মন্দিরদ্ধারে এই লিপিটি উৎকীর্ণ হইয়াছিল, তাহা একটি পুরাতন মন্দির। একবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবার পর, তাহা পুনঃ-সংস্কৃত হইয়াছিল। পুনঃ-সংস্কারকালে, নূতনলিপি-বিবরণ। দ্বারফলক সংযোগের সময়ে, লিপিটি উৎকীর্ণ হইয়া থাকিবে। যিনি এই পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম বালাদিত্য [৯-১০ পংক্তি], পিতার নাম গুরুদত্ত, পিতামহের নাম হরদত্ত [৮-৯ পংক্তি]; তাঁহারা মহাযান-মতাবলম্বী ছিলেন; এবং কৌশাম্বী হইতে আসিয়া, তৈলাঢ়ক নামক স্থানে [৫-৭ পংক্তি] বাস করিতেছিলেন। বালাদিত্যের নামানুসারে মন্দিরটি এখন “বালাদিত্য-মন্দির” বলিয়াই কথিত হইতেছে। ইহা শাস্ত্রসঙ্গত হইয়াছে বলিয়াই স্বীকার করিতে হইবে। কারণ, যিনি মন্দির নির্ম্মাণ করেন, তাঁহার পুণ্য অপেক্ষা, সংস্কার-কর্ত্তার পুণ্য অধিক বলিয়া শাস্ত্রেও উল্লিখিত আছে।
প্রশস্তি-পাঠ।
१ ॐ
श्रीमन्महीपालदे-
२ व-राज्य-सम्वत् ११
३ अग्निदाहोद्धारे
४ गते देय धर्म्मोयं प्रवर-
५ मा(म)हायान-यायिनः पर-
६ मोपासक श्रीमत्तैलाढ़-
७ कीय ज्याविष(?) कौशाम्बी-
८ विनिर्गतस्य हरदत्तनप्तु-
९ ः र्गुरुदत्तसुत-श्रीवाला-
१० दित्यस्य। यदत्र पुण्यं त-
११ द्भवतु सर्व्व-सत्वराशे र-
१२ नुत्तर-ज्ञानावाप्तय इति।
বঙ্গানুবাদ।
ওঁ
শ্রীমহীপালদেবরাজ্যের একাদশ সংবৎসরে, অগ্নিদাহের[৫] পর, জীর্ণোদ্ধার সাধিত হইলে, কৌশাম্বী হইতে সমাগত শ্রীমত্তৈলাঢ়ক-নিবাসী প্রবর-মহাযান-মতাবলম্বী জ্যাবিষ(?) হরদত্ত-পৌত্র গুরুদত্ত-পুত্র শ্রীবালাদিত্যের এই ধর্ম্মার্থে দান। ইহাতে যে কিছু পুণ্য সঞ্জাত হইবে, তাহাতে যেন সকল জীব সর্ব্বোৎকৃষ্ট জ্ঞানলাভ করে ইতি।
- ↑ Archæological Survey Report, Vol. III, p. 122.
- ↑ Archæological Survey Report, Vol. III, p. 123.
- ↑ Journal and Proceedings A. S. B., Vol. IV, (New Series) pp. 106-107.
- ↑ Ramacarita (Published in the Memoirs of A. S. B.)
- ↑ ভূগর্ভ হইতে বালাদিত্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খনন করিবার সময়ে দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল,—এই বিখ্যাত মন্দিরটির একবার জীর্ণোদ্ধার সাধিত হইয়াছিল। প্রস্তরলিপির “অগ্নিদাহ”-শব্দ তাহাকেই সূচিত করিতেছে। পুরাতন মন্দির অগ্নিদাহে বিনষ্ট হইবার কথা “প্যাগ্-সাম-জন্-জাঙ্গ” নামক তিব্বতীয় ভাষায় রচিত বৌদ্ধধর্ম্মের উত্থানপতনের ইতিহাসে উল্লিখিত আছে।