গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/আমাদের পৃথিবী
গ্রহ-নক্ষত্র
আমাদের পৃথিবী
জ্যোতিষীরা বলেন, আকাশে যে হাজার হাজার ছোট-বড় নক্ষত্র আছে, আমাদের পৃথিবী তাহাদেরি মত একটি। সূর্য্য এবং বড় বড় নক্ষত্র যেমন সর্ব্বদাই গরম থাকিয়া জ্বলিতেছে, পৃথিবী অবশ্যই সে-প্রকার জ্বলিতেছে না। ইহার ভিতর গরম থাকিলেও উপর বেশ ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। সূর্য্যের আলো আসিয়া পৃথিবীতে পড়িলে, পৃথিবী সেই আলোতে আলোকিত হয়। পৃথিবী ছাড়িয়া যদি তোমরা চাঁদে বা নিকটের কোনো নক্ষত্রে গিয়া দাঁড়াইতে পার, তবে সেখান হইতে সূর্য্যের আলোকে আলোকিত এই পৃথিবীকে চাঁদের মত উজ্জ্বল দেখিবে।
এখন জিজ্ঞাসা করিতে পার, যে প্রকাণ্ড পৃথিবীর উপরে আমরা বাস করিতেছি, তাহার আকার কিরকম?
খোলা মাঠের মাঝে দাঁড়াইয়া চারিদিকে তাকাইলে মনে হয়, যেন পৃথিবীটা আমাদের ফুট্বল্খেলার মাঠের মত সমতল। প্রকৃত ব্যাপার কিন্তু তাহা নয়। পৃথিবী কখনই ফুট্বলের মাঠের মত সমতল নয়,—ইহা ফুট্বলেরই মত গোল।
মনে কর, একটা বড় টেবিলের উপরে দুইটি পিপীলিকা মিষ্টান্নের খোঁজে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। টেবিল্ সমতল, এদিকের পিপীলিকা
টেবিলের উপরে দুইটি পিপীলিকা মিষ্টান্নের খোঁজে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
ওদিকের পিপীলিকাকে দেখিতে পাইবে না কি?—নিশ্চয়ই দেখিতে পাইবে।
এখন মনে করা যাউক, যেন একটা ফুট্বল্ সূতা দিয়া ঝুলাইয়া রাখা গিয়াছে এবং তাহার উপরে দুইটা পিপীলিকা ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। পর পৃষ্ঠার ছবিটি দেখিলেই বুঝিতে পারিবে, দুইটি পিপীলিকা একই বলের উপরে আছে, কিন্তু কেহ কাহাকেও দেখিতে পাইতেছে না।
আবার মনে কর, যেন নীচেকার পিপীলিকা উপরের পিপীলিকার সহিত দেখা করিতে উপর দিকে উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে! এখানে
ফুট্বলের উপরে দুইটি পিপীলিকা
অবশ্যই দুইএরই দেখা-শুনা হইবে; কিন্তু হঠাৎ হইবে না। উপরের পিপীলিকাটি প্রথমে নীচের পিপীলিকার সেই লম্বা লম্বা শুঁয়ো দুটি দেখিতে পাইবে। তার পরে তাহার দেহের সর্ব্বাংশই দেখিতে পাইবে।
যে সকল সাঁকোর উপরকার রাস্তা হাতীর পিঠের মত ঢালু, তাহাতেও ঠিক আগেকার মত ব্যাপার দেখা যায়।
মনে কর, একটি লোক এই রকম একটা সাঁকোর একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া আছে এবং অপরপ্রাপ্ত হইতে একটা গাড়ী সাঁকোর উপরে আসিতেছে। লোকটি প্রথমে গাড়ীখানা দেখিতে পাইবে না। কারণ, সাঁকোর ঢালু অংশ দৃষ্টি আট্কাইয়া দিবে। ইহার পরে গাড়ী সাঁকোর উপর অগ্রসর হইতে থাকিলে, প্রথমে গাড়োয়ানের পাগড়ীটা তার পরে গাড়ীর ছাদ এবং সকলের শেষে গাড়ী, গরু ও চাকা নজরে পড়িবে।
তোমরা যদি কলিকাতায় ভাগীরথীর উপরকার হাওড়ার পুল দেখিয়া থাক, তবে ঐ কথাগুলি বেশ বুঝিবে। এই পুলের উপরকার রাস্তা হাতীর পিঠের মতই ঢালু। কলিকাতার দিকের রাস্তায় দাঁড়াইয়া যদি হাওড়া ষ্টেশনের গাড়ীগুলা কি রকমে আসিতেছে দেখ, তবে প্রথমে গাড়ীগুলাকে দেখিতেই পাইবে না। তার পরে সেগুলি ক্রমে অগ্রসর হইতে থাকিলে, একএকটু করিয়া শেষে তাহাদের সর্ব্বাঙ্গ দেখিতে পাইবে।
আমাদের পৃথিবী যে হাতীর পিঠের মত সত্যই ঢালু, তাহা ঐ-প্রকার পরীক্ষাতেই স্পষ্ট বুঝা গিয়াছে।
সহরের মধ্যে বা অপর স্থলভাগে এই পরীক্ষা করা যায় না, কারণ ঘর-বাড়ী পাহাড়-পর্ব্বত সম্মুখে দাঁড়াইয়া পরীক্ষার ব্যাঘাত জন্মাইয়া দেয়। সমুদ্রই এই পরীক্ষার উপযুক্ত স্থান। সেখানে ঘর-বাড়ী নাই, পাহাড়-পর্ব্বত প্রায়ই দেখা যায় না; বৃহৎ জলরাশি চারিদিকে ধূ ধূ করে। জাহাজে চড়িয়া যখন সমুদ্রের উপর দিয়া যাওয়া যায়, তখন খুব দূরের জাহাজগুলিকে দেখা যায় না। পৃথিবীর উপরটা হাতীর পিঠের মত ঢালু, তাই ঐ ঢালু অংশ মাঝে দাঁড়াইয়া থাকিয়া দূরের জাহাজগুলিকে আড়াল দিয়া রাখে। তার পরে সেগুলি যতই নিকটে আসিতে থাকে, একে একে তাহাদের সকল অংশই নজরে পড়ে। প্রথমে জাহাজের চোঙ্ কিংবা মাস্তুল দেখা যায়, তার পরে জাহাজের কাম্রা ইত্যাদি এবং সকলের শেষে তাহাদের তলাটা নজরে পড়ে।
ফুট্বলের পরীক্ষাতেও আমরা উহাই দেখিয়াছিলাম। নীচের পিপীলিকা যখন উপরের পিপীলিকার সহিত দেখা করিতে চলিয়াছিল,
একটি ছোট নদী। তাহার উপরে একটি সাঁকো। সাঁকোর এক প্রান্ত হইতে একটি লোক ও অপর প্রান্ত হইতে একখানি গাড়ী সাঁকোর উপরে আসিতেছে।
তথন তাহাদের মধ্যে হঠাৎ দেখা-শুনা হয় নাই। প্রথমে তাহার শুঁয়ো দেখা গিয়াছিল, তার পরে আরো অগ্রসর হইলে তাহার পা-গুলি-পর্য্যন্ত ক্রমে ক্রমে দেখা গিয়াছিল। সাঁকোর উপর দিয়া গাড়ী আসার উদাহরণেও আমরা ঐ রকমটাই দেখিয়াছিলাম। গাড়ীর সকল অংশ একেবারে দেখা যায় নাই; প্রথমে গাড়োয়ান, তার পরে গাড়ীর ছাদ, তার পরে গরুর মাথা এবং শেষে গাড়ীর সকল অংশ দেখা গিয়াছিল। খোলা সমুদ্রের উপর দিয়া জাহাজের যাওয়া-আসাতেও ঐ প্রকার দেখা গেল। কাজেই স্বীকার করিতে হইতেছে, আমাদের পৃথিবীটা ফুট্বলের মত ঢালু।
দু’চার মাইল জমিতে এই ঢাল বুঝা যায় না।; সমুদ্রের মাঝে জাহাজের উপরে দাঁড়াইয়া যখন অনেক দূরের জাহাজকে আসিতে দেখা যায়, তথনি উহা জানা যায়।
ফুট্বলের বেড় মাপিলে তাহা দেড় ফিট্ বা দুই ফিটের অধিক হয় না; কিন্তু পৃথিবীর বেড় প্রায় পাঁচিশ হাজার মাইল এবং মাটির ভিতর দিয়া মাঝখানটা মাপিলে প্রায় চারি হাজার মাইল হইয়া দাঁড়ায়। আমাদের পৃথিবীকে ফুট্বলের সঙ্গে তুলনা করা গেল বটে, কিন্তু এই ফুট্বলটি যে কত বড় তাহা অনায়াসে অনুমান করা যাইতে পারে। তার উপরে আবার পণ্ডিতেরা বলেন, বিনা সূতায় ফুট্বলকে আকাশে ঝুলাইয়া রাখিলে যেমন হয়, আমাদের গোলাকার বৃহৎ পৃথিবীটি ঠিক সেই-রকম আকাশে বিনা সূতায় ঝুলিয়া দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। আমরা পৃথিবীর উপরকার ক্ষুদ্র প্রাণী, কাজেই আমরাও পৃথিবীর ঘাড়ে চাপিয়া ছুটিয়া চলিয়াছি।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, পৃথিবী যে সত্যই চলিতেছে তাহার প্রমাণ কোথায়?—ইহার প্রমাণ আছে। গাড়ী, নৌকা বা ষ্টীমারে চাপিয়া চলিবার সময়ে চাকার শব্দে, জলের শব্দে এবং তাহার হেলা-দোলাতে আমরা বুঝিতে পারি, যে আমরা চলিয়াছি। পৃথিবী চলিবার সময়ে সে-প্রকার কাঁপুনি দেয় না, হেলে না, দোলে না এবং শব্দও করে না; কাজেই আমরা পৃথিবীতে চাপিয়া চলিয়াও বুঝিতে পারি না যে, আমরা চলিতেছি। মহাসমুদ্রের মাঝে যদি এমন একথানি ষ্টীমারে চড়িয়া যাওয়া যায় যে, যাহার কলের ঝন্ঝনানি নাই, হেলা-দোলা নাই, তাহা হইলে যেমন আমরা বুঝিতে পারি না যে, ষ্টীমার চলিতেছে কি দাঁড়াইয়া আছে, তেমনি নিঃশব্দ অচঞ্চল পৃথিবীর উপরে চড়িয়া দৌড়াদৌড়ি করিয়াও আমরা তাহার চলা বুঝিতে পারি না। এই কথাটা খুব অদ্ভুত, কিন্তু অদ্ভুত হইলেও সম্পূর্ণ সত্য।
প্রাতে বিছানা ছাড়িয়া উঠিলেই আমরা সূর্য্যকে পূর্ব্বদিকে আকাশের গায়ে দেখিতে পাই। তার পরে যত বেলা বাড়িতে থাকে, সূর্য্য তত আাকাশের উপরে উঠিতে থাকে; শেষে বারোটার পরে পশ্চিমে হেলিয়া সন্ধ্যার সময়ে পশ্চিম আকাশে সূর্য্য অস্ত যায়। রাত্রিতেও দেখা যায়, চাঁদও সেই রকম করে। চাঁদ যেখানেই থাকুক্, এক-একটু করিয়া পশ্চিম দিকেই চলিতে থাকে এবং শেষে পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। কেবল চাঁদ নয়, রাত্রিতে যে-সকল ছোট-বড় নক্ষত্র আকাশে উদিত হয়, তাহারাও পূর্ব্বদিক্ হইতে ধীরে ধীরে চলিয়া পশ্চিমে অস্ত যায়।
চন্দ্র, সূর্য্য এবং নক্ষত্রদের এই পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমে গিয়া অস্ত যাইবার কারণ তোমরা বলিতে পার কি? পাখী যেমন আমাদের বাড়ীর পূর্ব্বদিকের গাছ হইতে উড়িয়া মাথার উপর দিয়া চলে এবং শেষে পশ্চিম দিকের বটগাছে গিয়া বসে, চন্দ্র সূর্য্য এবং নক্ষত্রগুলি কি সেই রকমে আকাশের উপর দিয়া উড়িয়া চলে? ইহারা পূর্ব্ব হইতে সত্যই যে পশ্চিমে চলিয়া অস্ত যায়, তাহা অস্বীকার করা যায় না, কারণ, ইহা আমরা নিজের চোখেই দেখিতে পাই। কিন্তু পণ্ডিতেরা বলেন, ঠিক উল্টা কথা; ইঁহারা বলেন, সূর্য্য ও নক্ষত্রেরা আকাশে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। আমাদের পৃথিবীই কেবল লাট্টুর মত ঘুরিয়া ঘুরিয়া এক গোলাকার পথে সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরপাক্ খাইতেছে। ইহাতেই সূর্য্যের ও নক্ষত্রদের উদয়-অস্ত দেখা যায়।
বোধ হয় এই কথাটা বুঝিলে না। আচ্ছা মনে কর, তুমি যেন সূর্য্য হইয়া এক জায়গায় স্থির হইয়া দাঁড়াইলে এবং তোমার বন্ধু ধরণীকে বলিলে, “আমার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াও”। ধরণী তোমাকে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। এখন যেন তুমি তাহাকে বলিলে, “উহুঁঃ! হ’ল না। তুমি নিজে ঘুরপাক খাও এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াও”। ধরণীর খুব ঘুর লাগিল বটে, কিন্তু মনে কর, যেন সে তোমার কথায় নিজে ঘুরপাক খাইতে খাইতে তোমার চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল এবং তুমি মাঝে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আমোদ দেখিতে লাগিলে।
এই ঘুরপাক-খেলা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, তুমি স্থির আছ, ধরণীই ঘুরিতেছে। পণ্ডিতেরা বলেন, পৃথিবীকে লইয়া আমাদের সূর্য্য মহাকাশে এই রকম একটা ঘুরপাক খেলা করে। সূর্য্য তোমারি মত আকাশে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে এবং আমাদের পৃথিবী ধরণীর মত সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। কেবল ঘুরিয়া বেড়ানো নয়, ধরণী যেমন নিজে ঘুরপাক খাইতে খাইতে তোমার চারিদিকে ঘুরিয়াছিল, আমাদের পৃথিবীও ঠিক সেই রকমেই নিজে ঘুরপাক খাইতে খাইতে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে।
আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে।
মনে কর, যেন একটি পরিষ্কার টেবিলের মাঝে একটা ল্যাম্প্ রাখিয়া, সেই টেবিলের উপরেই একটা লাট্টু ঘুরানো যাইতেছে। এখন যদি এই লাট্টুকে ল্যাম্পের চারিদিকে চালাইয়া লওয়া হয়, তবে আমাদের সেই ঘুরপাক-খেলার ধরণীর মত লাট্টু নিজে ঘুরিতে ঘুরিতে ল্যাম্পের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকিবে। পণ্ডিতেরা বলেন, সূর্য্য ল্যাম্পের মত স্থির হইয়া আকাশে দাঁড়াইয়া আছে; আমাদের পৃথিবীটাই কেবল নিজে ঘুরপাক খাইতে খাইতে সূর্য্যের চারিদিকে দিবারাত্রি ঘুরিয়া মরিতেছে। ধরণী হয় ত এক মিনিটে তোমার চারিদিকে ঘুরিয়া আসিতে পারে, কিন্তু পৃথিবী এই রকমে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করিতে তিনশত পঁয়ষট্টি দিন লয়।
পণ্ডিতেরা এ-সব কথা স্থির করিয়াছেন বটে, কিন্তু কি রকমে স্থির করিলেন, এখন তাহাই তোমাদিগকে বলিব।
আমরা যখন রেলের গাড়ীতে চড়িয়া কোনো স্থানে যাই, তখন পথের পাশের তারের বেড়া, টেলিগ্রাফের থাম ও গাছ-পালার দিকে তাকাইলে মনে করি, আমরা যে দিকে যাইতেছি, পথের ধারের ঐ জিনিসগুলা যেন ঠিক তাহার উল্টা দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। নৌকায় চড়িয়া যখন যাওয়া যায়, তখনো নদীর ধারের গাছ-পালা ঘর-বাড়ী ও ঘাটে বাঁধা নৌকাগুলিকেও ঐ রকম উল্টা দিকে চলিতে দেখা যায়। বলা বাহুল্য, ঘর-বাড়ী ও গাছ-পালা চলে না, চলি আমরাই। কিন্তু মনে হয়, যেন পথের পাশের সব জিনিসই ছুটিয়া চলিয়াছে।
পণ্ডিতেরা আমাদের চোখের এই ভুলটাকে দেখিয়া বলেন, আমরা যেমন রেলের গাড়ী বা নৌকায় চড়ি, আমরা সকলেই সেই প্রকারে পৃথিবীতে চড়িয়া বসিয়া আছি। কিন্তু পৃথিবী স্থির নাই, সে আমাদের ঘাড়ে লইয়া লাট্টুর মত বন্-বন্ করিয়া ক্রমাগত পশ্চিম হইতে পূর্ব্ব দিকে ঘুরিতেছে। কাজেই সূর্য্য তারা প্রভৃতি যে-সকল জিনিস আকাশে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদিগকে আমরা উল্টাদিকে অর্থাৎ পূর্ব্ব হইতে পশ্চিম-দিকে চলিতে দেখি।
গাড়ী বা নৌকায় চড়িলে যাহা দেখিতে পাই, পৃথিবীর মত একটা প্রকাণ্ড গাড়ীতে চড়িলে যে, আমরা তাহাই দেখিতে পাইব, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহই হইতে পারে না। আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, গাড়ী বা নৌকা যখন ঝাঁকুনি না দিয়া নিঃশব্দে চলে, তখন চোখ্ বুজিয়া বসিয়া থাকিলে, চলিতেছি কি না তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। জানালায় উঁকি দিলে যখন দেখা যায় যে, পথের পাশের গাছ-পালা বা নদীর ধারের ঘর-বাড়ী চলিতেছে, তখন এই সব দেখিয়াই ঠিক করিতে হয় যে, গাড়ী বা নৌকা চলিতেছে। পৃথিবী ঝাঁকুনি না দিয়া তাহার উপরকার মানুষ-গরু ঘর-বাড়ী ও পাহাড়-পর্ব্বতকে বুকে লইয়া নিঃশব্দে লাট্টুর মত ঘুরিতেছে, কাজেই পৃথিবীর ঘোরা আমরা বুঝিতে পারি না। পথের ধারের গাছ-পালা স্থির আছে, কি চলিতেছে দেখিয়া যেমন আমরা গাড়ী চলিতেছে কি না বুঝিয়া লই, এখানেও তেমনি আকাশের চন্দ্র সূর্য্য ও নক্ষত্রেরা চলিতেছে কি না দেখিয়া, পৃথিবী চলিতেছে কি না বুঝিতে হয়। কিন্তু প্রতিদিনই সূর্য্য পূর্ব্বে উদিত হইয়া পশ্চিমে অস্ত যাইতেছে এবং রাত্রিতেও নক্ষত্রেরা দলে দলে পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমে ডুবিতেছে। কাজেই স্বীকার করিতে হয় যে, আমাদের পৃথিবী পশ্চিম হইতে পূর্ব্বপাকে লাট্টুর মত ঘুরিতেছে বলিয়াই, তাহাদিগকে আমরা পূর্ব্ব হইতে পশ্চিম দিকে চলিতে দেখিতেছি।
সূর্য্যের উদয় হইলে দিন হয় এবং তাহা অস্ত গেলেই রাত্রি হয়। কাজেই সূর্য্য আমাদের দিন ও রাত্রির কারণ, এ কথা আমরা স্পষ্ট বুঝিতে পারি। পৃথিবী লাট্টুর মত ঘুরপাক খায় বলিয়াই যে, দিন-রাত্রি হয়, তাহা এখন বুঝা যাইবে।
মনে করা যাউক, যেন টেবিলের উপরে একটা ল্যাম্প্ জ্বলিতেছে। এটা যেন আমাদের ছোট সূর্য্য। সূর্য্য যেমন আকাশের মাঝে দাঁড়াইয়া তাপ ও আলোক ছড়ায়, টেবিলের উপর দাঁড়াইয়া ল্যাম্পও চারিদিকে সেই প্রকারে তাপ ও আলোক ছড়াইতেছে।
তার পরে মনে করা যাউক, এই ল্যাম্পেরই পাশে একটা বড় রকমের লাট্টু, তার হুলের উপরে দাঁড়াইয়া বন্-বন্ করিয়া ঘুরিতেছে।
টেবিল-ল্যাম্প ও ঘূর্ণমান লাট্টু
এই লাট্টু যেন আমাদের পৃথিবী। ইহারি উপরে যেন আমাদের ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীর সব দেশ ও নদ-নদী পাহাড়-পর্ব্বত সকলি রহিয়াছে। লাট্টুও ঘুরপাক খায়, পৃথিবীও ঘুরপাক খায়, কাজেই লাট্টুকে পৃথিবী বলিয়া মনে করা ভুল হইল না।
এখন ছবির দিকে একবার তাকাইলেই তোমরা বুঝিতে পারিবে, লাট্টুর যে আধখানা ল্যাম্পের আলোর দিকে আছে, কেবল তাহাতেই আলো পড়িতছে; পিছনের দিকটায় একেবারে অন্ধকার। লাট্টু যদি ক্রমাগত না ঘুরিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিত, তাহা হইলে চিরদিন ধরিয়া উহার এক অংশের উপরেই আলো পড়িত। কিন্তু লাট্টু স্থির নাই; কাজেই যে আধখানায় এখন আলো পড়িতেছে, একটু পরে তাহাই পিছনে গিয়া অন্ধকারে ডুবিতছে এবং যাহা পিছনের অন্ধকারে ছিল, তাহা ল্যাম্পের সম্মুখে আসিয়া আলোকিত হইতেছে।
এখন লাট্টুর আলোয় থাকাকে যদি দিন ধরা যায় এবং অন্ধকারে যাওয়াকে রাত্রি বলা যায়, তাহা হইলে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, লাট্টুর প্রত্যেক অংশে একবার দিন হইয়া একটু পরেই রাত্রি হইতেছে। আমাদের পৃথিবী একটা বড় লাট্টুর মত ঘুরপাক খাইতেছে এবং সূর্য্য মাঝখানে দাঁড়াইয়া একটা প্রকাণ্ড ল্যাম্পের মত আলো দিতেছে। কাজেই পৃথিবীর প্রত্যেক অংশ একবার আলোকিত হইয়া যে, পরে অন্ধকারে ডুবিতেছে, তাহা সহজে বুঝা যায় না কি? ঠিক্ এই রকমেই দিনের পর রাত্রি এবং রাত্রির পর দিন চিরকাল ধরিয়া পৃথিবীতে চলিয়া আদিতেছে। পৃথিবী একবার ঘুরপাক দিতে চবিশ ঘণ্টা সময় লয়। এই জন্য আমাদের দিনরাত্রির পরিমাণ চব্বিশ ঘণ্টা।
ছবিতে লাট্টু তাহার হুলের উপরে ঠিক্ সোজা হইয়া ঘুরিতেছে না; পৃথিবীও তাহার মেরুদণ্ডের উপরে ঠিক্ সোজা হইয়া ঘুরে না। তোমাদের থেলার লাট্টু যেমন কখনো কখনো ঘাড় বাঁকাইয়া ঘুরে, পৃথিবী ঠিক্ সেই-রকমই ঘাড় বাঁকাইয়া ঘুরপাক খায়। গ্রীষ্মকালের দিন যে কিরূপ দীর্ঘ এবং শীতকালের রাত্রি যে কত বড়, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। পৃথিবী তাহার মেরুদণ্ডের উপরে বাঁকিয়া ঘুরপাক খায় বলিয়াই, দিন-রাত্রির পরিমাণের এইরকম কমিবেশি হয়। তা ছাড়া, পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর যে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রির কথা তোমরা গল্পে শুনিয়াছ, তাহাও পৃথিবী ঘাড় বাঁকাইয়া ঘুরে বলিয়া হয়।
পৃথিবীর মেরুদণ্ড কতটা বাঁকিয়া থাকে, তোমাদের স্কুলের একটা গ্লোব্ দেখিলেই তাহা বুঝিবে। আমরা এখানে সেই গ্লোব্ লইয়াই দুখানা ছবি দিলাম।
প্রথম ছবিখানিতে একটি ল্যাম্প্ জ্বলিতেছে এবং ল্যাম্পের পাশে গ্লোব্ রহিয়াছে। ল্যাম্প্ যেন সূর্য্য এবং গ্লোব্ যেন তোমাদের পৃথিবী।
গ্লোব্ পৃথিবীরই মত মেরুদণ্ড বাঁকাইয়া আছে বলিয়া, ল্যাম্পের আলো উহার উপরের মেরু-প্রদেশকে আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। এখন যদি তোমরা গ্লোব্টিকে বন্-বন্ করিয়া ঘুরাইতে থাক, তাহা হইলে দেখিবে, ঘুরপাক খাওয়ার সময়ে উহার উপরকার মেরু প্রদেশ কখনই অন্ধকারের মধ্যে যাইবে না। পৃথিবী যখন এই-রকম অবস্থায় দাঁড়াইয়া ঘুরপাক খায়, তখন তাহারো উত্তর মেরুতে রাত্রির অন্ধকার আসে না। এজন্য সেখানে বহুকাল রাত্রি হয় না।
দ্বিতীয় চিত্রে দেখিতে পাইবে, গ্লোবের উপর দিকের মেরুতে অন্ধকার আসিয়া পড়িয়াছে। পৃথিবী যখন এই-রকম অবস্থায় আসিয়া
ল্যাম্প্ এবং গ্লোব্—২য় চিত্র
দাঁড়ায় তখন তাহারো উত্তর-মেরুতে অন্ধকার আসে। এই অবস্থায় ঘুরপাক খাইতে থাকিলে একটুও দিনের আলো উত্তর মেরুতে আসিয়া পড়ে না। মেরু-প্রদেশে এই রকমে অনেক দিন ধরিয়া রাত্রি চলে।
তাহা হইলে বোধ হয় তোমরা বুঝিতে পারিতেছ, পৃথিবী ঘাড় বাঁকাইয়া ঘুরপাক খায় বলিয়াই দিন-রাত্রির পরিমাণের এত কমিবেশি হয়। প্রতিবৎসরে গ্রীষ্ম বর্ষা প্রভৃতি যে-সব ঋতু পৃথিবীতে একে একে দেখা দেয়, তাহারাও কতকটা ঐ কারণে পৃথিবীতে উপস্থিত হয়। দিন বড় হইলে মাটি-পাথর খুব গরম হয়; তথনকার ছোট রাত্রিতে মাটি-পাথর তাপ ছাড়িয়া ঠাণ্ডা হইতে পারে না, কাজেই খুব গ্রীষ্ম হয়। ইহাই গ্রীষ্মকাল। যখন দিন ছোট হয়, তখন মাটি-পাথর গরম হইতে না হইতে রাত্রি আসে এবং বড় রাত্রিতে পৃথিবীর সব জিনিস ভয়ানক ঠাণ্ডা হইয়া পড়ে। ইহাই শীতকাল। এই কারণ ছাড়া, ঋতুপরিবর্ত্তনের আরো অনেক কারণ আছে। তোমরা যখন প্রাকৃতিক ভূগোল পড়িবে, তখন সেগুলি বুঝিবে।