গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/গ্রহ-উপগ্রহ

গ্রহ-উপগ্রহ

আমরা এপর্য্যন্ত কেবল পৃথিবীর কথাই বলিলাম। পৃথিবী ছাড়া আমাদের জানা-শুনা আর যে-সকল তারা আকাশে আছে, এখন একে একে তাহাদের কথা বলিব।

 আমরা পূর্ব্বে দেখিয়াছি, আমাদের পৃথিরী লাট্টুর মত নিজে ঘুরপাক খাইতে খাইতে প্রায় তিনশত পঁয়ষট্টি দিনে সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে। কিন্তু তাই বলিয়া একা পৃথিবীই সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে না। পৃথিবী ছাড়া আরো সাতটি ছোট-বড় পৃথিবীর মত নক্ষত্র সর্ব্বদা সূর্য্যের চারিদিকে প্রায় গোলাকার পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। ইহাদের সবগুলিই যে, কাছাকাছি থাকিয়া সূর্য্যকে বেড়িয়া ঘুরিতেছে তাহা নয়। কেহ সূর্য্যের খুব কাছে আছে; কেহ আরো একটু দূরে আছে; কেহ বা অনেক দূরে আছে। আকাশের একটা প্রকাণ্ড স্থান জুড়িয়া ইহারা সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে এবং সূর্য্য মাঝে দাঁড়াইয়া আছে। কাহারো এমন সাধ্য নাই যে, ঘোরা বন্ধ রাখিয়া একটু দাঁড়ায়। চোখে ঠুলি-বাঁধা গরু যেমন ঘানীর চারিদিকে অবিরাম ঘুরিয়া বেড়ায়, সূর্য্যের চারিদিকে সেই রকম আট্‌টা পৃথিবী দিবারাত্রি পাক খাইতেছে। ঘানীর বলদ দড়াদড়ি দিয়া ঘানীর সঙ্গে বাঁধা থাকে। অবশ্য এই পৃথিবীগুলাকে সূর্য্য দড়াদড়ি দিয়া বাঁধিয়া রাখে নাই; কিন্তু সূর্য্যের আকর্ষণ আছে এবং সেই আকর্ষণই দড়াদড়ির কাজ করে। কাহারো এমন সাধ্য নাই যে, সূর্য্যের আকর্ষণ না মানিয়া একটু এদিক্ ওদিক্ যায়। চুম্বক যেমন লোহাকে টানিয়া রাখে, এই টান যেন সেই রকমের।

 আমাদের পৃথিবী এবং আরো যে সাতটা তারা সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে, জ্যোতির্ব্বিৎ পণ্ডিতেরা তাহাদের এক-একটা নাম দিয়াছেন। খুব কাছে থাকিয়া যেটি সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে, তাহার নাম বুধ; তার পরে শুক্র এবং তার পরেই আমাদের এই পৃথিবী। পৃথিবী যে পথে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে, তাহার বাহিরে মঙ্গল বুহম্পতি শনি ইউরেনাস্ এবং নেপ্‌চুন্, পর পর দূরে দূরে থাকিয়া সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে। তাহা হইলে বুধ শুক্র পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস্ এবং নেপ্‌চুন্ এই আটটিই সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আকাশে যে হাজার হাজার নক্ষত্র আছে, তাহাদের সকলে সূর্যের চারিদিকে ঘুরে না, কেবল এই আট্‌টিই সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই জন্য জ্যোতিষীরা এগুলির একটা পৃথক নাম দিয়াছেন। ইঁহারা বুধ শুক্র পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস্ ও নেপ্‌চুন্ সকলকেই গ্রহ বলিয়া থাকেন।

 গ্রহ ছাড়া আকাশে যত ছোট-বড় আলোকের বিন্দু দেখা যায়, তাহারা সকলেই নক্ষত্র বা তারা। ইহাদের সঙ্গে আমাদের সূর্য্যের কোনো সম্বন্ধ নাই। এরা নিজেরাই একটা একটা প্রকাণ্ড সূর্য্য এবং তাহাদের রাজ্য সূর্য্যের রাজ্য হইতে অনেক দূরে। আমাদের সূর্য্য আট্‌টি গ্রহকে আপনার চারিদিকে ঘুরাইয়া লইতেছে। যে-সকল মহাসূর্য্যকে আমরা অতি দূরে ছোট নক্ষত্রের আকারে মিটি-মিটি জ্বলিতে দেখিতেছি, তাহাদের প্রত্যেকটি হয় ত অনেক গ্রহকে এই রকমেই বাঁধিয়া ঘুরাইতেছে। কিন্তু তাহা দেখিবার বা জানিবার উপায় নাই। ইহারা এতদূরে আছে যে, খুব বড় দুরবীণ দিয়াও তাহাদের সন্ধান করা যায় না।

 সূর্য্যের অধীনে থাকিয়া আমাদের পৃথিবী সূর্য্য-প্রদক্ষিণ করিতেছে; তাই আমরা পৃথিবীতে থাকিয়া সূর্য্যের কথা বেশি জানি এবং বুধ শুক্র প্রভৃতি আরো যে সাতটা গ্রহ সূর্য্যকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদেরও কথা জানি। নক্ষত্রদের সম্বন্ধে খুব বেশি কথা জানা নাই, যাহা একটু আধটু আমাদের জানা আছে, তাহা পরে বলিব।

 এপর্য্যন্ত যাহা বলা হইল তাহাতে বুঝা গেল, রাত্রিতে আকাশে যে-সব আলোক-বিন্দু দেখা যায়, তাহাদের মধ্যে পৃথিবীকে লইয়া কেবল আট্‌টি-মাত্র গ্রহ, আর বাকি সব নক্ষত্র। গ্রহেরা সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। নক্ষত্রদের প্রত্যেকটা সূর্য্যের চেয়ে অনেক বড়; আমাদের কাছ হইতে অনেক দূরে আছে বলিয়াই উহাদিগকে ছোট দেখায়।

 এই সব বুঝা গেল। কিন্তু এপর্য্যন্ত আমরা চাঁদের সম্বন্ধে একটি কথাও বলি নাই; চাঁদটা কি? জ্যোতিষীরা চাঁদকে উপগ্রহ বলেন। গ্রহেরা যেমন সূর্য্যকে ঘুরিয়া মরে, উপগ্রহেরা সেই-রকম এক একটা গ্রহের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। তাই পৃথিবীর কাছ-ছাড়া হইতে পারে না বলিয়া চাঁদকে খুব বড় দেখায়, কিন্তু চাঁদ নক্ষত্রদের চেয়ে অনেক ছোট। কাজেই দেখা যাইতেছে, চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে এবং পৃথিবী সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করিবার সময়ে চাঁদকেও সঙ্গে লইয়া যায়। পৃথিবীর কাজ একটা, অর্থাৎ সূর্য্যকে ঠিক এক বৎসরে ঘুরিয়া আসা; কিন্তু চাঁদের কাজ দুইটা, অর্থাৎ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা এবং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতে করিতে সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসা। বড়ই অদ্ভুত নয় কি?

 চাঁদ অর্থাৎ উপগ্রহ কেবল যে পৃথিবীরই আছে, তাহা নয়। বৃহস্পতি শনি প্রভৃতি অনেক গ্রহেরই চারিদিকে চাঁদ ঘুরিয়া বেড়ায়। কোনো কোনো গ্রহের আবার অনেকগুলি করিয়া চাঁদ। আমাদের পৃথিবীর একটি চাঁদে রাত্রির কত শোভা হয়, যে-সব গ্রহের তিনটি চারিটি আট্‌টি দশটি করিয়া চাঁদ আছে, তাহাদের রাত্রিগুলি কেমন সুন্দর হয়, তাহা তোমরা মনে ভাবিয়া দেখ দেখি।

 সূর্য্যকে ঘিরিয়া কি-রকম পথে গ্রহগণ চলা-ফেরা করে, তাহার একখানা ছবি দেওয়া হইল। ইহা দেখিলে তোমরা বুঝিবে বুধ শুক্র পৃথিবী সূর্য্যের কত কাছে এবং ইউরেনাস্ ও নেপ্‌চুন্ কত দূরে। কিন্তু ইহাদের কোনোটির পথ অপরের পথকে কাটিয়া চলে নাই। এটা বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার!

 আমরা দেখিতে পাই যেখানে দুটো রাস্তা কাটিয়া চলিয়াছে সেখানে গাড়ীতে গাড়ীতে, মানুষে গাড়ীতে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা থাকে।

 মনে কর, তোমাদের বাজারের মধ্যে যে চৌরাস্তা আছে, তাহার একটা রাস্তা ধরিয়া একটা গরুর গাড়ী এবং আর একটা রাস্তা ধরিয়া একটা ঘোড়ার গাড়ী ঠিক চৌমাথায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এই অবস্থায় যদি একখানা গাড়ীর গাড়োয়ান তাহার গাড়ীকে না থামায় বা পাশ কাটাইয়া গাড়ীখানিকে না চালায়, তাহা হইলে মহাবিপদ উপস্থিত হয়; গাড়ীতে গাড়ীতে ধাক্কা লাগে!

 পৃথিবীর পথ যদি শুক্রের বা মঙ্গলের পথকে কাটিয়া চলিত, তাহা হইলে ঠিক এই রকম বিপদেরই সম্ভাবনা থাকিত। তথন হয় ত এমন দিন আসিত, যখন দুই পথের চৌমাথায় পৃথিবী, শুক্রের বা মঙ্গলের মুখোমুখী আসিয়া পড়িত এবং একটা অপরটাকে ধাক্কা দিয়া একবারে চূরমার হইত। ভগবান্ কোনো গ্রহের পথের উপরে অন্য গ্রহের পথকে মিলিত হইতে দেন নাই, তাই গ্রহেরা বেশ নিশ্চিন্ত হইয়া সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়।

 গ্রহ ও উপগ্রহদের চলা-ফেরার মধ্যে আর একটা বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার আছে। কোনো গোলাকার পথে ঘুরিতে গেলে বাঁ-দিক থেকে ডানদিকে অথবা ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে ঘুরা যায়। ঘড়ির কাঁটা গোলাকার পথে দিবারাত্রি ঘুরিয়া বেড়ায়। যদি একটু ভাবিয়া দেখ, তাহা হইলে স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে, দুটো কাঁটাই বাঁ-দিক্ হইতে ডান


সৌরজগৎ

দিকে ঘুরিতেছে। বড় আশ্চর্য্যের বিষয়, বুধ শুক্র পৃথিবী মঙ্গল প্রভৃতি যে আট্‌টি গ্রহ সূর্য্যকে মাঝে রাখিয়া গোলাকার পথে ঘুরিতেছে, তাহারাও ঘড়ির কাঁটার মত একমুখো হইয়া পশ্চিম হইতে পূর্ব্বে ছুটিয়া চলিয়াছে। কেবল ইহাই নয়, গ্রহদের চারিদিকে যে-সকল উপগ্রহ অর্থাৎ চাঁদ ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহাদের প্রায় সকলেই গ্রহদের সঙ্গে যোগরক্ষা করিয়া একই পাকে ঘুরিতেছে। পৃথিবী চব্বিশ ঘণ্টায় যে একবার ঘুরপাক খায়, অপর গ্রহেরাও এক একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ে ঐ রকম ঘুরপাক দেয়। ইহাদেরও ঘুরপাক দেওয়ার দিক, সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করার দিকের সঙ্গে অবিকল এক।

 ছোটবড় গ্রহ-উপগ্রহেরা যে ঠিক একই পাকে ঘুরিতেছে, এটা কি খুব আশ্চর্য্যের বিষয় নয়? একই রাজার রাজ্যে যত আইন-কানুন থাকে, সকলই এক হয়। এক প্রজার জন্য এক রকম আইন্ এবং আর প্রজার জন্য ঠিক তার উল্টা আইন্, এমনটি কোনো রাজ্যেই দেখা যায় না। আমাদের গ্রহ-উপগ্রহেরা ঠিক যেন একই নিয়ম মানিয়া রাজভক্ত প্রজার মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এই রাজাটি কে তাহা জান কি?—সূর্য্যই সেই রাজা। অবশ্য রাজার রাজা জগদীশ্বর সকলের মাথার উপরে আছেন। কিন্তু যে রাজার অধীনে ইহারা প্রত্যক্ষভাবে চলা-ফেরা করে, তাহার শাসন এমনি কড়া যে, প্রজাদের চাল-চলনে একটুও এদিক-ওদিক হইবার উপায় নাই।

 সূর্য্যকে আমাদের এই জগতের রাজা বলিলাম। কিন্তু ইহাকে গ্রহ-উপগ্রহের পিতাও বলা যায়। একই পিতার সন্তানদের আকৃতি প্রকৃতি চাল-চলনে অনেক মিল দেখা যায়। রাম ও যদু দুই ভাই এবং মালতী তাহাদের বোন। যদি একটু মন দিয়া তাহাদের চাল-চলন আকৃতি-প্রকৃতি লক্ষ্য কর, তবে তাহাদের মধ্যে অনেক মিল দেখিতে পাইবে। চুলের রঙ্, গায়ের রঙ্, চোখের তারার রঙ্, হাসি-কান্না এবং চলাফেরার মধ্যে অনেক মিল একে একে দেখা যাইবে। কাজেই দুজনের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল দেখিলে, অনায়াসে অনুমান করা যাইতে পারে যে, তাহারা একই পিতার সন্তান বা একই পরিবারের লোক। গ্রহ-উপগ্রহদেরও চাল-চলন গতিবিধির মধ্যে এই রকম মিল দেখিয়াই পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, তাহারা একই পিতার সন্তান। সূর্য্যই এককালে নিজের দেহকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া বুধ শুক্র পৃথিবী ইত্যাদি গ্রহ ও তাহাদের চারিদিকের চাঁদগুলিকে সৃষ্টি করিয়াছে। বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয় নয় কি? আমরা পরে এ সম্বন্ধে তোমাদিগকে অনেক কথা বলিব।