গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বত
চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বত
ছবির উপরে যে-সব গোল গোল চিহ্ন আছে, সেগুলি কি বলিতে পার কি? এগুলিকে জ্যোতিষীরা চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বতের গর্ত্ত বলিয়া স্থির করিয়াছেন। বিসুভিয়স্, এট্না প্রভৃতি পৃথিবীর আগ্নেয় পর্ব্বতের নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনিয়াছ। এই সকল পর্ব্বতের চূড়ায় ভয়ানক গর্ত্ত থাকে, তাহা হইতে সময়ে সময়ে ধোঁয়া ছাই বাহির হইয়া নিকটের গ্রাম-নগর ছাইয়া ফেলে। কখনো কখনো আবার সেই গর্ত্ত দিয়া আগুনের মত গরম গলা মাটি পাথর ও ধাতু বাহির হয় এবং পাশের গ্রাম-নগর ডুবাইয়া দেয়।
বিসুভিয়স্ পর্ব্বতের অগ্নিবৃষ্টি অনেক দিন আগে পম্পে নগরকে এই রকমে একেবারে নষ্ট করিয়া দিয়াছিল। সে-সময়ে বিসুভিয়স্ হইতে এত ছাই এবং গলা মাটি পাথর ও ধাতু বাহির হইয়াছিল যে, তাহাতে নগরের ঘর-বাড়ী জীব-জন্তু সব চাপা পড়িয়া গিয়াছিল। এখন লোকে সেই সকল ছাই ও জমাট ধাতু কাটিয়া নগর বাহির করিতেছে। যাহা হউক চাঁদের উপরে যে-সব আগ্নেয় পর্ব্বতের গর্ত্ত দেখিতেছ, তাহা হইতে কিন্তু এখন আর ছাই বা আগুন বাহির হয় না, হইলে তাহা দূরবীণ দিয়া আমরা পৃথিবী হইতে দেখিতে পাইতাম।
জ্যোতিষীরা দুই শত তিন শত বৎসর ধরিয়া চাঁদের পাহাড়-পর্ব্বত পরীক্ষা করিতেছেন, কিন্তু তাহাদের একটুও পরিবর্ত্তন দেখিতে পান নাই। আমাদের দূরবীণগুলি এখন চাঁদকে এত বড় করিয়া দেখায় যে, চাঁদে যদি কলিকাতার হাইকোর্ট, জেনারেল্ পোষ্ট্-অফিস্ বা মনুমেণ্টের মত একটা বড় বাড়ী প্রস্তুত হইত, তাহা হইলে আমরা সেই নূতন বাড়ি এখানে বসিয়া দেখিতে পাইতাম; কিন্তু এপর্য্যন্ত এরকম কিছুই দেখা যায় নাই। মাটির বা পাথরের পুতুল গড়িয়া ঘরে রাখিলে তাহাকে যেমনটি রাখা যায়, চিরদিনই সেই-রকম থাকে; চাঁদও যেন সেই-রকম একটি পুতুল। বৎসরের পর বৎসর চাঁদকে দেখিয়া শুনিয়া ইহার একটুও পরিবর্ত্তন দেখা যায় নাই।
কিন্তু খুব প্রাচীন কালে চাঁদের সব আগ্নেয় পর্ব্বত হইতে যে ভয়ানক আগুন উঠিত এবং গলা ধাতুর স্রোত বাহির হইয়া চারিদিক ডুবাইয়া দিত, এখনো এত দূর হইতে আমরা তাহা বুঝিতে পারি।
পূর্ব্বপৃষ্ঠায় চাঁদের একটা আগ্নেয় পর্ব্বতের বড় ছবি দিলাম। ছবি দেখিলেই বুঝিতে পারিবে, চাঁদের উপরকার কতক জায়গা যেন খুব উঁচু প্রাচীর দিয়া ঘেরা আছে এবং তাহার মাঝে যেন কয়েকটা উঁচু-উঁচু পাহাড় আছে। চাঁদের আগেকার ছবিতে যে-সব ছোট গোলাকার আগ্নেয় পর্ব্বত দেখিয়াছ, তাহাদের আকৃতি ঠিক এই রকমের অর্থাৎ চারিদিকে উঁচু প্রাচীর, মাঝে একটা বা দুইটা উঁচু পাহাড়। যে আগ্নেয় পর্ব্বতের ছবিটা পূর্ব্ব পৃষ্ঠায় দিলাম, তাহার নাম কোপার্নিকাস্।
“কোপার্নিকাস্” নাম শুনিয়া অবাক্ হইও না; এ নাম আমাদেরই দেওয়া। তোমার যদি দুইটা পোষা কুকুর থাকে, এবং তাহাদের একটা কালো ও একটা শাদা হয়, তাহা হইলে প্রত্যেককে এক-একটা পৃথক্ নাম দিতেই হয়। তাহা না হইলে যখন তুমি কালো কুকুরটাকে কাছে আানিতে চাও, তখন কেবল তুতু করিয়া ডাকিলে দুইটাই কাছে আসিবে। কিন্তু যদি তুমি কালো কুকুরটিকে “কালু” এবং শাদাটিকে “টেবি” বলিয়া ডাক, তখন কালু বলিয়া ডাকিলে কালো কুকুরই কাছে আসিবে এবং “টেবি” বলিয়া ডাকিলে শাদাটাই কাছে আসিয়া তোমার পায়ের গোড়ায় লুটাইবে। ইহাও যেন সেই-রকম; চাঁদের বড় বড় আগ্নেয় পর্ব্বতগুলি ও সমুদ্রগুলির এক-একটা নাম দেওয়াতে, একটা পর্ব্বতের সঙ্গে আর একটা পর্ব্বতের গোলমাল হয় না।
চাঁদের পর্ব্বতের নাম দেওয়ার কথায় একটা ঘটনা মনে পড়িয়া গেল। তিন চার বৎসর পূর্ব্বে আমি তোমাদেরি মত ছোট ছেলেদের দূরবীণ দিয়া চাঁদ দেখাইতেছিলাম। চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বত, গুহা, পাহাড়ের শ্রেণী ও উঁচুনীচু মাটি দেখিয়া তাহারা অবাক্ হইয়া যাইতেছিল। নিকটে একটি অল্পশিক্ষিত ভৃত্য দাঁড়াইয়া ছিল; তাহাকেও দূরবীণ দিয়া চাঁদ দেখাইলাম এবং কোন্ পাহাড়টার কি নাম তাহাও বলিতে লাগিলাম। পৃথিবীর মত চাঁদেও পাহাড় পর্ব্বত আছে দেখিয়া সে খুবই আশ্চর্য্য হইল, কিন্তু সকলের চেয়ে আশ্চর্য্য হইল চাঁদের পাহাড়গুলির নাম শুনিয়া। সে বলিতে লাগিল “মহাশয়, কল দিয়া ত চাঁদের পাহাড় দেখাইলেন; কিন্তু পাহাড়গুলির নাম জানিলেন কি রকমে?”
আমরা ত হাসিয়াই খুন্। চাঁদের পাহাড় দেখিয়া লোকটা বিস্মিত হইয়া ভাবিতেছিল, আমরা কোনো যন্ত্র দিয়া পাহাড়ের নামগুলাও হয় ত চাঁদ হইতে পৃথিবীতে আমদানি করিয়াছি। আমরা তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম, পাহাড় পর্ব্বত গাছপালা বা জীবজন্তুর নাম বিধাতা তাহাদের গায়ে লিখিয়া দেন নাই, তাহাদিগকে চিনিয়া লইবার জন্য মানুষই তাহাদের এক একটা নাম দেয়।
চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বতের বিবরণ বলিতে গিয়া অনেক বাজে কথা বলিয়া ফেলিলাম। এখন আবার “কোপার্নিকাস্” আগ্নেয় পর্ব্বতের ছবিটি দেখা যাউক। ইহার চারিদিকে যে প্রাচীরের মত পাহাড় বেড়িয়া রহিয়াছে, তাহা কম উঁচু নয়। পণ্ডিতেরা হিসাব করিয়া। দেখিয়াছেন, ইহার উচ্চতা দুই মাইলের উপরে, মাঝের পাহাড়ের উচ্চতা আরো বেশি। তাহার পরে যে জায়গা ঘেরা রহিয়াছে, মাপিলে তাহা প্রায় ছাপ্পান্ন মাইলের সমান হয়। তাহা হইলে দেখ, ঐ পাহাড়-ঘেরা গোলাকার জায়গাটাও নিতান্ত ছোটখাটো স্থান নয়। ছাপ্পান্ন মাইল প্রশস্ত একটা গোলাকার স্থান দুই মাইল উঁচু পাহাড় দিয়া ঘেরা এবং ঘেরা জায়গার মধ্যে আবার দুই একটা উঁচু চূড়াযুক্ত পাহাড়। চাঁদের সকল আগ্নেয় পর্ব্বতগুলিই যে এত বড় তাহা নয়। কোনোটিকে ইহা অপেক্ষা অনেক ছোটও দেখা গিয়াছে, কিন্তু প্রত্যেক আগ্নেয়গিরির গঠন ঠিক একই রকমের।
আমাদের পৃথিবীতে যত আগ্নেয় পর্ব্বত আছে, তাহাদের সঙ্গে চাঁদের পর্ব্বতগুলির আকার মিলাইয়া দেখিলে দুয়ের মধ্যে অনেক তফাৎ দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের কোনো আগ্নেয় পর্ব্বত দুই তিন মাইল উঁচু পাহাড়ে ঘেরা নাই এবং তাহাদের কোনোটিরই মুখ পঞ্চাশ মাইল বা একশত মাইল চওড়া নয়। চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বতগুলির অবস্থা এ-রকম কেন হইয়াছে, তোমর কেহ বলিতে পার কি? বোধ হয় পারিবে না; জ্যোতিষীরা অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ইহার কারণ স্থির করিয়াছেন।
ইহা বুঝিতে হইলে পৃথিবী ও চাঁদের আকর্ষণের কথা একটু জানা আবশ্যক। পৃথিবী তাহার উপরকার সকল জিনিসকে চাঁদের দিকে টানে, এজন্য আমরা জিনিসকে ভারি বলিয়া বোধ করি। পাঁচ সের ওজনের একটা লোহার গোলাকে মাটি হইতে উঠাইতে কত কষ্ট হয় দেখিয়াছ ত? গোলাকে পৃথিবী নীচের দিকে টানে তুমি তাহাকে উপর দিকে টানো, কাজেই পৃথিবীর টানের চেয়ে তোমার টান, অধিক না করিলে গোলাকে মাটি হইতে উঠাইতে পারিবে না। এজন্য কোনো জিনিসকে মাটি হইতে উঠাইতে গেলে বেশ্ জোর লাগে।
চাঁদের দেহটা পৃথিবীর তুলনায় খুব ছোট, এজন্য সে তাহার উপরকার জিনিসগুলাকে পৃথিবীর মত জোরে টানিতে পারে না, এজন্য চাঁদে সব জিনিসই হাল্কা। হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে, পৃথিবীতে যে জিনিসটার ওজন ছয় সের, চাঁদে তাহার ওজন মোটে এক সের। তুমি কত ভারি জিনিস মাটি হইতে উঠাইতে পার জানি না। বোধ হয় দশ সের জিনিস বেশ সহজে তুলিতে পার। তাহা হইলে চাঁদে তুমি ষাট্ সের অর্থাৎ দেড় মণ জিনিস অতি সহজে উঠাইতে পারিবে। তুমি কতটা লাফ্ দিতে পার? হয় ত ছয় সাত হাতের বেশি পার না। তুমি চাঁদে গিয়া যদি লাফ্ দিতে আরম্ভ কর, তাহাহইলে পৃথিবীর লাফের ছয় গুণ লাফাইতে পারিবে, অর্থাং ছত্রিশ হাত, কি বেয়াল্লিশ হাত অনায়াসেই লাফাইবে। ইহা বাঘের লাফের চেয়েও অনেক বেশি। ঢিল ছুঁড়িয়া তুমি ঢিলটাকে কত উপরে উঠাইতে পার আন্দাজ করিয়া দেখিয়াছ কি? তোমার হাতে যদি খুব জোর থাকে, তাহা হইলে ত্রিশ হাতের বেশি বোধ হয় তুমি ঢিলকে উপরে উঠাইতে পারিবে না; কিন্তু চাঁদে গিয়া ঠিক সেই-রকম জোরে ঢিল ছুঁড়িলে সেটি প্রায় একশত আশী হাত পর্য্যন্ত উপরে উঠিবে।
তোমার ওজন কত আমি ঠিক জানি না; হয় ত তুমিও জান না। মনে করা যাক্, তোমার ওজন ত্রিশ সের। তুমি যদি চাঁদে গিয়া উপস্থিত হও, তাহা হইলে সেখানে পা-দিবামাত্র, তোমার শরীরটা খুব হাল্কা বোধ হইবে। কারণ চাঁদ পৃথিবীর চেয়ে খুব অল্প জোরে তোমার শরীরকে টানিবে। সেখানে যদি ওজনের কল থাকে, তাহা হইলে দেখিবে তোমার শরীরের ত্রিশ সের ওজন কমিয়া পাঁচ সের হইয়া দাঁড়াইয়াছে। চাঁদের রাজ্যটা বড়ই অদ্ভুত নয় কি?
চাঁদে পঞ্চাশ এবং কখনো কখনো একশত মাইল চওড়া আগ্নেয় গিরি কি রকমে উৎপন্ন হইয়াছিল, তাহা বুবাইতে গিয়া চাঁদের এই রকম অল্প টানের কথাটাকেই জ্যোতিষীরা বলিয়াছেন। তোমরা বোধ হয় জলের ফোয়ারা দেখিয়াছ, আমাদের দেশের বড় বড় সহরের বাগানে এই-রকম ফোয়ারা অনেক দেখা যায়। মাটিতে-পোঁতা নলের মুখ দিয়া শত শত ধারায় জল পিচ্কারীর মত জোরে উপরে উঠে, তাহার পরে সেগুলি নীচে নামিয়া ছত্রাকারে ফোয়ারার চারিধারে পড়িতে থাকে। ফোয়ারার জোর যত বেশি হয়, জলের ধারাও তেমনি বেশি উপরে ওঠে ও নামিবার সময়ে নল হইতে অধিক দূরে ছড়াইয়া পড়ে।
জ্যোতিষীরা বলেন, দুই মাইল তিন মাইল উঁচু পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা আগ্নেয় পর্ব্বতগুলির আকৃতি ঐ রকমেই হইয়াছিল। হাজার হাজার বৎসর পূর্ব্বে যখন চাঁদের দেহের শত শত আগ্নেয় পর্ব্বত হইতে গলা ধাতু ধোঁয়া ও ছাই ফোয়ারার মত জোরে বাহির হইত, তথন তাহা অনেক উপরে উঠিত, কারণ চাঁদের টান বেশি নয়। তাহার পরে যখন নামিত, তথন আগ্নেয়-গিরির ফোয়ারার মুখ হইতে অনেক দূরে গিয়া ছত্রাকারে পড়িত। জ্যোতিষীরা বলেন, এই রকমে দূরে ছত্রাকারে পড়া ছাই পাথর ও গলা ধাতু হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া জমিয়া দুই মাইল তিন মাইল উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর নির্ম্মাণ করিয়াছে। এক কালে যে সত্য সত্যই চাঁদের আগ্নেয় পর্ব্বত হইতে ছাই পাথর ও গলা ধাতু বাহির হইত, তাহা ঐসকল প্রাচীর দেখিলেই বুঝা যায়।